শেকলটা ঝনাৎ করে খুলে ঘরে ঢুকতেই গা-টা গুলিয়ে উঠল সুধার। বিশ্রী পচা বেডসোরের গন্ধ ছাপিয়ে আরও বদখত একটা গন্ধ সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আজও আবার? হ্যাঁ, আজও বিষ্ঠায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে ওর শাশুড়ি ননীবালা। মাথাটা গরম হয়ে উঠল ওর। এই নিয়ে এ সপ্তাহে তিন দিন হল। গত সপ্তাহে দু’দিন এই কাণ্ড হয়েছিল।
“হে ভগবান, এ কী শাস্তি তুমি দিচ্ছ আমায়? গতজন্মে না জানি কী পাপ করেছিলাম!” নিজের মনে গজগজ শুরু করে ও।
একঘর, একদোর। বুড়িকে না পরিষ্কার করে ফেলে রাখারও উপায় নেই। এই ঘরেই ওঁর তক্তপোশের এক ধারে শুতে হবে ওকে। সামান্য ভাতে-ভাত রান্নাটা যদিও বাইরের দাওয়ায় সারে, শোওয়া বসা কাপড় পরা, সবই তো এ ঘরে। কী কুক্ষণে যে বুড়িকে ও নিজের কাছে এনে
রাখতে চেয়েছিল!
বছর চারেক বুড়ি ওর ঘর পাহারা দিয়েছে। এখন সেই ঋণ কড়ায় গন্ডায় শোধ হচ্ছে।
ভোর ভোর উঠে বাসি কাজ সারতে হয়। তার পর চলে লাইন দিয়ে জল ধরা, কাপড় কাচা। এর পরেও যে দিন পালা পড়ে, এ বাড়ির দু’-দুটো বাথরুম, পায়খানা পরিষ্কার করতে হয় ওকে। বুড়িকে দাঁত মাজিয়ে সকালের যাবতীয় কম্মো করানো, কাজে যাওয়ার আগে ডায়াপার পরিয়ে গা মুছিয়ে বাসি কাপড় ছাড়িয়ে দুধ মুড়ি কলা যে দিন যেমন থাকে খাওয়াতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। এত কিছুর পরে নিজে তৈরি হয়ে কাজে যাওয়া। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, পথে যদি একটা লরি ওকে পিষে দিয়ে যায়, বেশ হয়। একেবারেই মুক্তি ঘটে।
চার-চারটে বাড়িতে ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ করে যা পায়, ফুটকড়াই হয়ে যেতে সময় লাগে না। দু’টি শাকপাতা, কখনও বা এক-আধটা ডিম, তেল-মশলা, লাইট, খরচ তো কম নয়। তার উপর বুড়ির ওষুধ আছে, ডায়াপার আছে।
সুধার ছেলে নিতু অনেক দিনই বৌ নিয়ে আলাদা। ওর বাপটা এক দিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। বেঁচে আছে না মরে গেছে কে জানে! তবু ওরই নাম করে চান সেরে এক চিমটে সিঁদুর সিঁথিতে ঠেকায় ও। মা বলত, “সোয়ামির দোষ ধরতে নেই।” কিন্তু এই যে ওরই মাকে নিয়ে সুধা হিমশিম খাচ্ছে, তার বেলা? কোন জন্মের শত্তুর ছিল, এ জন্মে শোধ তুলছে। বুড়ির দু’-দুটো পেটের মেয়ে আছে,
একটা বিয়েওলা ছেলে আছে, কেউ এক বার উঁকি মেরে দেখে?
ওদের রাগের কারণ একটাই। বুড়ি বলেছিল, ভিটের জমিটা ওর নামে করে দেবে। সেই লোভে খরখরে ওই ননীবালাকে ঘরে এনেছিল ও। তা সে জমিতে খুড়শ্বশুরের ছেলেরা একটা ইটও গাঁথতে দিল না। ওই অচল জমির মতো ওর তক্তপোশে জগদ্দল পাথর হয়ে শুয়ে আছে ননীবালা, আজ প্রায় দু’বছর হয়ে গেল। এ বার একটা এসপার-ওসপার করতেই হবে।
বাইরের কাপড়টা ছেড়ে একটা রংচটা ম্যাক্সি গলিয়ে নেয় সুধা। তার পর নাকেমুখে কাপড় বেঁধে কাজে নেমে পড়ে। ডায়াপারে আজকাল আর কোনও কাজ হচ্ছে না। পা বেয়ে গড়িয়ে আসছে তরল বর্জ্য।
ভিজে কাপড়ে ডেটল দিয়ে সবটা মুছে নেয় ও। তার পরেও রেহাই নেই। বেডসোরগুলো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগাতে হবে। সব কিছুর পরে স্নান সেরে রান্না বসিয়ে খেয়ে উঠতে উঠতে চারটে বাজবে।
মাঝে মাঝে মনে হয় গলা টিপে বুড়িকে একেবারেই শেষ করে দেয়। তার পর শিউরে ওঠে। গত জন্মের পাপে এই দুর্গতি, এ জন্মে আর নতুন করে মন্দ কাজ করতে মন সায় দেয় না।
পাগলা বাবার মাদুলিটা বুড়ির হাতে বাঁধছিল সুধা। লোক দিয়ে আনিয়েছে। সে বলেছে, অবশ্যই কাজ হবে। মানে সপ্তাখানেকের মধ্যেই বুড়ি
পটল তুলবে।
কিন্তু তা যদি না হয়! যদি বুড়ি তার পরও বেঁচে থাকে, তা হলে?
আজ অনেকটা ভাল ননীবালা। ওর দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে হেসে বলল, “আমার পুঁটলিতে একটা সোনার আংটি আছে। আমি ম’লে আমার নাতিকে দিস।”
বজ্জাত বুড়ি! মরতে বসেছে, তবু কেমন সেয়ানাগিরি দেখো! নাতিকে, কেন সুধার নাম করতে কী হয়েছিল?
সুধা নিজের মনেই হাসে, কবে ওই আংটি গায়েব হয়েছে। ওই আংটি বেচেই বুড়ির ডাক্তার খরচা চলেছে তো। সুধা অত কোথা থেকে পাবে?
নিতু মাঝে মাঝে এক-আধ বার উঁকি মারে। তবে একটি পয়সা ঠেকায় না। উল্টে ওর কাছে হাত পাতে। দশ-বিশ যা পারে দেয় ও। তবু তো পেটের ছেলে, মাঝে-মাঝে মুখ দেখিয়ে যায়। লোকের কাছে কানাঘুষো শুনেছিল সুধা, ওর বর মধু নাকি হাবড়ার দিকে নতুন সংসার পেতেছে। পাত্তা দেয়নি। ও সব লোকের মুখ দেখাও পাপ।
মাদুলিটা পরার পর থেকেই বুড়ি কেমন ঝিম মেরে আছে। তবে খাওয়াদাওয়া আগের মতোই চলছে। এ সপ্তাহেও দু’দিন কাজ থেকে ফিরে ময়লা ঘাঁটতে হয়েছে ওকে। এ ভাবে কদ্দিন ওকে নরক যন্ত্রণা সইতে হবে, কে জানে!
সে দিন আবার ঘোরের মধ্যে বুড়ি বলছিল, “বাসনকোসন সব মেজে রেখেছি বৌ। ঘরে-দোরে ঝাঁটা দিয়ে পোস্কার করলুম। চান-পুজো সেরে দুটো ভাতে ভাত বসিয়ে দে, আমি তত ক্ষণে পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসি। বড় খিদে নেগেছে।”
কোন জন্মে শান্তিপুরের পুকুরের পাশের কুঁড়ে ছেড়ে, এই শহরের এক কোণে ঠাঁই নিয়েছিল ওরা। এখনও স্বপ্নে সেই পুকুরেই ডুব দেয়। গুয়ের কাঁথা কাচতে কাচতে গা-পিত্তি জ্বলছিল ওর। আর দু’-এক দিনের মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে। নিত্যিদিন এই ঝামেলা আর সহ্য হয় না।
একটা সুরাহা হয়েছে। ঘুম হয় না বলে কাজের বাড়ির ডাক্তার দাদাবাবুকে দিয়ে লিখিয়ে বেশ কিছু ঘুমের বড়ি জোগাড় করেছে ও।
কদিন ধরেই গুজিয়ার বায়না করছে বুড়ি। আজ দুটো গুজিয়া এনেছে ও। ছ’টা-সাতটা ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে কাপের জলে গুলে রেখেছে। রাতে ওই দুটো গুজিয়া খাইয়ে জলটা খাওয়াবে।
এ জন্মে তো রেহাই মিলুক। পরজন্মের কথা পরে ভাবা যাবে।
বুড়ির কাছাকাছি হতেই বোজা চোখ দুটো খুলে বুড়ি ডাকল, “মা, মা এসেছিস?”
সুধা ঘাবড়ে যায়, “কাকে মা বলছ?”
বুড়ি থেমে থেমে আবার বলে, “সু-ধা-কে।”
থমকে যায় সুধা। তার পর শুধু গুজিয়ার বাক্সটা নিয়ে এগিয়ে যায় বুড়ির দিকে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)