এই গল্পটি যাঁর লেখার কথা ছিল, তিনি এপ্রিল মাসে হারিয়ে গিয়েছেন। বোঝার সুবিধার্থে তাঁকে আমরা লেখক বলে উল্লেখ করব। বসন্ত হতেই লেখকের মধ্যে এক প্রকার উন্মাদনা লক্ষ করা গিয়েছিল, তিনি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত লয়ে কথা বলা শুরু করেছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি নতুন কিছু অভ্যাস করছেন, অথবা তাঁর তাড়া আছে কোথাও যাওয়ার, অথবা কিছু গোপন করছেন। তিনি যা লিখছিলেন তা স্বগতোক্তি হয়ে উঠছিল, জনসমক্ষে লেখক বিড়বিড় করছিলেন, আর যখন-তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছিলেন দক্ষিণবঙ্গের দাবদাহের মধ্যে। যখন ফিরে আসছিলেন, আমরা দেখেছিলাম, তাঁর দেহ অবসন্ন, তাঁর হাত, তাঁর কাঁধ হতে গলে প্রায় মাটির কাছাকাছি নেমে এসেছে। আমাদের মনে হচ্ছিল, লেখক বুঝি মাটি ছুঁতে চাইছেন তাঁর দুই হাত দিয়ে। লেখক বুঝি বটগাছের মতো— লেখক বৃক্ষ হয়ে উঠছেন, বুঝি কচি সাহিত্যিকদের আশ্রয় হয়ে উঠবেন এই বার। একটা-দুটো পাখি যে তাঁর মাথার ভিতর আগে থেকেই বাসা বেঁধেছিল, তা আমাদের জানা ছিল। তার পর জানলাম, এই বসন্তে লেখকের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকার বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। বিষয়টি এ বার আমাদের কাছে স্পষ্ট হল। আমরা জানলাম, প্রেমিকাটি লেখকের কাছ থেকে তার নিজের যা কিছু— সমস্ত উত্তেজক ও অনুত্তেজক পোশাক, একাধারে আশকারাদায়ী ও সসম্ভ্রম দূরত্বসৃষ্টিকারী নানা প্রসাধনী, বারোটি গল্পের বই (তার মধ্যে একটি নিষিদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, আর একটি ১৯৯৩-এ), তিনখানি বাংলা ধ্রুপদী উপন্যাস, একটি দাঁতের মাজন ও মাতা মেরির (যাঁকে মেয়েটি মা বলে ডাকত এবং রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে মিনিট কুড়ি ধ্যান করত যার সামনে বসে) একটি বাঁধানো ছবি নিয়ে লেখকের জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে— তখনও আমরা জানতাম না যে, এই গল্পের লেখকও আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন এক দিন। মেয়েটি যা ফেরত নিতে ভুলে গিয়েছে তা হল, তার কথা বলার গতি। বিচ্ছেদের খবর জানার পর আমাদের মধ্যে এক জন এই বিষয়টা চিহ্নিত করে যে, লেখকের সদ্যপ্রাক্তন প্রেমিকাও দ্রুতলয়ে কথা বলত— যেন সে নতুন কিছু অভ্যাস করছে, বুঝি তার তাড়া আছে কোথাও পালানোর, অথবা সে সকলের থেকে গোপন করছে যে, লেখকের প্রতি তার আর কোনও মোহমায়া বেঁচে নেই।
এত দূর জানার পর লেখকের প্রতি আমাদের অহেতুক মায়া হয়, যে-হেতু আমরা বরাবর গল্প-উপন্যাস লেখকদের প্রতি, বলা চলে সাহিত্যিকদের (মূলত পুরুষ) প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। তার পর আমরা জানতে পারি, লেখক মেয়েটিকে কোনও দিন ভালবাসেননি, কেবল লেখার লোভে তাকে কাছে টেনেছিলেন। লেখক মনে করেছিলেন, মেয়েটিকে ওলটপালট করে তার সবটুকু পড়ে ফেলবেন আর তার পর লিখবেন এমন এক উপন্যাস, যা আগে লেখা হয়নি। যা পড়ে পাঠক হাসবেন ও কাঁদবেন, সারা রাত যৌন উত্তেজনায় জেগে থাকবেন, উপন্যাসটি অতঃপর পুরস্কৃত হবে এবং ক্রমশ কালজয়ী হয়ে উঠবে। আধপড়া মেয়েটি এ সবের পূর্বেই লেখককে ছেড়ে চলে গেলে লেখক প্রথমে আছড়ে ভেঙে ফেলেন তার লেখার টেবিল ও চেয়ার, তার পর অস্থির ভাবে বেরিয়ে যান গৃহ হতে, ফিরে আসেন যখন, তখন তাঁর দু’টি হাত প্রায় মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে আর তাঁর মুখ হতে মুষলধারে বেরিয়ে আসছে আধপড়া সব কথা। সেই সব লিখে ফেলার লোভে আমরা তাঁর সান্নিধ্যে এলে বুঝতে পারি, এ সব কথার কোনও সঙ্গতি নেই। লেখক মেয়েটির খোঁজ করেন না কোথাও, এমনকি তার নামটুকুও আমাদের জানান না, তাকে আমরা অগত্যা ‘মেয়েটি’ বলেই উল্লেখ করছি। লেখক শুধু কথার ফাঁকে দ্রুতলয়ে মেয়েটির সঙ্গে তাঁর যাপিত জীবনের বিশদ বর্ণনা দেন, আমাদের কান লাল হয়ে ওঠে। আমাদের মধ্যে অনেকেই যৌন উত্তেজনায় জেগে থাকে সারা রাত। কেউ কেউ মেয়েটির খোঁজ করে হন্যে হয়ে। সব কিছু শুনে আমরা বুঝতে পারি, মেয়েটি লেখকের বিত্ত এবং প্রতিভা ব্যতীত আর কিছুর প্রতি আকৃষ্ট ছিল না।
এ কথা জানার পর লেখক তিন দিন ঘুমোতে পারেন না, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। তিনি একের পর এক এমন সমস্ত গল্প লিখতে শুরু করেন, যা প্রমাণ করে মেয়েটি লেখককে নয়, আসলে লেখকই মেয়েটিকে ত্যাগ করেছেন। টান-টান সেই সব গল্প পড়ে আমাদের পিঠ বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়, আমরা লেখকের মধ্যে এক আততায়ীকে চিহ্নিত করি, তাঁর প্রতি বিতৃষ্ণ হই। লিখতে লিখতে লেখক এক সময় গুলিয়ে ফেলেন কে কাকে ত্যাগ করেছে, কে কার পিঠে ছুরি বসিয়েছে, কে কার থেকে বারোখানা গল্পের বই, তিনটে উপন্যাস ও মাতা মেরির ছবি নিয়ে পৃথিবীতে বিলীন হয়ে গিয়েছে— আমাদেরও আর মনে থাকে না।
তেরোই এপ্রিল লেখক আমাদের কাছে হাজির হন, আমাদের নাকের সামনে তাঁর ডান হাতের কব্জি তুলে ধরে তাঁকে শোঁকার আর্জি জানান। আমরা লেখকের কব্জির গন্ধ শুঁকি, আর টের পাই, লেখকের কব্জি থেকে মেয়েটির গায়ের গন্ধ নির্গত হচ্ছে। আমরা অবাক হই, ভাবি সে বুঝি ফিরে এসেছে। তখন লেখক আমাদের জানান যে, তিনি সন্দেহ করছেন তাঁর গল্প থেকে মেয়েটির সুগন্ধ তাঁর দেহে ছড়িয়েছে, যে ভাবে ভোপালে বা চেরনোবিলে অতর্কিতে এক দিন বাতাসে ছড়িয়েছিল মারণ কণা। তেজস্ক্রিয় সে সব গল্পকে লেখক ত্যাজ্য ঘোষণা করে আমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, কিন্তু আমরা লেখককে ফিরিয়ে দিই, কারণ এত দিনে তাঁর প্রতি আমাদের যাবতীয় বিশ্বাস লোপ পেয়েছে, জন্ম নিয়েছে ভয় এবং সন্দেহ। আমরা তাঁকে জানাই তাঁর ভীতি অমূলক, আমরা তাঁকে ফিরে যেতে বলি।
তার পর এক গ্রীষ্মদুপুরে আমার বুকের ঘামে আমি নিজের ঠাকুমার গন্ধ ফেরত পাই, যা সমেত তিনি ২০০৫ সালে গত হয়েছিলেন। আমার পরিচিতরাও তাদের দেহে বিগত সব পূর্বপুরুষ ও পোষ্যের গন্ধ পেতে শুরু করে। লক্ষ করি, প্রত্যেকেই আমরা আমাদের কব্জিতে বহন করছি মা-ঠাকুমা, প্রেমিক-প্রেমিকা ও আমাদের পরম শত্রুর দেহের আতর। এই তথ্যসমেত আমরা লেখকের আস্তানায় ছুটে যাই ও দেখি, গল্পটা না লিখেই তিনি হারিয়ে গেছেন। লেখকের ঘরে পড়ে আছে শুধু তাঁর গায়ের বুনো ঘ্রাণ। অথবা লেখক মরে আতর হয়েছেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)