Advertisement
E-Paper

মোজায় গোঁজা মেরুদণ্ড

সত্তরের দশকে আমি উত্তর ২৪ পরগনার একটা কলেজে পড়াতাম। আমার বয়স তখন তিরিশের নীচে। সেই কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছে। আমি নজরদারি করছি। হঠাৎ দেখি, সামনের বেঞ্চে একটা ষন্ডামার্কা ছেলে একটা বই খুলে লিখছে। আমি ধমক দিয়ে বইটা কেড়ে নিলাম।

সুনীল সরকার

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
ছবি: মণীশ মৈত্র

ছবি: মণীশ মৈত্র

সত্তরের দশকে আমি উত্তর ২৪ পরগনার একটা কলেজে পড়াতাম। আমার বয়স তখন তিরিশের নীচে। সেই কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছে। আমি নজরদারি করছি। হঠাৎ দেখি, সামনের বেঞ্চে একটা ষন্ডামার্কা ছেলে একটা বই খুলে লিখছে। আমি ধমক দিয়ে বইটা কেড়ে নিলাম।

ছেলেটি কোনও প্রতিবাদ করল না, শাসানি বা ভয় দেখানো তো দূরের কথা। শুধু এক বার আমার চোখে চোখ রেখে, খানিকটা দার্শনিক নির্লিপ্ততায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কিছু ক্ষণ পর কলেজের ভাইস- প্রিন্সিপাল ঘরে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, খানিক ক্ষণ আগে আমি এক জন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে একটা বই কেড়ে নিয়েছি কি না। আমি ‘হ্যাঁ’ বলতে উনি আমাকে শিগগিরি বইটা ছেলেটিকে ফেরত দিয়ে অন্য ঘরে চলে যেতে বললেন। আমি থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এমন আজব হুকুম কেন! উনি বললেন, ‘ওকে ধরা যায় না।’ আর জানালেন, ছেলেটি সশস্ত্র। যদিও কলেজে একটা তুচ্ছ কারণে এ সবের অপব্যবহার সে করবে না। তবে কলেজের এই ছোট্ট চৌহদ্দিটার বাইরে যে বিরাট সমাজটা রয়েছে, তার প্রতিটা আনাচকানাচ ওর নামে কাঁপে। সেখানে সে ইতিমধ্যেই হাফ ডজন মানুষকে কোতল করার রেকর্ড করে রেখেছে।

পরে জানলাম, সে অধ্যক্ষের কাছে আমার নামে ‘অভিযোগ’ও করেছিল। বলেছিল, কোথাকার কে একটা চ্যাংড়া মাস্টার এসেছে! এমন আকাট আর হাঁদা যে ওর সম্পর্কে কোনও খবরই রাখে না! তাই বই কেড়ে নিয়ে অন্যায় করলেও ওর নাকি আমার ওপর করুণাই হয়েছিল। তাই ও নিজের আসল চেহারাটা আর আমাকে দেখায়নি!

যা হোক, ভাইস প্রিন্সিপালও তো ওর সামনে চুনোপুঁটি, অসহায়। তাই কী আর করতে পারেন তিনি! আমাকেই শোধরালেন। মূর্খামি দূর করে ঘর থেকে বের করে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। আর ছেলেটিকে ডেকে এনে তার সিট ফেরত দিয়ে, শান্তি কিনলেন।

তবে, টুকলি ধরতে ওস্তাদ ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল। তিনি জাত-গোয়েন্দা। যে কোনও হল-এ হঠাৎ ঢুকে, ঠিক মক্কেলটিকে ঘাড় ধরে তুলতেন। হয়তো সে নিপাট ভালমানুষটি সেজে লিখে চলেছে। ধরা পড়ে আকাশ থেকে পড়ার ভানও করছে। কিন্তু প্রিন্সিপালের অভিজ্ঞ চোখে ধুলো দেওয়া অসম্ভব। তিনি তক্ষুনি নিপুণ গোয়েন্দার মতো, পকেট থেকে, পেনসিল বক্স থেকে, জুতোর ভেতর থেকে ঠিক বের করে আনতেন চোতা-কাগজ। তখন টুকলিবাজের মুখটি আমসি।

প্রিন্সিপাল এক দিন স্টাফরুমে আমাদের একটা চোতা দেখালেন। বাজেয়াপ্ত কাগজটা চওড়ায় ২ ইঞ্চি, লম্বায় ১২ ইঞ্চি। কিন্তু তাতে কোনও প্রশ্নের উত্তর লেখা নেই। শরীরের কোন জায়গায় কোন প্রশ্নের উত্তর সেঁধিয়ে আছে, এটা তার সূচিপত্র। পরীক্ষাটা জীবনবিজ্ঞানের। সূচিপত্রটা এ রকম— মোজায় মেরুদণ্ড, হাঁটুতে ব্যাঙ, কোমরে ফুসফুস, আস্তিনে রক্ত। ওইটুকু কাগজ, প্রায় অণু-লিপিতে লেখা। কিন্তু কী চমৎকার! পরিচ্ছন্ন! সারিতে বেঁধে বেঁধে ছবির মতো অক্ষর চলেছে! এই রত্নাকরটি পরজীবনে কোনও শিল্পক্ষেত্রে গিয়ে বাল্মিকী হয়েছিল কি না, কে জানে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy