দরজা খুলে দিল বাড়ির বৌমা তিথি।আয়া মঙ্গলা জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন আজ?”
“তোমার আদরযত্নে খারাপ থাকবেন কী সাধ্যি!” তিথির গলায় শ্লেষ।
কটাক্ষে কান দিল না মঙ্গলা। ঢুকে গেল ভিতরে। বাইরের শাড়ি পাল্টে পেশেন্টের ঘরে এল। ভাড়া করা মুভিং বেডে চোখ বুজে আছেন মজুমদারবাবু। মুখে মাস্ক। চুল ভিজে। চোখ-মুখে স্নিগ্ধ ভাব। বোঝা যাচ্ছে, রাতের আয়া সীমা পেশেন্টকে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে।
মঙ্গলা নার্সিং হোম থেকেই দেখছে মজুমদারবাবুকে। নিউমোনিয়ার খুব খারাপ অবস্থায় ভর্তি করানো হয়েছিল। বাবাকে রিলিজ়ের সময় বড় ছেলে শান্তনু নার্সিং হোমে কথা বলে মঙ্গলাকে বাড়িতে বহাল করেছে। মজুমদারবাবুর দুই ছেলে। দু’জনেই দূর শহরে থাকে। বাবার শরীর খারাপ শুনে এসেছিল নার্সিং হোমে। পাড়ার লোক তো এখনও দেখে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
মজুমদারবাবু চোখ খুলেছেন। মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে মঙ্গলা জিজ্ঞেস করে, “চা খাবেন?”
মুখে মৃদু হাসি খেলে যায়। তার মানে খাবেন। মঙ্গলা রান্নাঘরে ঢোকে। এই রান্নাঘর এখন শুধু পেশেন্টের জন্য ব্যবহার হয়। রোগীর যে হেতু বিছানাতেই সব কিছু, সেই ঘেন্নায় ছেলে-বৌমা এখন নিজেদের রান্না-খাওয়া দোতলায় আলাদাকরে নিয়েছে।
গ্যাস উনুনে দু’কাপ জল চাপায় মঙ্গলা।
মজুমদারবাবুর বৌ মারা গেছেন বারো বছরের উপর। ভেঙে পড়েননি। আগের মতোই সংসারের সমস্ত দায় সামলেছেন। সংসার খরচ বাবদ ছেলেদের থেকে কিচ্ছু নিতেন না। বিদেশি ব্যাঙ্কের উঁচু পোস্টে চাকরি করতেন। সেই মানুষটাকে আজ ছেলের উপর নির্ভর করে বাঁচতে হচ্ছে। পাড়ার লোকজন মজুমদারবাবুকে দেখতে এসে এ সব কথাই আলোচনা করে।
চা বানানো হয়ে গেল মঙ্গলার। বাবুরটা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোয়।
বেডের পাশে দাঁড়িয়ে প্লেটে চা ঢেলে বাবুকে খাওয়াচ্ছে মঙ্গলা। তার আগে হ্যান্ডল ঘুরিয়ে বেডটা সোজা করে নিতে হয়েছে। খুলে রাখতে হয়েছে অক্সিজেন মাস্ক। বেশি ক্ষণ খুলে রাখা যাবে না। কষ্ট হচ্ছে বুঝলেই পরিয়ে দিতে হবে। মঙ্গলা টের পায়, পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তিথি। বলে, “কী মনে হচ্ছে, কাজটা আজ করা যাবে?”
চাপা বিরক্তি নিয়ে মঙ্গলা বলে, “দেখছেন তো দিব্যি বসে চা খাচ্ছে। এই অবস্থায় কাজটা করতে গেলে গোটা ব্যাপারটা ভেস্তে যেতে পারে।”
“কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলতে হবে কাজটা। জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে...” বলে চলে গেল তিথি।
মঙ্গলার বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘টাকা তো তোমাদের ব্যাঙ্কেও ঢুকেছে বানের জলের মতো। একটু খরচা করো।’
নিজের চা গরম করে নিয়ে মঙ্গলা এসেছে পেশেন্টের ঘরের সামনের বারান্দায়। ছেলে-বৌমার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকতে মঙ্গলা চোখের সামনে দেখেছে। এক দিন ডিউটিতে এসে দেখে ঘরে মুভিং বেডটা নেই। মজুমদারবাবুকে শোয়ানো হয়েছে ঘরের সাধারণ বিছানায়। ছেলে, বৌমা মিলে ঘরটা পরিষ্কার করছে। চশমা পরানো হয়েছে মজুমদারবাবুকে।
অবাক হয়ে মঙ্গলা জিজ্ঞেস করেছিল, “ডাক্তারবাবু কি মুভিং বেড সরিয়ে দিতে বলেছেন?”
শান্তনু বলেছিল, “না, ব্যাঙ্কের লোক আসবে বাবার টিপছাপ নিতে। বাবাকে মোটামুটি সুস্থ দেখাতে হবে।”
শুনে যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল মঙ্গলা।
তিথি বলেছিল, “বাবার দায়িত্ব যখন আমাদের, তাঁর চিকিৎসার খরচ চালাতে ব্যাঙ্কের টাকা আমরা তুলতেই পারি। তবে টাকা তোলার কথা তুমি কাউকে কিছু বোলো না। আর একটা ব্যাপারেও তোমার হেল্প চাই আমাদের।”
“কোন ব্যাপারে?” জানতে চেয়েছিল মঙ্গলা।
“বাবাকে মুক্তি দিতে হবে তোমাকে।”
বিরাট ঝাঁকুনি লেগেছিল কথাটা শুনে। এ রকম প্রস্তাব মঙ্গলাকে আগে কেউ কখনও দেয়নি। এর পর শান্তনু বলতে থাকে, “জানি, কথাটা শুনতে তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু ভেবে দেখো, এতে বাবারও শান্তি, আমরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব। বাবা তো আর কোনও দিনই হেঁটে চলে বেড়াতে পারবে না। তুমি কাজটা করে দিলে পঁচিশ হাজার পাবে। শুধু মুখ থেকে মাস্কটা খুলে রাখবে। একটু বেশি ক্ষণ। বাবা চলে গেলে ফেরপরিয়ে দেবে।”
“কাজটা তোমরা করে নিচ্ছ না কেন? সীমাকে দিয়েও তো করাতে পারো। আমাকে কেন বলছ?” জিজ্ঞেস করেছিল মঙ্গলা।
শান্তনু বলেছিল, “প্রথমত, বাড়িতে বাইরের কেউ এক জন না থাকলে পাড়ার লোক আমাদের সন্দেহ করবে। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে ঝামেলা করবে। আর, সীমাকে দিয়ে কাজটা করানো যাবে না। মেয়েটা বাইরে প্রচুর ছেলের সঙ্গে ঘোরে। তাদের মধ্যে কাউকে ঘটনাটা বলে দিলে, আমরা মুশকিলে পড়ে যাব।”
উত্তরে চুপ করে ছিল মঙ্গলা। শান্তনু ফের বলে, “তোমাকে এখনই ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু বলতে হবে না। একটু ভেবে জানিয়ো। যে টাকাটা পাবে, তোমার টানাটানির সংসারে অনেক কাজে লাগবে।”
শেষের কথাটি একেবারে মোক্ষম বলেছিল শান্তনু। ঘর থেকে ওরা চলে যাওয়ার পর মঙ্গলা ভাবতে বসেছিল নিজের সংসার নিয়ে। কুড়ি বছরের বেশি হয়ে গেল কর্তা নিরুদ্দেশ। প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। ভগবানের উপর ভক্তি ছিল খুব। এক বার এক নামগানের আসরে গিয়ে আর ফিরলেন না। রেখে গেলেন দুই ছেলে, এক মেয়ে। তারাকেউই সে ভাবে মানুষ হল না। তিন জনেরই বিয়ে দিয়েছে মঙ্গলা।
ছেলেদুটো টুকটাক কাজ করে, নেশাভাঙও করে, আর চেয়ে থাকে মায়ের রোজগারের দিকে। নাতনিটা বড় হচ্ছে, বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়ে এল। বাড়ি আজ অবধি পাকা করা হল না। এই সময় টাকাটা পেলে মঙ্গলার কিছুটা সুরাহা হয় বইকি!
সে দিন দুপুরের দিকে ব্যাঙ্কের দুটো লোক এসেছিল। প্রচুর খাবারদাবার দিয়ে অ্যাপায়ন করা হল তাদের। মজুমদারবাবুর আঙুলের ছাপ নিয়ে চলে গেল তারা। রাত আটটায় সীমা এল। মঙ্গলা ডিউটি শেষে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে, শান্তনু নেমে এসেছিল দোতলা থেকে।। জিজ্ঞেস করল, “কী ঠিক করলে?”
মঙ্গলা বলেছিল, “কাজটা হয়ে যাবে। তবে পঁচিশ নয়, পঞ্চাশ হাজার লাগবে। কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রেখো, পেশেন্ট যখন খারাপ কন্ডিশনে থাকবে কাজটা তখনই করা যাবে। নয়তো নানা বিপত্তি হতে পারে।”
এক কথায় রাজি হয়ে গেল শান্তনু। ডবল টাকা চাওয়া নিয়েও কিছু বলল না। তার মানে কী পরিমাণ টাকা পেয়েছে বাবার অ্যাকাউন্ট থেকে!
চা খাওয়া অনেক ক্ষণ শেষ। ঘরে আসে মঙ্গলা। জানলা দিয়ে আসা রোদ্দুর মজুমদারবাবুর পেটের কাছে এসে পড়েছে। সেখানেই বাবুর দুটো হাত। ডান হাতের অনামিকায় থাকা আংটিটা জ্বলজ্বল করছে। মঙ্গলার মাথায় আসে, মজুমদারবাবু মারা গেলে আংটিটাও তো চলে যাবে ছেলে-বৌমার দখলে। এখন যা সোনার দাম, ওটা বেচলেই মঙ্গলার টাকাটা দিতে পারবে ওরা।
বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বাবুর আংটিটা খোলার চেষ্টা করছে মঙ্গলা। হাতে নিয়ে দেখবে, ওজন কেমন। এমন সময় কেঁপে ওঠে মজুমদারবাবুর দুই হাত। মঙ্গলাকে অবাক করে মজুমদারবাবু কাঁপা হাতে আংটি খুলে ফেলে মঙ্গলার বাঁ হাতের অনামিকায় পরাতে থাকেন। শরীরে কাঁটা দেয় মঙ্গলার। দূরে কোথাও মঙ্গলধ্বনি বেজে ওঠে। শাঁখ, উলু... মঙ্গলা মজুমদারবাবুর মুখের দিকে তাকায়। মাস্কের আড়ালে কাশফুলের মতো হাসি। লজ্জা পায় মঙ্গলা। বলে, “এখন নয়। তোমাকে সুস্থ করে তুলি, তার পর পরিয়ো। নয়তো ওরা ভাববে আমি চুরি করেছি।”
*****
মাঝে পাঁচ দিন কেটে গেল। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে মজুমদারবাবুর। আজ গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে পেশেন্টের ঘরে ঢুকল মঙ্গলা। সীমা এখনও যায়নি। মঙ্গলাকে দেখে বলল, “রাতে ডাক্তার এসেছিল। রাইল্স টিউব লাগাতে হয়েছে।”
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সীমা। ওর ডিউটি শেষ। মজুমদারবাবুর দিকে তাকায় মঙ্গলা, অসাড় পড়ে রয়েছেন। আজ আর চা খেতে পারবেন না। মঙ্গলা নিজের জন্য চা বানাতে যায়।
চা-পাতা ভেজাতে দিয়ে ঘরে এসে দেখে, তিথি আর শান্তনু দাঁড়িয়ে আছে। শান্তনু বলে, “আজ তা হলে কাজটা হয়ে যাক, নাকি?”
মঙ্গলা কোনও উত্তর দেয় না। চোখ যায় মজুমদারবাবুর ডান হাতের আঙুলে। এ কী, আংটিটা নেই! মাথায় রাগ উঠে যায় মঙ্গলার, গলা তুলে বলে, “আমার আংটিটা কই?”
ভারী আশ্চর্য হয়ে তিথি বলে, “তোমার আংটি!”
“ওই হল, আমার বাবুর আংটি কোথায়?”
“খুলে রেখেছি। আজ তো চলেই যাবেন।”
মঙ্গলা ঝাঁঝের গলায় বলে ওঠে, “এক্ষুনি নিয়ে এসো আংটিটা। নয়তো আমি সবাইকে সব কিছু বলে দেব।”
তিথি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শান্তনু জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ তোমার কী হল মাসি?”
মঙ্গলা উত্তর খুঁজে পায় না। তিথি ফিরে আসে। মঙ্গলার হাতে তুলে দেয় আংটি। মজুমদারবাবুকে আংটিটা পরাতে পরাতে মঙ্গলা বলে, “তোমাকে আমি কিছুতেই চলে যেতে দেব না। এক জনকে আটকাতে পারিনি। তোমাকে আটকাবই। ঠিক সুস্থ করে তুলব।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)