Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আশ্চর্য প্রেমিক, অনন্য লেখক

বিমান চালানো ছিল তাঁর নেশা। স্ত্রীকে ভালবেসেও দূরে সরিয়ে রেখেছেন, জড়িয়েছেন অন্য সম্পর্কে। পাশাপাশি চলেছে উপন্যাস, কবিতা লেখা। বিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যিকদের অন্যতম তিনি, আঁতোয়ান দ্য সঁতেক্সুপেরি। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। বিমান চালানো ছিল তাঁর নেশা। স্ত্রীকে ভালবেসেও দূরে সরিয়ে রেখেছেন, জড়িয়েছেন অন্য সম্পর্কে। পাশাপাশি চলেছে উপন্যাস, কবিতা লেখা। বিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যিকদের অন্যতম তিনি, আঁতোয়ান দ্য সঁতেক্সুপেরি। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন।

খামখেয়ালি: নিজের বিমানে আঁতোয়ান দ্য সঁতেক্সুপেরি। ছবি: গেটি ইমেজেস

খামখেয়ালি: নিজের বিমানে আঁতোয়ান দ্য সঁতেক্সুপেরি। ছবি: গেটি ইমেজেস

রাহুল দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সময়টা ১৯৩০। প্যারিস থেকে বুয়েনস আইরেসে পৌঁছলেন কনসুয়েলো সানচিন। মেয়েটির জন্ম এল সালভাদোরে, বিয়ে হয়েছিল আর্জেন্টিনার কূটনীতিক এনরিক গোমেজ কারিল্লোর সঙ্গে। মাত্র এগারো মাসের বিবাহিত জীবন, তার পরই হঠাৎ মারা যান বছর পঞ্চাশের মানুষটি। উনত্রিশ বছর বয়সি স্ত্রীর জন্য রেখে যান অঢেল সম্পদ। কনসুয়েলোর এক বন্ধু তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক বিমানচালকের। নাম, আঁতোয়ান দ্য সঁতেক্সুপেরি। কয়েক বছরের মধ্যেই যার নাম জঁ পল সার্ত্র, আলব্যের কাম্যু, আদ্রেঁ মালরোঁ, জঁ জেনে, লুই ফেরদিন সেলিন প্রমুখ বিশ শতকের দিকপাল ফরাসি লেখকদের সঙ্গে এক সঙ্গে উচ্চারিত হবে। ‘দি লিটল প্রিন্স’ লিখে গোটা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দেবেন যিনি, তখনও পর্যন্ত লেখক হিসাবে তিনি নিতান্তই অপরিচিত।

প্রথম দেখাতেই কনসুয়েলোর প্রেমে পড়ে যান সঁতেক্সুপেরি। তাঁকে বিমানে চাপিয়ে সূর্যাস্ত দেখানোর প্রস্তাব দেন। বিমান চালাতে চালাতেই নিজের সম্পর্কে অনেক কথা বলে যান তিনি। তখনও পর্যন্ত তাঁর একটিমাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে, ‘সাদার্ন মেল’। মাত্র তিন কপি বিক্রি হয়েছে। সাহারা মরুভূমিতে তাঁর বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই। সঁতেক্সুপেরির হাতগুলো দেখে কনসুয়েলোর মনে পড়ে রাফায়েলের ছবির কথা। তাঁকে চুমু খান সঁতেক্সুপেরি। তার পর, চলন্ত বিমানেই বিয়ের প্রস্তাব দেন কনসুয়েলোকে।

এর পর থেকে দু’জনের জীবনই ভরে উঠতে থাকে নানান নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতে। যে রাতে তাঁদের এনগেজমেন্ট পার্টি চলছে, হঠাৎ জরুরি কারণে সঁতেক্সুপেরিকে বিমান নিয়ে উড়ে যেতে হয়। বুয়েনস আইরেসে বিপ্লবও শুরু হয় তার পর। কনসুয়েলো আগেও বিপ্লব দেখেছেন, মেক্সিকোয়— পনেরো বছর বয়সে। তাঁর মনে হয়, সঁতেক্সুপেরি যেন সেই বন্য পাখি, আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে যে উড়ে চলেছে। অথচ কনসুয়েলোকে হতে হবে সেই বাগান, যেখানে মনের মানুষটি আলো দেবেন, শেকড় প্রোথিত করবেন।

কিছু দিন পর প্যারিসে ফিরে আসেন কনসুয়েলো। সঁতেক্সুপেরির সঙ্গে তখন তাঁর এনগেজমেন্ট ভেঙে গেছে! বিয়ে ঠিক হয়েছে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে। ঠিক এই সময়েই ফের সঁতেক্সুপেরির ফোন। কনসুয়েলোর সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁকে উন্মাদ করে দিয়েছে। কনসুয়েলোও টের পান, আসলে তিনি ভালবাসেন এই মানুষটিকেই। এই মানুষটি ছাড়া সব কেমন শান্ত, একঘেয়ে। তাঁর জীবনে আবার ফিরে আসেন সঁতেক্সুপেরি। প্রেমিক নাকি শুধু দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর শক্তি কনসুয়েলোকে কত দূর নিয়ে যায়! কনসুয়েলো প্রমাণ করে দিয়েছেন, তাঁকে ছাড়াও নিজের মতো করে বাঁচার শক্তি তাঁর আছে। ১৯৩১ সালের ২৩ এপ্রিল বিয়ে হয় তাঁদের। এই সময়েই দেখা নোবেলজয়ী মরিস মেতারলিংকের সঙ্গে। সঁতেক্সুপেরি তাঁকে বলেন, ‘‘লেখার মধ্য দিয়ে আমি আমার সমস্ত অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে চাই। লেখাই আমাকে দেয় চিন্তা করার অধিকার।’’ ‘নাইট ফ্লাইট’ লেখা শেষ করেন এর পর। এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন আঁদ্রে জিদ। ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন কবি পল ভালেরি-ও।

মরক্কোয় থাকার সময় দু’টি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। কনসুয়েলোকে নিয়ে সঁতেক্সুপেরির মনে একই সঙ্গে খেলা করে ঈর্ষা ও অধিকারবোধ। এক দিন প্লেন নিয়ে বেরিয়েও মাঝরাতে ফিরে আসেন, কনসুয়েলো অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন কি না, তা দেখার জন্য। আর এক বার কনসুয়েলো খবর পান, আঁতোয়ান নামের এক বিমানচালকের বিমান ভেঙে পড়েছে। ছুটতে ছুটতে গিয়ে যখন জানতে পারেন এ এক অন্য আঁতোয়ান, তখন তিনি পাগলের মতো হাসতে থাকেন। খেয়ালই করেন না, পাশেই মৃত বিমানচালকের স্ত্রী কেঁদে চলেছেন। শেষে মরফিন দিয়ে শান্ত করতে হয় দু’জনকেই।

রাশিয়া ভ্রমণের সময় ম্যাক্সিম গোর্কি নামে একটি বিমান ভেঙে পড়ে, যে বিমানে থাকার কথা ছিল সঁতেক্সুপেরির। কিন্তু এক দিন আগেই তিনি চলে যাওয়ায় রক্ষা পেয়ে যান। এক বার খবর এল, প্যারিস থেকে সাইগন যেতে গিয়ে তাঁর বিমান হারিয়ে গেছে। ১৯৩৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর, লিবিয়ার মরুভূমিতে সঁতেক্সুপেরির বিমান ভেঙে পড়ে। চার দিন ধরে তিনি মরুভূমির মধ্যে হাঁটতে থাকেন। শেষে বেদুইনরা তাঁকে দেখতে পায়, বেঁচে যান তিনি। এর কিছু দিন পরে কনসুয়েলো গুয়াতেমালায় নিজের বাড়িতে পৌঁছে জানতে পারেন, গুয়াতেমালাতেই বিমান ভেঙে সঁতেক্সুপেরি গুরুতর আহত, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কনসুয়েলোকে তাঁর কাছে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে আসার ব্যবস্থা হয়। কিছু দিন কাটিয়ে কনসুয়েলো ফিরে আসেন প্যারিসে।

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কনসুয়েলোর মা চেয়েছিলেন, মেয়ে ইউরোপ ছেড়ে তাঁর কাছে নিরাপদে এসে থাকুক। সঁতেক্সুপেরি শুনে শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন। কনসুয়েলোকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন এই সঙ্কটকালে ফ্রান্স ছেড়ে না যান। কনসুয়েলো তা-ই করেন। সঁতেক্সুপেরি চলে যান উত্তর আফ্রিকা। কয়েক দিন পরে কনসুয়েলো অন্য এক বিমানচালকের কাছ থেকে জানতে পারেন, তাঁর স্বামী ফ্রান্সে ফিরে এসেছেন! কনসুয়েলোকে কিছুই জানাননি। কনসুয়েলো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান এক হোটেলে। সঁতেক্সুপেরি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। জেগে উঠে কনসুয়েলোকে তিনি ফিরে যেতে বলেন। অত রাতে কোনও ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, অন্ধকারে রাস্তা আর মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে ফিরতে হবে, স্ত্রীর কোনও যুক্তিই মানতে রাজি হননি তিনি!

কনসুয়েলো যখন ঠিক করে ফেলেছেন এই দাম্পত্য থেকে পুরোপুরি সরে যাবেন, তখনই আবার স্বামীর একটি চিঠি পান। সঁতেক্সুপেরির সঙ্গে দেখা করে এক মেজরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা জানান কনসুয়েলো। সঁতেক্সুপেরি মেজরের ফোন নম্বর চেয়ে বলেন, তুমি বসো, আমি ওঁকে সব বুঝিয়ে বলে আসছি। এক ঘণ্টা পর ফিরে এসে কনসুয়েলোকে বলেন, ‘‘মেজর সব শুনে খুবই আপসেট, উনি আর তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান না।’’ পরে হাসতে হাসতে কনসুয়েলোকে জানিয়েছিলেন সঁতেক্সুপেরি, মেজরকে সে দিন তিনি কোনও ফোনই করেননি!

প্রায় এক বছর পর কনসুয়েলো পৌঁছন নিউ ইয়র্কে। আশ্চর্য, স্বামী তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন উল্টো দিকের আর এক হোটেলে! কনসুয়েলোর ঘর থেকে তাঁর স্বামীর ঘর দেখা যেত, সেখানে অবিরত চলত বহু সুন্দরী মেয়ের আনাগোনা। নিউ ইয়র্কে প্রথম কিছু দিন কনসুয়েলোর পরিচয় ছিল সঁতেক্সুপেরির পরিচারিকা হিসাবে। টাউন হলের এক কনসার্টে প্রথম তাঁরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে প্রকাশ্যে আসেন। বিরতির সময় স্ত্রীকে একা ফেলে রেখে চলে যান সঁতেক্সুপেরি। কনসুয়েলোর সঙ্গে একটা পয়সাও ছিল না, আশেপাশে পরিচিত কেউও নেই। সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে তিনি ফিরে আসেন। এর কিছু দিন পর স্ত্রীকে ট্রেনে তুলে দেন সঁতেক্সুপেরি। কনসুয়েলো শেষ স্টেশনের টিকিট কাটেন। নর্থপোর্টে পৌঁছে একটি বাড়ি ভাড়া নেন। কিছু দিন পর সেখানে আসেন সঁতেক্সুপেরি। নর্থপোর্টের বাড়িতেই তিনি লেখা শেষ করেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। ১৯৪৩-এ প্রকাশিত হয় এই ছোট্ট উপন্যাস বা নভেলা, পাঠকের রায়ে যে বই পেয়েছে বিশ শতকের সেরা ফরাসি বইয়ের শিরোপা, অনূদিত হয়েছে তিনশো ভাষায়।

১৯৪৪ সালের ৩১ জুলাই, তাঁর বিমান নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান সঁতেক্সুপেরি। আর ফিরে আসেননি। সঁতেক্সুপেরি কনসুয়েলোকে বলতেন, ‘‘মা যেভাবে সন্তানকে বোঝে, ভালবাসে, তুমিও আমাকে সে ভাবেই বোঝো, ভালবাসো। তুমি হয়ে ওঠো সেই বন্দর, প্রচণ্ড ঝড়ের সময় আমি যেখানে আশ্রয় নিতে পারি। তোমার মহিলা বন্ধুরা আমাদের সম্পর্ক নিয়ে তোমার কানে কত বিষ ঢেলেছে। কিন্তু

তুমি আমাকে ঠিক বুঝেছ আর ভালবেসে গেছ। তোমার ত্যাগ আমি ভুলিনি। তুমি এক মহান

কবি, কনসুয়েলো। যদি চাইতে, আমার চেয়ে অনেক বড় লেখক হতে পারতে তুমি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Antoine de Saint-Exupery Writer Aviator French
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE