শিবু আর পচা খুব টেনশনে। একটু হালকা হতে, এখন তরললোকে।
“বুঝলি পচা, আগে মা আসত রয়েসয়ে। শিবকে পটিয়ে ষষ্ঠীতে। এখন তো সগ্গেও নারীবাদী সংগঠন! মহালয়ার চণ্ডীপাঠ শেষ হওয়ার আগেই মা ঢুকে যাচ্ছে প্যান্ডেলে। ব্যস! কাড়াক ঝিং শুরু। ছারপোকার মতো মানুষ বেরিয়ে পড়ল। আমরা পুরো ঠুঁটো জগন্নাথ! কোনও আমদানি নেই। আগে পুজোর ভিড়ে দু’-একটা কানের দুল, গলার হার কপালে জুটত। এখন রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। বেশির ভাগই উপরে রং, ভিতরে জং। সব ইমিটেশন চেকনাই! উল্টে ধরা পড়লে আড়ং ধোলাই।”
“ঠিক বলেছ গুরু। সে বার বাদামতলায় একটা মানিব্যাগ ঝাড়লাম। ভিতরে শুধু লটারির টিকিট! এই জি-পে, ফোন-পে সব শেষ করে দিল। পুজো না কাটলে বাজার উঠবে না গুরু।”
“আর বাজার! এখন বসে আঙুল চোষ।”
“ঠিক বলেছ। আমাদের কথা ভাববার কেউনেই গো!”
“ওরে, মানুষকে কে বোঝাবে! চুরিবিদ্যা হল মহাবিদ্যা। পৃথিবীর আদিমতম শিল্প। শুধু কী দুগ্গাপুজোয় মুক্তি আছে রে! এর পরেই কালীপুজো। নামে এক দিনের পুজো। কিন্তু কমিটিগুলো তো জল-বাতাসা দিয়ে চার দিন ধরে শুকনো মালা গলায় মাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে। লাও ঠ্যালা! কোথাও বাইশ হাত, তো আবার কোথাও চব্বিশ হাত! এ দিকে আমাদের যে হাত খালি, সে দিকে সরকারের কোনও চিন্তা-ভাবনাই নেই! একটা হাজার টাকার সিভিক-চোর ভাতা চালু করলে, যা হোক করে অন্তত বাংলার খরচাটা তো চলে যেত। টেনশন হয় রে পচা! জগদ্ধাত্রীও এখন মফস্সল ছেড়ে কলকাতামুখী। তার পর টুকটাক ছট, কার্তিক তো পর পর লেগেই আছে। উৎসব মানেই ডাল সিজ়ন। আনন্দের রাত, আমাদের পেটে লাথ।”
“হতাশ হয়ে লাভ নেই গুরু। সব পুজোআচ্চা কেটে যাক। শীতকাল আসছে। গুছিয়ে ঠান্ডা পড়বে। সবাই লেপ চাপা দিয়ে জম্পেশ করে ঘুমের দেশে, আর আমরা একদম সাফ করে দেব নিঃশেষে।”
“সে গুড়ে বালি। পুজোর মোচ্ছব কাটতে না কাটতেই শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ। রাত তিনটে অবধি খেলা। তার পর আর ভাল অপারেশন হয়?”
“এটা তো মাথায় ছিল না! আচ্ছা, বাঙালি এত খেলা দেখে কেন? শীতের রাত! বৌয়ের পাশে চুপচাপ ঘুমো। তা নয়! সারা রাত নিজে টেনশন করবে, আর আমাদেরও টেনশনে ফেলবে।”
“ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সেজে ঝগড়া করে মরল। ওরে বোকা, মারাদোনার দাবনাটা দেখেছিস! শাকপাতা জাবনা খেয়ে ও রকম দাবনা কোনও দিন বানাতে পারবি? চারাপোনার আলু-বড়ি দিয়ে পাতলা ঝোল খেয়ে বিশ্বকাপ কপচায়! চায়ের কাপে তোলপাড় বিশ্ব! পুরো ম্যাচ সোজা বসে দেখার দম নেই, পিঠ টনটন করে, তারা সাত জন্মে কোনও দিন মাঠে নেমে খেলতে পারবে বলে তোর মনে হয়!”
“সে ছাড়ো গুরু ও সব। এখন উপায় কী হবে, সেটা বলো।”
“উপায় একটা বার করেছি। লাইন চেঞ্জ করব। কনে চুরি।”
“মানে? নারী পাচার! সে তো ধরা পড়লে বড় কেস খেয়ে যাব!”
“আরে দূর! পাচার নয়। কনের অমতে সম্বন্ধ করা বিয়ের দিন কনে ঝেড়ে তার লাভারের হাতে তুলে দেওয়া। ফেলো কড়ি, মাখো প্রেম। একটা ফুল কন্ট্রাক্ট নিয়েও ফেলেছি।”
“কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না গুরু। একটু খোলসা করে বলো।”
“বলছি… আরে, ওই প্যালা আছে না। এখন ‘কবি পেলব দত্ত’ হয়েছে। আমাদের লাইনেরই ছেলে। তবে একটু আলাদা। কলেজ স্ট্রিট ফুটপাতে দেখবি দশ টাকায় সব পুরনো বই বিক্রি হয়। সেই সব বই থেকে ঝেড়ে ব্যাটা সব কবিতা লেখে। এখানে ওখানে পাঠায়। কাউকে বলিস না।”
“কবিতা চোর! পুরো নতুন জিনিস মাইরি!”
“কিন্তু আসল সমস্যা আলাদা। নতুন বস্তির বুড়িকে চিনিস?”
“ওই যে শিখাদির সঙ্গে সারা দিন ঘোরে?”
“শিখাদি কী রে ব্যাটা! বৌদি বল!”
“ভুল হয়ে গেছে গুরু। ভুলেই গেছিলাম, যে তোমার তো আবার শিখাদি, থুড়ি বৌদির সঙ্গে একটু ইয়ে আছে। হ্যাঁ, ওই বুড়িদির কথা কী বলছিলে?”
“বলছি… ওই বুড়িকে ছাড়া প্যালা নাকি বাঁচবে না! পুরো প্যালেন্টাইন কেস। আমি শিখার কাছ থেকে বুড়ির মোবাইল নম্বরটা নিয়ে প্যালাকে দিয়েছি। এখন কেসটা পুরো জমে ক্ষীর! সামনের মাঘেই বুড়ির বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে দমকলে। কিন্তু ওই আগুন দমকল নেবাতে পারবে নাকি!”
তার পর…
বুড়ির বিয়ের দিন সন্ধেবেলা যথারীতি বুড়ি, শিখা আর বুড়ির বুলাপিসি বিউটি পার্লারে হাজির। বুড়ি আর শিখা খুব করে ধরল, বুলা পিসিকেও ফেসিয়াল করে নেওয়ার জন্য। পিসি বাপের জম্মে এ সব করেনি। প্রথমে তো রাজিই হচ্ছিল না। শেষে ওদের চাপাচাপিতে মত দিল। প্যারিস, পুট্টি সব মাখানোর পর যেই না দুটো গোল শসা চাপা দিয়েছে পিসির দু’চোখের ওপর, অমনি বুড়ি আর শিখা কিছু টাকা পার্লারের মেয়েগুলোর হাতে গুঁজে দিয়ে ওখান থেকে ফুড়ুত। বাইরেই ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল শিবু আর পচা। সোজা রেজিস্ট্রি অফিস। প্যালা আগেই হাজির ছিল। হয়তো খুব কবিতা পেয়ে গেছিল! তার পর সইসাবুদ, মালাবদল, মিষ্টিমুখ। মধুরেণ সমাপয়েৎ। পুরো গরম দু’শোর বান্ডিল শিবুর হাতে।
কিন্তু ও দিকে বিয়েবাড়িতে তো ফুল কেলো!
দমকল পার্টির সঙ্গে হেভি ঝামেলা লেগেছে বুড়ির বাপের। শেষে বিয়ের আশা ছেড়ে দমকল ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে চলে গেল।
দিনকয়েক পর বুড়ির ফোন, “শিবুদা, আমার চুনির আংটিটা হারিয়ে গেছে! তোমরা দেখেছ?”
“না রে!”
“আচ্ছা, পরে এক বার বিউটি পার্লারে খোঁজ করে দেখব না-হয়।”
ফোন রেখে পচার দিকে তাকাল শিবু। ওর দুঁদে চোখে এক সেকেন্ড লাগল সবটা স্ক্যান করতে। এ বার পচা আমতা আমতা করে বললে, “ক্ষমা করে দাও গুরু! লোভটা সামলাতে পারিনি! লাভারকে দেব! আর কোনও দিন মক্কেলেরটা মারব না!”
“মনে থাকে যেন! কিন্তু... তুইও প্রেম করছিস!”
লজ্জায় লাল পচা। মাথা নিচু। তার পর গভীর রাত অবধি একটা বড় বোতল দু’জনে সাবাড় করল।
টলমল পায়ে বাড়ি গিয়ে ডোরবেল বাজাতেই শিবুর বোন বুঁচি দরজাটা খুলে দিল। বুঁচির হাতটা গ্ৰিলের উপর। অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে একটা লাল চুনির আংটি।
শিবুর জড়ানো গলায় শুধু একটা কথাই শোনা গেল, “শালা… বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)