Advertisement
০২ মে ২০২৪
Bengali Feature

রামকথা যেন অমৃতসমান

কলকাতা অবশ্য তাঁকে চেনে। ফি রবিবার অক্টারলোনি মনুমেন্টের নীচে ‘মনুমেন্ট সৎসঙ্গ কমিটি’ নামে এক সংস্থার উদ্যোগে তুলসীদাসের রামকথা পড়তেন।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

গৌতম চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:২৩
Share: Save:

বক্সার থেকে ফোনে শ্রীনাথ পাণ্ডে জানালেন, আগামী কাল মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবসে তিনি অযোধ্যায় যাচ্ছেন না, বললেন, “অযোধ্যার মোহন্ত নিত্যগোপাল দাস আমাদের চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমরা পরে যাব।” এমনিতে শ্রীনাথবাবু কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সেলেব্রিটি নন, ফলে তাঁর যাওয়া না-যাওয়ায় কারও কিছু আসে যায় না।

কলকাতা অবশ্য তাঁকে চেনে। ফি রবিবার অক্টারলোনি মনুমেন্টের নীচে ‘মনুমেন্ট সৎসঙ্গ কমিটি’ নামে এক সংস্থার উদ্যোগে তুলসীদাসের রামকথা পড়তেন। শহরের হিন্দিভাষী ছোট ব্যবসায়ী, চাকুরে, ট্যাক্সি ড্রাইভার, লরির খালাসিরা সাধ্যমাফিক মাসে কিছু টাকা দিয়ে এই সংস্থাটি আজও টিকিয়ে রেখেছেন। এ দিকে করোনার পর থেকে শ্রীকান্ত বক্সারে দেশের বাড়িতে। সেখানেও পাঠ করেন, “রামকথা আমার জীবনে সবচেয়ে ভালবাসার জিনিস। এখানে দু’-চার জন হয় ঠিকই, কিন্তু কলকাতার মতো শ’খানেক লোক কোথায়?” শ্রীনাথ কলকাতার লেনিন সরণির অফিসে ‘দৈনিক জন্মভূমি’, ‘শিলং গেজ়েট’ ইত্যাদি ছোটখাটো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজ করতেন।

এহ বাহ্য! শ্রীনাথের ঠাকুরদা সুখরাম পাণ্ডেও ছিলেন কথাবাচক। স্ট্র্যান্ড রোডে জয়দয়াল গোয়েন্দকার বাড়িতে তাঁরা পুরুষানুক্রমে কথকতা করতেন। এ শহরের গোয়েন্দকা ও হনুমানপ্রসাদ পোদ্দারই গোরক্ষপুরের ‘গীতা প্রেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা। শ্রীনাথ জানান, বাবা-ঠাকুরদা ছাড়াও তিনি রামকথা শিখেছেন স্বামী রামসুখদাসের কাছে। রাজস্থানের সন্ন্যাসী রামসুখদাসও গীতা প্রেসের জন্য ‘গীতাদর্পণ’, ‘গীতামাধুর্য’ ইত্যাদি হরেক বই লিখেছেন, ২০০৫ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও মনুমেন্টের নীচে কথকতা করেছেন। ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ এবং ‘রামকথা’ তখনও কলকাতা ময়দানে একটি রাজনৈতিক দলের অস্ত্র হয়ে ওঠেনি। বাংলায় রামের ঐতিহ্যে ফিরতে গেলে তাই শুধু রাজনৈতিক তরজায় আটকে থাকলে চলবে না, ফিরতে হবে কথকতায়। পাণ্ডেজিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পলিটিক্সবাজিতে বিরক্ত হয়েই কি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত! তিনি হাসলেন, “দুর! আমরা তো রামনবমীতে কলকাতা থেকে ট্রেনে অযোধ্যা যেতাম, এ বারও তাই যাব।” অস্ত্র হাতে রামনবমীর মিছিল নয়, কলকাতা থেকে অযোধ্যা যাওয়াটাই এই শহরে কথাবাচকদের পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্য।

ফোনে ধরা গেল গোরক্ষপুরের জনপ্রিয় কথাবাচক মানবেন্দ্র ত্রিপাঠীকে। বছর কয়েক আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ‘রামায়ণ প্রোজেক্ট’-এ ভারতের বিভিন্ন এলাকার কথাবাচকদের সাক্ষাৎকার নেয়, অধ্যাপক অভিষেক বসু ও সেখ রফিকুল হোসেনের প্রচেষ্টায় সেগুলি ‘কবি, তব মনোভূমি’ নামে গ্রন্থিতও হয়। মানবেন্দ্র সেখানে অদ্ভুত একটি কথা বলেছিলেন, তাঁদের গোরক্ষপুরের গ্রামে রামলীলার নাচগানকে অশ্লীল ভাবা হত, গ্রামের বড়রা বলতেন, “ছি ছি! তোমরা রামলীলা করবে?” এ বার অন্য গল্প। বিহারের শোনপুর মেলায় কথকতা সেরে মানবেন্দ্র ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছেন অযোধ্যা, “উত্তরপ্রদেশ সরকার থেকে আমন্ত্রণ এসেছে। মকরসংক্রান্তি থেকে আমরা ১৫টা দল এক সপ্তাহ কথকতা করছি। বিদেশ থেকেও অনেকে আসবেন।” পুরো তুলসীদাস? “না না,” আঁতকে উঠলেন মানবেন্দ্র, “পুরোটা পড়তে এক সপ্তাহ লাগে। বাছাই কিছু অংশ। আমি যেমন রাম-সীতার বিয়ে, রাজ্যাভিষেক, সীতাহরণ শোনাব।” গ্রামের লোকেরা এখন আর রামলীলা নিয়ে অকথা-কুকথা বলে না। “পৃথিবীর এমন একটা পরিবারের কথা বলুন তো যারা রামের মতো ছেলে চায় না? সীতার মতো স্ত্রী চায় না? বা ভরতের মতো ভাই, হনুমানের মতো সেবক! হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কেউ কি বলবে এ রকম চাই না? তা হলে রামায়ণ শুধু একটা ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয় কী ভাবে?” জিজ্ঞেস করলেন মানব।

প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেল একটু পরেই। মানবেরই কথায়। কথাবাচক তো শুধু পাঠ করেন না, হরেক ব্যাখ্যায় সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গে রামায়ণকে মিলিয়ে দেন। মানবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই নতুন মন্দির কখনও তাঁর ব্যাখ্যানে আসবে কি না! “ভাবছি। যুদ্ধশেষে রাম-সীতার অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁদের নতুন প্রাসাদ, পাঁচশো বছর ধরে লোকে এরই অপেক্ষায় ছিল এ রকম কিছু হতেই পারে, বলুন।”

শ্রীকান্ত বনাম মানব নয়। বিহারের বক্সার এবং উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরও নয়। গল্প অন্যত্র। আগামী কাল প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে অর্ধসমাপ্ত মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে কথাবাচকরাই একমত নন। কেউ সাম্প্রতিকের জোয়ারে, কেউ আবার চিরাচরিত রামনবমীতে। গোলানোটাই ভবিতব্য ছিল। কথাবাচকদের থেকেও বড় বড়, উচ্চবর্গের লোকেরা ইচ্ছাকৃত অনেক গোলযোগ পাকিয়েছেন। অযোধ্যা বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক নাম রাখা হয়েছে ‘মহর্ষি বাল্মীকি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। বাল্মীকি থাকতেন তমসা নদীর ধারে, তাঁর আশ্রমে। উত্তরকাণ্ডে সীতা ও লব-কুশকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যায় এক বারই পা ফেলেছেন। বশিষ্ঠ বরং অযোধ্যার কুলপুরোহিত। বাল্মীকি রামায়ণে ঋষি বিশ্বামিত্র শুধু তাড়কাবধের জন্য রাম-লক্ষ্মণকে নিতে অযোধ্যায় আসেন না, মিথিলায় রাম-সীতার বিয়েতে যজ্ঞবেদিটিও সাজিয়ে দেন। বাল্মীকির আদিকাণ্ডে রামলালার প্রসঙ্গ নেই, অযোধ্যায় বিশ্বামিত্র হঠাৎ এসে হাজির। দশরথ তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, “তপোধন, পদ্মপলাশলোচন রামের বয়ঃক্রম মাত্র ষোড়শ বৎসর। রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করা ইঁহার সাধ্যায়ত্ত নহে।” তবু বিমানবন্দরের নামকরণে শুধু বাল্মীকিই থাকলেন।

ভক্তিস্রোতে উন্নয়ন

কিন্তু বাল্মীকি আর ব্যাসকে কখনও আলাদা করা যায়? বাল্মীকি, ব্যাস এক জন না বহু সেই তর্কেও আমরা ঢুকব না। বলার কথা একটিই। কলকাতা থেকে বারাণসী, অযোধ্যা সর্বত্র কথক যে আসনে বসে রামকথা শোনান, তার নাম ব্যাসাসন। ওই আসনে বসে যিনি কথকতা করবেন, তিনিই ব্যাস। মহাভারতের পরবর্তী পর্ব খিল হরিবংশ ব্যাসদেবের লেখা বলে লোকের ধারণা। সেখানে রাজসূয় যজ্ঞের কথা বলতে গিয়ে ব্যাস বলেন, “বাল্মীকিও এ কথা লিখে গিয়েছেন, গীতং চ বাল্মীকিমহর্ষিণা চ।”

কিন্তু শাস্ত্রকথা কবেই বা শুনত লোক? অযোধ্যা স্টেশনের নাম এখন অযোধ্যাধাম। আধখ্যাঁচড়া মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর ২৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি অবধি সেই স্টেশনে চলবে ৪৪টা স্পেশাল ট্রেন। স্টেশনের সামনে একটাই হোটেল ছিল, বছর তিনেক আগেও অযোধ্যা গিয়ে থাকতে হয়েছিল এক ধর্মশালায়।

আমি তাও হোটেল দেখেছিলাম, আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যখন আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ‘রামায়ণের পথ ধরে’ লিখছেন, তাঁকেও থাকতে হয়েছে কলতলার পাশে, চৌকি পাতা ঘরে। ধাম-টাম ছিল না, ছিল সাদামাটা অযোধ্যা স্টেশন। হাওড়া স্টেশন থেকে দুন এক্সপ্রেস ছাড়া অন্য ট্রেন সেখানে থামত না, প্ল্যাটফর্মে থাকত সার সার বানর।

যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকার জানিয়েছে, এ বার সেই শহর ঘিরে দফায় দফায় ৩১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। স্টেশন চত্বর আধুনিকীকরণের পাশাপাশি তৈরি হবে ‘রামপথ’, ‘ভক্তিপথ’, ‘ধর্মপথ’ ও ‘শ্রীরাম জন্মভূমি পথ’ নামে চারটি এক্সপ্রেসওয়ে। তিন বছর আগে সরযূতীরে গুপ্তারঘাটে একটি মন্দির ছাড়া বিশেষ কিছু দেখিনি। ওখানেই নাকি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন লক্ষ্মণ, পরে রামচন্দ্র স্বয়ং। সেই ঘাটকেও ঢেলে সাজানো হবে, ওয়াটার স্পোর্টস, বোটিং ও নানা সুবিধা থাকবে। দামামা বাজিয়ে দেবভক্তি এবং উন্নয়নের হাত ধরাধরি এই প্রথম!

মডেলটা অবশ্য তিন বছর আগেই দেখে ফেলেছি। সরযূতীরে রামঘাটে আলোকিত সন্ধ্যা, দূরের ফ্লাইওভারে ছুটন্ত গাড়ির হেডলাইট। আর পিতলের ভারী পিলসুজ ও প্রদীপ নিয়ে পুরোহিতদের সন্ধ্যারতি। আমাদের চেনা দশাশ্বমেধ ঘাটই মডেল। বারাণসী আজ যা ভাবে, অযোধ্যা আগামী কাল সেটাই করে।

কাল যা হবে

আগামী কাল দুপুর সাড়ে ১২টায় যজমান নরেন্দ্র মোদীর হাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা। বেলা ১২টায় লেন্স আর আয়নার সাহায্যে রামলালার বিগ্রহে এসে পড়বে সূর্যের আলো। বাল্মীকির আমলে এ সব আয়না ছিল না। ছিল না অনেক কিছুই। গতকাল সরযূর জলে মন্দিরের গর্ভগৃহ ধোওয়া হয়েছে, আজ ১২৫ কলস জলে নতুন বিগ্রহের স্নান। প্রসঙ্গত, তাড়কা বধের সময় রামচন্দ্রকে অরণ্যে নিয়ে যাওয়ার সময় ঋষি বিশ্বামিত্রকেও সরযূ পেরোতে হয়েছিল। সেখানে তিনি রামকে বলেছিলেন, এই নদী মানস সরোবরে উৎপন্ন। সরোবর থেকেই সরযূ নাম।

গঙ্গা, যমুনা থেকে সরযূ সকলে যে হিমালয়ের হিমবাহতে উৎপন্ন, আজ আমরা জানি। কিন্তু ভক্তির রাজনীতি বাল্মীকিকে পাত্তা দেয় না, ইতিহাস, ভূগোল সব কিছুকেই সে হারিয়ে দেয়। সীতার জন্মস্থান নেপালের জনকপুরে না বিহারের সীতামাঢ়হি-তে সেই তর্কের আজও মীমাংসা হল না। কিন্তু রাম পেয়ে গেলেন তাঁর জন্মস্থান। সে এই সরযূ হোক বা না হোক!

ধাম বনাম তীর্থ

হিন্দু বিশ্বাসে ধাম আর তীর্থে তফাত আছে। তীর্থ মানে স্বর্গলোকে পারাপারের জন্য নদীর ঘাট, তাই কালীঘাট থেকে কেদারনাথ সবই তীর্থ। আর নদীর ধার থেকে রাস্তাঘাট-সহ গোটা জনপদই যদি দেবতার আবাস হিসাবে গণ্য হয়, সেটি ধাম। প্রয়াগ কেন নাম বদলে প্রয়াগরাজ? কারণ স্বয়ং তুলসীদাস ‘রামচরিতমানস’-এ তাকে তীর্থরাজ আখ্যা দিয়েছেন। গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে কুম্ভমেলাখ্যাত প্রয়াগ তীর্থ, আর অযোধ্যা হয়ে গেল ধাম! এই জন্য অহেতুক বিজেপি, আরএসএসকে দায়ী করে লাভ নেই। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারততত্ত্ববিদ ডায়ানা য়েক তাঁর ‘ইন্ডিয়া: আ সেক্রেড জিয়োগ্রাফি’ বইয়ে দেখিয়েছিলেন, নতুন রাস্তাঘাট ও পর্যটনশিল্পের খাতিরে এই ধাম-ধারণা বদলে যায়। আগে চারধাম বলতে জোশীমঠ, পুরী, দ্বারকা ও রামেশ্বরমকে বোঝাত। এখন মধ্যপ্রদেশের চিত্রকূটেও আছে চারধাম। রাজস্থানের ঘাটিয়ালিতেও আছে স্থানীয় চারধাম যাত্রা। আর আধুনিক ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় উত্তরাখণ্ডে গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী-কেদার-বদ্রীর চার ধাম। কিন্তু এই ধারণা জনতার ভিতর থেকে উঠে আসে, রাষ্ট্র কখনও বলে দেয়নি, এটা ধাম আর ওটা তীর্থ। এখানেই আজকের অযোধ্যার বৈশিষ্ট্য। বারাণসীধামের কথা ভাবতে পারেন। সেখানে বারাণসী, বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট ও কাশী তিনটি স্টেশন। এটাই ধাম, এমন দিকচিহ্ন স্থানীয় স্টেশন বা বিমানবন্দর কখনও আঁকেনি।

অযোধ্যা এই ভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় আগামী কালের প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে রামকথার কথকরা বিভ্রান্ত, বিভ্রান্ত শঙ্করাচার্যরাও। জোশীমঠ ও পুরীর শঙ্করাচার্য যাবেন না ঘোষণা করে দিয়েছেন। এই লেখার সময় অবধি দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চী ও শৃঙ্গেরীর শঙ্করাচার্য প্রায় নীরব। আমাদের মতো সাংবাদিকদের অবশ্যই এই সব তথ্য জানাতে হয়, কিন্তু ধর্মের সত্য অন্যত্র। শঙ্করাচার্যরা হিন্দু ধর্মে কোনও ‘পোপ’ নন, কেউ তাঁদের মানতে পারেন, কেউ বা না মানতে পারেন। তুলোট কাগজে পুঁথি লিখে কথকতা করত নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের যে হরিহর রায়, বৌ-ছেলেকে নিয়ে যে বারাণসী পাড়ি দিয়েছিল, তার জীবনে কি আদৌ ধাম-তীর্থ, শঙ্করাচার্য এ সবের গুরুত্ব ছিল?

ব্যাসাসনে অপু

বারাণসীর বাঁশফটকা গলির বাড়িতেই দরিদ্র কথকের জীবন বালক অপুর চোখে প্রথম ধরা দেয়। সে রোজ বিকেলে দশাশ্বমেধ ঘাটে বেড়াতে যায়। “এখানে গান হইতেছে, ওখানে কথা হইতেছে, ওদিকে কে একজন রামায়ণ পড়িতেছে।” এই পরিবেশে হরিহর নতুন আশায় বুক বাঁধে, জড়ভরতের উপাখ্যানকে কথকতার পালার আকারে লিখে ফেলে। ঘাটের এক কথক অপুকে আদর করে রাজার বাড়ির নিমন্ত্রণে নিয়ে যায়, মোটা মোটা আটার পুরি, স্বাদহীন বেগুনের ঘণ্ট আর দাঁতভাঙা লাড্ডু খেতে হয় তাদের। নতুন পালার কথকতা হরিহরের আর করা হয় না। তার আগেই মৃত্যু হয়। অপুর কানে তখনও বাজে কথকতার শেষে বাবার পাঠ, “কালে বর্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী।”

এই কথকজীবনের পুরোটাই বিভূতিভূষণের স্বকপোলকল্পিত নয়। হাওড়ায় ব্যাঁটরার বারোয়ারিতলায় এক বার কথকতা করতে এসেছিলেন বিভূতিভূষণের বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, পাঠ করেছিলেন ‘তরণীসেন বধ’।

তরণীসেনের গল্প

ব্যাস, বাল্মীকি, শঙ্করাচার্যে কস্মিনকালেও তরণীসেনকে খুঁজে পাবেন না। তিনি একান্ত ভাবেই বাঙালি কৃত্তিবাস ওঝার সৃষ্টি। রাম-রাবণের যুদ্ধের লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছে, সংজ্ঞাহীন লক্ষ্মণকে গন্ধমাদন পর্বত এনে বাঁচিয়েছেন হনুমান। তবু যুদ্ধের বিরাম নেই। তখন বিভীষণের ছেলে তরণীসেনকে রাক্ষস-সেনার দায়িত্ব দেন রাবণ। তরণী সেনাপতি হয় একটাই কারণে। সে বলে, “বিষ্ণু অবতার রাম আমি ভাল জানি।” এই বিষ্ণুর হাতে মৃত্যু হলে তো অক্ষয় স্বর্গবাস। অতএব “সাজিল তরণীসেন করিতে সংগ্রাম/ আনন্দে সকল অঙ্গে লিখে রামনাম।” তার পর প্রবল যুদ্ধ। অঙ্গদ, নীল থেকে সুগ্রীব, সব বানরসেনা আহত। হনুমান পালিয়ে যায়, লক্ষ্মণও আহত। ধনুর্বাণ হাতে আসেন রামচন্দ্র। তরণী দেখে, রামের ভিতরেই পর্বত, নদনদী, তপোলোক, ব্রহ্মলোক। তখন সে রামের স্তব করে। রাম ভক্তকে মারতে চান না। তিনি বিভীষণকে জানান, এ-হেন ভক্ত তিনি লঙ্কায় আশা করেননি। ভক্তের জন্য সীতা উদ্ধার না করেই ফিরে যাবেন তিনি। পিতা বিভীষণ দেখলেন, সর্বনাশ! তাঁর ভক্ত পুত্র তো রামের হাতে মরে অক্ষয় স্বর্গের প্রত্যাশী। তিনি রামকে বলেন, ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়া এই রাক্ষসের মৃত্যু নেই। অতঃপর সেই ব্রহ্মাস্ত্রে “দুই খণ্ড হয়ে বীর পড়ে ভূমিতলে/ তরণীর কাটা মুণ্ড রামরাম বলে।” তার পর বিভীষণ জানান, এই বীর তাঁরই পুত্র। রামের হাতে মরে স্বর্গবাস চেয়েছিল। “ধন্য আমি পুণ্যবান আমার সন্তান/ মরিয়া তোমার হস্তে পাইল নির্বাণ।”

রাবণের কাছে নীতিশিক্ষা

এই যে রাক্ষসপুরীতে ভক্তি, রাম-রাবণের যুদ্ধশেষে এই ‘টেকনিক’টাই কাজে লাগান ফুলিয়ার কবি। বাল্মীকি রামায়ণে রামের ব্রহ্মাস্ত্রে আহত রাবণ ভূতলে, বিভীষণ এসে জানান, রাবণ বেদপারগ, মহাতপা, দানধ্যান ও অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতেন। রামের অনুমতি পেলে তিনি এ বার দাদার শেষকৃত্য করতে পারেন। রাম তখন বললেন, “মৃত্যুতেই সব শত্রুতার অন্ত। রাবণ যেমন তোমার স্নেহপাত্র, সেইরূপ আমারও জানিবে।” রামায়ণ শুধু পিতৃভক্তি, পতিভক্তির কথা বলে না। মৃত শত্রুকে সম্মান করতেও শেখায়। রামভক্ত রাজনীতি কবে যে এ সব শিখবে!

কিন্তু ওই যে রাবণের মৃত্যুর বর্ণনা সরাসরি দেননি বাল্মীকি, সেই ফাঁকটাকেই ব্যবহার করলেন কৃত্তিবাস। সংস্কৃতের আদিকবিকে ভিতু বলে ঠাট্টাও করলেন, “ভয়ে মুনি রাবণের মৃত্যু নাহি লেখে/ কি জানি রাবণ রুষ্ট হয় পাছে দেখে।” আদিকবিকে নিয়ে ‘ইরেভারেন্ট’ ভঙ্গিতে হাসিঠাট্টা করা যায়, এটাই রামায়ণী ঐতিহ্য।

অগত্যা কৃত্তিবাসেও ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাতে তৎক্ষণাৎ রাবণের মৃত্যু হল না, আহত রাক্ষসরাজকে দর্শন দিতে গেলেন রামচন্দ্র। রাবণ তো তাঁরই ভক্ত। “আমার পরম ভক্ত রাজা দশানন/ শাপেতে রাক্ষস-জন্ম হয়েছে এখন।” এই ভক্তি মধ্যযুগের অবদান। বাল্মীকির মহাকাব্যে এটি নেই, থাকার কথাও ছিল না। তাই কৃত্তিবাসে রুধিরাক্ত আহত রাবণের কাছে রাজনীতি শিখতে আসেন রামচন্দ্র, “ধর্মাধর্ম রাজকর্ম বিদিত তোমাতে/ তব মুখে রাজনীতি বাসনা শুনিতে।” রাবণ কী শেখালেন? যখনই ভাল কাজের ইচ্ছা হবে, আলস্য ত্যাগ করে সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলবে। আর খারাপ পাপ কাজে নামার আগে ভাবনাচিন্তা করা উচিত। “যদি সীতা আনিতাম ভেবেচিন্তে মনে/ তবে কেন সবংশে মরিব তব বাণে।” শঙ্করাচার্য থেকে কথকঠাকুর, সকলের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আগামী কাল মন্দির উদ্বোধন ভাল না খারাপ কাজ হিসেবে গণ্য হবে, সেই ভার ভাবীকালের কৃত্তিবাসদের হাতেই থাকুক।

তিনশো রামায়ণ

শুধু কৃত্তিবাস? কথকদের তুলসীদাসী ‘রামচরিতমানস’ পাঠের অন্যতম নিয়ম ৪২ দিন ধরে কথকতা। সারা মাস কেন? প্রতি মাসের চন্দ্রিমাস্নাত শুক্লপক্ষে দেবতাদের প্রাবল্য, এবং কৃষ্ণপক্ষে অসুরদের। সুরাসুর সকলেই রামনাম শোনে। তুলসীদাস জানান, রামের হাতে নিহত অসুরেরাও মুক্তি পায়। শ্রীরাম তো অক্ষরব্রহ্ম, তাই মৃত্যুর আগে কুম্ভকর্ণ, রাবণ সকলের দেহ থেকে নির্গত তেজঃপুঞ্জ তাঁর মুখে মিলিয়ে যায়। দেবতা, রাক্ষস সকলে সেই পরমব্রহ্মের প্রকাশ। এই অদ্বৈতবাদ ও ভক্তি বাল্মীকিতে নেই।

রামকথায় ভক্তির কি একটাই পথ? সে বহুধাবিস্তৃত। এ কে রামানুজন তাঁর ‘তিনশো রামায়ণ’ নিবন্ধের শুরুতেই বলেছিলেন, তিনশো একটি সংখ্যা মাত্র। শুধু সংস্কৃতেই অন্তত ২৫ রকম রামায়ণ আছে। লোককথায় পিতৃসত্য পালনের জন্য রাম বনবাসে যাচ্ছেন দেখে সীতা বায়না জুড়লেন, তিনিও যাবেন। রাম অনেক বোঝালেন, কিন্তু সীতা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “কবে রাম বনবাসে একা গিয়েছে? মনে করে দেখো, যতবার রাম বনবাসে গিয়েছে, সীতাও সঙ্গে ছিল।” তুলসীদাসের অরণ্যকাণ্ডে রামচন্দ্র সীতাকে বলেন, “প্রিয়ে, এ বার কিছু নরলীলা সম্পন্ন করব। তুমি কিছু দিন অগ্নির মধ্যে বাস কর।” সীতা অগ্নিতে গেলেন, রেখে গেলেন তাঁর ছায়ামূর্তি। রাবণ তাকেই অপহরণ করল, তা নিয়েই যুদ্ধ হল। লঙ্কাধ্বংসের শেষে অগ্নি তাঁকে রামের কাছে ফেরত দিয়ে গেলেন। বাল্মীকির রাম-সীতা এ রকম নরলীলা করার কথা বলেন না। রামায়ণ বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ভাগবত, পদ্মপুরাণ ইত্যাদির অবদান। সেখানে এবং রামানুজী সম্প্রদায়ের লেখায় প্রথম রাম-সীতাকে বিষ্ণু ও লক্ষ্মী বলে ভাবা হয়। বস্তুত ভাগবতের প্রভাব বোঝা যায় মথুরা-বৃন্দাবনের রসিক সম্প্রদায়ের রামকথায়। সেখানে কৃষ্ণের মতো রাম প্রাসাদের রমণীদের সঙ্গে রাসলীলা করেন।

তুলসীদাস কিন্তু আরও কিছু নিয়ে এসেছেন। তিনিই রামলালা বা বালক রামচন্দ্রের কথা বলেন। সেই রামের ভক্ত ‘কাকভূশণ্ডি’ নামে কৈলাসবাসী এক অমর কাক। বিষ্ণুবাহন গরুড়কে তিনি রামকথা শোনান। উত্তরকাণ্ডে এসে কাকভূশণ্ডি জানান, ছোট্ট রামচন্দ্রের সঙ্গে তিনি খেলতেন। শিশু রামচন্দ্র আধো আধো ভাষায় কলকল করতে করতে তাঁকে ধরতে যেতেন, আর তিনি উড়ে পালাতেন। কিন্তু দূর আকাশে, ব্রহ্মলোকে যেখানেই কাক যায় না কেন, দেখা যায় তার দুই আঙুল পিছনেই শ্রীহরি। ভয়ে কাক উড়তে উড়তে ফের অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে। এই বার শিশু হাসল। হাসতেই কাক তার মুখে ঢুকে গেল। সেই মুখগহ্বরে অনেক পাহাড়, অনেক নদী, অনেক ব্রহ্মা, অনেক বিষ্ণু। কিন্তু সব ভুবনেই ভিন্নরূপে অযোধ্যা, দশরথ, কৌশল্যা ও রাম-লক্ষ্মণ। বহু ব্রহ্মাণ্ডে এই ভাবে শতকল্প কাটিয়ে কাকভূশণ্ডি আবার চলে এলেন শিশু রামের কাছে। মাত্র দুই পলকে ঘটে গেল এ সব মায়ার খেলা। দশরথ, কৌশল্যা এবং অন্যরা কিছু জানতেও পারলেন না।

অতএব লক্ষ্মী আর বিষ্ণু শুধু সংস্কৃত ভাষায় বা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রাসাদমন্দিরে থাকেন না। তাঁরা থাকতে পারেন শিশুর মুখে, আপনার-আমার প্রান্তিক ভাষায়, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কুঁড়েঘরে।

কোঙ্কণ উপকূলে কুঙ্কণা নামে একটি ভাষা আছে। এক দিকে মরাঠি, অন্য দিকে গুজরাতি ভাষার প্রবল চাপে সেই ভাষা আজ বিপন্ন। তবু সেখানেও কথকরা থালা বাজিয়ে রামায়ণ গান শোনান। সম্প্রতি অরিন্দম দাশগুপ্ত বাংলা অনুবাদে সেই গান বার করেছেন। সেখানে সীতা মহাদেবের মেয়ে। জনক আর দশরথ বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ ভায়রাভাই। রাজারা থাকেন কুঁড়েঘরে। বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটিকে বড় করতে হবে। তাই রানি প্রথমে চলে গেল আড়ালে। রাজা বললেন, “রানির তো বাচ্চা হবে, তাই আমি ঘরদোর সামলাচ্ছি।” ছোট্ট সীতা অক্লেশে হরধনুতে তির লাগিয়ে নিয়ে খেলা করে। অন্য দিকে রাবণের হাত-পা নেই, শুধু মাথা আর ধড়টাই সব। দাদারা তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেয়, বেচারি পরে তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করে দশ মাথা এবং লঙ্কারাজ্য পায়। বাল্মীকি রামায়ণে আছে, পঞ্চাশটি লোক স্বয়ংবর সভায় লোহার ভারী বয়ে আনে। অথচ কুঙ্কণা রামায়ণে সীতা ছোট থেকে লোহার ভারী হরধনু নিয়ে খেলা করে, অক্লেশে তাতে তির ছোড়ে।

নবনীতা দেব সেনও তাঁর ‘মেয়েরা যখন রামায়ণ গায়’ প্রবন্ধে একটি মৈথিলি গানের কথা বলেছিলেন। সেখানে সীতা ঝাঁট দিতে দিতে দেখেন উঠোনে হরধনু পড়ে আছে। তিনি বাঁ হাতে সেটিকে সরিয়ে দেন। কোথায় কঙ্কণ উপকূল আর কোথায় মিথিলা! নবনীতা ময়মনসিংহের চন্দ্রাবতী রামায়ণের কথা লিখেছিলেন। কী আশ্চর্য! সংস্কৃতে জৈমিনির ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ থেকে বাংলার ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’, দিবাকর ভট্টের ‘কাশ্মীরী রামায়ণ’, বহু জায়গায় সীতা রাবণের মেয়ে। এত সব কারণেই কলকাতা মনুমেন্টের কথক শ্রীকান্ত পাণ্ডে আজও রামকথা আর রামায়ণকে আলাদা করে দেন, “অয়ন মানে ঘর। ঘর পর্যন্ত যে চরিত, সেটা সংস্কৃতে বাল্মীকি মহারাজ লিখে গিয়েছেন। কিন্তু কলিযুগে মানুষরা বেশির ভাগ অশিক্ষিত, তারা সে সব বুঝবে না। তাই গোস্বামীজিকে ভগবান এটা সরল ভাষায় লিখতে বললেন, ‘ভাষাবদ্ধ করবি মৈঁ সোঈ/ মোরেঁ হৃদয় প্রীতি অস হোঈ।’ তাই তুলসীদাসজি সংস্কৃতের গণ্ডি ভেঙে অওধি, ভোজপুরি ভাষা ব্যবহার করলেন, যাতে সাধারণ মানুষ এ সব বুঝতে পারে। তাই এর নাম রাখলেন ‘রামচরিতমানস’। মানস আর রামায়ণ তাই আলাদা।”

সংস্কৃত বনাম হিন্দি, রামায়ণ বনাম মানসেই সব ফারাক শেষ হয়নি। ময়মনসিংহের মেয়েরা ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’ গাইতে গিয়ে নবনীতাকে জানান, পুরুষরা রামায়ণ গান। আর তাঁরা করেন রামসীতার গান। নবনীতা লিখেছিলেন, সংস্কৃত থেকে আঞ্চলিক ভাষায়, লোক-ঐতিহ্যে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন রামকথার বীজ। যার যেটি পছন্দ, তুলে নিয়েছেন। বাল্মীকি এক রকম, কালিদাস আর এক রকম, কৃত্তিবাস, তুলসী বা কম্বনরা আর এক রকম। হিন্দুত্বের একাধিপত্য নিকেশ করতে তাই ফেসবুকে ‘আমাদের রাম সতীদাহ থেকে মেয়েদের বাঁচায়, ওদের রাম অগ্নিপরীক্ষা নেয়’ মার্কা বোকা-বোকা পোস্ট ঝাড়লে চলবে না, এই বিকল্প কথকতাগুলিও তুলে ধরতে হবে। কিন্তু বিকল্পের রাজনীতি কে আর করে! বাল্মীকিতে সমুদ্রের ধারে শ্রীরামের রামেশ্বরম শিব প্রতিষ্ঠার কাহিনি নেই, লোককথায় আছে। অযোধ্যাযাত্রার দিন কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী অন্ধ্রপ্রদেশের লেপাক্ষী মন্দিরে গিয়েছেন। সেখানেই জটায়ুর মৃত্যু। এটি বাল্মীকিতে নেই, স্থানীয় লোককথায় আছে। একটাই রামায়ণ ছিল না, কৃত্তিবাস নিজেই ‘জৈমিনি রামায়ণ’-এর কথা বলে গিয়েছেন, “এ সব গাহিল গীত জৈমিনী-ভারতে/ সম্প্রতি যে কিছু গাই বাল্মীকির মতে।”

সম্পাদনায় রাম

বাল্মীকি, কৃত্তিবাস বা জৈমিনি কেউই স্বরাট নন। পুঁথি থেকে ছাপাখানায় আসার পর তাঁরা নানা ভাবে সম্পাদিত হয়েছেন। সুকুমার সেন দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের প্রকাশকরা অনেকেই কৃত্তিবাসকে অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট ভাবতেন। তাই বারংবার সেটি কাটছাঁট করে নিজস্ব পয়ার ছন্দ জুড়ে দিতেন। কিন্তু ছাপাখানায় না গেলে সংগৃহীত পুঁথিগুলি থাকত অবিকৃত। গত শতাব্দীর শেষ ভাগে তাঁর প্রবন্ধ ‘কথকতার নানা কথা’ লিখতে গিয়ে ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র বরাহনগর পাঠবাড়িতে রক্ষিত একটি পুঁথির কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেখানে যুদ্ধশেষে সীতার অগ্নিপরীক্ষা দেখে হনুমান চটে আগুন, “আমার মা অশতি বলে রাম তাকে ত্যাগ করছেন! আজ দেখি, তিনি কেমন বীর! জদি মাকে প্রতিপালন কর্ত্তে পারবে না, আমায় কেনো বল্লে না। আমি ভিক্ষা করে মাকে খায়াতাম (পুঁথির বানান)।” হরধনু ভঙ্গকেও পাত্তা দেয় না হনুমান, “সে ধনু বহুকালের পুরাতন, জীর্ণ হয়েছিল।” ইতিহাসবিদকে আগামী কালের প্রাণপ্রতিষ্ঠার তাৎপর্য জিজ্ঞেস করেছিলাম। সাফ উত্তর, “আগে বৈষ্ণব রাজারা ধর্মের কারণে এ সব মন্দির তৈরি করতেন। এখন রাষ্ট্রের উদ্যোগে, ব্যবসায়ীদের উৎসাহে। কারিগররা কেউ হিন্দু, কেউ বা মুসলমান। সে দিক থেকে দেখলে এটাই প্রথম সেকুলার মন্দির।”

রাজনীতিকরা যদি নম্য হিন্দুত্বের বদলে কথকতা এবং রামকথাকে গুরুত্ব দিতেন, ইতিহাস বদলাত? গৌতমবাবু হাসলেন, “ভবিষ্যৎ বলবে। এই প্রশ্নের উত্তর আজই সম্ভব নয়। আর ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’-এ বশিষ্ঠ অযোধ্যায় বিরক্ত রামকে বলেছিলেন, সংসারে ঝামেলা থাকবেই।”

ঝামেলা কোথায় নেই? চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী নরম মনের মানুষ ছিলেন, তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় সীতা বিসর্জন সহ্য করা যায়নি। তাই বাল্মীকি রামায়ণের সারানুবাদে তিনি সপ্তম খণ্ডটি বাদ দেন। আমাদের রাজশেখর বসুর সারানুবাদ সেই রাস্তায় হাঁটেনি। রাজশেখরকে সাধুবাদ জানিয়ে তাই বুদ্ধদেব বসুর পরিষ্কার বক্তব্য, “যে সীতার জন্য এত দুঃখ, এত যুদ্ধ, তাকে পেয়েও হারাতে হল এই কথাটাই তো রামায়ণের অন্তঃসার। যুদ্ধে যখনই জয় হল, রামও তখনই সীতাকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত। কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। রামের যুদ্ধ, পাণ্ডবদের যুদ্ধকে এ জন্যই ধর্মযুদ্ধ বলেছে।”

কৃত্তিবাস-কথা

শিয়ালদহ-শান্তিপুর লাইনে ফুলিয়া জায়গাটাকে আজ আমরা কেমন ভাবে চিনি? কৃত্তিবাসের জন্মস্থান অবশ্যই, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা চমৎকার তাঁতের শাড়ি। শিল্প না থাকলে, শুধু রামায়ণী ঐতিহ্যে একটা শহরের অর্থনীতি যে স্টেশনের নাম বদলে টেকে না, তার উদাহরণ ফুলিয়া। নবীনচন্দ্র সেন রানাঘাটের মহকুমাশাসক থাকার সময় ১৮৯৪ সালে ফুলিয়া গিয়ে খুব দুঃখিত হন। জঙ্গল আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা দরিদ্র গ্রাম, এক মুসলমান প্রজার বাঁশঝাড়ে কৃত্তিবাসের ঢিপি বলে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল লোকজন। জায়গাটাকে পবিত্র জ্ঞানে হিন্দু-মুসলমান কেউই সেখানে জমি চষত না। উনিশ শতকের এই সব হতদরিদ্র মুসলমান চাষিরা ‘সেকুলারিজ়ম’ শব্দটা জানতেন না, তবু এখানেই বাংলার ঐতিহ্য।

অমিয়শঙ্কর চৌধুরী তাঁর ‘কৃত্তিবাস ও বাংলা রামায়ণ’-এ লিখছেন, এর বহু পরে উচ্চবর্গ এলেন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রচেষ্টায় জমিটা কিনে ‘কৃত্তিবাস কূপ’, ‘কৃত্তিবাস স্মৃতি বিদ্যালয়’ ও ‘কৃত্তিবাস স্মৃতিস্তম্ভ’ তৈরি হল। বাংলা ১৩২২ সালের ২৭ চৈত্র কৃত্তিবাসের জন্মদিনে উদ্বোধনে এলেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, তিনি বক্তৃতা দিলেন, “সে রাম, সে অযোধ্যা কিছুই নাই। তদ্রুপ আজ সেই ফুলিয়া নাই, সেই জাহ্নবী নাই, সেই কৃত্তিবাস নাই। তবু রামের কথা, রামের স্মৃতি সকল নরনারীর প্রাণে প্রাণে গাঁথা রহিয়াছে।” ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন তাঁর কাগজে সেই উৎসবের রিপোর্টাজ় লিখছেন, “লোকে লোকারণ্য। আসিয়াছেন পল্লীরমণীবৃন্দ… মনে হইল আমরা সত্যসত্যই এক মহাতীর্থে সমাগত হইয়াছি।” লেখাগুলিতে স্টেশনের নাম বৈঁচা। পূর্ব রেলের সেই স্টেশন আর নেই। নতুন অযোধ্যাধামের মতো, বৈঁচা থেকে একটু এগিয়ে তৈরি হয়েছে ফুলিয়া স্টেশন।

একটি কথা তাই মনে রাখতে হবে। বারাণসী মোগল আমলের শেষ থেকে একটি দেশীয় রাজ্যের রাজধানী ছিল, ইংরেজ রাজত্বেও সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কিছু তৈরি হয়েছে। আর অযোধ্যায় এখনও রামনাম ছাড়া অন্য শিল্প নেই। আগামী কালের উৎসব তাই চমকপ্রদ। ভবিষ্যতের কাকভূশণ্ডি ও কথাকারদের হাতেই বাকি গল্পটা আপাতত ছেড়ে দেওয়া যাক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Lord Rama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE