Advertisement
E-Paper

গজদন্ত তাঁর হাতে শিল্প

তাঁর কাজের গুণমুগ্ধ ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ থেকে নেহরু। শিল্প ও সঙ্গীতের সাধনায় নিবেদিত ছিল গৌরচন্দ্র ভাস্করের জীবন।আড়ি, চিহ্নে, কলম, থাপি, গিরদি, চোরসে— কতকগুলো যন্ত্রের নাম।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪৫
শিল্পী: কাজে মগ্ন গৌরচন্দ্র ভাস্কর।

শিল্পী: কাজে মগ্ন গৌরচন্দ্র ভাস্কর।

আড়ি, চিহ্নে, কলম, থাপি, গিরদি, চোরসে— কতকগুলো যন্ত্রের নাম। হস্তিদন্ত শিল্পের নাতিদীর্ঘ বলয়ের বাইরে সাধারণ্যে তেমন পরিচিতি ছিল না যন্ত্রগুলির। শিল্পীরাই প্রয়োজন এবং উপযোগিতা-মাফিক বানিয়ে নিতেন। যেমন ‘আড়ি’। দেখতে করাতের মতো। কাজও করাতের। কিন্তু এর ব্যবহারবিধি আলাদা। ঠেলে নয়, আড়ি চালাতে হয় টেনে। না হলে কাটা যাবে না হাতির দাঁত। ফলে এই যন্ত্রের দাঁতগুলির আকার অন্য রকম। ‘চিহ্নে’ যন্ত্রটি বাটালির মতো, কিন্তু ঠিক বাটালি বলা যাবে না একে। হাতির দাঁত খোদাইয়ে চিহ্নের চেয়েও সরু যে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয়, তার নাম ‘কলম’। ‘থাপি’ আসলে কাঠের তৈরি এক রকম হাতুড়ি। ‘গিরদি’ আর ‘চোরসে’ রেতের মতো বলে মনে হলেও এদের গঠন আলাদা। হাতির দাঁত মসৃণ করার কাজে লাগে এগুলি।

এখন এই সব যন্ত্রই পড়ে আছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গের মতো। আড়াই দশক আগে, ১৯৯২-এর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন শুধু যন্ত্রগুলিকেই নয়, কর্মহীন করে দিয়েছে বহরমপুরের কয়েকশো ‘গজদন্ত শিল্পী’কে। তাঁদের বক্তব্য, এতে কিন্তু হস্তি-নিধন কমেনি। আবার স্বাভাবিক কারণে মৃত হাতির দাঁতগুলিও কোনও কাজে লাগছে না। মাঝখান থেকে মৃত্যু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এক শিল্পের।

হস্তিদন্ত শিল্পের শেকড় অনেক গভীরে। রামায়ণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের কামসূত্র কিংবা বৃহৎসংহিতা-য় এই শিল্পের উল্লেখ আছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো সভ্যতায় এই শিল্পের নিদর্শন মিলেছিল। পরে চন্দ্রকেতুগড়, পাণ্ডুরাজার ঢিবি এবং পাল যুগে এর প্রচলনের কথা সুবিদিত। শ্রীহট্ট এবং ত্রিপুরা অঞ্চলেও চল ছিল হাতির দাঁতের শিল্পের। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে শ্রীহট্ট-ত্রিপুরার হস্তিদন্ত শিল্পীরা ঢাকায় চলে আসেন। পরে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে (১৭০৪) এই শিল্পীরা জিয়াগঞ্জ ও কাশিমবাজার-সহ মুর্শিদাবাদের নানান স্থানে বসতি তৈরি করে নবাব ও অভিজাতবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে বহরমপুরে সেনা-ছাউনি তৈরি হলে, বিদেশেও প্রসার লাভ করে এই শিল্প। এ সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ‘গৌরচন্দ্র ভাস্কর জন্মশতবর্ষ স্মারক পত্রিকা’য়।

এই শিল্পকর্মের জন্যই ১৯৭০ সালে পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার

বিশ শতকে হস্তিদন্ত শিল্পের রাজাধিরাজ গৌরচন্দ্র ভাস্কর। তাঁর বাবা হরেকৃষ্ণ ভাস্করকে পুরস্কৃত করেছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। আর গৌরচন্দ্রের গুণমুগ্ধের তালিকায় পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু থেকে রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, বিধানচন্দ্র রায় থেকে পদ্মজা নায়ডু, রবীন্দ্রনাথ-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু হাতির দাঁতের শিল্পই নয়, গৌরচন্দ্রের জীবন জুড়ে সঙ্গীতেরও বিপুল সমারোহ। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের দিকপালেরা পরম স্নেহে তাঁকে সুরের স্পর্শ দিয়েছেন।আর মহাত্মা গাঁধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সাক্ষাৎ তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে দেশপ্রেম। সঙ্গীত-শিল্প চর্চার পাশাপাশি হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসায় রোগীরও সেবা করেছেন আমৃত্যু।

বহরমপুরে ১/১ রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন গলির ঠিকানায় ১৯০৯ সালের ৮ এপ্রিল জন্ম গৌরচন্দ্রের। মাত্র দু’বছর বয়সে হারান মা গোবিন্দসুন্দরীকে। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর শিল্পের পাঠ শুরু বাবা হরেকৃষ্ণ ভাস্করের কাছে। কিন্তু বাবাও চলে গেলেন অকালে ১৯২১-এ, গৌরচন্দ্র তখন বারো বছরের কিশোর। সে বছরেই দেশবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। ১৯২৫-এ দেখা পেলেন গাঁধীজির, আর ১৯২৯-এ বহরমপুরে নেতাজির বক্তৃতায় ডুবে গেলেন দেশপ্রেমে। বাবার মৃত্যুর পর গৌরচন্দ্রের শিল্পগুরু মামা হরিপদ ভাস্কর। চর্চা চলছিল জোরকদমে, এমন সময় কাশিমবাজার রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত বাই গওহরজান ও মালকাজানের ঐতিহাসিক নৃত্যানুষ্ঠান গৌরচন্দ্রকে টেনে আনল সঙ্গীতেও। ১৯৩০-এ একুশ বছরের গৌরচন্দ্র রওনা দিলেন দিল্লি। সেখানে আইভরি প্যালেসে যোগ দিলেন আপন শিল্পসত্তাকে আরও ঝালিয়ে নিতে। হস্তিদন্ত শিল্পে মুর্শিদাবাদি ঘরানা তখন চেনা হয়ে গিয়েছে তাঁর। এই ঘরানার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য ছিল একটিমাত্র দন্তখণ্ড থেকে একটি সম্পূর্ণ শিল্পবস্তু নির্মাণ। চালক-সহ চলমান গো-যান, পাউডার কেস, ময়ূরপঙ্খী-তৈরির একচেটিয়া অধিকার ছিল তাতে। আরও দু’টি ঘরানা আছে এই শিল্পের— উত্তর ভারতের জালি বা জাফরির কাজ আর মহীশূরের মূর্তি শিল্প।

দিল্লি এসে গৌরচন্দ্র শিল্পী জয়নারায়ণ, মহম্মদ খয়রাতিমিঞা, পণ্ডিত নাথ্‌থু ওস্তাদ প্রমুখ দিকপাল শিল্পীর সান্নিধ্য পেলেন। অন্য দিকে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের গভীর চর্চাও শুরু হল এখানেই। উস্তাদ আইনুদ্দিন খানের কাছে শিখলেন সেতারবাদন, পণ্ডিত বদ্রীপ্রসাদ শর্মার কাছে গ্বালিয়র ঘরানার খেয়াল এবং ডাগর ঘরানার উস্তাদ নাসিরুদ্দিনের একমাত্র বাঙালি ছাত্র রমেশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে শিখলেন ধ্রুপদ। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির সঙ্গেও সংযোগ তৈরি হয় তাঁর।

শিল্প ও সুরে ঋদ্ধ গৌরচন্দ্র বহরমপুরে ফিরলেন ১৯৪৬-এ। হস্তিদন্ত শিল্পে তত দিনে তিনি মুর্শিদাবাদি ঘরানার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন উত্তর ভারতীয় ঘরানাকে। দুয়ের সংযোগে জন্ম নিল এক অনিন্দ্য শিল্পকর্ম। ১৯৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬১ এবং ৬৪-তে তাঁর শিল্প রাজ্যের মধ্যে সেরা শিল্পের পুরস্কার পেল। ১৯৭০-এ পেলেন জাতীয় পুরস্কার।

১৯৯৪-এর ২২ এপ্রিল মৃত্যুর দিন পর্যন্ত শিল্প-সঙ্গীত-সেবায় প্রায় সক্রিয়ই ছিলেন গৌরচন্দ্র। ১৯৯২-এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে নিষিদ্ধ হয় হাতির দাঁতের শিল্প। সে যন্ত্রণা তাঁকে আহত করেছিল, বলছিলেন তাঁর ছেলে রমাপ্রসাদ। তিনি নিজেও আঁকেন অসাধারণ। বাবার স্মৃতি আগলে এখন সঙ্গীত আর দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ চয়নে নিজেকে সঁপেছেন এই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক।

১/১ রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন গলির ‘সুর-শিল্পলোক’ নামের বাড়িটা এক মিউজিয়ম। ঘরের দেওয়াল জুড়ে রমাপ্রসাদের আঁকা উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি, আমির খান, ফৈয়াজ খান, গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, ডি ভি পালুস্কর-সহ বিশিষ্ট সঙ্গীতাচার্যদের তৈলচিত্র। এ বাড়ির বাতাসে সুর, শোনা যাবে ১৯০২-এ গওহরজানের প্রথম রেকর্ড, বা রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বন্দে মাতরম, ‘অরিজিনাল’ নটী বিনোদিনী। কেশরবাই কখনও গান রেকর্ড করতেন না। প্রাণপ্রকাশ ঘোষ গোপনে রেকর্ড করেছিলেন তাঁর দুটি গান, সেই রেকর্ডও আছে রমাপ্রসাদের সংগ্রহে। পাঁচ হাজার শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড-সহ তাঁর সংগ্রহে যা আছে, তা একটানা বাজানো যাবে ১৬ হাজার ঘণ্টা!

বাবার কাজের যন্ত্রগুলি পরম যত্নে গুছিয়ে রেখেছেন। ‘‘এই ঘর আমার কাছে পবিত্রভূমি। কত অর্ধসমাপ্ত কাজ বাবাকে গুটিয়ে প্যাকেট করে রাখতে হয়েছে তখন! আজ ভাবলে কষ্ট হয়,’’ বলেন রমাপ্রসাদ। ঐতিহ্যবাহী এক শিল্পকে হারিয়ে যেতে দেখেছেন বলেই কি অতীতকে আঁকড়ে রাখার এমন ব্যাকুলতা তাঁর? রমাপ্রসাদ ভাস্করের সংগ্রহে আড়াইশো বছর পুরনো বৈষ্ণব গ্রন্থ ছাড়াও আছে ১৮৫৮-র ‘শব্দকল্প’-এর প্রুফ, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, উর্দু, জাপানি ভাষার প্রায় ৬০০ অভিধান। সময় এখানে শান্ত হয়ে চুপটি করে বসেছে। সুর আর শিল্প অপেক্ষা করে আছে প্রকৃত সমঝদারের।

Gaur Chand Artist গৌরচন্দ্র
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy