Advertisement
E-Paper

একটা [ভয়] কষ্ট লজ্জা

আমার খুদে-মাস্তান বেলায় ২৬ জানুয়ারি ময়দানে প্যারেড দেখতে যাওয়ার খুব চল ছিল। দূরদর্শনে দেখানো সত্ত্বেও কেন যে শীতকালে সাতসকালে লোকজন প্যারেড দেখতে যেত, এখনও বুঝি না। তখন তো আরওই বুঝতাম না। কেবল ট্যাবলোগুলো যখন নানা রকম সেজেগুজে আসত, ভারী ভাল লাগত।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

আমার খুদে-মাস্তান বেলায় ২৬ জানুয়ারি ময়দানে প্যারেড দেখতে যাওয়ার খুব চল ছিল। দূরদর্শনে দেখানো সত্ত্বেও কেন যে শীতকালে সাতসকালে লোকজন প্যারেড দেখতে যেত, এখনও বুঝি না। তখন তো আরওই বুঝতাম না। কেবল ট্যাবলোগুলো যখন নানা রকম সেজেগুজে আসত, ভারী ভাল লাগত। ভয়ঙ্কর ভিড় হত। আমি এক বারই গিয়েছিলাম। আর, অঘটন আর আমি যেহেতু যমজ, সুতরাং আমি থাকলে অঘটন দূরে থাকে কী করে?

আমি, দিদি আর দাদা, তিন জনের সাইজ নেহাতই কম হওয়ায়, মা একেবারে সামনে দাঁড় করাতে পেরেছিল। যাতে ঘোড়ার খুর থেকে মিলিটারিদের হাতে কিম্ভূত নামের বন্দুক, পিস্তল, মার্চপাস্ট ভাল করে দেখতে পারি। দেখার উদগ্র বাসনা কি কেবল আমাদের? পেছনের লোকজনেরও একই ইচ্ছে। অতএব ঠেলাঠেলি শুরু। ভিড়টা জমাট হয়ে ঠেলছে। এবং যা হওয়ার ছিল, ভিড়ের চাপে একটা সময় বাঁশের রেলিং ভেঙে পড়ল। অতএব হুড়মুড়িয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। মা, আমাদের ওপর, যত দূর সম্ভব তিন জনকে পাখির ডানার মতো আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েক জন লোক মা’কে মাড়িয়ে চলে গেল। আমাদের খুব কিছু লাগেনি। কিন্তু মুখ, বুক মাটিতে চেপ্টে খুব দমবন্ধ লাগছিল। সে-সময় লোকজন বোধ হয় এত উন্মত্ত ছিল না, তাই আমাদের পড়ে থাকতে দেখে, মাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়নি। বরং অনেকে মিলে গোল করে দাঁড়িয়ে আমাদের উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। তখন আমার গব্বর সিং-এর মতো সাহস ছিল। তাই কেটে-ছড়ে গেলেও লাগেনি। আঘাত লাগলেও ব্যথা করেনি।

গোল বাধল পরে। বেশ পরে। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে কলকাতার বাইরে নেমন্তন্ন যাচ্ছিলাম। কাটোয়া লাইনের ট্রেন। হুলুস্থুলু ভিড়। চাপাচাপিতে মনে হচ্ছিল প্রাণটাই ঠোঁটে এসে ঠেকেছে। ঘেমেনেয়ে একশা। আচমকা আমার সেই ২৬ জানুয়ারির স্মৃতি ফিরে এল, কোনও নোটিস না দিয়ে। ব্যস। মনে হল, তখুনি নেমে যাই। এ বার নিশ্চয়ই এমন চাপাচাপি হবে আমি মাটিতে পড়ে যাব। এই সব লোক আমায় পিষে দিয়ে চলে যাবে। ও মা! তুমি কোথায়? আমার কাছটায় এসে দাঁড়াও। জলতেষ্টা পেয়েছে। ওয়াটারবটল দাও। আমি নেমে যাব। পরের স্টেশনে। অনেক কষ্টে বুঝিয়েসুঝিয়ে সে যাত্রা আমায় বিরত করা গেল। কিন্তু ভিড়ের চাপ আমার মনে ভয়ের বীজ ছিটিয়ে দিয়ে গেল।

ক্লাস এইটে পড়ার সময় দিল্লি বেড়াতে গেলাম। বাঙালি যেমন হয়, পুরো এলাকায় বুড়ি না ছুঁয়ে ফেরে না। ভ্রমণ-ঠাকুর পাপ দেয়। বাঙালিত্ব হরণ হয়। হরিদ্বার, হৃষীকেশ, লছমনঝুলা— সব থানেই এক্কা-দোক্কা করা চাই। সঙ্গে আশ্চর্য সব লোকাল গাইডও জুটে যায়। লছমনঝু লা ব্রিজের ঠিক মাঝখানে যখন, আমাদের গাইড মহাশয় মুখে কয়েকশো ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘জানেন, ঠিক এই জায়গায় গত সপ্তাহেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। মেলার সময় ভিড় হয় তো, ব্রিজের ওপর এত ভিড় ছিল যে বাবার কোল থেকে একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা পড়ে গঙ্গায় তলিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাবা ঝাঁপ দেয় ব্রিজ থেকে, আর তার পেছনেই বাচ্চার মা ছিল, সে-ও ঝাঁপ দেয়। কেউ কিছু বোঝার আগেই তিন জন গঙ্গা মাইয়ার...’ আমার সারা শরীর ঝিমঝিম করছে। গলায় মনে হচ্ছে পাথর ঢুকে গেছে। হার্টটা মনে হচ্ছে কেউ দড়ি দিয়ে বেঁধে গঙ্গা মাইয়ার অতলে নামিয়ে দিচ্ছে। বিনবিন করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি খুব ভিড় আমার চারপাশে, সবাই মিলে ঠেলছে আমাকে, দিদিকে, আমাদের সবাইকে। মা, তুমি কোথায়? জল খাব। আমি ব্রিজে উঠব না। ওইখানে কত লোক দাঁড়িয়ে। আমি আর মন্দিরে যাব না। আমায় ছেড়ে দাও। গোটা ব্রিজটা কেমন ঘোরের মধ্যে পেরিয়ে গেলাম। কাউকে কিছু বলিনি।

কিন্তু এর পর থেকে বাসে ভিড় হতে শুরু করলেই আমার স্টপ না এলেও আমি ঝটপট নেমে পড়তাম।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy