Advertisement
E-Paper

সবুজ বন্ধু

কচি ধানগাছের সবুজে চোবানো শরীর। সঙ্গে পাকা বট ফলের রঙে মানানসই ঠোঁট। গলায় কালো বেড়টা বুঝি আস্ত একখানা মালা! বাবা বলল, এ কিন্তু ঠিক টিয়া নয়। এ হল চন্দনা। পাহাড়ি অঞ্চলের পাখি। পলাশদিঘির হাটে সস্তায় পেয়ে গেলাম। বাবার হাতে ঝুলছে ঝকঝকে খাঁচা। ভিতরে লাফাচ্ছে পাখিটা। আর আমার বুকের খাঁচায় লাফাচ্ছে ঝড়ের মতো হঠাৎ পাওয়া আনন্দ।

মৃণালকান্তি সামন্ত

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

কচি ধানগাছের সবুজে চোবানো শরীর। সঙ্গে পাকা বট ফলের রঙে মানানসই ঠোঁট। গলায় কালো বেড়টা বুঝি আস্ত একখানা মালা! বাবা বলল, এ কিন্তু ঠিক টিয়া নয়। এ হল চন্দনা। পাহাড়ি অঞ্চলের পাখি। পলাশদিঘির হাটে সস্তায় পেয়ে গেলাম।
বাবার হাতে ঝুলছে ঝকঝকে খাঁচা। ভিতরে লাফাচ্ছে পাখিটা। আর আমার বুকের খাঁচায় লাফাচ্ছে ঝড়ের মতো হঠাৎ পাওয়া আনন্দ।
মা বলল, আহা! এত সুন্দর পাখিটাকে খাঁচায় ভরে রাখবে! কষ্ট হবে না ওর?
নতুন খাঁচার ঠিকরানো আলো নেচে উঠল আমার চোখে। পাখির রঙের বাহার পালটে দিল বাড়ির হাওয়া। কষ্ট কেন হবে ওর! আদর করে চান করাব। কথা শেখাব। আমার সব ভাল ভাল খাবারের ভাগ দেব। ভাই বোন তো কেউ নেই। ও বেশ সর্বক্ষণের একটা বন্ধু হবে আমার। মা ওর নাম দিল রামধনু। বলল, ডানায় যার আকাশের গন্ধ, সে রামধনু ছাড়া আর কী!
আমার ভিতরে ফুটবলের মতো আবার লাফিয়ে উঠল আনন্দ।
আহা, খাঁচায় যেন ভরা থাকবে রামধনুর সাত রঙা স্বপ্ন! তাও আবার আমার চোখ ছুঁয়ে।
স্কুল ফেরত আমি পাকা তেলাকুচা খুঁজে আনি। বাবার বাজারের থলি হাতড়ে লাল লঙ্কা রাখি। রামধনু ভালবাসে। মা ওকে চান করায় হলুদ গোলা জলে। বাবা শিস দিতে শেখায়। আমার অঙ্কে ভুল হয়ে যায় ওর শিসের শব্দে। বাবা কান মলে দেয়! বলে, এত বড় গুনটায় সব ঠিক করে শেষে যোগে ভুল! কী অঙ্ক করছ!
তবু আমার কষ্ট নেই। উঠোনের কোনায় যে ঝুলছে রামধনু।
আমার লেজঝোলা বন্ধু। স্কুল থেকে ফিরতে এক দিন ও বলে উঠল, নোটু, এলি বাবা?

অবিকল মা-র মতো! ওর কাছে গেলাম। এক ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভাল রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলে মাও ঠিক এমনি করে দেখে। আমার কান্না পেল। কেউ খুব ভালবাসলে কেন যে চোখে জল আসে কী জানি!

বিকেলের মরা রোদে সার্কাসের গ্লোবে বাইক খেলার মতো ডিগবাজি খায় রামধনু। খাঁচার বেড় ঠোঁটে শক্ত করে ধরে বুঝি ভেঙে ফেলতে চায়!
ও কি ফিরে যেতে চায় মা-বাবার কাছে? ওর কি মনে পড়ে যায়, পাহাড়ি বনে গাছের কোটরে ওদের নির্জন বাসাটার কথা? ওর ছটফটানিতে আমার মনে ধোঁয়ার মতো পাক খায় কষ্ট। ও আমার বন্ধু। কিন্তু আমি হয়তো ওর বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি। মা বলল, যতই আদর করিস বাবা, দিনের শেষে ও জঙ্গলেই ফিরতে চায়। ওরা যে আকাশ আঁকড়ে বাঁচে!

ফুটবল গ্রাউন্ডের ধারে বিশাল বটগাছ। বিকেলে তার ডালপালায় প্রচুর টিয়া। খেলা শেষে ঘাড় উঁচু করে দেখি ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকে আর পাকা ফল ফেলে টপাটপ। নীচটা ড্রয়িং খাতায় জলছবির মতো লালে লাল। বিকেল গড়ালে হুস করে উড়ে যায় দল বেঁধে। যাবার সময় খুব আস্তে শিস দেওয়ার মতো অদ্ভুত এক আওয়াজ করে যায়। ট্যাঁও...। ওই ডাক হয়তো ওদের খোলা আকাশে বাঁচার আনন্দের শব্দ। রামধনুর জন্য খুব মন খারাপ হয়। সে তো এমন আওয়াজ করে না কোনও দিন।

সে দিন রোববার। সবাই দুপুরের ঘুমে। আমি চুপি চুপি গেলাম রামধনুর কাছে। তাকিয়ে আছে সে আমার চোখে এক ভাবে। ঠিক সে দিনের মতো। তবে এ বার ওর চোখে আমার জন্য ভালবাসা নয়, খাঁচায় ভরা থাকার কষ্টকে যেন দেখতে পেলাম। খুব মায়া হল বন্ধুর জন্য।

সাহস করে একটা কাণ্ড করে বসলাম! খুলে ফেললাম খাঁচার দরজা। অবিশ্বাসী চোখে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল ও দরজার দিকে। ঝপ করে পাখা মেলে ঝাঁপ দিল খোলা বাতাসের সমুদ্রে। সঙ্গে কানে এল শিস দেওয়ার মতো শব্দটা, ট্যাঁও... বটগাছ ছেড়ে যাওয়া টিয়া যেন!

একটু একটু করে চলে গেল অনেক দূরে। ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। সামনের লোহার খাঁচা নয়, আমার বুকের খাঁচাটাই বুঝি ধু ধু ফাঁকা হয়ে গেল! সবুজ বন্ধু আমার মিশে গেল আকাশের নীলে। রামধনুরই মতো। জলে ঝাপসা হয়ে এল চোখ। সেখানে শুধু বন্ধু হারানোর দুঃখই নেই, তাকে খোলা আকাশের বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দও আছে। বাবা বলল, ইস! খাবার দেওয়ার পর দরজাটা বোধ হয় ঠিকঠাক লাগানো হয়নি।

আমি তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, তাই হবে নিশ্চয়।

ডাহা মিথ্যে। তবু মিথ্যেকেই থাকতে দিলাম সত্যি হয়ে!

green friend mrinal kanti samanta sea bird school
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy