Advertisement
E-Paper

অবয়ব

কলেজ স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে পুরনো বই কেনাটা একটা নেশা আমার। শুধু আমি নই, আমার মতো পাগল আরও অনেক আছে এ শহরে এবং শহরতলিতে, যারা শুধু পুরনো বই কেনার জন্য লোকাল ট্রেন বা বাসে চেপে বেশ কয়েক মাইল ঠেঙিয়ে এসে হাজির হয় এই তীর্থস্থানে।

নন্দিতা বাগচী

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

কলেজ স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে পুরনো বই কেনাটা একটা নেশা আমার। শুধু আমি নই, আমার মতো পাগল আরও অনেক আছে এ শহরে এবং শহরতলিতে, যারা শুধু পুরনো বই কেনার জন্য লোকাল ট্রেন বা বাসে চেপে বেশ কয়েক মাইল ঠেঙিয়ে এসে হাজির হয় এই তীর্থস্থানে। ‘তীর্থস্থান’ শব্দটা একটু কানে বাজল কি? তবে আমি নিরুপায়। আমার কাছে এটা সত্যিই তীর্থস্থান।

আমি এক জন স্নাতক। সেই সুবাদে কলেজ স্ট্রিটের কাছাকাছি একটা ছাপাখানায় প্রুফ দেখার কাজ করি। কাগজ আর কালির যত কাছাকাছি থাকা যায় আর কী। ছাপাখানার কালির গন্ধটা আমার ভারী ভাল লাগে। তবে সব চাইতে ভাল লাগে পুরনো বইয়ের গন্ধ। বেশ বৃষ্টির মতো। ঠান্ডা-ঠান্ডা, সোঁদা-সোঁদা। কোনও লাইব্রেরিতে ঢুকলে আমার মনে হয় যেন অক্সিজেন পার্লারে ঢুকেছি। বুক ভরে টেনে নিই সেই সুঘ্রাণ।

আজই আমি মাইনে পেয়েছি। রোজগার সামান্য হলেও পুরনো বই কেনার সামর্থ্য আমার আছে। তাই ‘চায়ের তেষ্টা পেয়েছে’ বলে মিনিট পনেরোর জন্য বেরিয়ে এসেছি প্রেস থেকে। আর আমার মাইনে পাওয়ার দিনটাতে ওরাও কেমন যেন আমার হাতের নাগালে এসে হাজির হয়। ওরা মানে আমার পছন্দের বইগুলোর কথা বলছি। এমনি করেই আমি শেক্‌সপিয়ারের বেশ কিছু নাটকের মালিক হয়েছি। আর আছেন মধুসূদন, কালীপ্রসন্ন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, শরৎচন্দ্র, রাজশেখর, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, শরদিন্দু, নজরুলরা। স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছেন আমার জীর্ণ, নোনা-ধরা ঘরটার দেওয়াল-আলমারিতে তাঁদের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধ্বজা উড়িয়ে।

আজও আমাকে দেখেই সব ক’টা দাঁত বের করে বাণীব্রতদা বললেন, ‘এসো এসো, তোমার জন্যই রেখে দিয়েছি এটা। কালই এসেছে। একেবারে ফ্রেশ।’

সদ্য আগত সেই প্রচ্ছদহীন বহুব্যবহৃত লজ্‌ঝড়ে ‘ফ্রেশ’ বইখানা দেখে তো আমি চমৎকৃত। প্রথমেই বুক ভরে টেনে নিলাম গন্ধটা, তার পর মুদ্রণের সালটা দেখে নিলাম চট করে। প্রায় সত্তর বছর আগেকার বই। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’, যেটা তিনি গত শতাব্দীর প্রথম দিকে লিখেছিলেন। বইটা আমি পড়েছি বেশ কিছু বছর আগে, আমাদের পাঠ্য ছিল নাটকটা।

আমি থাকি দক্ষিণ শহরতলিতে। আজ বাড়ি ফেরার পথে কবি নজরুল স্টেশনে নেমে গড়িয়ায় একটু ঢুঁ মেরেছিলাম আমাদের পত্রিকার দফতরে। ডিমনিটাইজেশনের হুজ্জতিতে এ বারে মার খেয়ে গেল আমাদের লিট্‌ল ম্যাগাজিনটা। আজ সবাই মিলে স্থির করা হল, এ বারের বইমেলায় আর প্রকাশ করা সম্ভব হবে না পত্রিকাটা। তবে দমে যাবার পাত্র নই আমরা। মোমবাতির শিখার ওপরে ডান হাতের চেটো রেখে শপথ নিয়েছি, ‘আসছে বছর আবার হবে’।

পত্রিকা প্রকাশ পাবে না বলে মনের ভেতরে একটা চিনচিনানি ছিলই, তাই অটোওয়ালার সঙ্গেও আজ খুচরো নিয়ে হাতাহাতির উপক্রম। সে দশ টাকার কয়েন নেবে না, সেটাও নাকি অচল হয়ে যাবে ক’দিন বাদেই। আমিও খবরের কাগজ পড়া জ্ঞান ঝাড়ি— কয়েনটা নেবেন, না কি থানায় যাবেন? শেষমেশ সহযাত্রীদের সহায়তায় ব্যাপারটার একটা মীমাংসা হল।

বাড়িতে ঢুকতেই মা বললেন, পাঁচশো টাকার নোট ভাঙানোর জন্য লাইন দিয়েছিলেন সকালে, ব্যাংকের ক্যাশ টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় সে টাকা ভাঙানো যায়নি। এ দিকে ঘরে চাল বাড়ন্ত। আমার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। পুত্রসন্তান। শিবরাত্রির সলতে যাকে বলে আর কী। তাই বাজারে গিয়ে চাল কিনে এনে, হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে নিজের ঘরে এসে বসেছি। ঝোলা ব্যাগ থেকে ‘চন্দ্রগুপ্ত’কে বার করে চোখ দুটো বুজে ঘ্রাণ নিচ্ছি তার। সেই প্রাচীন সুগন্ধের সঙ্গে নতুন চালের ফুটন্ত ভাতের সুবাস এক অদ্ভুত যুগলবন্দি বাজাচ্ছে আমার অন্তরমহলে।

বইটার পাতাগুলো আলতো হাতে ওলটাতে থাকি। প্রতি পাতায় কত বিচিত্র নাম লেখা। অলকেশ নন্দী, প্রণতি বসু, শুচিতা ঠাকুর, ব্রতীন দে, তুষার সর্দার, শ্রীমতী তলাপাত্র, রায়হান হক, নীলমণি বসাক। তার মানে, কোনও না কোনও সময়ে এঁদের সকলেরই এই বইটার মালিকানা ছিল। কেউ কেউ আবার মার্জিনে নোটও লিখে রেখেছেন দেখছি।

হঠাৎ আমার মস্তিষ্কে একটা স্ফুলিঙ্গ-মোক্ষণ। এই নামগুলোর তো নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট কিছু অবয়ব আছে, ভার্চুয়াল তো নয়। তাদেরকে খুঁজে বের করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মুহূর্তে সারা পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয়। নিশাচররা প্যাঁচার মতো গোল্লা পাকানো চোখগুলো পর্দায় সেঁটে টাইপ করে চলেছেন বিশ্বময়। এই মধ্যযামে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ভেরি ভেরি অ্যাকটিভ হয়ে উঠেছে। চেনা-অচেনা ‘অনলাইন’ মানুষগুলো সবুজ টিপ পরে গবেষণায় মেতে উঠেছেন। আমিও অনুসন্ধানে ব্রতী হই।

ব্রতীন দে বেশ ভদ্র মানুষ। বললেন, ‘আমি শিকাগোতে থাকি... এখানে এখন কাজের সময়... পরে কথা হবে।’ সবার শেষে একটা হাসিমুখের ছবি।

শ্রীমতী তলাপাত্র অবশ্য বেশ বাক্যবাগীশ। ইমোশনাল হয়ে উঠলেন আমার মেসেজটা পড়ে। বললেন, ‘ইস! ওই বইটা এখন আপনার কাছে? জানেন, আমার ছেলের এখন চন্দ্রগুপ্ত পাঠ্য... আমিই ধরেবেঁধে পড়াচ্ছি... চাণক্য চরিত্রটা কী ইন্টেলিজেন্ট লাগছে যে কী বলব! অথচ আমি নিজে যখন পড়েছিলাম, তখন বড়ই পূতিগন্ধময় লেগেছিল তাঁকে... মনে হয়েছিল কী সিনিক্যাল আর সেডিস্ট একটা ক্যারেকটার... দেখুন, নাটকটার প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের কোনও একটা পাতায় আমি লিখে রেখেছি, ‘প্রভাতের সর্বাঙ্গে ঘা! পুঁজ পড়ছে,’ এটা একটা ডায়ালগ হল? কিন্তু আপনি আমাকে খুঁজে পেলেন কী করে বলুন তো?’

সে কথার জবাব না দিয়ে একটা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাদের ডায়ালগটাকে অব্যাহতি দিই আমি। এ বার আমার আবার খোঁজার পালা। গন্তব্য চন্দ্রগুপ্তের প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য। আশ্চর্য! সত্যিই তো, মার্জিনে লেখা আছে ওই কথাগুলো! একটু অস্পষ্ট হলেও পড়া যাচ্ছে।

প্রণতি বসু বা শুচিতা ঠাকুর নামের কাউকে পেলাম না। হয়তো বিয়ের পর তাঁদের পদবি বদলে গেছে। শ্রীমতী তলাপাত্র হয়তো পদবি বদলাননি, কিংবা বিয়ের পরে পড়াশোনা করেছেন।

নীলমণি বসাকের বেশ বয়েস হয়েছে মনে হল। বললেন, ‘ধুস মশাই, চন্দ্রগুপ্ত পড়তে একটুও ভাল লাগত না। তবে হেলেনকে আমার দারুণ লাগত, ভালও বেসে ফেলেছিলাম হয়তো তাকে... দেখুন, দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে হেলেন যখন আন্টিগোনাসকে রিফিউজ করে কুষ্ঠরোগী-ফোগী বলছে, সেখানে লাল কালি দিয়ে একটা তির-বেঁধা হার্টের ছবি আঁকা আছে...’

আরও অনেক কথা লিখে চলেছেন তিনি। আমি শুধু ‘আচ্ছা’, ‘বেশ’, ‘তাই?’ ছোট ছোট শব্দে প্রতিক্রিয়া জানাই। ভদ্রলোক নিঃসঙ্গ। স্ত্রী মারা গেছেন। একা থাকেন। ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের সংসার এবং কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত, তাই তাঁর একমাত্র অবলম্বন এখন এই ‘চ্যাটিং’। সারা রাত জেগে চেনা-অচেনা ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কথা চালাচালি করে ভোরের দিকে ঘুমোতে যান। আজ নাকি আমি তাঁকে তাঁর যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছি। মুকুলিকা নামের এক সহপাঠিনীকে ভালবাসতেন তিনি। সেই তদানীন্তন তরুণীটিও নাকি তাঁর প্রেম-প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, তাই ওই তির-বেঁধা হৃদয়, ইত্যাদি।

অলকেশ নন্দী বললেন, ‘আরিব্বাস! চন্দ্রগুপ্ত? নাটকটার কী ডায়ালগ মাইরি! ভাবুন তো, সেই কোন কালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সেকেন্দারের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন— ‘সত্য সেলুকস! কী বিচিত্র এই দেশ!’ ডায়ালগটা কেমন ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল মনে আছে? তবে আজ যদি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বেঁচে থাকতেন, তবে হয়তো লিখতেন— সত্য সেলুকস! কী বিচিত্র এই বঙ্গ! হাহাহা, কেমন দিলাম বলুন? যা চলছে চারিদিকে! তবে প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের স্থান-কাল-পাত্রগুলো অবশ্য বদলাতে হত তাঁকে। স্থান: গঙ্গা-নদীতট; দূরে দ্বিতীয় হুগলি সেতু। কাল: দিবা রাত্রি। পাত্র-পাত্রী: আপনার-আমার অতি চেনা কিছু মানুষ। হাহাহা। ভাল থাকবেন। দিনকাল ভাল নয়।’

আমার মোবাইল ফোনের ঘড়িটা জানান দিচ্ছে, রাত এখন পৌনে তিনটে। এখন শুয়ে পড়া উচিত, নয়তো কাল প্রুফ দেখতে গিয়ে চোখ দুটো বিদ্রোহ জানাবে। মায়ের মৃদু নাক ডাকছে পাশের ঘরে। বোতল থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। পুরনো আমলের বাড়ি বলে উঠোন পেরিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। বাথরুম সেরে যখন আবার উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় উঠলাম, তখন দূরের শ্মশানটা থেকে শেয়ালগুলো ডেকে উঠল রাত্রির তৃতীয় প্রহরের সমাপ্তি ঘোষণা করে।

লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছি একটু আগে। শেয়ালগুলো এখনও ডাকছে। হঠাৎ দেখি, কে যেন দাঁড়িয়ে আছে আমার ঘরের চটা-ওঠা মেঝেটার ওপরে। পরনে ধুতি, গলায় পইতে, মাথার পেছনে গিঁট-খোলা লম্বা টিকি।

ভয়ে কেঁপে উঠে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কে? আমার ঘরে ঢুকলেন কী করে?’

ঠোঁটের ওপরে আঙুল রেখে তিনি বললেন, ‘ধীরে বৎস, ধীরে। শ্মশান আমার প্রিয় স্থান। সেখানে দাঁড়িয়ে পচা হাড়-মাংসের সুগন্ধ নিচ্ছিলাম। বড় মোহময় সে সুরভি। সংসারকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু এই পিডিএফ ডাউনলোডের চক্করে আমাকে প্রতি দিন মানুষের সংসারে প্রবেশ করতে হয়। ওঃ, কী অধঃপতন!’

‘আপনি কী বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’ চোখ দুটো রগড়ে বলি আমি।

ব্রাহ্মণ নিজের মনে বিড়বিড় করছেন, ‘জাতির সমস্ত বিদ্যা, ক্ষমতা আত্মসাৎ করে নিজের ভাণ্ডার বাড়িয়ে চলেছে। মুহুর্মুহু এই পতন আর সহ্য হয় না।’

‘কার কথা বলছেন?’ অনুসন্ধিৎসু আমি।

জিভে আর টাকরায় চুকচুক আওয়াজ তুলে ব্রাহ্মণ বললেন, ‘প্রযুক্তির কথা বলছি। ওই অন্তর্জাল না কী যেন বলো তোমরা। ঊর্ণনাভের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক যার। তুমি কেমন কুশাঙ্কুর হে যে এই সামান্য কথাটুকুও বোঝো না! মনে হচ্ছে তোমারও কেশগুচ্ছ উপড়িয়ে দেখতে হবে যে, করোটির মাঝখানে ঘৃত-টৃত আছে, না কি শুধুই গোময়!’

‘কিন্তু আপনি কে?’ আবারও বোকার মতো প্রশ্ন করি আমি।

‘ওঃ, কী অধঃপতন! একেবারে পর্বতের শিখর হতে গভীর গহ্বরে! আজ ব্রাহ্মণ তাই মূষিকের মতো গৃহের এক অন্ধকার গর্ত থেকে অন্য অন্ধকার গর্তে সেঁধোবার জন্য মাথা নিচু করে চলেছে।’

একে গভীর রাত, তার ওপরে সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখ দুটো জড়িয়ে আসছে আমার। তাই বেয়াড়ার মতো বলে ফেলি, ‘আগে আপনার পরিচয় দিন, নইলে আমাকে নিস্তার দিন।’

‘মূর্খ, অর্বাচীন, বেয়াদব! আমাকে আত্মপরিচয় দিতে হবে? আমার চেহারা, আমার অবয়ব দেখে আর আমার মুখের পূতিগন্ধময় ভাষা শুনে কি বুঝতে পারছ না যে আমি চাণক্য?’

লেপটা সরিয়ে তড়াক করে উঠে বসি আমি। বলি, ‘আশ্চর্য! আপনি মগধ সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্য? দ্বিজেন্দ্রলালের চাণক্য?’

‘হ্যাঁ, আমিই সেই দুর্ভাগা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দুর্ভাগ্য আমার সঙ্গী। ইচ্ছা করে কাঁদি, চিৎকার করে কাঁদি,— আমার অশ্রুজলে পৃথিবী ডুবিয়ে ভেঙ্গেচুরে ভাসিয়ে দিই। কিন্তু অশ্রুর উৎস শুকিয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় যে, ভিতরে অশ্রু জমাট হয়ে গিয়েছে। অবিচারে অত্যাচারে ঈশ্বরকেও মেঘে ছেয়ে ফেলেছে— দেখতে পাই না।’

‘এত কীসের কষ্ট আপনার ব্রাহ্মণ? দ্বিজেন্দ্রলাল তো শেষ পর্যায়ে মেয়ে আত্রেয়ীকে ফিরিয়ে এনেছিলেন আপনার কাছে। তখন আপনি কুঞ্জবনে সামস্ত্রোত্র শুনতে পেয়েছিলেন। নদীকে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে দেখেছিলেন। আকাশ থেকে একটা স্নিগ্ধ সৌরভ-হিল্লোল ভেসে আসছে, উপলব্ধি করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এ আলোকের উচ্ছ্বাস না অন্ধকারের বন্যা?’

‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু সেটা অতীত। বর্তমান আবার আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।’

‘প্রকৃতিস্থ হোন ব্রাহ্মণ।’ সমবেদনার সুরে বলি আমি।

ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে, মাথার টিকিটি দুলিয়ে ব্রাহ্মণ বললেন, ‘চাণক্য কূট, কৌশলী, বিচক্ষণ, তাই তো জানো তোমরা?’

‘বিলক্ষণ!’ বিছানার ওপর একটা চাপড় মেরে বলি আমি।

‘ইহা সত্য নহে বৎস। আজ আমি বড়ই দীন। আকাশে যদি ঈশ্বর থাকতেন, তা হলে তিনি জানতেন, চাণক্যের কী দুর্দশা চলছে। কিন্তু হায়! তিনিও তো অপসারিত আজ।’

‘কেন ব্রাহ্মণ? আপনি কি নাস্তিক হয়ে গেছেন? ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন?’

‘হা হতোস্মি! ঈশ্বর কোথায়? আকাশ জুড়েই তো উপগ্রহদের অবস্থান এখন। মেঘও আর জীমূত নেই এখন, ক্লাউড তার নাম। যত্ত সব পূতিগন্ধময় পিডিএফ-এর ভাণ্ডার। আমাদের প্রজ্ঞা বলে, মেঘ হচ্ছে যক্ষের বার্তাবহ। ডাকহরকরার মতো বার্তা প্রেরণই তার কাজ। কিন্তু আজকাল তোমরা ঊর্ণনাভের মতো জাল বুনে বুনে একটা করে অবয়বহীন তথ্য পাসওয়ার্ডের আঁকশি দিয়ে টেনে নামাচ্ছ তার কাছে গচ্ছিত সঞ্চয় থেকে। তার ধারণ ক্ষমতাও নাকি মেগা-গিগা ছাড়িয়ে গেছে। যত্ত সব! এ সব ভার্চুয়াল ব্যাপার পছন্দ করি না আমরা। অবয়ব চাই আমাদের, সুদৃশ্য অবয়ব। ঝকঝকে দুটো প্রচ্ছদের মাঝখানে আমাদের চেহারা-চরিত্রের বর্ণনা চাই, অলংকরণ চাই। আর সেই আয়ত অবয়বটির পৃষ্ঠবংশে চাই রচনাটির শিরোনাম এবং স্রষ্টার নাম। এই অধঃপতন বন্ধ করো তোমরা। আমি অদূর ভবিষ্যতে কী দেখছি জানো?’

‘কী ব্রাহ্মণ?’ নত মুখে প্রশ্ন করি আমি।

‘পুস্তক সাম্রাজ্যের উপর প্রেতের ভৈরবনৃত্য! শতাব্দী পূর্বে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মগধরাজ নন্দকে সিংহাসনচ্যুত করে, তাঁকে বধ করে, তাঁর শোণিতে রঞ্জিত হস্তে এ শিখা বাঁধব। এখনও বাঁধি নাই, এই দেখো! আজও আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই অধঃপতনকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাই আমি।’

‘কী অপরাধে, ব্রাহ্মণ?’

‘হত্যার অপরাধে। সনাতন পাঠকের অধিকার লুণ্ঠন করবার অপরাধে। পাঠকের হাতে পুস্তক ফিরিয়ে দাও তোমরা।’

আমি মিনমিন করে বলি, ‘কিন্তু ডাউনলোডিংকে কি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়? সে তো ভার্চুয়াল...’

ব্রাহ্মণ ঠোঁটের কোনায় ব্যঙ্গ ফুটিয়ে বললেন, ‘যায় বইকী। সব কিছুরই একটা উৎপত্তিস্থল থাকে। দ্বাদশ সূর্যের তেজে স্থাবর-অস্থাবর, ভার্চুয়াল-রিয়াল, সব কিছুই অঙ্গার হয়ে যেতে পারে। আকাশই যদি না থাকে, তবে উপগ্রহ, তরঙ্গ, স্মৃতি-ভাণ্ডাররা থাকবে কোথায়? চাণক্যের রাজনীতির নাম শোনোনি? কদর্য প্রবৃত্তিগুলিকে কাজে লাগাতেই ভালবাসি আমি। বন্ধুকে শত্রু করতে ভাল লাগে, হিংসাকে লেলিয়ে দিতেও। বর্তমান পৃথিবীতে অবশ্য বহু অনুগামী আছে আমার।’

আরও অনেক কথা বলে চলেছেন সেই অদ্ভুতদর্শন, কটুভাষী ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মতেজে লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছে তাঁর মুখখানা। আমার দিকে তাকিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি নামিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা আমার অপছন্দের চিহ্ন, তোমাদের মতো সব কিছুকেই পছন্দের তালিকাভুক্ত করতে পারি না আমি। আজ চললাম। এর পর যখন তখন মধ্যরাত্রিতে আমাদের নিম্নাভিমুখে টানাটানি কোরো না। তোমাদের এই ডাউনলোডিং বড়ই পীড়াদায়ক আমাদের জন্য। এই বায়বীয়, অবয়বহীন অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না আমরা। আমাদের ভর চাই, আকার চাই, চাই পাঠকের হাতের অন্তরঙ্গ স্পর্শ...’

তীব্র হুক্কা হুয়া ঐকতানে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। বিছানার ওপরে হতভম্বের মতো বসে আছি। মনে পড়ে গেল চন্দ্রগুপ্ত বইটার কয়েকটা পাতা মিসিং ছিল বলে নাটকটা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছিলাম আমি, ওই পাতাগুলো জেরক্স করে নেব বলে। তখনই কি চাণক্যমশাই ঢুকে পড়েছিলেন আমার ঘরে? না কি নেহাতই স্বপ্ন? ঠাহর করতে পারি না। তবে একটা সিদ্ধান্ত নিই ঠান্ডা মাথায়। কালই এই পাতাগুলো জেরক্স করে বাঁধাতে দেব বইটা। মলাট দুটো হবে লাল টুকটুকে আর সোনালি হরফে লেখা থাকবে বইটার নাম এবং লেখকের নাম। আমার এই একক প্রচেষ্টায় যদি কিছুটা মান ভাঙাতে পারি ওই প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্রাহ্মণের। প্রলয়ের পূর্বে এই কলির ব্রাহ্মণ যদি দ্বাদশ সূর্যের তেজে আকাশ-টাকাশ পুড়িয়ে দেন তো সমূহ ক্ষতি হবে প্রযুক্তির। উপগ্রহ, তরঙ্গ, সঞ্চয়কোষ সহ ক্লাউডরাও পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আর বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে এই পৃথিবীর যাবতীয় লেখাজোখা।

Book Lover Books
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy