Advertisement
E-Paper

বাড়ি ভেঙে পড়ল

সে দিন কী একটা কথাপ্রসঙ্গে আবার বিবেকানন্দ রোড ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা উঠল। এই অবসরপ্রাপ্ত বার্ধক্যে মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের একটা দিনের কথা। সারা দিন দোলের উৎসব গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে মহানন্দে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার পর থেকেই দেখি, বেশ বৃষ্টি আরম্ভ হল।

শ্যামল কৃষ্ণ বসু

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

সে দিন কী একটা কথাপ্রসঙ্গে আবার বিবেকানন্দ রোড ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা উঠল। এই অবসরপ্রাপ্ত বার্ধক্যে মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের একটা দিনের কথা। সারা দিন দোলের উৎসব গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে মহানন্দে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার পর থেকেই দেখি, বেশ বৃষ্টি আরম্ভ হল। সাল-তারিখ হুবহু মনে করতে পারি না। কলকাতা পৌর সংস্থায় তখন আমি এক জন ‘ডিস্ট্রিক্ট বিল্ডিং সার্ভেয়ার’। থাকি বিরাটি ঋষি অরবিন্দ পার্কে। ট্রেনে বা বাসে কলকাতায় গিয়ে সাত-আট জন কাউন্সিলরের বিশাল অঞ্চলের তদারকি করতে হয়। কোথায় কোন রাস্তায় বাড়ির প্ল্যান ঠিক আছে কি না, কোথায় কে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাচ্ছে। লালবাজার ও সংশ্লিষ্ট থানার সহযোগিতায় সে সব বন্ধ করাই কাজ।

বর্ষাকাল খুব ভাল লাগে, তাই বাড়ির চার পাশের গাছ-গাছালিতে ঝমঝম বৃষ্টিপড়া দিব্যি উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ মনে হল, দেখি তো কলকাতার কী অবস্থা! কারণ, বৃষ্টি বেশি হলে মনে মনে এক অজানা আশঙ্কা ভর করে— আমার এরিয়ায় কোনও পুরনো বাড়ি ধসে পড়ল না তো! যেই টিভি খুলেছি, সংবাদে দেখি বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে!

মধ্য কলকাতার আলিমুদ্দিনের কাছে কলিন লেন-এ একটি নির্মীয়মাণ চারতলা বাড়ি ভেঙে পড়েছে। সাংবাদিক বলছেন, প্রায় ৩৪ জন তখন পর্যন্ত মারা গেছে। দমকল, পুলিশের লোক, তার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের জটলা। একটু পরে রাত ন’টা নাগাদ শোকার্তদের সমবেদনা জানাতে পৌঁছেছেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।

আচম্বিতে মানসিক আঘাত পেলে ভয়ে-আশঙ্কায় মানুষের অবস্থা কী হয়, সে দিন টের পেলাম। কারণ, কলিন লেন আমারই তত্ত্বাবধানের অঞ্চলের মধ্যে পড়ে! এর আগে দেখেছি, আমাদের ডিপার্টমেন্টের নিপাট ভালমানুষ নাটক-পাগল সৌরেনদা, আদর্শবাদী সরস্বতীদা-দের এই ধরনের ঘটনায় লালবাজারের লকআপে থাকতে হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের এবং সাধারণ মানুষের কাছে তখন সিধে ফর্মুলা— কর্পোরেশনে চাকরি করে এবং নগরস্থপতি বিভাগ মানেই দু’নম্বরি!

সারা রাত টিপটিপ বৃষ্টি হল সে দিন। বসে ভাবছি, কখন বাড়িতে পুলিশ আসে। কারণ, আগের অনেক কেসে দেখেছি, এই ধরনের কিছু ঘটলেই আগে অ্যারেস্ট, তার পর বক্তব্য শোনা। এখন অবশ্য আইন বদলে নির্মাণকারী সংস্থাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়। তখন তা ছিল না।

জানলা খুলে অন্ধকারে রাস্তার দিকে চেয়ে রাত যখন প্রায় ভোর হয়ে এল, ছুটলাম প্রথম ট্রেন ধরে কলকাতা। পৌঁছেই, আমার এক ইন্সপেক্টরের বাড়ির খোঁজ করতে লাগলাম। কোথায় বিরাটি আর কোথায় টালিগঞ্জ নাকতলা! আমার তত্ত্বাবধানে যে চার-পাঁচ জন ইন্সপেক্টর ছিলেন, তার মধ্যে পুরঞ্জয়ের অধীন ছিল ওই অঞ্চল। আমার পক্ষে বিশাল অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি বা কেসের হিসাব রাখা মুশকিল, তাই তার সাহায্যপ্রার্থী হওয়া। আগে কখনও যাইনি। তাই, বাড়ি খুঁজে যখন বের করলাম, তখন প্রায় আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। দেখি, সে-ও বেরোবার জন্য রেডি হচ্ছে। বলল, ‘চলুন সোজা অফিস, যা হওয়ার হবে। ফেস তো করতেই হবে, সাইটে যাওয়া রিস্কি হবে।’

ওর বউদি বাড়ির পুকুরের শিঙি মাছের ঝোল দিয়ে দুজনকে জোর করে একটু ভাত খাইয়ে দিলেন, লকআপে ঢোকার আগে শেষ খাওয়া হিসেবে! একটা ট্যাক্সি নিয়ে দুজনে সোজা অফিস ধর্মতলায়। পথে ও বলল— ‘বিশ্বাস করুন শ্যামলদা, কোন বাড়িটা, আমিও বুঝতে পারছি না। ওখানে অনেকগুলো বাড়িতেই নোটিস দেওয়া আছে, পুলিশ পোস্টিং করা আছে।’

এ সব ঝামেলা হলে, রাজনৈতিক নেতারা আবার একটু বন্ধ-আঁখি। তাঁরা নাকি আগে কিছুই জানতেন না। দাদাদের এই একটা গুণ— আগে প্রচুর অনুরোধ ‘ওটা আমার লোক, কিছু করবেন না’, কিন্তু অঘটন ঘটলেই অন্য মূর্তি। তখন চোখ উলটে বলেন, ‘কত বার বলেছি অ্যাকশন নিতে, কিন্তু নেওয়া হয়নি। নিশ্চয়ই ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’

অফিসে পৌঁছে দেখি, ডেপুটি কমিশনার দেবুদা আগেই এসে গেছেন। এক নাগাড়ে টেলিফোন বাজছে, উনি সামলাচ্ছেন। কয়েক জন কাউন্সিলর বসে আছেন, কমিশনার সাহেবও বসে আছেন। আমরা দুজন বলির পাঁঠার মতো বাইরে দাঁড়িয়ে আছি— ভাবছি, ঢুকলেই তো সাসপেনশনের কাগজ ধরাবে, কাগজে সে খবর বড় বড় করে ছাপা হবে। পুলিশের লোক অফিসে এসে গেছে, সঙ্গে নিয়ে যাবে।

দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে যেই ঢুকতে যাব ওঁর ঘরে, হঠাৎ দেখি মধুদা, অর্থাৎ ডেপুটি কমিশনারের পিওন বাইরে বেরিয়ে আসছে। তাকে জিজ্ঞেস করায় বলল— ওটা তো আপনার এরিয়া নয়, ওখানকার কাউন্সিলর তো অমুক বাবু। ওটা অন্য এক জনের আন্ডারে। শুনে আমাদের দুজনের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এ তো একদম অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স! আসলে অনেক সময়ে একই রাস্তার দুই ফুটপাত দুই ওয়ার্ডের হয়। এ ভাবে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম সম্মানহানি থেকে।

অবশ্য পরে রাত জেগে বেশ ক’দিন ওখানে আমাদের ডিউটি দিতে হয়েছে। ধ্বংসস্তূপ সরানো, চাপা পড়া মৃতদেহ বার করিয়ে মর্গে পাঠানো ইত্যাদির জন্য। তিন-চার দিন চাপা থাকা মৃতদেহের বিকট গন্ধ সেই থেকে মাথায় ঘাঁটি গেড়েছে।

এর আগে-পরে বেহালা বুড়ো শিবতলায় বাড়ি ভেঙে পাঁচ জনের মৃত্যু, নন্দরাম মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড, বউবাজারে রশিদ খানের বাড়ি ধসে পড়ে মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনার ঘনঘটা। যা হোক, কলিন লেনের পরের ঘটনা হল, ক’বছর বাদে ল্যান্সডাউন রোডের ‘শিবালিক বিল্ডিং’ ভেঙে পড়া। ১৩-১৪ জন মানুষের মৃত্যু হল। ঘটনাক্রমে তখনও ওটা আমার অঞ্চলের মধ্যে। এ বার আর রাস্তার এ-ধার ও-ধার নেই। একটা ছ’তলা বাড়ি— যেটা তখন থেকে প্রায় আট-দশ বছর আগে শেষ হয়েছে। আবাসিকরা বাস করছে, সেই অবস্থায় সরাসরি উল্লম্ব ভাবে নীচে ধসে পড়েছে।

দেখলাম, সুপার ইম্পোজড লোডের কথা মাথায় না রেখে, সয়েল টেস্টের রিপোর্ট না মেনে, পুরো ছাদে উঁচু করে মাটি ফেলে বাগান তৈরি করা হয়েছিল। কলিন লেনের বাড়ির কোনও অনুমোদন ছিল না, কিন্তু এই বাড়ি অনুমোদনপ্রাপ্ত। শিবালিক পতনে আমার বা আমার নিকটতম অফিসারের কোনও দায় ছিল না, কারণ সেটা বহু আগেই অনুমোদিত এবং সম্পূর্ণ শেষ হওয়া বাড়ি ছিল। তবু আঞ্চলিক অফিসার হিসেবে এখানেও পুলিশ ও দমকলের সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ সরানো, মানুষ উদ্ধার ইত্যাদি করতে হয়েছে।

মনে পড়ে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন পরিচিত বিরোধী নেত্রী। ঘটনাস্থলের অদূরে বেশ কিছু শ্রোতার সামনে মাইক নিয়ে মানুষ-মৃত্যুর এবং শিবালিক পতনের তদন্ত চাইছেন, আর দোষীদের শাস্তি।

আরও মনে পড়ে এক বৃদ্ধের কথা। সম্ভবত চার তলায় ছিলেন। উদ্ধারকাজ শুরুর তিন-চার দিন পরে যখন প্রায় ধরে নেওয়া হয়েছে যে আর কেউ নীচে নেই, হঠাৎ এক দমকলকর্মী একটা ক্ষীণ গলার শব্দ শুনতে পেয়ে, বললেন, বোধহয় কেউ বেঁচে আছে! এ বারে, সাবধানে গ্যাসকাটার দিয়ে রড কেটে, স্ল্যাবগুলো অল্প-অল্প কাটা ও রিমুভ করা নীতিতে কাজ করার পরে, প্রায় আট-দশ ঘণ্টা বাদে সবাই থ হয়ে দেখলাম, এক অবাঙালি বৃদ্ধ দুই স্ল্যাবের ফাঁকে প্রায় সুস্থ অবস্থায় আছেন।

কিন্তু তার পর যা ঘটল, তা আরও তাজ্জব করে দেওয়া ব্যাপার! দমকল-কর্মীরা তাঁকে পাঁজাকোলা করে বার করতেই, ধুতির কোমরের গাঁট থেকে বৃদ্ধ একটা একশো টাকার নোট সেই কর্মীদের দিকে এগিয়ে দিলেন!

কর্মীরা অবশ্য হেসে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু আমি এখনও ভাবি, উনি কি আমাদের সমাজের কোনও কাজ হয়ে গেলেই যে ‘মিষ্টি খাওয়ার টাকা’ দিতে হয়, সেই ঘুষ-নীতি অনুযায়ী রিফ্লেক্স অ্যাকশনে টাকাটা বের করেছিলেন, না কি হাতের কাছে যা-হোক কিছু দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন?

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy