Advertisement
E-Paper

স্টেথোস্কোপের ২০০ বছর

প্যারিসের নেকার হসপিটাল। ১৮১৬। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক স্থূলকায়া যুবতী এসেছেন বুকের কষ্ট নিয়ে। ডাক্তার বুঝতে পারলেন, হৃদ্‌যন্ত্রের শব্দটা শোনা দরকার। কিন্তু শ্লীলতা বজায় রেখে যুবতীর বুকে কান পাতা সম্ভব নয়।

অর্ক বৈরাগ্য

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

প্যারিসের নেকার হসপিটাল। ১৮১৬। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক স্থূলকায়া যুবতী এসেছেন বুকের কষ্ট নিয়ে। ডাক্তার বুঝতে পারলেন, হৃদ্‌যন্ত্রের শব্দটা শোনা দরকার। কিন্তু শ্লীলতা বজায় রেখে যুবতীর বুকে কান পাতা সম্ভব নয়। পাশে পড়ে থাকা একটি নোটবুককে গোল করে গুটিয়ে, চোঙা মতো বানিয়ে, এক দিক রোগীর শরীরে রেখে, কান পাতলেন অন্য দিকে। শুনতে পেলেন লাব-ডুপ, লাব-ডুপ।

ডাক্তারবাবুর নাম: রেনে লেনেক। ঠিক দুশো বছর আগে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন স্টেথোস্কোপের ধারণাটি। যন্ত্রটা বানিয়ে উঠতে অবশ্য সময় লেগেছিল আরও দু-তিন বছর। পরে স্টেথোস্কোপকে উন্নত করেন বেশ কয়েক জন ডাক্তার, কিন্তু জনক হিসেবে লেনেকের নাম চিরদিন জ্বলজ্বল করবে।

এখন এই যন্ত্রটিকে অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্র পিছনে ফেলে দিয়েছে বটে, কিছু দিন আগেই আমেরিকার এফ-ডি-এ ছাড়পত্র দিল ব্লুটুথ স্টেথোস্কোপকে— নিমেষের মধ্যে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসেও ডাক্তারবাবু শুনতে পারবেন আপনার হৃৎস্পন্দন। কিন্তু, তা বলে স্টেথোস্কোপ ছাড়া কি ভাবা যায় ডাক্তারের ছবি?

শোনা যায়, ৩৫ বছর বয়সের ডক্টর লেনেক, রাস্তায় খেলা করা ছেলেদের দেখে স্টেথোস্কোপের ধারণাটি পেয়েছিলেন। ছেলেগুলো একটা চোঙের এক দিকে কান পেতে, অন্য দিকে পিন ঘষে তার আওয়াজ শুনছিল। তখন ডাক্তারির রীতি ছিল, বুকের আওয়াজ শোনার জন্যে সরাসরি বুকে কান পাতা। একে বলা হত ’ইমিডিয়েট অসকাল্টেশন’। লেনেক প্রথমে ঐ চোঙার নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য সিলিন্ডার’। পরে তাতে আরও কিছু পরিবর্তন করার পর, নাম হয় স্টেথোস্কোপ। আর লেনেক এই পদ্ধতিকে বলেছিলেন ‘মিডিয়েট অসকাল্টেশন’। স্টেথোস্কোপ এক দিনে জনপ্রিয় হয়নি, ডাক্তাররা এবং রোগীরাও অনেক সময় ‘সিলিন্ডার’কে বাঁকা চোখে দেখেছেন।

লেনেক যে সময়ে কাজ করছিলেন, তখন চিকিৎসাবিজ্ঞান একেবারে শৈশবে। লেনেক এই আবিষ্কারটি করে ডাক্তারি পরীক্ষার চতুষ্কোণটিকে সম্পূর্ণ করলেন। ইন্সপেকশন (লক্ষ করা), প্যালপেশন (ছঁুয়ে দেখা), পারকাশন (আঙুল দিয়ে বাজিয়ে বুঝতে চাওয়া, ভেতরের অঙ্গগুলি কী অবস্থায় আছে), আর অসকাল্টেশন (শোনা): এগুলি ডাক্তারি পরীক্ষার ধাপ। এই শোনা-র ব্যাপারটাকে লেনেক একটা বস্তুগত রূপ দিলেন।

সেই সময় লেনেক আরও একটা খুব জরুরি কাজে হাত দিয়েছিলেন। যক্ষ্মারোগ ছিল দুরারোগ্য, যক্ষ্মার প্রথম ওষুধ আবিষ্কার হয় ১৯৪৩ সালে (স্ট্রেপটোমাইসিন), আর তার ১২০ বছর আগে লেনেক নিষ্ঠাভরে লিপিবদ্ধ করছেন যক্ষ্মার যাবতীয় রোগ-লক্ষণ। তখন ইউরোপে, হাসপাতালে তাঁরাই ভর্তি হতেন, যাঁরা সমাজে বর্জিত। সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ হাসপাতালের চৌকাঠ পেরোতেন না। তাঁদের চিকিৎসা হত তাঁদের বাড়িতে। মানে, এখন যা হয়, তার একেবারে উলটো। সেই দুঃস্থ রোগীরা যখন হাসপাতালে আসতেন, প্রায় জেনেই আসতেন, এ হল স্রেফ মৃত্যুর আগের ধাপ। লেনেক সুযোগ পেয়েছিলেন ওই রোগীদের খুব ভাল করে কাছ থেকে দেখার। তিনি তাঁদের বুকে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে, বিভিন্ন রকম শব্দকে মন দিয়ে শুনতেন আর তাঁর অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করতেন, আর তাঁরা মারা গেলে, শব ব্যবচ্ছেদ করে, সেই শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করতেন রোগীর ফুসফুস পরীক্ষা করে। আবার তার পাশাপাশি লেনেক কাজ করেন লিভারের সিরোসিস নিয়ে, যাকে তাঁর সম্মানে লেনেক’স সিরোসিস বলা হয়।

যক্ষ্মারোগীদের সঙ্গে সারা ক্ষণ থাকার কারণে তিনিও সেই রোগের কবলে পড়ে ১৮২৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা যান। লেনেক বুকের শব্দগুলোর বিভিন্ন নামকরণ করেছিলেন তাদের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে, ২০০ বছর পরও সেই নামই ব্যবহার করেন ডাক্তাররা।

গত কয়েক দশকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান তরতর করে এগিয়ে চলেছে। এই টেলিমেডিসিন আর রেডিয়ো-ডায়াগনোসিসের যুগে, স্টেথোস্কোপকে অনেকেই অপ্রাসঙ্গিক মনে করছেন। হ্যান্ড-হেল্ড আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, ফোনোকার্ডিয়োগ্রাফি এসে, রোগ নির্ণয়ের ব্যাপারে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে বৃদ্ধ, মন্থর স্টেথোস্কোপ-কে। তবে কি সময় এসে গেছে চিকিৎসকদের স্টেথো নামিয়ে রাখার?

ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই চিকিৎসক, ডা. আব্রাহাম ভার্গিজ, আর ডা. অতুল গাওয়ান্ডে— নতুন করে ভাবাতে চাইছেন ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের দিকগুলোকে নিয়ে। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রামাণ্য বই ‘হ্যারিসনস প্রিন্সিপ্‌ল্‌স অব ইন্টারনাল মেডিসিন’-এর প্রথম সংস্করণ (১৯৫০)-এ লেখা কথাগুলোকেই যেন নতুন করে আবার ভেবে দেখার সময় এসেছে, যেখানে ডা. হ্যারিসন বলেছেন: এক জন রোগী শুধুমাত্র কিছু লক্ষণ, রোগ, রোগগ্রস্ত অঙ্গ এবং মানসিক যন্ত্রণার শিকার নন, তিনি এক জন সাধারণ মানুষ— ভীত, এবং আশাবাদী— যিনি সাহায্য, আশ্বাস ও মুক্তির পথ খুঁজছেন।

তাই এখন অনেক ডাক্তার বলছেন, অত্যাধুনিক চিকিৎসার প্রযুক্তি নিশ্চয়ই রোগ নির্ণয় করবে অনেক সহজে ও দ্রুততায়, কিন্তু সেটাই ডাক্তারের ভূমিকার শেষ নয়। বরং যন্ত্র যেখানে শেষ করবে, সেখানেই শুরু হবে ডাক্তারের দায়িত্ব। স্টেথোস্কোপ বুকে বসানোর পর ডাক্তার এবং রোগী যেন এক অদৃশ্য আবেগপূর্ণ সম্পর্কের দুই প্রান্তে এসে উপস্থিত হন। সেই সম্পর্কের অন্যতম ‘মিডিয়েটর’ লেনেকের সিলিন্ডার, যার মধ্যে দিয়ে বুকের একমুখী শব্দের পাশাপাশি নিঃশব্দে চলতে থাকে বিশ্বাস, ভরসা, আর পারস্পরিক সম্মানের প্রবাহ। আর তার মাঝখানে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা গোটানো নোটবুক, আর ২০০ বছরের ইতিহাস।

abairagya@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy