আলোর সঙ্গে শুরু হয়েছে অদ্ভুত বাজনা, সন্ধ্যা নামছে শহরে-মফস্সলে। কুয়াশার পরত আর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পোকাদের ভিড় পেরিয়ে দূরের মাঠে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আলোর ওঠা-নামা। ভিতরে তখন উচ্চগ্রামে মোটর বাইকের শব্দ, কিছু ক্ষণ আগে লাল নাকওয়ালা জোকার হাসিয়ে যাওয়ার পরে দর্শকাসনে বসে বুক ঢিপ ঢিপ। তিন জন মোটরবাইক নিয়ে ঘুরছে... সার্কাস এসেছে শহরতলিতে। রঙিন পোস্টারে দেওয়াল ঢাকা, বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে তরুণী। রিকশায় লিফলেট বিলি করতে করতে মাইকে একটানা প্রচার— “বাঘের মুখে মানুষ, আসুন দেখুন বিচিত্রা সার্কাস— প্রতিদিন একটা, চারটে, সাতটা। সার্কাস ময়দান, অগ্রিম টিকিটের ব্যবস্থা আছে।”
কয়েক দশক আগেও আমাদের চলাফেরার পথে এই দৃশ্যগুলো খুব চেনা ছিল। এখন সে শীতও নেই, সার্কাসেরও দিনও গেছে। খুঁজে দেখলে সার্কাসের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গল্প অনেক। সার্কাস দলের ভিতরেও রাগ, অভিমান, ভালবাসা, ষড়যন্ত্রের গল্প রয়েছে। এই বিচিত্র সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা নিয়ে দীর্ঘকাল কেটেছে বাঙালির।
আদি কথা
সার্কাসের আদিরূপ ছিল সাধারণ ভাবে নানা ধরনের বিনোদনমূলক শো, যা মানুষের শারীরিক কসরত, পশুপালন বা নাটকীয় প্রদর্শনী নিয়ে গঠিত ছিল। এর বিস্তারিত উৎপত্তি স্পষ্ট ভাবে জানা না গেলেও, সার্কাসের আধুনিক রূপের বিকাশ শুরু হয় ১৭৭০ সালে ইংল্যান্ডে, যখন ফিলিপ আস্টলি নামক এক ইংরেজ একটি ঘোড়া প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রথম ‘সার্কাস’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। তিনি লন্ডনের পাশেই একটি আঙিনা তৈরি করেন যেখানে ঘোড়া, জিমন্যাস্টিক্স-কসরত এবং বিভিন্ন শারীরিক প্রদর্শনী করা হত। এই বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য একটি গোলাকার আঙিনা তৈরি করা হয়, যা আস্টলির নিজেরই উদ্ভাবন। ‘সার্কাস’ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘circus’ থেকে, যার মানে ‘চক্র’ বা ‘গোলাকার জায়গা’। এটি উল্লম্ব আঙিনায় পরিবেশিত শো এবং দর্শকদের আসন-সহ গোলাকার কাঠামোকে নির্দেশ করে। সার্কাস নামটি আসলে পুরনো রোমান বিনোদনমূলক শোয়ের উৎস থেকে এসেছে। রোমান সাম্রাজ্যে ‘সার্কাস’ ছিল একটি বড় আঙিনা বা স্থান, যেখানে ঘোড়া দৌড়নো এবং অন্যান্য খেলা বা কসরত প্রদর্শন করা হত। ঐতিহাসিক ভাবে, রোমান সার্কাস ছিল একটি গোলাকার বা অর্ধগোলাকার স্টেডিয়াম, যেখানে বহু মানুষ এক সঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারতেন। পেশাদার সার্কাসের নামকরণও এই রোমান শব্দ থেকেই এসেছে, কারণ এটি দেখানোর জন্য একটি গোলাকার আঙিনা বা মঞ্চ ব্যবহৃত হত এবং তাতে অনুষ্ঠিত হত নানা ধরনের বিনোদনমূলক কার্যক্রম।
পশ্চিমের হাওয়া
ভারতে সার্কাসের ইতিহাসের প্রথম পদচারণা অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে, যখন ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে বিস্তৃত। তখনই পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমশ ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করতে শুরু করে। ব্রিটিশদের সঙ্গে আসা ইউরোপীয় সার্কাস দলগুলি কলকাতায় তাদের পরিবেশনা শুরু করেছিল। এই সময়ে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় থিয়েটারগুলোতে ইংরেজ এবং অন্যান্য ইউরোপীয় সার্কাস দলগুলি শো করত। প্রথম দিকে সার্কাস ছিল শুধু ইংরেজ শাসক এবং উঁচু শ্রেণির মানুষের জন্য বিলাসিতার অনুষঙ্গ। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই শোগুলি ছিল একেবারে দূরের কথা, কারণ তাদের কাছে এই ধরনের বিনোদন তখন নেহাতই শখের বিষয়।
তবে ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতের সার্কাস শিল্পের প্রথম দিকের শিকড় রোপিত হয়। ব্রিটিশরা তাদের সৈন্যদল ও কর্মীদের বিনোদনের জন্য ইউরোপীয় সার্কাসের বিভিন্ন খেলা ও কসরত এখানে নিয়ে আসে। এই ধরনের শো ছিল ভারতে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতি, যা পুরনো দেশীয় বিনোদনের ধরন থেকে একেবারে আলাদা। কলকাতার মতো শহরে এই সব শো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, বিশেষত সাহেব ও প্রভুরা এই শোগুলি দেখতে পছন্দ করতেন। ব্রিটিশ শাসনের সময় ইউরোপীয় সার্কাস দলের মাধ্যমে পশ্চিমি সাংস্কৃতিক ছোঁয়া ভারতীয় দর্শকদের মাঝে পৌঁছনোর পাশাপাশি, এক নতুন ধরনের বিনোদনের জন্ম দেয়।
ভারতে সার্কাসের জনক বলা হয় বিষ্ণুপান্ত মোরেশ্বর চাতরেকে। তাঁর হাত ধরে শুরু হয় ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’। পরবর্তী কালে তিনি সার্কাস অ্যাকাডেমিও তৈরি করেন। বাংলায় এর পথিকৃৎ ছিলেন প্রিয়নাথ বসু। বিদেশি সার্কাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তৈরি করেন ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’, যেখানে ভারতের প্রথম মহিলা সার্কাসশিল্পী হয়ে যোগ দিয়েছিলেন সুশীলাসুন্দরী। ১৮৯৬ সালের নভেম্বর মাসে রেওয়ার মহারাজা ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ দেখে খুশি হয়ে তাদের দু’টি বাঘ উপহার দেন। প্রিয়নাথ দলে রিংমাস্টারের দায়িত্ব পালন করতেন। সেই সময় সার্কাস বা শরীরচর্চার প্রশিক্ষকদের ‘প্রোফেসর’ বলে ডাকা হতো। প্রিয়নাথ হয়ে ওঠেন ‘প্রোফেসর বোস’।
স্থানীয় দলগুলোর উত্থান
অবিভক্ত বাংলায় ঢাকার শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ‘গ্র্যান্ড শো অব ওয়াইল্ড অ্যানিম্যালস’ সার্কাস দলটি তিনি পরিচালনা করতেন। ১৯০০ সাল নাগাদ ভারতীয় সার্কাস দলগুলো জন্মাতে শুরু করে। কলকাতার পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাতেও সার্কাসের আসর বসতে শুরু করে। ১৯৩০-এর দশকে বাংলা অঞ্চলে প্রথম স্থানীয় সার্কাস দল গড়ে ওঠে। এই সময়ে কলকাতা, নদিয়া, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম-সহ বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চলে সার্কাসের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তখনকার সার্কাসের দলগুলো ছোটখাটো হলেও, তাদের পরিবেশনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
‘দ্য গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ ছাড়াও কিছু বিখ্যাত সার্কাস দল ছিল হিপ্পোড্রোম, র্যামন, কার্লেকার, কমলা, গ্র্যান্ড ফেইরি, লায়ন, গ্র্যান্ড গ্লোস্টার ইত্যাদি। প্রোফেসর কৃষ্ণা, প্রোফেসর রামমূর্তি, কৃষ্ণলাল বসাক— এঁরা ছিলেন এই সোনালি সময়ের সার্কাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নাম।
‘এশিয়ান’ সার্কাস’ ছিল একটি বিশেষ দল যা পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় সার্কাস দলগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল পরবর্তী কালে। এই দলটি প্রায় এক দশক ধরে মঞ্চে পেশাদার সার্কাস পরিবেশন করেছে। আগের সার্কাস দলগুলির প্রধান আকর্ষণ ছিল তাদের অভিনব প্রাণী প্রদর্শনী, যেখানে থাকত বাঘ, হাতি এবং কুকুরের বিশেষ কসরত। এক সময় সার্কাসের আসরে দর্শকের ভিড় ছিল অভূতপূর্ব। বিভিন্ন সময়ে একে বলা হত ‘বাঘের মঞ্চ’, কারণ তখন বিশেষ ভাবে বাঘের খেলা দেখানো হত।
সোনালি যুগ
১৯৪০ থেকে ১৯৭০-এর দশক ছিল বাংলা সার্কাসের সোনালি সময়। তখন সার্কাস শিল্প তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। সার্কাসের মঞ্চে শো ছিল দুর্দান্ত এবং পরিবেশনা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। কলকাতা, শিলিগুড়ি, মালদহ, বর্ধমান, হাওড়া, বরিশাল, ঢাকা-সহ নানা জায়গায় সার্কাসের শো অনুষ্ঠিত হত। সার্কাসের মরসুমে, বিশেষ করে শীতকালে দর্শকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো হত। ‘এশিয়ান সার্কাস’ ছিল সে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার্কাস, যা সারা ভারতে পরিচিত ছিল।
‘ন্যাশনাল সার্কাস’ তাদের বিভিন্ন শোয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তাদের প্রাণী প্রদর্শনী। তাদের পশুদের পারফরমেন্স— বিশেষ করে হাতি, বাঘ এবং ঘোড়ার কসরত— দর্শকদের মুগ্ধ করত। এই দলের ‘টাইট্রেস’, ‘হুপ লুপ’ এবং ‘ফায়ারওয়াকিং’ আজও অনেকের স্মৃতিতে অম্লান।
এই সময়ের সার্কাস দলগুলোতে শুধু প্রাণী প্রদর্শনীই ছিল না, নৃত্য, অ্যাক্রোবেটিক্স, ম্যাজিক এবং নানা ধরনের শারীরিক কসরতও দেখা যেত। প্রতিটি দল নিজেদের শোয়ে কিছু না কিছু নতুনত্ব নিয়ে আসত, আর সেই কারণে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ত। বিখ্যাত সার্কাস দলগুলির মধ্যে ছিল নৃত্য ও শারীরিক কসরত, বিশেষ করে অ্যাক্রোবেটিক্স প্রদর্শন তাদের অন্যতম জনপ্রিয় শো। তখনকার দলগুলি অভিনব কৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করত, ফলে শো দেখার জন্য দর্শকের ভিড় লেগে থাকত। সে কালে প্রতি শীতেই কলকাতায় গড়ের মাঠে সার্কাসের আসর বসত। পার্ক সার্কাস ময়দান নামকরণের পিছনেও ছিল সার্কাসের ভূমিকা। হাওড়া ময়দানেও সার্কাসের প্রদর্শনী হত। দেশীয় সার্কাসের পাশাপাশি বিদেশের সার্কাসও আসত। এই সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সার্কাসের বিজ্ঞাপন থাকত।
পরবর্তী পরিবর্তন ও সঙ্কট
নব্বইয়ের দশক থেকে সার্কাস শিল্পে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের আধিপত্য বাড়ে এবং সার্কাসের দর্শকসংখ্যা কমতে থাকে। এক দিকে সিনেমা, আর এক দিকে রিয়েলিটি শো ও টেলিভিশন চ্যানেলের প্রভাবে সার্কাসের জনপ্রিয়তা অনেকটাই হারিয়ে যায়। তা ছাড়া, প্রাণী অধিকার রক্ষাকারী আন্দোলনও সার্কাস শিল্পের উপর প্রভাব ফেলে। তখন থেকেই বিভিন্ন সার্কাস দল প্রাণীর খেলা দেখানো বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এর বদলে পরে শুরু হয় নানা শারীরিক কসরত, অ্যাক্রোবেটিক্স, মোটর বাইকের খেলা, জিমন্যাস্টিক্স এবং মানুষের কল্পনাশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সব কৌশল। এই সময় থেকেই সার্কাসের শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হয়, যা দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
সার্কাসের জগৎ এখন অনেকটাই পরিবর্তিত। এক সময় যেখানে জীবজন্তুর খেলা, সাইকেল শো, বাঘের খেলা ছিল মূল আকর্ষণ, এখন সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি, লাইট, ভিএফএক্স এবং থিয়েটারের মিশ্রণ দেখা যায়। জাম্বো সার্কাস-এর মতো দলগুলি এখন প্রযুক্তির সাহায্যে দর্শকদের নতুন অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। এখনকার দলগুলিতেও কিছু পুরনো কসরত রেখে আধুনিক পরিবেশনা যোগ করা হয়েছে, যাতে দর্শকরা নতুন কিছু পায়। তবুও সার্কাসের জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই, তাই সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে প্রচার করার চেষ্টা হয়। এই সময়ে সার্কাস শিল্পে এক নতুন ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ‘সার্ক ডু সোলেইল’-এর মতো আধুনিক সার্কাস দলগুলো প্রযুক্তি ও থিয়েটারের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের পরিবেশনা তৈরি করছে। ডিজিটাল মিডিয়ায় এমন সার্কাস দলগুলো নানা ধরনের শো এবং কর্মশালা আয়োজন করছে, কারণ লড়াইটা অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
শীত আসে ক্যালেন্ডার মেনে। পশমের শালওয়ালা কাশ্মীর থেকে নিজে না এসে এখন পোস্ট করে দেয় অনলাইন অর্ডার পেয়ে। নতুন গুড়ও তাই। দ্রুত বদলে যেতে থাকা সময়ে সার্কাসও জৌলুস হারিয়েছে স্বাভাবিক নিয়মেই। তবু কিছু নস্টালজিয়া আর থেকে যাওয়া দৃশ্যকল্প মাঝে মঝে উত্তুরে হাওয়ায় বয়ে আনে সার্কাসের দিনগুলো। ট্রাপিজ়ের খেলার মতো জীবন যেন শিখে নিয়েছে— ‘শো মাস্ট গো অন’।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)