Advertisement
E-Paper

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

জ্যৈষ্ঠ মাসে ধর্মরাজের পুজো হত। পুজো শুরু হত পাথরের মাথা থেকে ফুল পড়লে। জুন মাসে গরমের ছুটিতে আমরা চলে যেতাম চৌপাহাড়ির জঙ্গল পেরিয়ে মায়ের বাপের বাড়ির গ্রামে। রুখা-শুখা লাল কাঁকুরে জমিতে কচি কচি আনন্দের বুড়ি-চু ফুঁড়ে ফুঁড়ে উঠত। আর ফুঁসে উঠত ধর্মরাজপুজোর ঢাকের বাদ্যি। পুজোর সঙ্গে অনেকটা ভয়ও জড়ানো ছিল। ইলেকট্রিক না-থাকা গ্রামে এক চিলতে চাঁদের আলোয় খানিকটা হারেরেরে’র ফিলিং হত।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩

জ্যৈষ্ঠ মাসে ধর্মরাজের পুজো হত। পুজো শুরু হত পাথরের মাথা থেকে ফুল পড়লে। জুন মাসে গরমের ছুটিতে আমরা চলে যেতাম চৌপাহাড়ির জঙ্গল পেরিয়ে মায়ের বাপের বাড়ির গ্রামে। রুখা-শুখা লাল কাঁকুরে জমিতে কচি কচি আনন্দের বুড়ি-চু ফুঁড়ে ফুঁড়ে উঠত। আর ফুঁসে উঠত ধর্মরাজপুজোর ঢাকের বাদ্যি।

পুজোর সঙ্গে অনেকটা ভয়ও জড়ানো ছিল। ইলেকট্রিক না-থাকা গ্রামে এক চিলতে চাঁদের আলোয় খানিকটা হারেরেরে’র ফিলিং হত। ধর্মরাজতলায় ঢোকার মুখেই একটা ঝাঁকড়া গাছ। ছোট-বড় মেয়েরা বড় বড় গোল গোল চোখ করে বলত, ওই গাছের তলা দিয়ে গেলেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ভয়ে তো আধমরা, একে অমন গমগমে জমজমে পুজো, যত ক্ষণ না ঠাকুরের মাথা থেকে ফুল পড়ে, তত ক্ষণ সবার প্রাণ গলায়, এর মধ্যে খামখা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দরকার কী, আর মা জানলে তো রক্ষে নেই।

গাছটা এতটাই ঝাঁকড়া ছিল যে বেশ নুয়ে পড়েছিল, তার তলা দিয়ে বড়রা কেউই যেতে পারত না, আর ছোটরা ভয়েই যেত না। ‘আচ্ছা তুলু দিদি, তুই কি কাউকে দেখেছিস ওই গাছটার তলা গিয়ে গিয়েছে আর মাথা ঘুরে পড়েছে?’ ‘শোন ক্যানে, বড়রা কি মিছে বলবে রে? উয়াদের কথা শুনতে হয়, শুধোতে নেই।’ আমি আর বেশি প্রশ্ন করিনি, কোন কোন বড়রা বলেছে? তারা কি কাউকে দেখেছে? ওই গাছে কি ভূত থাকে? আমি গাছের সঙ্গে আমার ফ্রকের বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখেই চলেছি নিয়মিত।

এর পর দিদিমা চলে গিয়েছে। মা আর কখনওই গ্রামের বাড়িতে পা রাখতে চায়নি। কুড়ি-বাইশ বছর পরে, আমি, মা আর অনেক মাসতুতো দাদা-দিদিরা ফিরে গিয়েছিলাম সেই গ্রামে। গিয়ে দেখলাম ধানের মরাই, গোয়ালের পেছনের জানলা আর বুগনভেলিয়া গাছে রয়েও গেছে আমার ছোটবেলা। ক্ষয়েছে, তবে তেমন ক্ষতি হয়নি।

ঘুরতে ঘুরতে পর দিন ঘোর দুপুর বেলায় পৌঁছলাম ধর্মরাজতলায়। গাছটা একদম একই রয়েছে। শুনশান দুপুর, কেউ কোথাও নেই। দাঁড়ালাম গাছটার সামনে। ভাবলাম, এক বার গুড়ি মেরে তলা দিয়ে চলেই যাই। কী আর হবে, মাথা ঘুরে যাবে তো? ও ম্যানেজ করে নেব। কিন্তু কিছুতেই পারলাম না।

আজ তো কেউ নেই আমায় বারণ করার। আর বারণ করলে তো আমি হেসেই উড়িয়ে দেব। তবু কেন যেতে পারছি না? বুঝলাম ঝঞ্ঝাট অন্য জায়গায়— যদি আমি মাথা ঘুরে পড়ে না যাই, তা হলে কী হবে? আমার তো সব ক্ষয়ে যাবে। যা এখানে আমি অনেক যত্ন করে তুলোয় মুড়ে রেখে গিয়েছি, তাতে যদি যুক্তি এসে থাবা বসায়, তা হলে? আমার ছোটবেলা ভায়োলেটেড হয়ে যাবে। যে ছোট্ট মেয়েটাকে আমি সরল বিশ্বাসে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিলাম আজ তাকে হাত ধরে তার সেই বিশ্বাসের গণ্ডি পার করে দেব কী করে? তার কুসংস্কার বলি, আর সারল্য বলি কিংবা মানার অভ্যাস বলি— যা কিছু ছিল, খুব পবিত্র ছিল। আজ হট করে কটাস কটাস যুক্তি এসে ঘা মারলে, তার নরম মনটা টুকরো হওয়ার ধাক্কা সইতে পারব তো? এত বড় তঞ্চকতা আমি করব তার সঙ্গে?

আর তাই কথাটা যত বার মনে পড়ে, আর স্বাভাবিক বুদ্ধি এসে হেসে খুন হয়ে আমাকে বলে ‘ভ্যাট!’, আমি জোর তর্ক করি, হ্যাঁ, ওই গাছটার তলা দিয়ে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এখনও যায়। আমি জানি, আমি নিশ্চয়ই করে জানি।

sanchari mukhopadhyay rabibasariya anandabazar question forest june tree
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy