Advertisement
E-Paper

তেজপাতা

গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো সংগীত, শিল্প, তিরন্দাজি, ভবিষ্যদ্বাণী, আলো, জ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো ভারিক্কি সব বিষয়ের দায়িত্বে। তার ওপর ইনিই চার ঘোড়ার রথে করে রোজ সূর্যকে পুব আকাশ থেকে পশ্চিম আকাশে নিয়ে যান, তাঁকে বাড়ি ফেরান আর আবার তাঁকে তাড়া করে বাড়ি থেকে বার করে আকাশে পাঠান। এই সব করে করে অ্যাপোলোর ভারী গুমোর জন্মাল।

পিনাকী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো সংগীত, শিল্প, তিরন্দাজি, ভবিষ্যদ্বাণী, আলো, জ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো ভারিক্কি সব বিষয়ের দায়িত্বে। তার ওপর ইনিই চার ঘোড়ার রথে করে রোজ সূর্যকে পুব আকাশ থেকে পশ্চিম আকাশে নিয়ে যান, তাঁকে বাড়ি ফেরান আর আবার তাঁকে তাড়া করে বাড়ি থেকে বার করে আকাশে পাঠান। এই সব করে করে অ্যাপোলোর ভারী গুমোর জন্মাল। এক দিন পথে এরস্‌-এর সঙ্গে দেখা, আর তাঁর সঙ্গে নিয়ে ফেললেন পাঙ্গা। এরস্‌-এর উচ্চতা আর তিরন্দাজি নিয়ে আলগা মন্তব্য করে বসলেন। এরস্‌ পাক্কা ধনুর্বিদ, কাঁধে সব সময় তির আর ধনু। এই এরস্‌ বা কিউপিড আমাদের মদনদেবের মতন প্রেমেরই দেবতা। কিন্তু তাঁর তির মদনশরের চেয়ে অনেক গোলমেলে। দুই রকমের তির রাখতেন তূণে। সোনার আর সিসের। সোনার তির কাউকে ছুড়লে সে সামনে যাকে দেখত তার প্রেমে পাগল হয়ে যেত, আর সিসের তির কাউকে ছুড়লে তার মন থেকে প্রেম ভালবাসা উবে গিয়ে সে নীরস কেঠো মনের লোক হয়ে যেত। এরস্‌ সোনার তির মারলেন অ্যাপোলোকে, আর সিসের তির মারলেন নদীদেবতা পেনিয়সের কন্যা পরমাসুন্দরী দাফনে’কে। সে তখনই অ্যাপোলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। অ্যাপোলো তো প্রেমে উন্মাদ। প্রেম নিবেদন করতে দৌড়লেন দাফনের কাছে, আর ভীত দাফনে পালাতে লাগল অ্যাপোলোর থেকে। শেষ পর্যন্ত দাফনে নদীতীরে পৌঁছে তার বাবাকে অনুরোধ করে তাকে বাঁচাতে। জলদেবতা অনেক মায়াবিদ্যা আর ছদ্মবেশ জানতেন, তাই দিয়ে মেয়েকে বাঁচাতে গেলেন। অ্যাপোলো যখন হাঁপাতে হাঁপাতে নদীতীরে এলেন, তখন দাফনে এক সোনালি পাতার এক সুঠাম গাছ হয়ে গিয়েছে। সেটাই তেজপাতার গাছ।

অ্যাপোলো দাফনেকে জিততে পারেননি, কিন্তু তাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন, তাই তেজপাতার গাছ হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয় গাছ, আর সেই তেজপাতার মুকুট তিনি পরতেন। অ্যাপোলোর বিশাল ভক্তকুলের কাছে তেজপাতার মুকুট শৌর্য-বীর্যের প্রতীক, বিজয়ের স্মারক। ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বে যখন অলিম্পিক শুরু হয়, বিজয়ীদের গলায় তেজপাতার মালা আর মাথায় তেজপাতার মুকুট পরানো হয়েছিল। প্রথমে গ্রিক আর তার পর রোমান সাম্রাজ্যে— সেখান থেকে এই প্রথা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইতালিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে চিরাচরিত উষ্ণীষের বদলে এখনও তেজপাতার মুকুট পরা হয়। পোয়েট ল্যরিয়েটদের তেজপাতার মালা দিয়ে বরণ করা হয়, কারণ অ্যাপোলো যে কাব্যেরও দেবতা। রোমানিয়াতে ভ্যালেন্টাইন ডে’র আগের রাতে বালিশের তলায় তেজপাতা রেখে শোয়া দস্তুর, তাতে নাকি ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীকে স্বপ্নে দেখা যায়।

গ্রিসের দেলফিতে অ্যাপোলো মন্দিরের চালা তেজপাতার। তার তলায় বসে মহিলা পুরোহিত পাইথনেস্‌ ভবিষ্যদ্বাণী করার কিছু আগে চালা থেকে ছিঁড়ে একটা তেজপাতা চিবিয়ে নিতেন। কাঁচা তেজপাতা কিন্তু ভাল মাদক। পাইথনেস্‌দের কাছে নেশার আলো-আঁধারিতে ভবিষ্যতের কুহেলি দেখে বর্ণনা করা কি সহজ হত? আর অলিম্পিকের আদ্যিকালে তেজপাতার মুকুট বা ল্যরেল পরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সেই আমলের ডোপিং-এর কোনও সম্পর্ক ছিল কি?

তা বলে তেজপাতা শুধুই মাথার মুকুট আর গলার হার নয়। সেই আদ্যিকাল থেকে ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোর রান্নাঘরে তেজপাতার ভারী সমাদর। পানসে রান্নায় ঝাঁজ আর স্বাদ জুড়তে তার জুড়ি নেই। রান্নায় সে নিজেকে জাহির করে না কক্ষনও, বরং আস্তে আস্তে তার স্বাদ আর বাস ছড়ায় রান্নায়। সাধে কি ওস্তাদ শ্যেফদের কাছে ‘সিজনিং’ হিসেবে তেজপাতার এত কদর? অ্যাপোলোর প্রিয় গাছের পাতাটি রান্নায় দিয়ে খেলে হজমের ক্ষমতা বাড়ে। সে অন্য মশলাদের মতো হজম ক্ষমতার সর্বনাশ করে না। তার ওপর কেটেছিঁড়ে গেলে ঘা হওয়া থেকে বাঁচায়, প্লেগের প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। সতেরো শতকের চিকিৎসক কাল্‌পেপার তো মুখের ব্রণ সারানোর জন্যে তেজপাতার তেলকে অব্যর্থ ওষুধ বলেছিলেন। আজও ইউরোপে আমিষ পদ আর তেজপাতা থাকবেই। হালের ২০০০ সালেই তুর্কিরা ৩৬০০ টন তেজপাতা রফতানি করেছে, এমনই তার চাহিদা!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

বেতন না দিলে বোমা মারব!

ছবি: সুমিত্র বসাক

আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগে। পোস্টাল অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে। সময়টা আশির দশকের প্রথমার্ধ। ফিজিক্স অনার্সে পার্ট ওয়ান শেষ করে তখন পার্ট টু পড়ছি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সটান দরখাস্ত করে দিলাম। আর কী আশ্চর্য, কপালগুণে জুটেও গেল চাকরিটা! দুটো শিফটে ডিউটি। সকাল ছ’টা থেকে দশটা, আবার দুপুর দুটো থেকে সন্ধে ছ’টা। মাঝের সময়টায় কোনও মতে নাকেমুখে গুঁজে কলেজে ক্লাস।

প্রথম দিন সাতেক এ-টেবিল সে-টেবিল ঘুরে, অবশেষে স্থায়ী একটা টেবিল জুটল। আমি হলাম ‘মানি অর্ডার পেড ক্লার্ক’। দিনের শুরুতে পোস্টম্যানদের মধ্যে মানি অর্ডার বিতরণ, আর দিনের শেষে তাদের কাছ থেকে হিসেবপত্র বুঝে নেওয়া— এই হল পেড ক্লার্কের কাজ। এরই ফাঁকে, সকাল ন’টা থেকে দশটা পর্যন্ত বেচতে হত খাম, পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, ডাকটিকিট— এই সব।

কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে হয়েছে সেই সময়! প্রতি মাসের শুরুতে এক ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধ আসতেন মানি অর্ডারের খোঁজে। তাঁর ছেলে সম্ভবত বাইরে থাকে, সে টাকা পাঠাত। কিন্তু টাকা খুব নিয়মিত আসত না। বৃদ্ধকে ‘না’ বলতে খুব কষ্ট হত। এক বার এক জন এসে এক টাকার একটা ডাকটিকিট চাইল। দিলাম। সে ডাকটিকিট হাতে নিয়ে উদাস, গম্ভীর ভাবে বলল, ‘এটার দাম আগে পঞ্চাশ পয়সা ছিল।’ আমি আর কী করি। অনেক কষ্টে, মুখ টিপে হাসলাম। আর এক বার এক জনকে কোনও এক অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করতে পাঠিয়েছিল। সে আমার কাছ থেকে ডাকটিকিট কিনে, খামে লাগিয়ে, সেই খাম রেজিস্ট্রি করার বদলে ডাকবাক্সে (আমরা বলতাম ‘ঢোল’) ফেলে চলে গেল। তার পর যথারীতি অফিসে রামবকুনি খেয়ে, খানিক বাদে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমাকে বলল, মস্ত ভুল হয়ে গেছে। আমি তো খামটা ডাকবাক্সে ফেলে দিয়েছি! এখন কী হবে? তাকে বললাম, টেনশন করবেন না, ঠিক একটায় আসুন। ডাকবাক্স খোলা হলে, সেখানে হাজির থেকে, আপনার খামটা খুঁজে নিয়ে রেজিস্ট্রি কাউন্টারে জমা করবেন। আর হ্যাঁ, এ বার আবার রসিদ নিতে ভুলে যাবেন না!

এক দিকে অফিস, অন্য দিকে কলেজ সামলাতে গিয়ে আমার তখন প্রাণান্তকর অবস্থা। কলেজে এক অধ্যাপক প্রতি দিন হুঁশিয়ারি দিতেন, ‘হয় চাকরি কর, নয় লেখাপড়া কর। দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলা চলবে না।’ আমি তাঁকে বলতাম, স্যর, দু’নৌকোয় পা দিয়েই আমায় চলতে হবে। কারণ দুটোই আমার কাছে সমান জরুরি। আবার সেকেন্ড শিফটে অফিসে ঢুকতে একটু দেরি হলেই পোস্টমাস্টারমশাইয়ের চোখরাঙানি: ‘অফিসে সময়মত না এলে আমি কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ্য হব!’

সেই সময় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন হত মানি অর্ডারের মাধ্যমে। প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কাজের চাপ থাকত খুব বেশি। শিক্ষকরা যাতে সময়মত বেতন পান, সে জন্য নিয়ম ভেঙে পাঁচ হাজার টাকার বদলে প্রতি বিটে পনেরো থেকে কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে দিতাম। প্রথম প্রথম পোস্টম্যানরা আপত্তি করলেও পরে অবশ্য সবাই সেটা মেনে নিয়েছিল। চাপ কমানোর জন্য ‘উইন্ডো পেমেন্ট’ও করতাম। অর্থাৎ, সরাসরি কাউন্টার থেকে বেতন দেওয়া হত। তখন প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ছিল খুবই কম। আর টাকার অঙ্কটাও ছিল অদ্ভুত। কারও ৭৭৮ টাকা ৯৫ পয়সা, তো কারও ৬৫৩ টাকা ৯৯ পয়সা! কপাল ভাল থাকলে হিসেব এক বারে মিলে যেত, সে দিন অফিস থেকে বের হতে হতে সন্ধে সাড়ে ছ’টা-সাতটা। আর যে দিন ভাগ্যদেবী অপ্রসন্না হতেন, সে দিন পাঁচ পয়সা বা দশ পয়সার হিসেবের গন্ডগোল মেলানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। বহু চেষ্টায় যখন হিসেব মিলত, চোখ তুলে দেখতাম, গোটা অফিস, সমস্ত টেবিল— ফাঁকা। শুধু পোস্টমাস্টারমশাই তাঁর চেয়ারটায় বসে ঝিমোচ্ছেন। আমার জন্য আটকে রয়েছেন বেচারা তিনিও।

এ রকমই এক মাস্টারমশাইদের বেতনের মরশুম। এক দিন সকালে কোনও দিকে না তাকিয়ে, ঘাড়মুখ গুঁজে কাজ করে চলেছি, হঠাৎ কাউন্টারের ও-পাশ থেকে এক জনের ভারী গলা: ‘আমার বেতনটা দিয়ে দাও না ভাই।’ মুখ তুলে যাঁকে দেখলাম, তাঁকে শুধু আমি কেন, এলাকার অনেকেই চেনেন। যত না শিক্ষক হিসেবে, তার চেয়ে বেশি সত্তর দশকের ‘ডন’ হিসেবে।

বললাম, আপনার মানি অর্ডার তো এখনও আসেনি। ‘ইয়ার্কি হচ্ছে! বেতন আটকে রেখে আমাকে হয়রানি করানো হচ্ছে? আমি কিছু বুঝি না, না?’ শান্ত ভাবে বললাম, সত্যি বলছি, আপনার বেতন এখনও আসেনি। এ বার ও-প্রান্ত থেকে রীতিমত হুমকি: ‘আরে বেতন দেবে কি না বলো।’ এ বার আমিও গলার স্বর কিছুটা চড়িয়ে বললাম, না এলে দেবটা কোত্থেকে? কাউন্টারের ও-প্রান্ত তখন টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে গেছে সত্তরের দশকে। ‘দেবে না? এক্ষুনি বেতন না দিলে অফিসসুদ্ধ তোমাকে বোম মেরে উড়িয়ে দেব!’ এ বার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল আমার। বললাম, আনুন দেখি কত বোম আছে আপনার! গোলমাল শুনে ইতিমধ্যে আমার সহকর্মীরা এসে জড়ো হয়েছেন। ওঁরা সামাল দিতে গেলেন। আরও কিছু ক্ষণ গোলাগুলি বর্ষণ করে, আমাকে যারপরনাই দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে তার পর মান্যবর মাস্টারমশাই প্রস্থান করলেন।

প্রথমার্ধের ডিউটি শেষ করে বাড়ি এসে সে দিন আর কলেজ যাইনি। দুপুর একটার দিকে হঠাৎ সেই মাস্টারমশাইয়ের আবির্ভাব, একেবারে আমার বাড়িতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার দু’হাত ধরে অঝোরে কান্না। ‘ভাই, বেবিফুড কেনার পয়সা নেই পকেটে। মাথারও ঠিক নেই তাই। তোমাকে আজেবাজে অনেক কথা বলেছি। আমায় ক্ষমা করো।’

নিমেষে সব রাগ উবে গিয়ে, মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক প্রাইমারি স্কুলমাস্টারের নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারের ছবি।

আমার বাবাও যে এক জন প্রাথমিক শিক্ষক!

দীপক কুমার ঘোষƒ কুশমন্ডি,
দক্ষিণ দিনাজপুর

dipakghosh945@gmail.com

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy