Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
John Herschel

চাঁদের বুকে উড়ে বেড়ায় বাদুড়-মানব

তাদের মধ্যেও আছে উন্নত প্রজাতি। অনেকটা কল্পনার দেবদূতের মতো দেখতে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন হার্শেল নাকি তাদের দেখেছেন তাঁর ২৮৮ ইঞ্চির টেলিস্কোপে। ফলাও করে খবর ছেপেছিল এক মার্কিন পত্রিকা। ১৮৫ বছর আগে বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ভুয়ো খবরের এই কেলেঙ্কারি। চঞ্চল পালখবরে আরও বলা হল, জন হার্শেল নতুন ধরনের টেলিস্কোপ উদ্ভাবন করতে পেরেছেন বলেই এই যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে।

১৮৩৫ সালে নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ পত্রিকায় প্রকাশিত চাঁদের বাদুড়-মানব। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

১৮৩৫ সালে নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ পত্রিকায় প্রকাশিত চাঁদের বাদুড়-মানব। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২০ ০০:৫০
Share: Save:

নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হেডলাইনটি আলোড়ন ফেলে দিল শহরে। ‘জ্যোতির্বিজ্ঞানের চমকে দেওয়া আবিষ্কার’— চাঁদে মিলল প্রাণের সন্ধান! আবিষ্কর্তা যে সে লোক নন, তখনকার দিনের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন হার্শেল। তাঁর ২৮৮ ইঞ্চি শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে দক্ষিণ আকাশ পর্যবেক্ষণ করার সময়েই নাকি এই আবিষ্কার। খবরে আরও প্রকাশ, এই আবিষ্কারের বিস্তারিত বিবরণ ‘এডিনবরা জার্নাল অব সায়েন্স’ নামক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছে এবং এখন থেকে এটার ধারাবাহিক পুনর্মুদ্রণের অধিকার একমাত্র নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ পেয়েছে। যাই হোক, প্রাণের ব্যাপারে প্রথম দিনের খবরে স্পষ্ট করে বলা না হলেও, সেখানকার পাহাড়, নদী, জঙ্গল কেমন হতে পারে তা সুন্দর করে ছবি-সহ বোঝানো ছিল। তারিখটি ২৫ অগস্ট, ১৮৩৫। সারা দিন শহরের প্রতিটি লোকের মুখে একটাই কথা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা, সবার চোখেই বিস্ময় আর উত্তেজনা। কেউ সেদিনকার ‘দ্য সান’ জোগাড় করতে পারলেই কাড়াকাড়ি পড়ে যাচ্ছে। রাত বেড়ে চলেছে, তাও ওই খবরের কাগজের অফিসের নীচে ভিড় আর কমছেই না।

খবরে আরও বলা হল, জন হার্শেল নতুন ধরনের টেলিস্কোপ উদ্ভাবন করতে পেরেছেন বলেই এই যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। কৃত্রিম আলোক-উৎসের সাহায্যে চাঁদের প্রতিবিম্বকে একশো গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করার উপায় তিনিই প্রথম আবিষ্কার করলেন।

সে সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ স্যর উইলিয়ম-এর ছেলে জন হার্শেলের অসাধারণ বিজ্ঞান-প্রতিভার কথা বিশ্বের কেউই অস্বীকার করতে পারত না, আমেরিকাবাসীরা তো নয়ই। পিতা-পুত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানের বহু বিস্ময়কর তথ্য সামনে এনেছেন। শুধু টেলিস্কোপ দিয়েই স্যর উইলিয়ম কিছু দিন আগে ইউরেনাস গ্রহ আর শ’খানেক নতুন নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন। সুতরাং তাঁর সুযোগ্য পুত্র যে চাঁদে প্রাণের সন্ধান দেবে, এ আর আশ্চর্য কী! দুরুদুরু বুকে সবাই অপেক্ষা করতে লাগল পরবর্তী খবর জানার জন্যে।

পরের দিন দ্বিতীয় খবর— হার্শেল ও তাঁর সহকর্মী গ্রান্ট তাঁদের ১৪,৮২৬ পাউন্ডের প্রকাণ্ড লেন্সটিকে অবশেষে চাঁদের মাটিতে ফোকাস করতে পেরেছেন। তাঁরা দেখতে পেয়েছেন দামি দামি ধাতুসমৃদ্ধ চকচকে সুন্দর পর্বতশ্রেণি, একটি নীল সমুদ্র আর উজ্জ্বল সাদা বেলাভূমি, নরম পাখির পালকের মতো পাতাওয়ালা নাম-না-জানা গাছপালা। একটি বাগানের মতো জায়গায় আছে কয়েকটি পিরামিড ধরনের স্থাপত্য আর সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে এক ধরনের কালচে লাল ফুল— দেখতে আকন্দ ফুলের মতো, কিন্তু আকারে পদ্মফুলের চেয়েও বড়।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন হার্শেল।

আমেরিকায় উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। বিস্ময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল দূর-দূরান্তেও। খবরের কাগজের অফিসে দিন-রাত কাজ চলতে লাগল যাতে আরও বেশি কাগজ ছেপে বার করা যায়।

আরও দিন সাতেক কেটে গেল। আমেরিকার আর এক বিখ্যাত পত্রিকা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-ও অভিনন্দন জানিয়ে স্বীকার করল, ‘এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতে মোটেই অসম্ভব নয়।’ ‘দি নিউ ইয়র্কার’ জানাল, ‘এই আবিষ্কার সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞানে, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।’ কিন্তু তখনও আসল খবর আসেনি।

পরের কিস্তিতে ছাপা হল, চাঁদে একটি অরণ্যে ওক জাতীয় বড় বড় গাছ দেখা গিয়েছে। এর পাতাগুলো খুব চওড়া আর মসৃণ। এই গাছের নীচে বাদামিরঙা এক পাল চতুষ্পদ প্রাণী চরে বেড়াচ্ছে, যাদের অনেকটা বাইসনের মতো দেখতে। তা ছাড়া আছে সাদা এবং লাল রঙের উড়ন্ত পাখি, হালকা নীল রঙের একশৃঙ্গ ছাগল, ছোট ছোট জ়েব্রা এবং একটি অদ্ভুত গোলাকৃতি উভচর প্রাণী, যারা সাগরের বেলাভূমির উপর প্রচণ্ড গতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। খবরে দেখা গেল, হার্শেল এ পর্যন্ত ৩৮ রকমের বিভিন্ন গাছ এবং প্রায় ৭৫ রকম বিভিন্ন গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ দেখতে পেয়েছেন। খবরের কাগজে প্রত্যেক প্রাণী সম্বন্ধে হার্শেলের নিজের আঁকা ছবি আর তার সঙ্গে সহজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেওয়া ছিল, যাতে জনসাধারণের বুঝতে অসুবিধে না হয়।

এই খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা পূর্ব আমেরিকায় কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম। বাল্টিমোর, ফিলাডেলফিয়া, বস্টন থেকে বিজ্ঞানীরা নিউ ইয়র্কে ছুটে আসতে লাগলেন টাটকা খবর পাওয়ার আশায়। রুদ্ধশ্বাস শিহরন যখন চরমে উঠেছে, তখনই বেরোল খবরের শেষ কিস্তি, আর সমস্ত আমেরিকা বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল! খবরটা হল— ‘চাঁদে বাদুড়-মানবের অস্তিত্ব’।

এই বাদুড়-মানবদের নাকি প্রথম দেখা গিয়েছে একটা পাহাড়ের চুড়ো থেকে সমতল ভূমির দিকে ধীর গতিতে উড়ে উড়ে নামতে। পৃথিবীর মানুষের মতোই এদের দেখতে, শুধু ডানা দু’টি বাড়তি। গড় উচ্চতা আন্দাজ চার ফুট, মুখ ছাড়া সারা দেহ তামাটে রঙের মসৃণ লোমে ঢাকা। ডানা দু’টো খুবই পাতলা ও হালকা। মুখমণ্ডল হলদেটে, তবে ওরাংওটাং-এর চেয়ে কিছুটা ভাল দেখতে, ঠোঁট খুব পুরু, চোখ দু’টি বুদ্ধিদীপ্ত। মুখমণ্ডলের বেশির ভাগ অংশ শক্ত ঘন গোঁফদাড়িতে ঢাকা। সবচেয়ে বড় কথা, ওদের শুধু উড়তেই দেখা যায়নি, কথা বলতে, স্নান করতে এবং একটা পাথরের উপর বসে ফল খেতেও দেখা গিয়েছে! এদের মধ্যে আবার একটি উন্নত প্রজাতির সন্ধান মিলেছে। তারা পৃথিবীর মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর দেখতে। কাল্পনিক দেবদূতের ছবি যেমন হয়, অনেকটা তেমন।

এ সব খবর জনমানসে এতই নাড়া দিয়েছিল যে, ম্যাসাচুসেটসের এক মহিলা-সমিতি চাঁদের মানুষদের কী করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা যায়, তা নিয়ে লেখালিখি শুরু করল।

এ দিকে কয়েক জন বিজ্ঞানী কিন্তু কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না ঘটনাটা। বিশেষত টেলিস্কোপের তত্ত্বটা ওদের কাছে মাত্রাছাড়া মনে হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ বার বার বলছে যে, বিজ্ঞানীদের জন্য ছবি এবং গাণিতিক ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ ৪০ পাতার বিবরণ তাদের কাছে আছে, কিন্তু স্থানাভাবে বিস্তারিত ছাপা যাচ্ছে না— এই তথ্যটিই ছিল সেই বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে সন্দেহজনক। শেষে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি কমিটি হঠাৎ নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’-এর অফিসে এসে মূল কাগজপত্রগুলো দেখতে চাইল। তাঁদের বলা হল, এখনই ওগুলো দেখাতে হার্শেলের বারণ আছে। অথচ হার্শেলকেও আমেরিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, ক্রমশ সন্দেহ ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ইতিমধ্যে অতি সাধারণ ‘সান’ পত্রিকা বিক্রির সংখ্যায় বিশ্বের অন্য সব কাগজকে ছাপিয়ে গেল। এই খবর ও নিবন্ধগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে বেড়ে চলল সন্দেহও। অবশেষে প্যারিসের ‘ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’ বহু তর্ক-বিতর্কের পর তিক্ত সমালোচনার ঝড় তুলে ঘোষণা করল— ‘পুরোটাই নিছক গাঁজাখুরি গপ্পো’।

তত দিনে নিউ ইয়র্কের আর একটি কাগজ ‘জার্নাল অব কমার্স’ তাদের এক দুঁদে সাংবাদিককে গোপনে তদন্তে নামিয়ে দিয়েছে ‘সান’ পত্রিকার সম্পাদক রিচার্ড অ্যাডামস লক-এর পিছনে। এই ধুরন্ধর সাংবাদিক তুমুল গোয়েন্দাগিরির পর আবিষ্কার করলেন এক চাঞ্চল্যকর তথ্য— ‘এডিনবরা জার্নাল অব সায়েন্স’ নামে কোনও বিজ্ঞান পত্রিকা কোনও কালে ছিলই না! তার পর ক্রমশ তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণের সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাডামস লক আর আসল ব্যাপারটা চেপে রাখতে পারলেন না।

জানা গেল, ‘সান’ পত্রিকার মালিক মোজেস ওয়াই বিচ অনেক দিন ধরেই লককে ভয় দেখাচ্ছিলেন যে, তাঁর কাগজের বিক্রি যদি এক সপ্তাহের মধ্যে না বাড়ে, তা হলে তিনি কাগজ বন্ধ করে দেবেন। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে লক যাতে আর কোনও কাগজে চাকরি না পান, তার ব্যবস্থাও করবেন। নিরুপায় লকের পক্ষে এই সব মুখরোচক গালগল্প উপহার দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এ ব্যাপারে লক তাঁর বন্ধু বিখ্যাত সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো-র লেখালিখি থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। তার উপর ছবি এঁকে আর মাথা খাটিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বার করে ঘটনাগুলোকে নিখুঁত করে তুলেছিলেন। লকের সবচেয়ে সুবিধে হয়েছিল, হার্শেল তখন আমেরিকায় ছিলেন না, দক্ষিণ আফ্রিকার এক গণ্ডগ্রামে তাঁর প্রিয় মানমন্দিরে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন, ফলে এ সব খবর তাঁর কাছে পৌঁছয়নি।

এর পর লক এক দিন আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখলেন, ‘আমি যা করেছি তার জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবি না। আমি সেই সব জ্যোতির্বিদদের উপহাস করতে চেয়েছিলাম, যাঁরা এখনও বিশ্বাস করেন চাঁদে মানুষ আছে।... দিনের পর দিন আমি অফিসের বাইরে জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে শুনতাম তারা কী বিশ্বাস করতে ভালবাসে, তার পর ফিরে এসে তা-ই লিখতাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা— মানুষ যা বিশ্বাস করতে চায়, তাই-ই সহজে বিশ্বাস করে। অবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। এই সত্যটা আমি প্রমাণ করে গেলাম।’

এই ঘটনার পর লকের ভাগ্যে তিরস্কার যত না জুটেছিল, তার চেয়েও বেশি জুটেছিল প্রশংসা আর পুরস্কার। এক সার্থক সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে তিনি প্রচুর সম্মান পেয়েছিলেন। তাঁর নিবন্ধগুলো নিয়ে একটা ছোট্ট বই বেরিয়েছিল, নাম ‘দ্য সেলিব্রেটেড মুন স্টোরি’। শুধু এই বইটাই মাত্র কয়েক দিনে ৬০,০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল আর তার ফলে তিনি প্রচুর অর্থ পেয়েছিলেন।

ও দিকে জ্যোতির্বিদ জন হার্শেলের কানে যখন সব খবর পৌঁছল, তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি আর তাঁর দু’জন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীই জানতেন যে তাঁদের টেলিস্কোপের লেন্সের মাপ ২৮৮ ইঞ্চির ধারেকাছেও নয়, মাত্র ১৮ ইঞ্চি! কিন্তু যখন তিনি জানলেন যে শেষ পর্যন্ত সব কিছু ফাঁস হয়ে গিয়েছে, তখন তিনিও লককে চিঠি লিখে অভিনন্দন না জানিয়ে পারেননি— ‘...পৃথিবীর বড় বড় পণ্ডিতদের ঘোল খাইয়ে এমন সুন্দর রসিকতা করার এক সার্থক নজির রেখে গেলেন আপনি।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

John Herschel Astronomer U.K.
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE