Advertisement
E-Paper

গোপন ‘লাইক’টি রবে না গোপনে, সব কিছু জানিয়ে দেবে ফেসবুকই!

ফেসবুক থেকেই জানা যাবে, আপনি হিন্দুত্ববাদী কি না! কোন অন্তর্বাস আপনার পছন্দের, তাও জানিয়ে দেয় অনলাইন তথ্যভাণ্ডার। শ’দেড়েক লাইক থেকে কোনও মানুষ সম্পর্কে এমন তথ্য জানা যায়, যা তাঁর খুব কাছের লোকও জানেন না। ফেসবুক থেকেই জানা যাবে, আপনি হিন্দুত্ববাদী কি না! কোন অন্তর্বাস আপনার পছন্দের, তাও জানিয়ে দেয় অনলাইন তথ্যভাণ্ডার। শ’দেড়েক লাইক থেকে কোনও মানুষ সম্পর্কে এমন তথ্য জানা যায়, যা তাঁর খুব কাছের লোকও জানেন না।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৭ ০০:০০

বেচারা রবি ঠাকুর! যখন লিখেছিলেন, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’, ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন কি, কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি হবে এক দিন? তবে, নীরব নয়নে নয়, সব গোপন কথা ফুটে উঠবে কোনও ঠান্ডা ঘরে রাখা সার সার কম্পিউটারে স্ক্রিনে। তাতেই প্রকাশ হতে থাকবে আমাদের প্রত্যেকের একান্ত গোপন সব কথা। রাগ, লজ্জা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ভালবাসা— সব কিছু। সার্ভারে জমা হয়ে থাকবে আমাদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য। কম্পিউটার উগরে দেবে, জানতে চাইলেই। তার নাম দেবে ‘বিগ ডেটা’।

কতখানি গোপন তথ্য? কম্পিউটার জানিয়ে দেবে আপনার লিঙ্গপরিচয়, গায়ের রঙ, ধর্ম, ভাষা। জানিয়ে দেবে, আপনি কোন রোগে ভুগছেন, আপনি কোন রেস্তোরাঁয় খেতে পছন্দ করেন, অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখেন কি না, সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ আপনার কতখানি অপছন্দ। বলে দেবে, সোমবার রাতে আপনি কোথায় ছিলেন, অন্য দিনের তুলনায় আপনার মেজাজ সে দিন খারাপ ছিল কি না। নিখুঁত বলে দেবে, আপনি ভিন্ন মতের প্রতি কতখানি অসহিষ্ণু, কতখানি রক্ষণশীল, অপরিচিতের সঙ্গে কত সহজে মিশতে পারেন, কত দ্রুত রেগে যান। কম্পিউটার বলে দেবে, আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্প বা নরেন্দ্র মোদীকে ভোট দেবেন কি না, ব্রেক্সিটের পক্ষে সায় দেবেন কি না।

কী ভাবে, সেই গল্পে যেতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত ত্রিশটা বছর। ১৯৮০-র দশক। মনস্তত্ত্বের এক বিশেষ শাখা, সাইকোগ্রাফিক্‌স-এর গবেষণায় এক মস্ত মোড় ঘুরল। যার মূল কাজ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ। আশির দশকের শেষ ভাগে গবেষকরা তৈরি করে ফেললেন একটা নতুন মডেল। নাম OCEAN। মানুষের চরিত্রের পাঁচটি দিকের মাপকাঠি দিয়ে তৈরি মডেল, প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের আদ্যক্ষর জুড়ে তৈরি নাম। গবেষকরা জানালেন, ‘ওপেননেস’, অর্থাৎ কোনও নতুন অভিজ্ঞতা অথবা ‌ধারণার জন্য কারও মন কতখানি খোলা; ‘কনশিয়েনশাসনেস’, বা কোনও কাজের ব্যাপারে কেউ কতখানি খুঁতখুঁতে; ‘এক্সট্রোভার্সন’ বা সামাজিক পরিসরে মেলামেশা করতে কে কতখানি স্বচ্ছন্দ; ‘এগ্রিয়েব্‌লনেস’, অর্থাৎ অন্যের কথা বুঝতে এক জন কতখানি তৈরি; এবং ‘নিউরোটিসিজম’, অর্থাৎ কেউ কত সহজে রেগে যান, বিরক্ত হন, বিচলিত হন। এই পাঁচটি জিনিস জানতে পারলেই কোনও মানুষ সম্বন্ধে প্রায় সবটুকু বলে দেওয়া সম্ভব, সত্যিই। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন তার মোক্ষম প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু, সে কথা নাহয় যথাসময়ে বলা যাবে।

সাইকোগ্রাফিক্‌স-এর দুনিয়ায় এই মডেল— ‘বিগ ফাইভ পার্সোনালিটি টেস্ট’— ছিল বৈপ্লবিক। কিন্তু, একটা খুচরো সমস্যাও ছিল। কারও সম্বন্ধে এই কথাগুলো জানা যাবে কী ভাবে? একটাই উপায় ছিল জানার: বিপুল আকারের একটা প্রশ্নপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতে হত, উত্তরগুলো দিন। প্রশ্নগুলো, বুঝতেই পারছেন, খানিক বেমক্কা ছিল। অপরিচিত প্রশ্নকর্তার কাছে নিজের অতি ব্যক্তিগত সব কথা কে আর ফাঁস করতে চায়! ফলে, থমকেই ছিল ওশান-এর প্রয়োগ। তার পর ফেসবুক এল। আর এলেন মাইকেল কোসিনস্কি নামক এক পিএইচডি-র ছাত্র। ঢেউ উঠল ওশান-এ। উথালপাথাল হয়ে গেল দুনিয়া।

ওশান-এর মডেল যখন তৈরি হচ্ছে, কোসিনস্কি তখন নেহাত শিশু। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। তিনিই বদলে দিলেন সাইকোগ্রাফিক্‌স-এর খোলনলচে। ২০০৮ সালে পিএইচডি-র জন্য ডাক পেলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সাইকোমেট্রিক্‌স সেন্টার থেকে। সেখানেই ছিলেন আর এক পিএইচডি-র গবেষক, ডেভিড স্টিলওয়েল। কোসিনস্কি তাঁর প্রজেক্টে যোগ দিলেন। তখন সদ্য ফেসবুক জনপ্রিয় হচ্ছে। স্টিলওয়েল একটা অ্যাপ তৈরি করেছিলেন— ‘মাইপার্সোনালিটি’। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হত সেখানে। প্রায় সব উত্তরই ঠিক-ভুল, অথবা একদম ঠিক-ঠিক-ঠিকও নয় ভুলও নয়-ভুল-একদম ভুল— এই ছকে বাঁধা থাকত। বিগ ফাইভ পার্সোনালিটি টেস্টের প্রশ্ন। যেমন, ‘আমি খুব সহজে রেগে যাই’ অথবা ‘আমি অচেনা মানুষের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ নই’— এই উক্তিগুলো তাঁর জন্য কতখানি প্রযোজ্য, মাইপার্সোনালিটি অ্যাপে সেই কথা জানাবেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা, আর সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁদের বিগ ফাইভ প্রোফাইল তৈরি হবে, তেমনই বাসনা ছিল স্টিলওয়েল আর কোসিনস্কির। অবশ্য, সেই বিশ্লেষণ জানিয়ে দেওয়া হবে উত্তরদাতাকেও।

তাঁদের হিসেবে অবশ্য একটা ভুল হয়েছিল। তাঁরা অনুমান করেছিলেন, বড় জোর কয়েক ডজন বন্ধুবান্ধব আর পরিচিত লোকজন উত্তর দেবেন তাঁদের প্রশ্নগুলোর। কিন্তু দেখা গেল, বাঁধ ভেঙে বন্যার মতো উত্তর এসেই চলল। কয়েকশো বা হাজার নয়, কয়েক লক্ষ মানুষ স্বেচ্ছায় উত্তর দিলেন তাঁদের সব প্রশ্নের। যে ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না বলে প্রায় কুড়ি বছর আটকে ছিল ওশান মডেল, ফেসবুকে হঠাৎই সেই উত্তরের প্লাবন এল। যে কথা কোনও মানুষকে বলা যায় না, কি-বোর্ডের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্রয়ে তা প্রকাশ করতে কম অস্বস্তি হয়েছিল বলেই কি? নাকি, নিজেকে যে মানুষ বলে চিনি, কম্পিউটারের অ্যাপও তাকে চিনতে পারে কি না, সেটা দেখার কৌতূহল? স্টিলওয়েল আর কোসিনস্কির সামনে আলিবাবার গুহা খুলে গেল।

লক্ষ লক্ষ উত্তর বিশ্লেষণ করে তাঁরা তৈরি করে ফেললেন প্রত্যেক উত্তরদাতার বিগ ফাইভ প্রোফাইল। এ বার শুরু অন্য কাজ। সেই প্রতিটি লোক সম্বন্ধে অনলাইন দুনিয়ায়— মূলত ফেসবুকে— আর যা তথ্য পাওয়া গেল, সেগুলোর বিশ্লেষণও আরম্ভ হল। যেমন, কোনও উত্তরদাতা ফেসবুকে কোন পেজগুলোকে লাইক করেছেন, তার সঙ্গে সেই উত্তরদাতার বিগ ফাইভ প্রোফাইলের ম্যাপিং আরম্ভ হল। এমন দরজা খুলল, যা দিয়ে দেখে ফেলা যায় মানুষের মনের গহনতম প্রান্তও। দেখা গেল, শুধুমাত্র ‘ফেসবুক লাইক’ বিশ্লেষণ করেই বলে দেওয়া যায় কোন মানুষটি কেমন। তৈরি করে ফেলা যায় তার বিগ ফাইভ প্রোফাইল। আলাদা করে কোনও প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার দরকার পড়ে না। কী রকম? কোসিনস্কি জানিয়েছেন, গড়ে মাত্র ৬৮টা ‘ফেসবুক লাইক’ বিশ্লেষণ করেই বলে দেওয়া যায়, প্রোফাইলের মালিক সাদা চামড়ার না কি কালো বা বাদামি (৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে উত্তরটা ঠিক হয়), তিনি সমকামী না বিষমকামী (উত্তর ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ৮৮ শতাংশ), তিনি ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক না কি রিপাবলিকানদের (৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব)। শুধু ‘ফেসবুক লাইক’-এর ভিত্তিতেই প্রায় নিখুঁত বলে দেওয়া যায়, প্রোফাইলের মালিক কতখানি বুদ্ধিমান, কতখানি আবেগপ্রবণ, তাঁর ধর্ম কী, মাদকাসক্তি আছে কি না। এমনকী, তাঁর বাবা-মা বিবাহবিচ্ছিন্ন কি না, বলে দেওয়া যায় তা-ও।

কোসিনস্কি জানিয়েছেন, কোনও এক জনের বন্ধুরা তাঁর সম্বন্ধে যতটুকু জানে, ফেসবুকের গোটা সত্তর ‘লাইক’ বিশ্লেষণ করলেই তার চেয়ে বেশি জেনে নেওয়া সম্ভব। ১৫০ লাইক থেকে জানা যায় তা-ও, যে কথা বাবা-মা অবধি জানেন না। ৩০০ লাইক বিশ্লেষণ করলে যত গভীরে যাওয়া যাবে— কোসিনস্কির মতে— স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকাও পরস্পরের বিষয়ে তত কথা জানেন না। যদি আরও তথ্য পাওয়া যায়? এক সাক্ষাৎকারে কোসিনস্কি বলেছিলেন, ‘তা হলে কারও সম্বন্ধে এমন কিছু কথাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব, যার অস্তিত্ব সেই মানুষটি নিজেও জানেন না।’

মানবসভ্যতার ইতিহাসে সিআইএ-কেজিবি যা পারেনি, অসীম প্রভাবশালী একনায়কের পক্ষে যা সম্ভব হয়নি, কম্পিউটারের সামনে বসে সেই অসাধ্যসাধন করে ফেললেন কোসিনস্কি। মানুষের মন পড়ার নিখুঁত যন্ত্র তৈরি করে ফেললেন। বাকিটা করল ডিজিটাল সভ্যতা। নরেন্দ্র মোদী ভারতকে যে ডিজিটাল দুনিয়ার অংশ করে তোলার স্বপ্ন দেখান আমাদের। ডিজিটাল দুনিয়ায় আমাদের পায়ের ছাপ অনপনেয়। গুগ্‌ল-এ যা সার্চ করছি, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যা কিনছি, ইনস্টাগ্রামে যে ছবি আপলোড করছি, যেখানে যেখানে চেক-ইন করছি, জিপিএস আমাদের যে ঠিকানা থেকে যে ঠিকানায় যেতে দেখেছে— সব তথ্য জমা হয়ে থাকছে আমাদের নামে। এমনকী, পকেটে থাকা মোবাইল ফোন মেপে দিচ্ছে আমাদের হাঁটার গতি, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, মেজাজ কেমন আছে। কোসিনস্কি-উত্তর দুনিয়ায় সেই তথ্য ঘেঁটেই নিখুঁত ভাবে আমাদের মূর্তি গড়ে দেয় সেই বিগ ডেটা।

আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা আর সুরক্ষিত নয়, সব তথ্য পেয়ে যাবে পুলিশ!

কেজিবি-সিআইএ যা পারেনি, কেন আজ তা জলের মতো সহজ, এই প্রশ্নের একটাই উত্তর হয়। এত দিন অবধি মানুষ তথ্য গোপন করত, তার পক্ষে যতখানি সম্ভব। আর এখন আমরা নিজেরাই জানিয়ে চলেছি যা কিছু জানানোর, এমনকী যা কিছু কখনও জানানোর নয়, তা-ও। কিছু জেনেবুঝে, আর অনেক তথ্যই ফাঁস হয়ে চলেছে আমাদের অজ্ঞাতসারে বা সতর্কতার অভাবে। আসলে, রাষ্ট্র যখন আমাদের সম্বন্ধে তথ্য খোঁজে, তখন আমরা বিপদ দেখতে পাই অনেক সহজে। আর সেই তথ্যই যখন জমা হতে থাকে নৈর্ব্যক্তিক সার্ভারে, সেই বিপদ দেখতে পাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন। এমনকী, গুগ্‌লে চিংড়ির মালাইকারির রেসিপি সার্চ করার পরেই যখন ফেসবুকে সাজেস্টেড পেজ হিসেবে কলকাতার কোনও বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপন আসতে থাকে, অথবা গুগ্‌ল ম্যাপ যখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানিয়ে দেয়, শহরের যে প্রান্তের রাস্তা ধরে আপনার গাড়ি চলছে সেখানে ট্রাফিকের হালহকিকত কেমন, তখনও আমরা ভেবে দেখি না, কতখানি নজরদারির মধ্যে রয়েছি নিরন্তর। একেবারে ‘রিয়াল টাইম’ নজরদারি, অজস্র অতন্দ্র চোখের সামনে।

বিজ্ঞাপনের দুনিয়াকে তুমুল বদলে দিচ্ছে বিগ ডেটা। সব সম্ভাব্য ক্রেতার জন্য এক বিজ্ঞাপনের আর কোনও প্রশ্নই নেই। যাঁরা সম্ভাব্য ক্রেতা নন, তাঁদের জন্যও বিজ্ঞাপন দেওয়ার দরকার নেই। অনলাইন দুনিয়ায় হাজির, এমন প্রত্যেকটি মানুষকে খাপে খাপে সাজিয়ে রাখছে বিগ ডেটা। কে দার্জিলিং চা কিনতে পারে আর কার পক্ষে কেনা সম্ভব ফিনফিনে অন্তর্বাস, কার কাছে শিশুদের উন্নতিকল্পে সাহায্য পাওয়া সহজ হবে আর কাকে টেনে আনা যাবে অনলাইন তিনপাত্তির আলো-আঁধারি ঘুপচিতে, বিগ ডেটার কল্যাণে তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায় এখন। ফলে, ডিজিটাল মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতাদের ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। আরও বেশি টার্গেটেড, আরও বেশি মাইক্রো বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে। হয়তো আর কিছু দিনের মধ্যেই প্রত্যেকটি মানুষের জন্য তৈরি হবে আলাদা আলাদা বিজ্ঞাপন। যে যেমন মানুষ, ঠিক তেমনটি করে। ভেবে দেখলে, আমাদের কাছে আমাদেরই বিক্রি করছেন এই বিজ্ঞাপনদাতারা। মানে, আমরা ঠিক যা, তাঁদের পণ্যকেও ঠিক তেমনটাই করে তুলছেন তাঁরা।

আসলে, তাঁদের পণ্য যা, তার জন্য একেবারে খাপে খাপে মিলে যাওয়া মানুষদের খুঁজে নিচ্ছেন বিজ্ঞাপনদাতারা। ভাবতেই পারেন, বিগ ডেটা আসলে তৈরি করে দিয়েছে একটা আশ্চর্য সার্চ ইঞ্জিন, যেখানে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লিখে সার্চ করলে উত্তরে কম্পিউটার উগরে দিচ্ছে কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ-কোটি মানুষের নাম-ঠিকানা, ইমেল, ফোন নম্বর, ছবি। রক্তমাংসের মানুষ। আমি, আপনি, আমরা। এ বার শুধু আমাদের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পালা।

শুধু কি তেল-সাবান, জামাকাপ়ড়, যৌনক্ষমতাবর্ধক বড়ি আর মোবাইল ফোনই বিক্রি করা সম্ভব এই ভাবে? আলেকজান্ডার জেমস অ্যাশবার্নার নিক্স নামক এক ব্রিটিশ সাহেব এই কথা শুনলে মুচকি হাসবেন। ২০১৬ সালের সবচেয়ে সাড়া জাগানো দুটো ঘটনার পিছনে রয়েছে তাঁর সংস্থা, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। ঘটনা দুটো যথাক্রমে ব্রেক্সিট আর মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়। তাঁর অবদান ঠিক কতখানি, তা নিয়ে তর্ক চলবে। কিন্তু, নিক্স দাবি করছেন, দুটো ঘটনাই ঘটেছে তাঁর সংস্থার বিগ ডেটা ব্যবহারের গুণে। মুখের রেখা একটুও না কাঁপিয়ে নিক্স বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০ কোটি ভোটারের প্রত্যেকের বিগ ফাইভ প্রোফাইল রয়েছে তাঁর সংস্থার কম্পিউটারে। বিপুল টাকা খরচ করে বিভিন্ন সংস্থা থেকে হরেক তথ্য কিনেছেন তিনি— সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য, কে কোন গাড়ি চালান সেই খবর, শপিং, ক্লাব মেম্বারশিপ, কে কোন ম্যাগাজিন পড়েন, কে কোন চার্চে যান, সব তথ্য। তার পর, সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তাকে বসিয়েছেন ভোটারদের তালিকায়। অর্থাৎ, ভোটার তালিকার প্রতিটা নাম আসলে তাঁর পরিচিত মানুষ। তিনি জানেন, কে অভিবাসীদের ভয় পায়, কার মুসলমান-বিদ্বেষ কতখানি, কে আজও বিশ্বাস করে না ডারউইনের তত্ত্বে।

এবং, তিনি জানেন, কার কাছে কী ভাবে বিক্রি করা যাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। নিক্স হাসতে হাসতে বলেছেন, প্রত্যেক মহিলার জন্য একই বার্তা, প্রত্যেক কালো আমেরিকানের জন্য অভিন্ন কথা— এ ভাবে প্রচার হয় নাকি! প্রত্যেকের জন্য আলাদা বার্তা তৈরি করাই ডিজিটাল দুনিয়ার বিজ্ঞাপনের মূল কথা। নিক্স অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন সেই শর্ত। হোয়াইট হাউস জানে, নিক্স সে খেলায় হারেননি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন, ব্রেক্সিটের প্রধানতম প্রবক্তা নাইজেল ফারাজ জানেন, নরেন্দ্র মোদীও জানেন, মেরুকরণের বাড়া অস্ত্র নেই। নরমপন্থীদেরও যত দ্রুত উগ্রপন্থী করে তোলা যায়, যত সরিয়ে নেওয়া যায় যুক্তির পথ থেকে, জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কাস্টমাইজ্‌ড বার্তা সেই কাজটাই করতে পারে। বিগ ফাইভ প্রোফাইল থেকে যার মধ্যে হিন্দুত্ববাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনের লক্ষণ পাওয়া যায়, তার কাছে প্রতি দিন হিন্দুদের বিরুদ্ধে হওয়া সত্যি— এবং অতি অবশ্যই কাল্পনিক— ঘটনার ফিরিস্তি পাঠিয়ে, মুসলমানদের পাওয়া অন্যায্য সুবিধার তালিকা দিয়ে, হিন্দুদের বঞ্চনার কথা বলে তাকে করে তোলা যায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী। নাইজেল ফারাজরা যেমন জানতেন, অভিবাসীরা এসে ইংল্যান্ডের সব চাকরি দখল করে নেবে, এ কথাটা বার বার বলে গেলে অভিবাসন-বিরোধীদের মধ্যে উগ্রতা ক্রমে বাড়তেই থাকবে। আলেকজান্ডার নিক্সদের কাজই হল এই উগ্রতা বাড়িয়ে, বিভাজনগুলোকে তীব্রতর করে তোলা। ভোটের বাজারে তার মাহাত্ম্য প্রশ্নাতীত।

তার জন্য মিথ্যে কথা বলতে হলে হবে। তথ্যগত ছলচাতুরি তো বটেই, ডাহা মিথ্যে বলতেও পিছপা নয় এই কাস্টমাইজ্‌ড বিজ্ঞাপন। একটা মিথ্যে কী ভাবে ‘সত্যি’ হয়ে উঠতে পারে, কী ভাবে গোটা দুনিয়া হয়ে উঠতে পারে ‘পোস্ট-ট্রুথ’, আচরণগত অর্থনীতিতে তার দুর্ধর্ষ ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু, সে প্রসঙ্গান্তরের কথা। আপাতত শুধু এটুকু ভাবার, কী ভাবে আমাদের কাছে আমাদেরই ছবি বিক্রি করে দুনিয়ার অধীশ্বর হয়ে উঠতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদীরা।

‘গোপন কথাটি’ নিয়ে আর কোনও গান আর কখনও লেখা হবে কি? ‘গোপন কথা’টাই যে বিলুপ্ত হয়ে গেল এই ডি়জিটাল দুনিয়ায়!

Facebook Secret
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy