Advertisement
E-Paper

দাইমা

গুণবালা বর্মন। ছিপছিপে চেহারা। উচ্চতা মাঝারি। গলায় সরু রুপোর চেন। দু’হাতে রংচটা সোনালি চুড়ি। দু’চোখে প্রত্যয়। সত্তর ছুঁয়েও তিনি ক্ষিপ্র। ব্লাউজের ভেতর মোবাইলটা সেঁধিয়ে দিতে দিতেই উঠে পড়েন কারও সাইকেলের পিছনে কিংবা ভ্যানরিকশয়— ‘দেরি হয়ে গেলে কেস জটিল হয়ে যায়, ঝুঁকি বাড়ে।’

দীপংকর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০৬

গুণবালা বর্মন। ছিপছিপে চেহারা। উচ্চতা মাঝারি। গলায় সরু রুপোর চেন। দু’হাতে রংচটা সোনালি চুড়ি। দু’চোখে প্রত্যয়। সত্তর ছুঁয়েও তিনি ক্ষিপ্র। ব্লাউজের ভেতর মোবাইলটা সেঁধিয়ে দিতে দিতেই উঠে পড়েন কারও সাইকেলের পিছনে কিংবা ভ্যানরিকশয়— ‘দেরি হয়ে গেলে কেস জটিল হয়ে যায়, ঝুঁকি বাড়ে।’

কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমার এক প্রত্যন্ত প্রান্ত পুখিহাগা। সেখান থেকে আরও দেড় কিলোমিটার হেঁটে (সাইকেল বা বাইক ছাড়া কিছুই এখানে চলে না, পথ বলতে সরু আলপথ, কখনও সামান্য চওড়া) পৌঁছনো যায় গুণবালার গ্রামে। ‘ইন্দ্রের কুঠি’। এখানকার প্রায় সকলেই চাষ করেন, কেউ মাথাভাঙায় দোকানে কাজ করেন, কেউ অন্যের অটো চালান। গিলাভাঙা, ধানের ডাঙা, নিত্যানন্দ— আশপাশে প্রায় সব গ্রামেরই একই হালচাল। গ্রামগুলির সবাই এক ডাকে চেনে গুণবালাকে। কারণ তিনিই এই বিরাট এলাকার একমাত্র দাইমা। এ পর্যন্ত প্রসব করিয়েছেন হাজারের বেশি প্রসূতির। ৩৭ বছর আগে প্রথম হাত দিয়েছিলেন কাজে, সেই সদ্যোজাত এখন শক্তপোক্ত জোয়ান, ধনবর বর্মন। থাকেন গুণবালার কয়েক ঘর আগে। ‘ছোট মা’ ডাকেন গুণবালাকে।

শিক্ষিত-শহুরে নাগরিক যতই নাক কুঁচকোন, আজও গোটা দেশ জুড়ে জড়িয়ে আছেন ধাত্রী-জননীরা। ঠিকঠাক তথ্য নেই, তবে বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, এ দেশে লক্ষাধিক মানুষ এখনও নিয়মিত দাইয়ের কাজ করেন। গুণবালা প্রথম যৌবনে জেঠিমা ফুলমতির কাছে হাতেনাতে কাজ শিখেছেন। ‘ডাক’ এলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন জেঠি। তিনিই তখন এ তল্লাটে একমাত্র ধাত্রী। জেঠি যখন চলে গেলেন, গুণবালার বয়স
বছর পঁয়ত্রিশ। সেই থেকেই তাঁর দাইমা হওয়া, পাকাপাকি। রাত-বিরেতেই ‘কল’ আসে বেশি। পার্টি সাইকেল বা মোটরবাইক আনলে উঠে পড়েন তাতেই। কখনও বা ভরসা দুটো পা। আর পারিশ্রমিক? ‘যে যা দেয়। কেউ বিশ, কেউ পঞ্চাশ, কেউ একশো। সঙ্গে শাড়ি একখানা। কারও কাছে দাবি করি না কিছু।’

এখন তো বাড়িতে প্রসব করানো ঠিক নয়। কেন তবে এ কাজ করেন? গুণবালার দৃঢ় উত্তর, ‘কল না এলে তো আমি যাই না। লোকে আমাকে ডাকে কেন? ওরা ভরসা করে, তাই ডাকে। সব জেনেশুনে বাড়িতে বসে থেকে তো একটা প্রাণ মেরে দিতে পারি না!’

‘তবে পেশেন্ট দেখলেই আমি বুঝতে পারি, কেস বাড়িতে হবে না রেফার করতে হবে হাসপাতালে। তেমন বুঝলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই, সময় নষ্ট করি না। জীবন বাঁচানোই তো ধম্ম।’ হাসপাতাল, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই তাঁর। সিস্টার-দিদিরাই যে তাঁকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন আরও ভাল, নিরাপদ, ঝুঁকিহীন প্রসবপদ্ধতি।

নিজের কথা জিজ্ঞেস করলে একটু ব্যথিত দেখায় তাঁকে। ‘প্রথম ছেলেটা মরে গেল সাত বছর বয়সে। তার পর সে মানুষটা (স্বামী)। ছোট জন আলাদা থাকে। আমি একা। একা থাকাই ভাল, জানেন, তা হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা যায়। এ কাজে পরিষ্কার থাকাটাই মেন। যখন ট্রেনিং নিলাম, হেল্‌থ ‌সেন্টারে ডাক্তার-দিদিরাও বলে দিয়েছেন। দেখুন আমার হাত, নখ...’ গুণবালা তার পর নরম স্বরে বলেন, ‘আমিই শেষ দাই এখানে, জানেন! নাতনি (ছোট ছেলের মেয়ে) ইস্কুলে পড়ে। বারো ক্লাস। ওরা কেউ এ সব শিখবে না।’

bengdbcu@gmail.com

mid-wife dipankar bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy