Advertisement
E-Paper

কানে পরছেন মাকড়ি, পায়ে ঘুঙুর

রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ থেকে পাওয়া বহু ভাস্কর্যে দুর্গা যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রসাধন করছেন নিজেই, সাজছেন বিবিধ অলঙ্কারে। শুভাশিস চক্রবর্তীরাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ থেকে পাওয়া বহু ভাস্কর্যে দুর্গা যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রসাধন করছেন নিজেই, সাজছেন বিবিধ অলঙ্কারে। শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
প্রসাধনরতা: শৃঙ্গার দুর্গা। নবম শতাব্দী, গদরমল মন্দির, মধ্যপ্রদেশ

প্রসাধনরতা: শৃঙ্গার দুর্গা। নবম শতাব্দী, গদরমল মন্দির, মধ্যপ্রদেশ

বল খেলছেন কিশোরী উমা। তাঁর পিতৃগৃহে। এতটাই মনোযোগী যে দুই বাহু ঘর্মাক্ত হয়ে গেছে কিশোরীর। বল লাফানোর এই খেলাকে বলে কন্দুকক্রীড়া। হিমালয়দুহিতার প্রিয় খেলা। মহাকবি কালিদাসও উল্লেখ করেছেন পার্বতীর কন্দুকপ্রীতির কথা। তবে ‘স্বয়ম্বর পার্বতী স্তোত্র’–তে কবি দুর্বাসা লক্ষ করছেন ক্রীড়াকালে গিরিনন্দিনীর কর্ণকুণ্ডল অনবরত দুলছিল— ‘নির্ধূত কুণ্ডল’, সেই সঙ্গে হাতের কাঁকনের রিনরিন শব্দ মুগ্ধ আবেশ তৈরি করছে— ‘নির্ধ্বনি কঙ্কণ’। ১৭ সংখ্যক শ্লোকে শিবজায়ার কেশবিন্যাসে পুষ্পরাজির উল্লেখ থাকলেও ২৪ সংখ্যক শ্লোকে দেখি কবির কাতর প্রার্থনা— ‘অক্ষম হেম কলকঙ্গদ রত্নশোভম/ লাক্ষাবিলম্ জননী পাণিযুগম্‌ ত্বদীয়ম্‌’— তোমার দু’খানি হাত বাজুবন্ধ আর বলয়ে সজ্জিত হয়ে আছে। গহনাগুলির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে লাক্ষা প্রলেপ। জননী, ওই হাত দু’টি আমার মাথার উপর রাখো।

অস্ত্রসজ্জিতা দেবী দুর্গা প্রসাধন-বিলাসে ও অলঙ্কারসজ্জায় রীতিমতো পটিয়সী ও নিখুঁত। ‘শৃঙ্গার দুর্গামূর্তি’ নির্মাণ সেই গুপ্তযুগ থেকে শিল্পীদের প্রিয় বিষয় ছিল। রাজস্থান, গুজরাত এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে যে দুর্গাভাস্কর্যগুলি পাওয়া গেছে তার মধ্যে অনেকগুলিই ‘স্বালঙ্কারা’ দুর্গা, নিজেই অলঙ্কারচর্চা করছেন দেবী। মন্দসৌর থেকে পাওয়া ষষ্ঠ শতাব্দীর এক ভাস্কর্যে দেবীর পরনে ব্যাঘ্রচর্ম। বক্ষদ্বয়ের মধ্য দিয়ে নেমে এসেছে কণ্ঠহার, যার শেষে একটি বাতাস-লাঞ্ছিত লকেট। চতুর্ভুজা দেবীর দুই হাত উপরের দিকে তোলা, দু’হাত দিয়ে তিনি পরছেন টিকুলি। হাতে অস্ত্র নেই। বোঝা যায়, রণগমনের পূর্বে তিনি প্রসাধন সেরে নিচ্ছেন এক বার।

রাজস্থানের জোধপুর থেকে ৬৬ কিমি দূরে অসিয়ান। সেখানে হরিহর মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে অষ্টম শতাব্দীতে খোদাই করা একটি মূর্তির বৈশিষ্ট্য— অষ্টভুজা দুর্গা বসে আছেন সিংহের উপর। ডান পায়ে ঘুঙুর বাঁধছেন নিজেই। অষ্টম অথবা নবম শতকের আর একটি দুর্গামূর্তি পাওয়া গিয়েছিল রাজস্থানের আবানেরি থেকে। এই দেবীও সিংহের পিঠে বসে প্রসাধনে মনোযোগী। মধ্যপ্রদেশের গদরমল মন্দিরের শৃঙ্গার দুর্গাও প্রায় একই রকম ভাবে আত্মপ্রসাধনে শোভিতা। নবম শতাব্দীর এই ভাস্কর্যে সিংহারূঢ়া শিবপত্নীর দুটি হাত দক্ষিণ কর্ণে একটি বড় মাকড়ি পরানোতে ব্যস্ত, অন্য একটি হাত মাথার পিছন দিক থেকে সামনে এগিয়ে এসে ললাটে টিকুলি স্থাপন করছে। দেবী নিজের সজ্জা দেখে নিচ্ছেন বাম হাতের দর্পণে।

বামনপুরাণে দেবীর নাম কাত্যায়নী। বাণভট্ট ‘কাদম্বরী’-তে তাঁর উল্লেখ করেছেন— ‘কাত্যায়ন্যা ত্রিশূলেনেবাঙ্কিতম্’। কাত্যায়ন ঋষি বা কাত্যায়ন বংশীয়দের দ্বারা দেবী পূজিতা হতেন বলে তাঁর এই নাম। ‘তন্ত্রসার’–এ কাত্যায়নীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী বলা হয়েছে। সেখানে এসেছে দেবীর অলঙ্কারাদির কথাও— হারনূপুরকেয়ূর–জটামুকুটমণ্ডিতাম— হার, নূপুর, কেয়ূর, জটামুকুট প্রভৃতি অলঙ্কারে তিনি বিভূষিতা। কিন্তু ‘হরিবংশ’ গ্রন্থের বিষ্ণুপর্বে কাত্যায়নী অষ্টাদশভুজা, দিব্য আভরণে সজ্জিতা এবং ‘হারশোভিতসর্বাঙ্গী মুকুটোজ্জ্বলভূষণা’।

দেবীর আর এক রূপ কৌশিকী। কালিকাপুরাণে তাঁর বর্ণনায় ছ’টি শ্লোক জুড়ে শুধুই অলঙ্কারের বিবরণ— কেশের অন্তভাগে একটি ঊর্ধ্বমুখ তিলক, গলায় মণিকুণ্ডল, মাথায় মুকুট, দুই কর্ণে জ্যোতির্ময় কর্ণপুর। তিনি পরে আছেন সুবর্ণ মণিমাণিক্য, নাগহার, গ্রীবায় রত্নকেয়ূর। ‘মহাভারত’–এর বিরাট পর্বে পাণ্ডব–অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তবে দেবী ময়ূরপুচ্ছের বলয় পরেছেন— ‘ময়ূর পিচ্ছবলয়া’— তাঁর ধ্বজেও ময়ূরপুচ্ছ শোভা পায়। ভীষ্ম পর্বে অর্জুনের দুর্গাস্তবেও তিনি ময়ূরপুচ্ছধ্বজধারিণী— ‘শিখিপিচ্ছধ্বজধরে নানাভরণভূষিতে’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রে’র নয় সংখ্যক শ্লোকে দুর্গা তাঁর পদযুগল-সংলগ্ন নূপুরের ধ্বনিতে মুগ্ধ করেছেন ভূপতিত শিবকে— ঝণঝণঝিঞ্ছিমি ঝিঙ্কৃতনূপুর শিঞ্জিতমোহিতভূতপতে। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’তেও আছে অলঙ্কারের উদ্ভাস— মুক্তাকেয়ূর, হার, কঙ্কণ, মৃদু–মধুর ধ্বনিযুক্তা চন্দ্রহার ও নূপুর পরিহিতা, রত্নোজ্জ্বল কুণ্ডলভূষিতা দুর্গা আমাদের দুর্গতি নাশ করুন।

অমরলোকের দেবতারা দেবীকে অস্ত্রে সাজানোর সময় নানা দেবতা তাঁকে গিয়েছিলেন হরেক আভরণ। হিমালয় দিয়েছিলেন বাহন সিংহ এবং বিবিধ রত্ন। দুর্গার গয়নার কারিগর স্বয়ং বিশ্বকর্মা। সোনা, মুক্তা আর মূল্যবান রত্ন দিয়ে তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন চন্দ্রকলা, বালা, মাকড়ি, টিকুলি, বাজুবন্ধ, আংটি, নূপুর। মহালয়ার ভোরে রেডিয়োয় বেজে ওঠে একটি শ্লোক— ‘জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনি রম্যকপর্দিনি শৈলসুতে’। ‘রম্যকপর্দিনি’ শব্দটির অর্থ সুন্দর করে বাঁধা খোঁপা। গ্বালিয়র থেকে পাওয়া গুপ্তযুগের এক ভাস্কর্যে দেবীর তরঙ্গময় কেশসজ্জা, সালঙ্কৃত কবরীবন্ধন ‘রম্যকপর্দিনি’র পাথুরে নিদর্শন।

বৃহদ্ধর্মপুরাণে দক্ষযজ্ঞের কাহিনি আছে। দেহত্যাগের পরে সতীর দেহ বিষ্ণুচক্রে বহু সংখ্যায় খণ্ডিত হয়েছিল— সুদর্শনেন চক্রেণ চিচ্ছেদ খণ্ডশঃশনৈ। অঙ্গসমূহ যেখানে যেখানে পতিত হল সেই স্থানগুলি সিদ্ধপীঠ হিসেবে খ্যাতি পেল— সিদ্ধপীঠাঃ সমাখ্যাতা। সতীর অঙ্গপতনের সঙ্গে কয়েকটি স্থানে পড়েছিল গয়নাও। শ্রীলঙ্কার নাইনাতিভুতে নূপুর, বারাণসীর গঙ্গাতীরে কর্ণকুণ্ডল, রাজস্থানের পুষ্করের কাছে গায়ত্রী পর্বতে দুই হাতের বালা পড়েছিল। মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার কিরীটকণা গ্রামে পড়েছিল স্বর্ণমুকুট— সেখানে দেবী এখন কিরীটেশ্বরী। বীরভূমের সাঁইথিয়ায় নন্দিকেশ্বরী মন্দিরে ভক্তের ঢল অষ্টমীর রাতকেও হার মানায়, কেননা এখানেই পড়েছিল সতীর কণ্ঠহার। পায়ের নূপুরের পতনস্থান নিয়ে মতান্তর আছে। কেউ বলেন ডান পায়ের নূপুর পড়েছিল লাদাখের কাছে, কারও মতে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমে। আর বাম পায়ের নূপুর নিয়ে দুই বাংলার লড়াই— বাংলাদেশের বগুড়া না কি পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক? কে করবে মীমাংসা?

কৃতজ্ঞতা: শ্রেষ্ঠা দাস, শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী

Durga Puja 2018 Durga Puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy