মালগাড়ির পরিত্যক্ত বগিটা কবে থেকে যে লাইনের উপরে পড়ে আছে, এলাকার কেউ জানে না। লাইন বাতিল হয়েছে বহু দিন। হিজুলির পুরনো দিনের মানুষজন ওই লাইনটাতে ট্রেন যেতে দেখেছেন। পুরনো লাইন বাতিল হয়ে যেতে সরকারি লোক এসে বগির ছোট দরজাটায় তালা লাগিয়ে সেই যে গেল, আর এল না।
মালগাড়ির ভিতরে সম্ভাব্য দামি জিনিসপত্রের লোভে গ্রামের কয়েক জন এসে তালা ভেঙে ঢুকে দেখল ভ্যাপসা গন্ধ, আরশোলা এবং ইঁদুরের নাদি ছাড়া আর কিছু নেই। আস্তে আস্তে সমাজবিরোধীদের আস্তানা হয়ে উঠল মালগাড়ির পরিত্যক্ত বগিটা।
এক বার ভিতরে বোমা বাঁধার সময় বোমা ফেটে নান্টু মস্তানের হাত উড়ে যায় এবং বগির কিছুটা অংশ তুবড়ে যায়। সেই থেকে বগির ধারেকাছে আর কেউ ঘেঁষত না।
আস্তে আস্তে ঘাস, শ্যাওলা, আকন্দলতা, বুনো ধুঁধুল, তেলাকুচোর লতায় ঢেকে গেল মালগাড়ির ইস্পাতের বডি। ঠিক যেন গাছগাড়ি! এখন আর দরকার না পড়লে এ দিকে কেউ আসে না।
*****
যাঁরা হিজুলিতে বাস করেন, সেই সব ট্রেনযাত্রী রানাঘাট স্টেশনে নেমে বাতিল লাইন ধরে ওই গাছগাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গ্রামের রাস্তা ধরেন। লতিকাও রোজ এই পথ ধরেই বাড়ি ফেরে। রানাঘাটে পালবাবুদের বাড়িতে এক বেলা রান্নার কাজ করে সে।
আগে লতিকার মা কাজ করত, এখন আর পারে না। লতিকার আরও দুটো বোন আছে। তারা সুন্দরী বলে আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটদের আগে বিয়ে হয়ে গেলে বড় মেয়ের বিয়ে হওয়া মুশকিল। তার ওপর লতিকা ঢ্যাঙা, গায়ের রং তামাটে, সামনের দাঁত উঁচু। তাতে দুঃখ নেই লতিকার। রান্নার কাজ করে ভালই টাকা পায় সে। নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারে।
এই নিয়ে পর পর তিন দিন লোকটাকে গাছের লতাপাতা সরিয়ে লাফ দিয়ে বগির ভিতরে ঢুকতে দেখল লতিকা। প্রথমে ভেবেছিল পাতাখোর। কিন্তু ঝোপঝাড় লতাপাতা সরিয়ে বগির ভিতরে লোকটা যে ভাবে অনায়াসে ঢুকে পড়ল, তাতে পাতাখোর বা মাতাল মনে হল না। লোকটা ভিতরে ঢোকার কিছু ক্ষণ পরে লতিকাও একই পদ্ধতিতে জঙ্গল সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। তেলাকুচোর কচি পাতা, ভাঙা ডগা লতিকার চুলে আটকে গেল। ভিতরে ঢুকে খোঁপাটা খুলে পাতা পরিষ্কার করতে করতে বগির ভিতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল লতিকা। বগির তোবড়ানো অংশে একটা বড়সড় ছ্যাঁদা। সেটা দিয়ে বাইরের আলো ভিতরে আসছিল। সেই আলোয় লতিকা দেখল, একটা লোক বগির গায়ে হেলান দিয়ে বসে ছোট প্লাস্টিকের পাখা নাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে আর তার দিকে চেয়ে আছে। লোকটার মুখভর্তি গোঁফ-দাড়ি।
লতিকাকে দেখে লোকটা আশ্চর্য হল কি না, বোঝা গেল না। ঝুলে ভর্তি চার দিক। মেঝেতে বিভিন্ন সাইজ়ের অনেকগুলো জলের বোতল। একটা কানা-উঁচু থালা, অনেকগুলো খবরের কাগজ এবং পলিথিন রাখা আছে। পাশে একটা কম্বলও আছে। লোকটাকে চিনতে পারল লতিকা।
“এই, তুমি কালীমন্দিরে খিচুড়ি নিতে গিয়েছিলে না সে দিন?”
লোকটা দু’বার উপর-নীচে মাথা ঝাঁকাল।
“আর এক দিনও স্টেশনের কাছে দেখেছি।”
লোকটা আবার সামনের দিকে মাথা ঝাঁকাল।
লতিকা বিরক্ত হয়ে বলে, “মরণ! বোবা না কি?”
লোকটা এ বার দু’দিকে মাথা নাড়াল।
“তোমার নাম কী? কোত্থেকে এসেছ?” প্রশ্ন করে লতিকা।
লোকটা পাখার ডাঁটি দিয়ে পিঠ চুলকে নিয়ে আবার হাওয়া খেতে লাগল।
“কানেও শোনো না নাকি? ঠিক ঠিক উত্তর দাও, নইলে গ্রাম থেকে লোকজন নিয়ে এসে তোমার ব্যবস্থা করব!” ঝাঁঝালো গলায় বলে লতিকা।
হাতপাখা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসল লোকটা। আর একটু এগোল লতিকা। “এখানে থাকো কী করে? কষ্ট হয় না?”
লোকটা দু’দিকে মাথা নাড়াল।
“কী নাম তোমার? বাড়ি কোথায়?”
লোকটা অবেশেষে মুখ খুলল, “কেউ পাগলা বলে, কেউ বলে ভিখিরি, কেউ বলে ছোটলোক...”
“বাবা-মায়ের দেওয়া নামটা বলো,” তাড়া লাগাল লতিকা।
দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে লোকটা উঠে দাঁড়াল। বলল, “বাবা-মায়ের দেওয়া নাম?” একটু থেমে লতিকার চোখে চোখ রেখে বলল, “সপ্তর্ষি।”
“কী সি?”
“সপ্তর্ষি। দেখলে! এই জন্যে নাম বলতে চাই না!” হাসল সপ্তর্ষি।
“ঠিক আছে। বুঝেছি। তোমার চলে কী করে? মন্দিরে তো রোজ খিচুড়ি দেয় না!”
“গান গাই রাস্তায়। কখনও ট্রেনেও গান করি।”
“ও। তার মানে ভিক্ষে করো? তুমি ভিখিরি?”
“গান গাই। হাত পাতি না। লোকে গান শুনে খুশি হয়ে টাকা দেয়।”
“অনেক গান জানো?”
লোকটা এবার একটা উল্টোনো রঙের বালতির উপর গিয়ে বসল। আর একটা উল্টোনো রঙের বালতি লতিকার দিকে এগিয়ে দিল।
লতিকা খুশি হল। কিন্তু বসল না। বলল, “অন্য এক দিন বসব। আজ তাড়া আছে। বাড়িতে অসুস্থ মা না খেয়ে বসে থাকবে। বললে না তো কতগুলো গান জানো?”
“বেশি জানি না। যেটা খুব ভাল জানি, সেই গানটাই গাই।”
লতিকার চোখে কৌতূহল দেখে সপ্তর্ষি গাইতে শুরু করল দিল, “দিল অ্যায়সা কিসিনে মেরা তোড়া, বরবাদি কি তরফ...”
লতিকা বলে, “এ তো বিশাল দুঃখের গান!”
সপ্তর্ষি নামের লোকটা বলল, “মানুষ দুঃখের গান শুনলে বেশি খুশি হয়। তখন একটু বেশি
পয়সা দেয়।”
লতিকা দেখল, কম্বলের উপর এক জোড়া নূপুর। সে দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আবার নাচোও নাকি?”
“না না। ওটা রাতে পায়ে পরে হাঁটি।”
আবার লতিকার কৌতূহলী চোখ।
সপ্তর্ষি বলল, “ভূতের ভয় না দেখালে এখানে রাতে মাতালদের জ্বালায় থাকতে পারব না।”
লতিকা হাসল, “মাইরি, তোমার কী বুদ্ধি!”
মাঝে মাঝেই বাড়ি ফেরার পথে সপ্তর্ষির আস্তানায় ঢুঁ মেরে যায় লতিকা। সপ্তর্ষি যে দিন থাকে না, সে দিন বগির ভিতরে একা বসে থাকে লতিকা। অনেক কিছু ভাবে। পাকা তেলাকুচো ফল খেতে আসা বুলবুলিরা চিনে গেছে লতিকাকে।
সপ্তর্ষিকে ভাল ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। মাঝে মাঝে দু’-চারটে শব্দ বাবুদের মতো করে ইংরেজিতে বলে। লতিকা একটা সিনেমা দেখেছিল টিভিতে। নায়ক খুব বড়লোকের ছেলে। বিশাল বড় বাড়ি। গাড়ি। অনেক কাজের লোক। নায়ক বাবার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সারা দিন পথে পথে ঘুরত। কুলিগিরি করে পেট চালাত। একটা গরিব মেয়ের সঙ্গে ভালবাসা হয়। পরে বাবার সঙ্গে ছেলেটির মিলমিশ হয়ে যায়। তার পর সেই গরিব মেয়েটাকে বিয়ে করে ছেলেটি নিজের বাড়ি ফিরে যায়। সপ্তর্ষি কি সে রকম কোনও বাপে-খেদানো ছেলে!
লতিকা ভাবে, মাকে বলে বারান্দাটা ঘরের মতো বানিয়ে নেবে পুজোর আগেই। গাছগাছালি পোকামাকড়ের মধ্যে কোনও মানুষ থাকতে
পারে নাকি!
*****
সপ্তর্ষি রাতে বগির মধ্যে ঢুকে দেখে, ভিতরটা সুন্দর করে গোছানো। নতুন জগ। স্টিলের থালা-বাটি-গ্লাসের সেট রাখা। ফুলছাপ বিছানার চাদর। একটা ওয়াড়-পরানো বালিশ।
বুঝতে পারে, এ সব লতিকার কাণ্ড। মাঝে মাঝে খাবার আনে। বারণ করলে শোনে না। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেছে!
চিটেগুড় যেন! কত খোঁজাখুঁজির পরে এমন একটা নিশ্চিন্তের জায়গা পেয়েছিল সে। ভবঘুরে টাইপের জীবনযাপন মানুষের পছন্দ হয়েছিল। প্রায় চার মিলিয়ন ভিউ! কম্বলের ভিতর থেকে স্মার্টফোনটা বার করল সপ্তর্ষি। পল্টাকে এখনই ফোন করতে হবে। এই ভূতুড়ে বগির সন্ধান
পল্টাই দিয়েছিল।
“হ্যালো, পল্টা! রিল তৈরির একটা নতুন জায়গা চাই। কালকের মধ্যেই।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)