Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
Short Story

পঞ্চম স্বর

গত দিন যে স্থানে একটি নধর বন্যবরাহ পাওয়া গিয়েছিল, পঞ্চম ভ্রাতা বৃক্ষের উপর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে দিকেই লক্ষ রেখেছিল।

ঋতা বসু
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০০:০৪
Share: Save:

গভীর অরণ্যে শিকারের একটা আলাদা আনন্দ আছে, সেটা নিষাদীদের চেয়ে ভাল কেউ জানে না। বারণাবত নগর সংলগ্ন এই বনভূমি তাদের প্রাণ, জীবিকা, আহার্য, বিনোদন— সব। প্রথম ও তৃতীয় নিষাদভ্রাতা আজ মায়ের সঙ্গে সাংসারিক কর্মে ব্যস্ত। দ্বিতীয় ভ্রাতা গিয়েছে অরণ্য-মধ্যবর্তী খরস্রোতা নদী থেকে মৎস্য আহরণে। চতুর্থ এবং পঞ্চম ভ্রাতা এসেছে গভীর অরণ্যে পশুবধের উদ্দেশ্যে।

গত দিন যে স্থানে একটি নধর বন্যবরাহ পাওয়া গিয়েছিল, পঞ্চম ভ্রাতা বৃক্ষের উপর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে দিকেই লক্ষ রেখেছিল। ভাগ্য সম্ভবত সুপ্রসন্ন, অল্প ক্ষণ পরই গভীর অরণ্যে সে দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল। ধনুকে শরযোজনা করে একমুখী দৃষ্টিতে শিকারের জন্য প্রস্তুত হল সে। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে ঘন ঝোপের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এল এক জন মানুষ। তার হাতে কোদাল। খননযন্ত্র নিয়ে এ ঘোর কাননে সে কী করছে? এ দিয়ে তো শিকার সম্ভব নয়!

পঞ্চম নিষাদ বৃক্ষ থেকে লাফিয়ে নেমে চতুর্থ নিষাদকে ডেকে সতর্ক পদসঞ্চারে এগোতে লাগল রহস্যময় ব্যক্তির দিকে। কঠিন পরিশ্রমের পর সেই ব্যক্তি বৃক্ষের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, হঠাৎ দুই নিষাদকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। কোদাল ফেলে পলায়নের চেষ্টা করতেই ভ্রাতাদ্বয় বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। সবলে চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করল পঞ্চম নিষাদ, ‘‘কে তুই? মতলব কী? বল, নয়তো এখনই তোর মাথা গুঁড়ো করে দেব।’’

যমদূতের মতো দু’দিকে দুই ভ্রাতাকে দেখে সেই ব্যক্তি বলল, ‘‘আমাকে দেখে কি তোমাদের মন্দ লোক বলে মনে হচ্ছে? আমি নিতান্ত নিরীহ এক খননকর্মী, নাম দশকর্মা।’’

‘‘তোমার কোদালে মাটি লেগে আছে। জঙ্গলে কি গুপ্তধনের খোঁজ পেলে না কি?’’

লোকটি ক্ষীণ হেসে বলল, ‘‘পাগল না কি? গুপ্তধন থাকলে আমার পূর্বে তোমরাই সন্ধান পেতে।’’

‘‘সেই কারণেই তো জিজ্ঞেস করছি, এত গোপনে কী করছ? আমাদের দেখে পালাচ্ছিলেই বা কেন? তা ছাড়া তুমি তো বারণাবতের লোকও নও।’’

পরিত্রাণের পথ নেই দেখে দশকর্মা বলল, ‘‘হস্তিনাপুর থেকে আমাকে পাঠিয়েছেন মহাত্মা বিদুর। বারণাবতে পাণ্ডবদের প্রাসাদ থেকে এই জঙ্গল পর্যন্ত সুড়ঙ্গ কাটছি দশ দিন ধরে। আজই শেষ হল। ওই দেখো।’’

‘‘কেন এ কাজ করছ?’’

‘‘সে সব আমার অজানা। রাজারাজড়ার আদেশ। তবে খুব গোপনে কাজটা সারতে হবে, এমনই নির্দেশ আছে।’’

দুই ভ্রাতা বনজ লতাগুল্মে ঢাকা সুড়ঙ্গমুখ দেখে চিন্তিত হয়ে বলাবলি করল, যুদ্ধটুদ্ধ লাগবে কি না কে জানে! তাদের শিকারের বাসনা নিবৃত্ত হল। দশকর্মা বলল, তার কাজ শেষ হয়েছে। সে এ বার রওনা দেবে হস্তিনানগরের দিকে।

চতুর্থ আর পঞ্চমের দশকর্মাকে এখনই নিষ্কৃতি দিতে ইচ্ছা নেই। তারা চাইছিল জ্যেষ্ঠ নিষাদ এক বার এর সঙ্গে কথাবার্তা বলুক। নানা চিন্তা করে তারা দশকর্মাকে বলল, ‘‘তুমি বিদেশি মানুষ। না জেনে তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দাও। কাছেই আমাদের ঘর। মা আছেন। তুমি ক্লান্ত। ক্ষুধার্তও নিশ্চয়ই। একটু কিছু মুখে দিয়ে হস্তিনানগর যাত্রা কোরো।’’

বক্তব্য অনুরোধের হলেও তাতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে আদেশের সুর। আপত্তি করে লাভ নেই বুঝে দশকর্মা নিষাদভ্রাতাদের সঙ্গ নিল।

গৃহে ফিরে তারা দেখে, মধ্যম নিষাদ অনেক মৎস্য নিয়ে এসেছে। মা সে সব নিয়ে দ্বিপ্রহরের রন্ধনের আয়োজন করছেন। অতিথি-সহ দুই ভ্রাতা ফিরলে সবাই মিলে অতিথির আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একে অতিথি তায় বিদেশি। দশকর্মার মুখে সুড়ঙ্গের কথা শুনে জ্যেষ্ঠ নিষাদের ভ্রু কুঞ্চিত হল। সে বলল, ‘‘পলায়নের পথ হিসেবে সুড়ঙ্গের ব্যবহার হতেই পারে। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডব এত দিন পুরোচনের গৃহে বাস করছিল শুনেছি, আগামী কাল তারা নতুন গৃহে আসবে। তারা জানে সুড়ঙ্গের কথা?’’

‘‘অবশ্যই। প্রকৃতপক্ষে তারা এর জন্যই অপেক্ষা করছিল।’’

‘‘বিদুর ছাড়া হস্তিনানগরে আর কেউ সুড়ঙ্গের বিষয় জানে না বলছ?’’

‘‘কেউ জানে না। এখন শুধু তোমরা জানলে।’’

‘‘কেন এ কাজ করবে, সে কথা বিদুর বলেননি?’’

‘‘প্রশ্ন করা আমার কাজ নয়। রাজাদের নানা প্রয়োজন থাকে। সব কার্যকারণ আমার জানার কথা নয়।’’

প্রথম নিষাদ দশকর্মার কথা শুনে খানিক ক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘‘অর্থাৎ পাণ্ডবরা জানে বিদুর তাদের জন্য সুড়ঙ্গ খনন করিয়েছেন। তুমি তো বিদুরের সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত সঙ্গী, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিদুরের শেষ কথা কী হয়েছিল, মনে আছে?’’

দশকর্মা একটু চিন্তা করে বলল, ‘‘পাণ্ডবদের বিদায়কালে সকলের আশীর্বাদপর্ব শেষে মহামতি বিদুর বলেছিলেন, ‘অভিজ্ঞ ব্যক্তির সর্বদা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকা উচিত। তৃণরাশির মধ্যে গর্ত করে বাস করলে হুতাশন কখনওই দগ্ধ করতে পারে না। শত্রুর অস্ত্র লোহার নয়, কিন্তু তা শরীর ছেদ করতে সক্ষম। যে সেটা জানে আর স্বীয় পঞ্চেন্দ্রিয় বশীভূত রাখতে পারে, শত্রু তাকে বিনষ্ট করতে পারে না।’ কথাগুলি তিনি ম্লেচ্ছ ভাষায় বলেছিলেন। দীর্ঘ দিন আমি তার সঙ্গ করেছি, তাই বুঝতে পেরেছিলাম।’’

‘‘শুনে পাণ্ডবরা কী বলল?’’

‘‘যুধিষ্ঠির বললেন, ‘বুঝলাম’।’’

‘‘আমিও বুঝলাম। চলো দশকর্মা, তোমাকে এগিয়ে দিই, নয়তো এ ঘন জঙ্গলে পথ হারাবে।’’

খানিকটা অগ্নিদগ্ধ মৎস্য, পানীয় জল আর গুড় দিয়ে নিষাদ ভাইয়েরা দশকর্মাকে নগরের বাইরে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিল। সে দৃষ্টিসীমার বাইরে গেলে জ্যেষ্ঠ নিষাদ বলল, ‘‘এই ব্যক্তি সত্যি কথাই বলেছে সম্ভবত। রাজারাজড়াদের নিরাপত্তার কারণে এমন বহু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবু চলো, এক বার নিজেরা গিয়ে দেখি সত্যিই বিপদের কোনও কারণ আছে কি না।’’

বারণাবতে পাণ্ডবদের জন্য নির্মিত প্রাসাদ দেখে নিষাদ ভ্রাতারা স্তম্ভিত। প্রাসাদের বাইরে তাদের মতো আরও বহু দর্শনার্থীর সমাবেশ। এমন অপূর্ব কারুকার্য, মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদ তারা ইতিপূর্বে দেখেনি।

এক পুরবাসী বলল, ‘‘কাল পর্যন্ত এই প্রাসাদ বস্ত্র দ্বারা আবৃত ছিল। আজ উন্মোচিত হয়েছে। কাল প্রাতেই পাণ্ডবভ্রাতাদের গৃহপ্রবেশ।’’

সব দেখে শুনে নিশ্চিন্ত জ্যেষ্ঠ নিষাদ বলল, ‘‘চার দিকে উৎসবের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে, অন্তত বহিঃশত্রুর আক্রমণের ভয় নেই।’’

ফেরার পথে জ্যেষ্ঠ নিষাদ ভ্রাতাদের বলল, ‘‘তোমরা প্রাসাদের মধ্যে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছ?’’

দ্বিতীয় নিষাদ বলল, ‘‘একটা বিচিত্র গন্ধ পাচ্ছিলাম... ঘি তেল লাক্ষা এই সবের।’’

পঞ্চম বলল, ‘‘মনে হল, বাঁশগুলোয় শন জড়িয়ে, শালের রস আর ধুনো মাটিতে গুলে কাঠামোয় লাগানো হয়েছে।’’

জ্যেষ্ঠ স্মিতমুখে বলল, ‘‘নিষাদদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের শক্তি যে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল।’’

চতুর্থ ভ্রাতা বলল, ‘‘চার দিকে প্রচুর পরিমাণে ঘি, তেল, কাঠ জড়ো করা ছিল। গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে বড় যজ্ঞ হবে বোধহয়।’’

‘‘শুধু তা-ই হলে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রাসাদ এ রকম অদ্ভুত ভাবে তৈরি হল কেন? একটা সন্দেহজনক গন্ধ পাচ্ছিলাম বলে নখ দিয়ে পাঁচিলের একটা অংশ খুঁটে নিয়ে এসেছি। এই দেখো, ভিতরে মুঞ্জঘাসের আস্তরণ। বহিঃশত্রুর জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়ার মানে আন্দাজ করা যায়, কিন্তু প্রাসাদটাকেই জতুগৃহ করে তোলার অর্থ কী? তবে কি শত্রু ঘরের মধ্যেই?’’ সন্দেহ প্রকাশ করল

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

এক মিশ্র অনভূতি নিয়ে নিষাদভ্রাতারা গৃহে ফিরে শোনে, পুরোচন এসেছিলেন। পাণ্ডবজননী কুন্তীর ব্রত উদ্‌যাপনের সংবাদ নিয়ে। কাল সেই উপলক্ষে নিষাদ পরিবারের সবার নিমন্ত্রণ সেখানে।

পুরোচন বারণাবতের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। হস্তিনাপুরের রাজা তাঁর বিশেষ বন্ধু। বারণাবতে পাণ্ডবরা তাঁর গৃহেই অতিথি হয়ে ছিলেন, যত দিন না প্রাসাদ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। এমন ব্যক্তি অরণ্যে এসে নিজে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, শুনে জ্যেষ্ঠ নিষাদ বিস্মিত হল।

‘‘বলেছিলাম না বিরাট যজ্ঞ হবে! কত দিন পর বেশ ভালমন্দ খাবারদাবার...’’ চতুর্থ নিষাদ আনন্দে করতালি দেয়।

‘‘আমাদের বলেছে মানে, নিশ্চয়ই বারণাবতের যত বৈশ্য, শূদ্র, কিরাত, চাষি, গোয়ালা, তাঁতি, কামার, কুমোর সবার নেমন্তন্ন। ভাগ্যিস পাণ্ডবরা এল! কী আহ্লাদটাই না হচ্ছে!’’ হস্তপদ প্রক্ষালন করতে করতে বলল দ্বিতীয় নিষাদ।

নিষাদজননী বললেন, ‘‘পুরোচন বলেছেন, শুধু আমাদের নেমন্তন্ন। ওরা পঞ্চপাণ্ডব, তোরাও পাঁচ ভাই। ওদেরও শুধু মা আছেন, বাবা নেই। তোদেরও তাই। এত শুভ যোগাযোগ সহজে হয় না। সেই জন্য ব্রত উদ্‌যাপনে আমাদের পরিবারের উপস্থিতি খুব দরকারি। পুরোচন বলেছেন, এত ভাল দক্ষিণা দেবে যা আমরা সারা জীবনেও শেষ করতে পারব না।’’

জ্যেষ্ঠ নিষাদ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘‘এত ক্ষণে বুঝলাম।’’

মা আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘‘কী বুঝলে? এতে বোঝার কী আছে? তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেন এই সৌভাগ্যে খুশি নও?’’

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বুদ্ধি-বিবেচনার উপর সকলেরই গভীর আস্থা। সে কী উত্তর দেয়, তা শোনার জন্য সকলে সাগ্রহে অপেক্ষমাণ দেখে সে বলল, ‘‘আমরা সমাজে অশুচি, অস্পৃশ্য। আমাদের ছায়া থেকেও যেখানে স্পর্শদোষ ঘটে, সেখানে আমাদের এই বিশেষ নিমন্ত্রণ কি যথেষ্ট সন্দেহজনক নয়?’’

‘‘কিসের সন্দেহ?’’

‘‘দেখো, পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের শত্রুতার কথা সবাই জানে। দুর্যোধনের জোরাজুরিতে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়েছেন, এটাও সবাই জানে। পুরোচন দুর্যোধনের বন্ধু। এই প্রাসাদ তৈরিও হয়েছে তাঁরই তদারকিতে। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে। মহাত্মা বিদুর ম্লেচ্ছ ভাষায় যা বলে পাণ্ডবদের সাবধান করেছেন, সে কথাগুলো মনে করো— তৃণরাশির মধ্যে গর্ত করে বাস করলে হুতাশন কখনই দগ্ধ করতে পারে না। আজ সেই প্রাসাদ দেখে ফেরার পথে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম দশকর্মার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার রহস্য। তৃণরাশি অত্যন্ত দাহ্য। তার মধ্যে গর্ত, মানে সুড়ঙ্গ আর হুতাশনের কী কাজ সে তো সবাই জানে। দশকর্মার গোপন কর্মের অর্থ প্রাসাদটি খুঁটিয়ে দেখলেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে আমি এ সব রাজকীয় ষড়যন্ত্র নিয়ে মাথাই ঘামাতাম না, যদি না পুরোচন আজ শুধু আমাদেরই নেমন্তন্ন করত। এটা নির্দোষ যজ্ঞ হলে যত দলিত আছে সবারই নিমন্ত্রণ থাকত। শুধু আমাদেরই বেছে নেওয়া হল কেন? পাণ্ডবদের সঙ্গে আমাদের এত সাদৃশ্য যে, আমাদের সামনে রেখে অনায়াসে দিনকে রাত করা যায়।’’

নিষাদমাতা প্রশ্ন করলেন, ‘‘তুমি কি কোনও বিপদ আশঙ্কা করছ?’’

‘‘যে সে বিপদ নয়, সবংশে ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা।’’

‘‘সে আর নতুন কথা কী? আমরা সমাজে পতিত দলিত শ্রেণি। অভাব, অপুষ্টি, দাবানল, খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অনাহার... আমাদের শত্রু কি একটি? কিন্তু এত বড় সৌভাগ্য কি আমরা কখনও কল্পনা করেছি? রাজার যজ্ঞ আমরা ছাড়া হবে না। আমি পুরোচনকে কথা দিয়েছি আমরা যাব।’’

‘‘যদি তাতে মৃত্যু হয় তবুও?’’

‘‘আমাদের বেঁচে থাকাটাও মৃত্যুর চেয়ে আলাদা কোথায়? প্রতিদিনই তোমরা শিকারে গেলে আমি কি মৃত্যুর ভয় পাই না? তার সঙ্গে আছে প্রতিদিনের অভাব অনিশ্চয়তা। তার চেয়ে এটা কি ভাল নয়? জীবনে অন্তত এক দিন রাজমাতার সান্নিধ্যে অতিথির সম্মান পাব। যে পুজোয় এত দিন কোনও অধিকার ছিল না, আজ আমরা ছাড়া তা পূর্ণ হবে না। এত গর্বের দিন কি আমরা কল্পনাও করতে পেরেছি কোনও দিন? এর পর যদি মৃত্যুও হয়, তা হলে তা-ই হোক।’’

নিষাদভ্রাতারা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মাতৃআজ্ঞা তারা লঙ্ঘন করতে পারছে না, কিন্তু তাদের ভঙ্গিতে অনিচ্ছার প্রকাশ স্পষ্ট।

জ্যেষ্ঠ নিষাদ বলল, ‘‘আচ্ছা মা, তোমার কথা মিথ্যে হওয়ার নয়। শুধু আমি আর তুমি যাব। বাকিরা থাকুক। কথা রাখাও হল, আবার সবাইকে বিপদে ফেলাও হল না।’’

নিষাদজননী দৃঢ় স্বরে প্রতিবাদ করে বললেন, ‘‘তা হয় না। পঞ্চভূত যজ্ঞে পঞ্চ অতিথিই দরকার। পুরোচন বলেছেন, পাণ্ডবজননীর সে রকমই অনুরোধ।’’

‘‘তা হলে তুমি যেয়ো না। আমরা পাঁচ জন যাই?’’

‘‘তাও হবে না। এ যজ্ঞে আহুতির জন্য জননী-সহ পঞ্চভ্রাতার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন।’’

‘‘তা হলে অনুরোধ বোলো না, আদেশ বলো।’’

‘‘ধরে নাও তা-ই।’’

মলিন হেসে জ্যেষ্ঠ নিষাদ বলল, ‘‘তবেই বুঝে দেখো মা, আসলে আমাদের আহুতি দেবার জন্যই এই যজ্ঞ। পাণ্ডবদের নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখার উপকরণ।’’

‘‘তুমি নতুন কথা বলছ না। যুগে যুগে রাজার জন্য প্রজা প্রাণ দেয়।’’

‘‘সে দেয় স্বেচ্ছায়। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মরণের সঙ্গে আমাদের এই অসহায় মৃত্যুর তুলনা হয়?’’

নিষাদ জননীর ভঙ্গিতে কাঠিন্য। দৃষ্টি দূরে, যেন এক অলীক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিশির ডাক শোনা মানুষের কণ্ঠে বললেন, ‘‘ধূপধুনো অগুরুর সুগন্ধ, ঢাকঢোলের বাজনা, চন্দনকাঠের আকাশচুম্বী ধোঁয়া, আমাদের দেহ ঘিরে হস্তিনাপুরবাসীর হাহাকার... কোনও দিন কল্পনা করতে পেরেছিলে এমন দৃশ্য? এমন সম্মান?

‘‘বাঁচার মতো মৃত্যুও আমাদের জীবনে এক অকিঞ্চিৎকর ঘটনা। শূদ্রের পূজা, পাঠ সমস্ত নিষিদ্ধ। অন্যদের সেবা আর সমাজের যত অশুচি কাজের জন্য আমাদের জন্ম। রাজা আসে রাজা যায়, আমাদের কোনও পরিবর্তন হয় না। আমাদের নিধন উচ্চবর্ণের জন্মগত অধিকার। সেখানে মৃত্যু যদি হয় রাজার মতো, আমি তাতে রাজি। কয়েক ঘণ্টার রাজসম্মান, হোক তা ছলনা, হোক তা প্রাণহীন অবস্থায় পাওয়া, তবু সে তো আমারই দেহকাঠামো। যা এ জীবনে পেলাম না, পারলৌকিক ক্রিয়ার গুণে তা যদি পরজন্মেও পাই, আমি এখনই প্রাণ ত্যাগ করতে রাজি।’’

মধ্যম নিষাদ জ্যেষ্ঠের পাশ থেকে সরে গিয়ে জননীর পাশে গিয়ে বলল, ‘‘মা ঠিকই বলেছে। দাবানলে প্রতি বছর জীবজন্তুর সঙ্গে কত নিষাদ, কিরাতের মৃত্যু হয়, কে তার হিসেব রাখে। এখানে যদি জতুগৃহের মধ্যে ছাইও হয়ে যাই, পরিণাম বড় মধুর। আমি রাজি।’’

পঞ্চম নিষাদও গিয়ে দাঁড়াল মা’র পাশে। বলল, ‘‘আমিও রাজি।’’

চতুর্থ ভ্রাতা বলল, ‘‘সবার যদি এটাই ঠিক মনে হয়, তা হলে আমারও অমত নেই।’’

তৃতীয় ভ্রাতা বলল, ‘‘পরিণাম এতটাই লোভনীয় যে, তা প্রতিরোধ করা সত্যিই মুশকিল। রাজার মতো মরণ হলে আমাদের স্বর্গবাস নিশ্চিত। ভোগের জন্য যথেচ্ছ দুধ, মধু, পানীয় আর সুন্দরী নারী। মৃত্যু মানবজীবনের অনিবার্য অমোঘ ঘটনা। আজ না

হয় কাল তা হবেই। যদি এই মৃত্যু নিশ্চিত করে স্বর্গবাস, বদলে দেয় আমাদের পরজন্ম, তবে এখনই তাকে বরণ করা উচিত।’’

জ্যেষ্ঠ নিষাদ একা দাঁড়িয়ে রইল কিছু ক্ষণ। তার পর বলল, ‘‘নিয়তি কেউ এড়াতে পারে না। আমরা সময়ের চক্রে এই ভাবেই বলিপ্রদত্ত। চাইলেও ঘটনাপ্রবাহ বদলানো যাবে না। স্বর্গবাস ও পরজন্মের সুখসমৃদ্ধি মানুষের চিরকালের কামনার ধন। তোমাদের তা অবহেলা করতে বলব কী করে?’’

শিয়রে শমন জেনেও বলিপ্রদত্ত নিষাদ পরিবার তাদের জীবনের অন্তিম রাত্রি অতিবাহিত করল পৃথক পৃথক চিন্তায়। কেউ পরজন্মে অকল্পনীয় সুখপ্রাপ্তির অপার্থিব আনন্দে মগ্ন রইল, কেউ স্বর্গসুখের কল্পনায় উত্তেজিত হল, কেউ বা কয়েক মুহূর্তের জন্য রাজসম্মানের অলীক সুখে নিমজ্জিত রইল।

শুধু জ্যেষ্ঠ নিষাদের মনের গভীরে জেগে রইল এক আশ্চর্য প্রতিজ্ঞা— যদি প্রকৃতই পরজন্ম বলে কিছু থাকে, তবে যে উচ্চবর্ণের জন্য আজ তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে যাচ্ছে, তাদের প্রতিরোধ করার জন্য যেন যুগে যুগে তাদের জন্ম হয় এই মূক, মূঢ়, ম্লান, অনার্য ভারতে। যেন নির্দিষ্ট ক্ষণে প্রত্যাঘাতের প্রতিজ্ঞা থেকে তারা বিচ্যুত না হয়। জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি তাদের চাই না।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Books Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE