গুজরাতের মুন্দ্রা বন্দরে বাজেয়াপ্ত হওয়া ২১ হাজার কোটির মাদকের সঙ্গে এ বার পহেলগাঁওয়ের জঙ্গি হামলার যোগসূত্র খুঁজে পেলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। ঘটনার ‘মূলচক্রী’ পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের পর্দাফাঁস করেছেন তাঁরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১২:৪৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার তদন্ত উঠে এল মাদক-যোগ! গুজরাতের মুন্দ্রা বন্দর দিয়ে সেই মাদক দেশের ভিতরে পাচারের চেষ্টা করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টকে এ বার সেই তথ্য দিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) বা এনআইএ। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, গোটা পরিকল্পনার ‘মূলচক্রী’ পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স’ বা আইএসআই।
০২১৮
শীর্ষ আদালতকে এনআইএ জানিয়েছে, পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বাকে সামনে রেখে দীর্ঘ দিন ধরেই ‘মাদক সন্ত্রাস’ চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি আদতে আইএসআইয়ের ‘হাতের পুতুল’। তাঁদের বোড়ের মতো ভারত-বিরোধী বিভিন্ন অপারেশনে কাজে লাগায় তারা। উদ্দেশ্য, জম্মু-কাশ্মীর ও পঞ্জাব-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় অশান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করা।
০৩১৮
সম্প্রতি গুজরাতের মুন্দ্রা বন্দরে ২১ হাজার কোটি টাকার মাদক ধরা পড়তেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখান থেকে ২,৯৮৮.২ কেজি হেরোইন উদ্ধার করেন তাঁরা। এর পর প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য, যা সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে এনআইএ।
০৪১৮
শীর্ষ আদালতকে দেওয়া হলফনামায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ইরানি মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায় আফগানিস্তানের মাদক পাচারকারীদের থেকে ওই হেরোইন ভারতের বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। আর তাই হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে পারস্য উপসাগর হয়ে ওই মাদক পশ্চিম ভারতের মুন্দ্রা বন্দরে পাঠায় ইসলামাবাদ।
০৫১৮
এনআইএর দাবি, ট্যালকম পাউডারের নাম করে অতি গোপনে ওই হেরোইন আমদানি করে এ দেশের পাচারকারীরা। দিল্লির নেব সরাই এবং আলিপুরের দু’টি গুদামে সেগুলি সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতায় ফাঁস হয় সেই ষড়যন্ত্র। যদিও ভারতীয় পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করা হেরোইনের অর্থ জঙ্গি নেতাদের কাছে পৌঁছে দেন পাক গুপ্তচরেরা। ফলে কাশ্মীরে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে টাকার অভাব হয়নি জঙ্গিদের।
০৬১৮
মুন্দ্রার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া কবীর তলোয়ার ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আর্জি জানিয়েছেন। ২৩ এপ্রিল বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি এন কোটেশ্বর সিংহর বে়ঞ্চে সেই মামলার শুনানিতে এর প্রবল বিরোধিতা করেন অতিরিক্ত সলিসিটার জেনারেল ঐশ্বর্য ভাটি। এজলাসে তিনি বলেন, ‘‘আইএসআই এটা আগেও করেছে। এই ভাবেই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির জন্য অর্থ সংগ্রহ করে পাক গুপ্তচর বাহিনী।’’
০৭১৮
এনআইএর আরও দাবি, ট্যালকম পাউডারের নাম করে আগে বৈধ নথি দেখিয়ে এ দেশে হেরোইন পাচার করেছে ইসলামাবাদ। কিন্তু সেই ছক ভেস্তে যাওয়ায় অত্যন্ত গোপনে অপারেশন চালাতে থাকে আইএসআই। আগে শুধুমাত্র পঞ্জাবে মাদক পাঠাত ইসলামাবাদ। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হওয়ায় গুজরাত-সহ পশ্চিম ভারতের উপকূলকে বেছে নিয়েছে আইএসআই।
০৮১৮
গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বৈসরনে জঙ্গি হামলার পরের দিনই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় এনআইএ। ২৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের হাতে তদন্তভার তুলে দেয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। প্রাথমিক ভাবে, ঘটনার দিন প্রতি মুহূর্তের টুকরো টুকরো তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দিয়েছে তারা।
০৯১৮
এনআইএর সন্ত্রাসদমন শাখার আইজি, ডিজি এবং এসপি পদমর্যাদার আধিকারিকদের নিয়ে গঠিত একটি দল এর তদন্ত চালাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। কোথা দিয়ে জঙ্গিরা এসেছিল, প্রথম হামলা কখন হল, পর্যটকদের সঙ্গে কী কী করা হয়েছিল, প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা চালাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। হামলার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা বলছেন গোয়েন্দারা।
১০১৮
সূত্রের খবর, পহেলগাঁও হামলায় নিহতদের পরিজনদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বয়ান রেকর্ড করবে এনআইএ। ২৬ এপ্রিল দুপুরে বাংলায় আসেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তিন অফিসার। বেহালার শখেরবাজারের বাসিন্দা নিহত সমীর গুহের বাড়িতেও যান তাঁরা। সমীরের স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে কথা হয় তাঁদের।
১১১৮
অন্য দিকে জঙ্গিহানার পর থেকে উপত্যকা জুড়ে তল্লাশি অভিযানে নেমেছে নিরাপত্তাবাহিনী। সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করে তাদের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের দাবি, জঙ্গিদের বেশ কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা সাহায্য করেছিল বলে তল্লাশি অভিযানে জানা গিয়েছে। সে রকম অন্তত ১৫ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
১২১৮
উপত্যকার পুলিশ সূত্রে খবর, পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, অস্ত্র মজুত এবং সরবরাহে সাহায্য করার অভিযোগে অন্তত পাঁচ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ঘটনার দিন বৈসরনের আশপাশেই ছিলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে তিন জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, তাঁদের মোবাইলে পহেলগাঁও হামলার দিন কয়েক আগের কিছু গ্রুপ চ্যাটও মিলেছে। সেখানে জঙ্গিদের সাহায্য করার প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তাঁরা।
১৩১৮
পহেলগাঁও জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার অন্তর্গত। গোটা জেলা জুড়ে তল্লাশি অভিযানে ২০০ জনের বেশি স্থানীয় বাসিন্দাকে আটক করেছে উপত্যকার পুলিশ। এ ছাড়া সেদোরি নালা মুস্তাকাবাদ মছিলের জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের বাঙ্কারের হদিস পেয়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। সেখান থেকে পাঁচটি একে-৪৭ রাইফেল, আটটি একে-৪৭ ম্যাগাজ়িন, একটি পিস্তল, একটি পিস্তল ম্যাগাজ়িন, একে-৪৭-এর ৬৬০টি কার্তুজ এবং এম৪ কারবাইনের ৫০টি কার্তুজ উদ্ধার করেছেন তাঁরা।
১৪১৮
অন্য দিকে, এই ঘটনার সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের কথা প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছে ইসলামাবাদ। এই আবহে আবার অদ্ভুত দাবি করে বসেছেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ। তিনি বলেছেন, ‘‘এ ব্যাপারে তদন্ত করে দেখুক রাশিয়া, চিন বা অন্য কোনও পশ্চিমা দেশ।’’ সাধারণত এই ধরনের ঘটনায় পাকিস্তানকে বার বার রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপের দাবি তুলতে দেখা গিয়েছে। এই প্রথম নির্দিষ্ট ভাবে কিছু দেশের নামোল্লেখ করেই তদন্তের আর্জি জানালেন সেখানকার এক মন্ত্রী। ফলে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
১৫১৮
পহেলগাঁওয়ে হামলার কিছু ক্ষণের মধ্যেই এর দায় স্বীকার করে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। কিন্তু, পরে ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে সে কথা অস্বীকার করে তারা। উল্টে গোটা ঘটনাটাই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা র-এর সাজানো বলে দাবি করেছে টিআরএফ। এ দেশের গোয়েন্দারা অবশ্য জানিয়েছেন, হামলাকারীদের মধ্যে দু’জন ছিলেন ভারতীয়। বাকিরা সবাই পাক নাগরিক।
১৬১৮
বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও মুখ খোলেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘কোনও তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করা হচ্ছে। হামলাকারীরা যে আমাদের নাগরিক, সেই ব্যাপারে সদর্থক প্রমাণ থাকতে হবে। কিন্তু, সেটা না করে নয়াদিল্লি ফাঁকা বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করছে।’’
১৭১৮
পাকিস্তানের এই নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছে চিন। বেজিঙের সরকারি সংবাদ সংস্থা গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোটা ঘটনার উপর নজর রাখছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সরকার। পাক বিদেশমন্ত্রী তথা উপপ্রধানমন্ত্রী ইসাক দারের সঙ্গে ড্রাগনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র ফোনে কথা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৮১৮
তবে ইসলামাবাদের এই দাবিকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না ভারত। উল্টে কড়়া ব্যবস্থা নিতে ফৌজের উপর পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ ব্যাপারে আমেরিকা এবং রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে নয়াদিল্লির দিকে। ফলে বড় আকারের কোনও বদলা যে ভারত নেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।