চক্ষুদান শেষে ধীরপায়ে উঁচু মই থেকে নেমে এল জাফর। আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল দেবীমূর্তির কাছ থেকে। দূর থেকে এক বার তাকাল প্রতিমার দিকে। একদম ঠিকঠাক লাগছে।
কাজের ব্যাপারে বরাবর খুঁতখুঁতে ও। দেবীর চক্ষুদান মনের মতো না হলে একটা চাপা কষ্ট বুকের মধ্যে ঘুরপাক খায়।
বহু বছর আগে, যখন জাফরের বাবা এই গ্রামের একমাত্র বারোয়ারির দুর্গামূর্তির কাজ করত, গ্রামের মোড়ল বাসুদেব চক্রবর্তী বলেছিলেন, “যত ক্ষণ মূর্তি তোমার হাতে গড়ে উঠছে ইসমাইল, তত ক্ষণ সে মূর্তি, তুমি হচ্ছ শিল্পী। যখন তোমার কাজ শেষ হয়ে যাবে, প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে দেবী দুর্গার, মানুষ তখন ভক্ত, মূর্তি তখন ঈশ্বর।”
কথাটা আজও মনে রেখেছে জাফর।
পলাশন গ্রামের প্রায় চারশো বছরের পুরনো এই দুর্গাপুজো। তখন ইংরেজরাও আসেনি এ দেশে।
দেবী দুর্গা স্বপ্নাদেশ দেন, তাঁর মূর্তি যেন তৈরি করে দশ ক্রোশ দূরে ভুঁইমোহন গ্রামের এক মুসলমান গন্ধবেনে রজ্জাক শেখ।
সেই নিয়ম আজও চলছে। রজ্জাক শেখের পাঁচ পুরুষ পরের প্রতিনিধি জাফর আলি শেখ।
পূর্বপুরুষরা সুগন্ধি, আতর, ধূপ, তেল এ সব বিক্রি করলেও, ও রং আর তুলিকেই জীবন ও জীবিকা করে নিয়েছে।
সকাল-দুপুর ছবি আঁকা শিখিয়ে যে সামান্য কিছু আয়-উপার্জন হয়, তাই দিয়েই ওদের মা-ছেলের সংসার কোনও রকমে চলে যায়। কিন্তু মা এখন অসুস্থ। খুবই অসুস্থ।
পাশে রাখা বালতির জলের মধ্যে হাতটা ডুবিয়ে হাতের তালুর উপর লেগে থাকা রংটা ধুয়েনিল জাফর।
রাত গভীর হচ্ছে। দেবীকে এখনও শাড়ি, মুকুট, গয়না, কাগজের অলঙ্কার পরাতে হবে। ত্রিশূল, ধনুক, তির, গদা দিয়ে সুসজ্জিত করে তুলতে হবে তাঁকে। সিংহের কেশর লাগানোও বাকি।
পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে জাফরের। বাবার হাত ধরে আসত এই দুর্গামণ্ডপে। বাবা একমনে কাজ করত। গম্ভীর হয়ে মূর্তির দিকে তাকিয়ে বসে থাকত ছোট্ট জাফর।
দেখত, কাঠ, খড়, দড়ি দিয়ে কী ভাবে কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। বাবা তার উপর স্তরে স্তরে মাটি লাগিয়ে নিখুঁত ভাবে ঠাকুরের আকার দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে দুর্গা, তাঁর চার সন্তান,সিংহ, মহিষাসুর।
তরল সোনার মতো রোদ এসে পাক খেয়ে যেত পলাশন গ্রামের আনাচ-কানাচে। গাঙুর নদীর দু’ধারে কাশফুলেরা মাথা দোলাত হাওয়ায়। শিউলির গন্ধ ভেসে আসত দূর থেকে। নতুনপুকুরে সেজে উঠত অসংখ্য পদ্মফুল।
পাড়ায় ওর বয়সি ছোট ছোট বাচ্চারা মেতে উঠত হুল্লোড়ে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জাফর। এ বছর বর্ষা হয়েছে খুব। সকলে বলছে, শীতও নাকি জাঁকিয়ে পড়বে। শুধু মায়ের জন্য চিন্তা হয়। বাবা মারা গিয়েছে আট বছর হল। মা ছাড়া নিজের বলতে কেউ নেই ওর। ঘুমে আর জাগরণে মায়ের জন্য কষ্টটা ঘুরপাক খায়।
চোখ বুজলেই ও দেখতে পায় মায়েরভয়ার্ত চোখ।
মাস পাঁচেক আগে মা বলল, “জিভে ফোড়ার মতো কিছু হয়েছে। কথা বলতে গেলে, কিছু চিবোতে গেলে ব্যথা করছে।”
প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি জাফর। যখন দিল, ডাক্তার জানাল, চতুর্থ স্টেজ।
এর পর একটানা জাফরের ছোটাছুটি। কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে মায়ের জিভের অস্ত্রোপচার। রেডিয়েশন, কেমোথেরাপির পর নির্বাক মায়ের শূন্য দু’চোখের নীরব আত্মকাহিনি বুঝতে বুঝতে এক নিঃসঙ্গ দিনযাপন।
ভিতরের ভাঙন বুঝতে পারে না মানুষ। ছাত্রদের আঁকা শিখিয়ে সামান্য রোজগার। সারা দিন গাধার মতো পরিশ্রম। অভিভাবকেরা পাইপয়সা উশুল করে নেয়।
অনেক কিছু বলতে চায় মা। তরল খাবার খেতে খেতে যখন মুখ থেকে বেরিয়ে আসে খাবারের প্রায় সবটুকুই, বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে জাফরের। যেন মনে হয়, কোনও অদৃশ্য ছুরি ওর হৃৎপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে রোজ।
আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। আর ক’দিন পর ষষ্ঠী। দেবী দুর্গার বোধন।
পলাশন গ্রামের রীতি মেনে দেবীর চক্ষুদানের সময় ঢাক বাজানো হয়। এত ক্ষণ ঢাকিরা বাজিয়ে নিশ্চিন্ত মনে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। দুর্গামণ্ডপের এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছে গ্রামের মাতব্বর শ্রেণির কয়েক জন। তারাও জাফরের তুলির টানে মুগ্ধ।
নিস্তব্ধ গ্রামটার বুক চিরে নিশিডাকের মতো ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে একটু আগে থেমে যাওয়া ঢাকের আওয়াজটা।
দুর্গামূর্তির দিক থেকে কেউই চোখ ফেরাতে পারছে না।
গোপাল মালাকার লুঙ্গির খুঁটে আট-দশটা ধূপ জড়িয়ে এনেছিল।
ফতুয়ার পকেট থেকে একটা দেশলাইবাক্স বার করে সেগুলো জ্বেলে দিয়ে মূর্তির পায়ের কাছে রেখে দিল। ধূপের সুগন্ধে দুর্গাদালান ভরে উঠল।
ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়ে দেবু হাওলাদার বলল, “হ্যাঁ রে জাফর, এই যে এত যত্ন নিয়ে প্রতিমা গড়ে তুলিস তুই, দশমীর দিন ভাসান হয়ে গেলে কষ্ট হয় না তোর?”
জাফরের এই কষ্ট বহু পুরনো। অব্যক্ত।
ও কিছু জবাব দেওয়ার আগেই গোপাল মালাকার বলল, “মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা সন্তানকে যদি তার ভাসান দিতে হয়, কষ্ট হবে না রে দেবু!”
জাফর কিছু বলল না। নেশাতুর এক কেরামতিতে সে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণতা দিতে লাগল দেবী দুর্গা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের।
দুর্গামণ্ডপের বাইরের আকাশ পরিষ্কার হতে লাগল একটু একটু করে। বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল এক অদ্ভুত মা-মা গন্ধ।
*****
আজ বিজয়াদশমী। নিদারুণ ও অব্যক্ত বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন দিগ্বিদিক।
দুপুর দেড়টায় জাফরের মা চলে গেল আজ। জাফরের পরিবার-পরিজন বলতে কেউই নেই। তবুও মুসলিম রীতি মেনে সে মায়ের ইন্তেকালের খবর বন্ধুবান্ধব পাড়া-প্রতিবেশীদের জানিয়েছে।
দাফন হবে বিকেলে। তার আগে হবে জানাজার নামাজ। বন্ধুবান্ধবরা আসতে শুরু করেছে বাড়িতে। মায়ের জান্নাত কামনা করছে তারা।
ঢাক বাজছে দূরে কোথাও। আজ বিসর্জন দেবী দুর্গার। দুপুরের বাতাসে পাক খেয়ে চলেছে এক গভীরতর মনখারাপ। জাফর শুনতে পাচ্ছে আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়ানো কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজ। শূন্যের আজান ভেসে আসছে তার কানে।
পলাশন গ্রামের দেবীপ্রতিমার বিসর্জন হবে আজই। নিজের মায়ের কবরও খোঁড়া হয়ে গিয়েছে।
ছবি: সুমন পাল
ঘাসজমির এক কোণে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল জাফর, “তোমার দোয়া ছিল আমার অদৃশ্য ঢাল। আমার সব বিপদকে ঠেকিয়ে রেখেছিল সে। তোমার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে আমি পারিনি। আমার গুনাহ মাফ কোরো। আজ তোমার বিসর্জন। আবার কখনও শরতের রোদ হয়ে, আমার রং, তুলি, আর ক্যানভাসের অদৃশ্য আঁচড়ে এ ভাবেই তুমি ফিরে ফিরে এসো, মা...”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)