Advertisement
E-Paper

সুখের মন্ত্রক আসছে

কুড়ি বছর পর অরুন্ধতী রায়ের নতুন উপন্যাস বেরোতে চলেছে আগামী মঙ্গলবার। এখানে তিনি শুধু প্রতিবাদী অ্যাক্টিভিস্ট নন, মরমি লেখক। গৌতম চক্রবর্তীকুড়ি বছর পর অরুন্ধতী রায়ের নতুন উপন্যাস বেরোতে চলেছে আগামী মঙ্গলবার। এখানে তিনি শুধু প্রতিবাদী অ্যাক্টিভিস্ট নন, মরমি লেখক। গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭ ০০:০০
মরমি: অরুন্ধতী রায়।

মরমি: অরুন্ধতী রায়।

আচ্ছে দিন আসেনি। উলটে আর্থিক বৃদ্ধির হার যে ভাবে কমেছে, মাংস খাওয়া উচিত কি না, ময়ূর চোখের জল ময়ূরীকে গর্ভবতী করে কি না ইত্যাদি জবড়জং বক্তব্য যে ভাবে চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আদতে সে আসবে কি না, বলা শক্ত।

কিন্তু ফুল ফুটুক, না-ফুটুক, আজ বসন্ত। আচ্ছে দিন না এলেও আগামী পরশু, ৬ জুন বিশ্বজোড়া পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে চূড়ান্ত সুখের মন্ত্রক। প্রায় কুড়ি বছর পর বেরচ্ছে অরুন্ধতী রায়ের নতুন উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’।

১৯৯৭ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ বেরনোর পরই ‘ম্যান বুকার’ এবং বিশ্বজয়। ভারতীয় সাহিত্যে তার আগে ভি এস নাইপল থেকে সলমন রুশদি অনেকেই ওই পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁরা সকলেই ছিলেন প্রবাসী। স্বদেশে বসে প্রথম উপন্যাসেই সম্মানলাভ, এবং তার পরও দেশে থেকে যাওয়া… অরুন্ধতীই প্রথম!

প্রথম আরও অনেক কিছুতেই। নতুন বই বেরনোর আগে অরুন্ধতী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সবাই বলতেন, লেখা ছেড়ে দিলে? ১৬টা নন-ফিকশন যেন লেখালেখির বাইরে।’ মাঝের কুড়ি বছরে অরুন্ধতী উপন্যাস লেখেননি ঠিকই, কিন্তু তাঁর নন-ফিকশন বারংবার প্রত্যয়ের সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছে, বড় বাঁধ কেন হওয়া উচিত নয়, কেনই বা কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কাশ্মীরিদের হাতেই থাকা উচিত! কখনও বা বস্তারের জঙ্গলে মাওবাদীদের ডেরায় হেঁটে গিয়ে দেখান, গোটাটাই যুগ যুগ সঞ্চিত অসাম্যের লড়াই। ‘ব্রিটিশ আমলের আগে থেকে আদিবাসীরা পুলিশ, প্রশাসন, মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য হয়েছে, আমরা খেয়াল রাখি না,’ লিখেছিলেন অরুন্ধতী। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কানহাইয়া, উমর খালিদদের উপর আক্রমণ নেমে আসার পর নিজেকেও স্বেচ্ছায় ‘জাতীয়তাবাদ-বিরোধী’ ঘোষণা করেন। ‘দিল্লি আর শ্রীনগরে দুই থাক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে কাশ্মীরকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে, ঘুষ, ভয় দেখানো, ব্ল্যাকমেল সব মিলিয়ে কাশ্মীরে আজ সরকার আর সেনার প্রায় একচ্ছত্র শাসন,’ বছর পাঁচেক আগে তাঁর ‘দ্য ডেড বিগিন টু স্পিক আপ ইন ইন্ডিয়া’ নিবন্ধে লিখেছিলেন অরুন্ধতী।

মৃতেরা কথা বলেছে এই নতুন উপন্যাসেও। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে এসেছে জিহাদিদের হাত থেকে কাশ্মীরের বন্দিপুরা শহরকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুক্ত করার বর্ণনা: ‘গ্রামবাসীরা বলে আগের দিন বিকেল সাড়ে তিনটেয় অভিযান শুরু হয়েছিল। মুখের চা ফেলে, বইখাতা খুলে, কড়াইতে আধভাজা পেঁয়াজ রেখেই বন্দুকের নলের সামনে বাসিন্দারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।’ রাষ্ট্র ও ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির অত্যাচারে মাকোন্দো এ ভাবেই শ্মশান হয়ে গিয়েছিল না? দ্বিতীয় উপন্যাসে অরুন্ধতী গার্সিয়া মার্কেজ-এর সার্থক উত্তরসূরি।

তিলো, মুসার মতো কাশ্মীরি বিদ্রোহীদের পাশাপাশি আছে গার্সন হোবার্ট। ‘ভারত সরকারের চাকরি করাটা আমার কাছে গৌরবের,’ বলে সে। কিন্তু টেনশন তাকে অ্যালকোহলিক করে দেয়, ক্ষইয়ে দেয়। কারণ গার্সন জানে, কাশ্মীরে শান্তি ফেরানোটা ‘একেবারে সঠিক যুদ্ধ। যে যুদ্ধে কেউ জিতবে না, কেউ হারবে না, অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে।’

শুধুই কাশ্মীর? না। কাশ্মীরি জঙ্গির প্রেমিকা তিলো একটি বাচ্চাকে নিয়ে পালাতে থাকে। জঙ্গলে অন্য এক গেরিলা কন্যা এই শিশুর জন্ম দিয়েছিল। তিলো শিশুকে নিয়ে একটি ট্রাকে ওঠে। ট্রাকের পিছনেই এক মরা গরু। আস্তাকুঁড়ে অতিরিক্ত প্লাস্টিক খেয়ে সে মারা গিয়েছে।

‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ

এই যে অতিরিক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ ভক্ষণে গোমাতার মৃত্যু, এই ‘উইট’-এই অরুন্ধতীর উজ্জ্বল উদ্ধার। উপন্যাসের শুরুতেই আছে দিল্লির এক কবরখানা। ‘গোধূলি লগ্নে যখন সূর্য অস্ত গিয়েছে, কিন্তু আলোর রেশ রয়েছে, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ুক্কু শেয়াল কবরখানার বটগাছ থেকে নেমে আসে।’ কিন্তু শকুনরা এই কবরখানায় আর নেই। গরুতে যাতে বেশি দুধ দিতে পারে, সে জন্য তাদের ডাইক্লোফেনাক নামে ওষুধ দেওয়া হয়। এটি আবার শকুনদের কাছে নার্ভ গ্যাসের সমতুল্য। ডাইক্লোফেনাক-আক্রান্ত মরা গরু খেয়ে শকুনরা লোপাট। আর গবাদি পশু তত ক্ষণে দুধের মেশিনে পরিণত। শহর আরও আইসক্রিম খায়, দুধ আর মিল্কশেক খায়। অরুন্ধতী রায় কেন সাহিত্য ছেড়ে অ্যাক্টিভিজমে নেমে পড়লেন, তা নিয়ে অনেক পাঠকের দুঃখ ছিল। কুড়ি বছর পর বোঝা গেল, ওই অ্যাক্টিভিস্ট-অভিজ্ঞতাই জারিত হয়ে গিয়েছে সাহিত্যের ভাষায়।

উপন্যাসের নায়িকা আঞ্জুম শকুন-পরিত্যক্ত এই কবরখানাতেই থাকে। আঞ্জুমের আসল নাম আফতাব। জন্মের পর ছেলে হয়েছে ভেবে মা-বাবা আনন্দে মেতেছিলেন। পরদিন মা লক্ষ করেন, শিশুটির নারী-যৌনাঙ্গও রয়েছে। বাবা চেঙ্গিজ খানের গল্প বলে আফতাবের মধ্যে পৌরুষ জাগানোর চেষ্টা করেন,
কিন্তু সে সাড়া দেয় না। আফতাব হয়ে গেল হিজড়ে আঞ্জুম। ‘দাঙ্গা তো আমাদের সত্তার মধ্যে। ভারত-পাক যুদ্ধ আমাদের ভিতরেই। সে যুদ্ধ কোনও দিন মিটবে না,’ উপলব্ধি করে সেই নপুংসক। এখানেই সাহিত্যের জিত, অরুন্ধতী লহমায় হয়ে ওঠেন মরমি লেখক।

Arundhati Roy The Ministry of Utmost Happiness
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy