E-Paper

সাত প্রতিমা অথবা পটচিত্রে দুর্গাপুজোর বিরল ঐতিহ্য

একটি সঙ্কীর্ণ গলিতে পর পর সাতটি দুর্গা, আবার কোথাও বহু প্রথা মেনে পটে ফুটে ওঠে দেবীর দ্বিমাত্রিক রূপ। বীরভূমের দুর্গাপুজোয় রয়েছে এমনই নানা বৈশিষ্ট্য। 

অলোক মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:১০
মাতৃপূজা: চালচিত্রসহ পাঁচড়ার বহুবর্ণের পটের দুর্গা। (ছবি: লেখক)

মাতৃপূজা: চালচিত্রসহ পাঁচড়ার বহুবর্ণের পটের দুর্গা। (ছবি: লেখক)

বীরভূমের খয়রাশোলের দু’টি গ্রাম, পাথরকুচি আর পাঁচড়া। এই দু’টি গ্রামের দুর্গাপুজোই নিজস্ব বিরল বৈশিষ্ট্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুজো-মানচিত্রে।

পাথরকুচির সাতদুর্গা

এক চিলতে সঙ্কীর্ণ গলিতে অবস্থিত পর পর সাতটি দুর্গাদালানে সাতটি দুর্গাপ্রতিমা, আর কোথাও পূজিত হয় বলে আমার জানা নেই। একটা সময়ে জমিদার বা রাজরাজড়া বা উচ্চবিত্ত ছাড়া দুর্গাপুজো করা, বা বংশানুক্রমে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। এই গ্রামে, যাঁদের মূল জীবিকা কাঁসা-পিতলের থালা তৈরি বা কখনও চাষ-আবাদ, তাঁরা কী করে এই পুজোর সূচনা করেন! তাও এক-আধটা নয়, সাত-সাতটা দুর্গাপুজো! বর্তমানে সপ্তমীর সকালে সাতটি দোলা পর পর কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে হিংলো নদীতে কলাবৌ স্নান করাতে যায়, মায়ের বোধন হয়। আবার এক সঙ্গেই সবাই ফিরে আসেন।

এই সাত দুর্গার পুজোকে ঘিরে পাথরকুচির যে বাসিন্দারা উৎসবে মাতেন, তাঁদের অধিকাংশই কর্মকার সম্প্রদায়ের। সেই কর্মকার পাড়ায় একশো মিটারের একটি সরু গলির মধ্যেই শতকপ্রাচীন এতগুলি দুর্গাদালান— শুধু ওই পাড়া বা গ্রামেই নয়, জেলার নিরিখেও বিরল ঘটনা। এখানকার বংশপরম্পরার ইতিহাস থেকে জানা যায়, বহুকাল আগে দু’টি দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। কিন্তু আত্মীয়স্বজন বা শরিকের মধ্যে কখনও কোনও সমস্যার জেরেই দুর্গাপুজো ও মন্দিরের সংখ্যা ভেঙে ভেঙে সাতে দাঁড়িয়েছে। ঠিক কবে, কেন এই বিসংবাদ এবং পুজোর ভাগাভাগি, সে কথা হারিয়ে গিয়েছে স্মরণাতীত কালের গর্ভেই।

পাথরকুচি গ্রামের ওই পাড়ার সকলেই কর্মকার হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁদের মধ্যে তিন ধরনের পদবি আছে— মেহেতরি, কর্মকার এবং মণ্ডল। প্রথমেই রয়েছে মেহেতরিদের দুর্গাদালান। তার পরই পর পর চারটি দুর্গাদালান কর্মকার পদবিযুক্ত পরিবারের। শেষ দু’টি দুর্গাদালান মণ্ডল পরিবারের। প্রত্যেকটি দুর্গাপুজোর দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায় সেই পরিবারের অন্যান্য শরিকের মধ্যেও।

দশমীর দিন দোলায় চেপে হিংলো নদীতে সাত দুর্গার এক সঙ্গে বিসর্জনের দৃশ্যও পশ্চিমবঙ্গে বিরল।

পাঁচড়ার পটের দুর্গা

বীরভূম জেলা ও পশ্চিমবঙ্গেরই আরও নানা স্থানে বেশ কিছু পটের দুর্গার দেখা মিললেও, পাঁচড়ার পটের দুর্গার নির্মাণকৌশল অনেকটাই আলাদা। এই পটের দুর্গার প্রচলন হয় প্রায় তিনশো বছর আগে। তবে পারিবারিক সুত্রে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে ঈশ্বর নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের লিখিত তথ্য বেশি নির্ভরযোগ্য। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের আদি পুজো ছিল বর্ধমান জেলার বনগ্রামে, পরে পাঁচড়ায় স্থানান্তরিত হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বিসর্জনের সময় এক বার তমাল গাছের ডালে লেগে গণেশের আঙুল ভেঙে যায়। পাঁচড়ার তৎকালীন জমিদার কমলাকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছারি চত্বরে এক বিশাল তমাল গাছ ছিল। তবে এই দুর্গাপুজো কিন্তু সেই জমিদার বংশের নয়। এই প্রাঙ্গণে তাঁদের রাধারানি মন্দির আছে। যা-ই হোক, আঙুল ভাঙাকে কেন্দ্র করে পরের বছর থেকেই পটে আঁকা দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়।

জমিদারদের পুজো না হলেও, যে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের এই পুজো, তাঁরা কিন্তু পাঁঠা বলিদানের খাঁড়াটি নিয়ে আসেন জমিদারবাড়ি থেকে। জমিদারবাড়ির রাধারানি মন্দির আছে এই কাছারি চত্বরেই, দুর্গামন্দির দক্ষিণমুখী এবং রাধারানি মন্দির পূর্বমুখী। দুর্গার থানে বলিদান হয় বলে, ওই ক’দিন রাধাকৃষ্ণকে মন্দির থেকে সরিয়ে জমিদারবাড়িতে এনে রাখা হয়। দশমীর পরে আবার রাধাকৃষ্ণবিগ্রহ রাধারানি মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।

বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাঁচ ঘরের উত্তরসূরিরাই এই পুজো চালান। এই পাঁচ পরিবারের পূর্বসূরিরা হলেন হরনাথ, দুর্গা, রাম, লক্ষ্মণ ও ভরতচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পটনির্মাণের কৌশল একটু অন্য রকম। প্রথমে বড় বালতিতে মাটির গুলুনি করা হয়। এই গুলুনি কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হয়, কারণ বীরভূমের বহু জায়গার মাটিতে কাঁকর থাকে। এর পর পরিষ্কার ধুতি গুলুনিতে ডুবিয়ে দুর্গার কাঠের একচালায় সেঁটে দেওয়া হয়। মাটির গুলুনি দেওয়া কাপড় যখন ভাল করে শুকিয়ে যায়, তখন ওই কাপড়ে খড়ি লাগানো হয়। সেই খড়ি জলে গুলে তাতে তেঁতুলবীজের গুঁড়ো মেশানো হয় আঠা হিসেবে। খড়ি শুকিয়ে গেলে পেনসিল দিয়ে নির্দিষ্ট মাপে মা দুর্গা এবং তাঁর সন্তানদের সবার ‘আউটলাইন’ করা হয়। এর পরেই রং করার কাজ শুরু হয়। মূল একচালার উপরে অর্ধচন্দ্রাকার চালচিত্র আঁকা হলে আঁকার কাজ শেষ হয়।

এই দুর্গাপুজো তান্ত্রিক মতে হয়। কাছারি চত্বরে জমিদার বংশের শিবমন্দিরের কুলুঙ্গিতে সারা বছর রাখা থাকে একটি সিংহের প্রাচীন দারুমূর্তি। সেটিকে এই পুজোর ক’দিন মায়ের বেদিতে এনে রাখা হত। তেল-সিঁদুরে চর্চিত এই সিংহের অবয়ব এখন আর বোঝা যায় না। পুজো শেষে সেই দারুমূর্তি আবার শিবমন্দিরেই ফিরিয়ে দেওয়া হত। তবে কয়েক বছর হল, দারুনির্মিত সিংহমূর্তিটি দুর্গাদালানেই রেখে দেওয়া হচ্ছে।

এখানে অষ্টমীতে কুমারীপুজো হয়। সপ্তমীতে সাতটি থালায় সাতটি ভোগ, অষ্টমীতে আটটি থালায় আটটি ভোগ ছাড়াও আরও দু’টি থালায় দু’টি ভোগ নিবেদন করা হয়— একটিতে লুচি ও সুজির ভোগ ও অন্যটিতে খিচুড়ির ভোগ হয়। নবমীতে ন’টা থালায় ন’টি ভোগ দেওয়া হয়। তবে, দশমীতে কোনও ভোগ দেওয়া হয় না। অষ্টমীতে নিখুঁত সাদা পাঁঠা এবং‌ নবমীতে কালো পাঁঠা বলিদানের রীতি আছে। বিসর্জনের আগে সিঁদুর খেলা হয় ও তার পর একটু বেলার দিকে ঘট বিসর্জন হয়। সন্ধেয়হিংলো নদীতে চালাসমেত দুর্গাপট নিরঞ্জন হয়।

বীরভূম জেলার সিউড়ির লম্বোদরপুরেও পটের দুর্গা পূজিত হন সরকার ও সেনগুপ্তদের যৌথ উদ্যোগে। বীরভূমের হাটসেরান্দিতেও পটচিত্রে দুর্গা পূজিত হন। বাঁশ, চট, মাটির প্রলেপ দেওয়া কাঠামোর উপরে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে, পূর্বজদের পরম্পরা অনুসারে চালচিত্র আঁকেন পটশিল্পী রামকৃষ্ণ সূত্রধর। সূত্রধরদের এই দুর্গাপট আঁকা চলছে প্রায় দু’শো বছর ধরে। কোথাও কোথাও পাঁচ বছর অন্তর পট আঁকা হয়। যেমন বর্ধমান জেলার অণ্ডালের দক্ষিণ খণ্ডে এমন পটদুর্গার পুজো হয়। তবে পাঁচড়াতে প্রত্যেক বছরই প্রথামাফিক পট আঁকা হয়। সবচেয়ে বেশি বার এঁকেছেন সাধু বাগদি। বছর চারেক হল তিনি প্রয়াত। তবে এর আগে-পরে অনেকেই হাত লাগিয়েছেন পট আঁকায়। যেমন ঈশ্বর সচ্চিদানন্দন চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, স্বপন পাল, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, জগবন্ধু রায়, লালন কবিরাজ প্রমুখ। সর্বশেষ পট এঁকেছেন শেখর কর্মকার। এঁরা কেউই জাত পটুয়া নন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Patochitro Durga Puja

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy