E-Paper

কেয়ার গন্ধ

“আর কাউকে এ সব কথা বলার আগে নিজের মুখটা আয়নায় দেখো পল্লবী। নিজেকে ঠিক করে চেনার চেষ্টা করো।”

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:১৬
ছবি: সৌমেন দাস।

ছবি: সৌমেন দাস।

পূর্বানবৃত্তি: ইসরো থেকে ফিরে আসছে জনমেজয়বাবুর ছেলে। তার প্রশিক্ষণ শুরু হবে জোকায়। তাই সুধাময়ীর মনে আনন্দ। পাশাপাশি জমে গেল জনমেজয়বাবুদের ক্লাবের আড্ডাও। পানসবাবুর সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হল এবার পুজোয় ওঁরা ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটাই করবেন। অন্য দিকে পল্লবী আবার দেখা করতে গেছে দেবলের সঙ্গে। কথায় কথায় দেবলের থেকে একটা ফ্ল্যাট চায় পল্লবী। দেবল এই আব্দারে অবাক হলেও আপত্তি করে না। জনমেজয় ‘ম্যাকবেথ’ করার কথা জানান দীপঙ্করবাবুকে। ঠিক হয়, দীপঙ্করবাবু জ্যোৎস্নাদেবীকে অনুরোধ করবেন সেই নাটকের অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করার জন্য। বাড়ি ফিরে যখন দীপঙ্করবাবু ফোনে কথা বলছেন জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে, তখন পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনাপ্রবাহ আঁচ করার চেষ্টা করে পল্লবী। ফোনের ওপারে মহিলা-কণ্ঠ শুনে তাঁর মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। সে নানা প্রশ্ন করে দীপঙ্করবাবুকে। ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিলেও স্ত্রীকে সরাসরি কোনও কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না দীপঙ্করবাবু।
ঘটনা বুঝতে অসুবিধে হয় না পল্লবীর। সে হিসহিস করে বলে, “এক বার বাবাকে নিয়েছে, এ বার ছেলেকে তাক করেছেন।”

দীপঙ্কর বলেন, “এ সব কী কথা বলছ পল্লবী!”

“ঠিক বলছি। ওরা অন্য রকম হয়। ছেলে আবার কিসের! তোমার সঙ্গে মাতৃত্বের কী সম্পর্ক! তিনি কি তোমার গর্ভদায়িনী মা!”

“তাতে কী হল?”

“এখনও তো সুন্দরী।”

“তুমি কী করে জানলে?”

“নামী সিনেমা পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেখেছি।”

“এ সব কথা বোলো না। মা-ছেলের মাঝখানে আসতে নেই।”

“উনি কিসের মা তোমার! আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”

দীপঙ্কর কঠিন হন, বলেন, “যেতে পারো। আমি বাধা দেব না।”

পল্লবী বলে, “এত বড় কথা! নোংরা, ইতর কোথাকার! থানায় যাব আমি।”

“কী বলবে থানায়?”

“তুমি দুশ্চরিত্র। বাবা ছুটেছিল, এখনও ছেলেও ছুটছে মেয়েমানুষটার পিছনে।”

“তোমার আটকাবে না বিবেকে?”

“ঘরে আগুন লাগলে বাঁচতে হবে তো আমায়!”

“আমি তোমাকে জানি, অনেক কথা বলতে পারি। ছেলের সামনে বলতে রুচিতে বাধবে।”

“বলে ফেলো, বলে ফেলো... ভালমানুষির মুখোশটা খুলে যাবে।”

“দেবল কবে ফ্ল্যাট দিচ্ছে?”

“মানে!” থমকায় পল্লবী।

“মানেটা তুমি আমার চেয়ে ভাল জানো।”

“কী জানি আমি?”

“গঙ্গার ধারে ফ্ল্যাট।”

“আজকাল অফিসে না গিয়ে আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করো!”

“না, ও সব কিছু করার দরকার হয় না।”

“তবে জানলে কী করে?”

“দেবলের বৌ আমায় বলেছে।”

“ও! দু’জনে এক হয়েছ!”

“কেউ এক হয়নি পল্লবী। সে তুমি ফ্ল্যাট নেবে কি বাগানবাড়ি নেবে, আমার জানার কথা নয়। আমার দরকারও নেই। তবে তুমি আমার মাকে অপমান কোরো না। তিনি অনেক বড়।”

“ভণ্ড, লম্পট তুমি।”

“আর কাউকে এ সব কথা বলার আগে নিজের মুখটা আয়নায় দেখো পল্লবী। নিজেকে ঠিক করে চেনার চেষ্টা করো।”

“তোমার তো নাকি নারীসত্তা জাগছে। সে সবের কী হল!”

“সময়ে হয়তো প্রকাশ পাবে। নিজেকে সুন্দর করো অন্তর থেকে। মাকে একটি অনুষ্ঠানের উদ্বোধক করতে চেয়ে ফোন করেছিলাম।”

পল্লবী কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

দীপ এসে বলল, “বাবা, তুমি যাবে না তো?”

“কেউ কোথাও যাব না। আমরা এক সঙ্গেই থাকব বাবা।”

ন তে মূঢ় ব্রহ্মাস্ত্রং প্রতিভাস্যতি। স্টেজে তখন রাধাবেশে দণ্ডায়মান জ্যোৎস্নাদেবী। বললেন, “পুত্র তোমার মুখ এত মলিন কেন! তোমার পিতৃদেব আনন্দ করছেন। তিনি জানেন, পুত্র বিশ্বজয়ী, কারণ তাঁর কাছে আছে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের অমোঘ সূত্র।”

কর্ণ নতজানু হলেন, বললেন, “মা, যদি মহাযুদ্ধ আমার বিনাশও ঘটায়, তুমি কিন্তু কখনও আমায়
ভুলে যেয়ো না।”

নতজানু হয়েছেন তিনি জ্যোৎস্নাদেবীর কাছে অভিনয়ের প্রয়োজনে। ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠেছিলেন তিনি। হিন্দুমতে নারীর কাছে পতি হলেন দেবতা।

মাঝরাতে বাইরে এলেন। স্মৃতিরা পালকি চেপে চলেছে সুদূর অতীতে, কখনও কখনও ছুঁয়ে
দিচ্ছে তাঁকেও।

আর তিনি কর্ণ করতে পারবেন না। চুল পাতলা হয়ে এসেছে। পরচুলা তিনি কখনও ব্যবহার করতেন না। নিখুঁত ভাবে ব্যাকব্রাশ করা ঘন কালো চুল ছিল তাঁর। বয়সের অনেক তফাত ছিল, মনে হত যেন পিতা। আবার একটু সাজলেই প্রার্থিত প্রেমিক।

তবুও দল ঠিক করল, এ বার থেকে কর্ণ করবে নতুন একটি ছেলে। জনমেজয় চ্যাটার্জি। পেশাদারি যাত্রায় নতুন, কিন্তু শখের যাত্রায় দীর্ঘ সময় ধরে স্টেজ মাতাচ্ছে। বেশ সুদর্শন। প্রথম দিনই জ্যোৎস্নাদেবী এবং ওঁকে প্রণাম করলেন।

উনি ছেলেটিকে আশীর্বাদ করে মৃদু হেসে বললেন, “পরশুরামের অভিশাপে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রথম পার্থের শেষ পরিণতি জানো তো?”

সে বলল, “হ্যাঁ।”

“সংস্কৃতে জ্ঞান আছে তো?”

জনমেজয় বলেছিল, “পালা তো বাংলায়!”

“কিন্তু দেবভাষা স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে প্রয়োগ করলে দর্শক বুঝতে পারবেন শিক্ষিত অভিনেতা।”

জনমেজয় একটু ভেবে বললেন, “আপনি তো কৃষ্ণ হবেন, অর্জুনসখা। আমায় বলবেন, ‘যুবরাজস্তু তে রাজা ধর্মপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। আমরা বিজয়ী হলে, তুমি পাণ্ডবপক্ষে থাকলে তুমিই হবে রাজা, আর যুধিষ্ঠির যুবরাজ।’”

“অপূর্ব! তুমি পারবে কর্ণ করতে। মনে রেখো মহাভারতের কবি তাঁর সমস্ত ঐশ্বর্য ঢেলে দিয়েছিলেন কর্ণ চরিত্রের জন্য। তিনিই বলতে পারেন, তুমি যাও ভগবান কেশব, যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনে আমার আনন্দ, আমার পরিচয়। আমার জয় নেই, পুরস্কার নেই, আমাকে দেখলে মহামতি ভীষ্ম ধনুঃশর ত্যাগ করেন। তবু... তবু...”

তাঁর সে দিনের সেই উচ্চারণ নতুন অভিনেতার সামনে যেন আহ্বান— সমুনাপেয় কৌন্তেয়ং যুদ্ধায় মম কেশব।

যুবক জনমেজয় তাঁর চরণ চুম্বন করেছিলেন, বলেছিলেন, “আমায় আশীর্বাদ করবেন।”

তিনি বলেছিলেন, “অথ বা সঙ্গমঃ কৃষ্ণে স্বর্গে নো ভবিতা ধ্রুবম্। অন্তকালে কেশব তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে স্বর্গভূমিতে। এই জন্মে না হোক পরের জন্মে তুমি আমার প্রতিভাকে, আমার বীরত্বকে ধ্রুব বলে স্বীকৃতি দিয়ো।”

তখন সকলেই চলে এসেছেন, অধিকারী বললেন, “বড়বাবু, আপনি না-হয় কর্ণ করুন।”

তিনি বললেন, “না। জনমেজয়কে আমি আশীর্বাদ করলাম। ও করবে।”

আর এক বার ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’-এর আদলে তৈরি হল পালা। প্রযোজনা তিনিই করেছিলেন। আর প্রিয়তম চরিত্র কর্ণে আবার তিনি। আর কুন্তী জ্যোৎস্নাদেবী। স্টারে হবে অভিনয়। প্রচুর মানুষকে বিনে পয়সায় কার্ড দেওয়া হল। কেউ এলেন না। আড়ালে হাসাহাসি করলেন। দর্শকও কম। অনেক টাকা খরচা হয়েছিল কস্টিউম, স্টেজে।

সামনের চেয়ারগুলিতে কিছু মানুষ আছেন। প্রেক্ষাগৃহে যে উপচে করা ভিড় থাকে, তার বদলে বিরাজ করছে শূন্যতা। ফুটবল মাঠের কোনও স্টার যখন ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ছেড়ে উয়ারি বা কাস্টমসে যায়, তাঁর জন্য কি দর্শক হয়! হয় না। সে দিনও হল না। তবুও তিনি করলেন অপূর্ব অভিনয়।

কুন্তীকে বলছেন, “ন চৈতৎ শ্রদ্ধধে বাক্যম্। আপনার কথা শুনলে মা আমার ধর্ম হবে না। অধর্ম হবে। আমি বীরের মর্যাদা থেকে ভ্রষ্ট হব।”

জ্যোৎস্নাদেবীর মনে হয়, বাংলা যাত্রার কুশীলবেরা আদৌ মানুষটার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। বয়স হয়েছিল, তবু কণ্ঠ তখনও তাঁর মেঘমন্দ্র, রূপে তখনও তিনি অনির্বাণ। যে দিন তিনি চিতায় উঠলেন, চন্দন দিয়ে সাজানো হয়েছে তাঁকে। কী অপরূপ দেখাচ্ছিল, যেন শাপভ্রষ্ট দেবদূত। সে দিন দীপঙ্কর তার পিতাকে দেখে মনে মনে কী বলেছে, জ্যোৎস্নাদেবী জানেন না, কিন্তু এক বার যদি একটু মমতা, শ্রদ্ধা নিয়ে দেখে থাকে, মনে হবে যেন জ্যোতির্ময় ভাস্কর।

না, আর ঘুম হল না। ঘড়িতে দেখলেন, রাত তিনটে উনচল্লিশ। স্নানঘরে গেলেন। শুচি করলেন মলিন দেহকে জলের স্পর্শে। এক বার তাকালেন ছবিটার দিকে। কেয়া ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগল। তিনি গেলেন কেয়ার কাছে। দুটো সাপের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। নাগ আর নাগিনী। ওরা ফণা আন্দোলিত করে জ্যোৎস্নাদেবীকে সম্ভাষণ করল, অভিবাদন জানাল। উনিও দেখেছেন ওঁদের। বলতেন, “নাগ-নাগিনী নয়, সর্পদেব ও তাঁর ভার্যা।” দুধের বাটি এগিয়ে দিতেন, কখনও প্রকম্পিত হতেন না, এমন দুঃসাহস ছিল তাঁর। সেই থেকে ওরা আছে। নিয়মিত দেখা পান না। আজ ব্রাহ্মমুহূর্তে পেলেন।

তিনি বলতেন, কিন্নরী-দর্শন আর সর্প-দর্শনের সঙ্গে সৌভাগ্যের যোগ আছে। শেষ দিকে যখন স্টেজ ছেড়েছেন, আর আহ্বান আসে না, সিংহাসনচ্যুত তিনি, ওরাও আসত না। গভীর বেদনায় বলতেন, “তোমার কেয়া ফুলের গন্ধও
আর ওদের প্রলুব্ধ করতে পারে না। আর আমি হারিয়েছি যশ।”

হাহাকারে ডুবে যেতে যেতে এক দিন নটসম্রাট লুপ্ত হলেন। বিস্মৃতির ছদ্মবেশে তিনি নিজে নিজেই হয়ে উঠলেন টপ্পা-গায়ক নবকার্তিক। কী যে সব টপ্পা তখন একের পর এক গাইতেন, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। দুঃখে-অভিমানে মৃত্যু হল অভিনেতার, জন্ম হল কলকাতার পুরাতনী গানের ভান্ডারে সমৃদ্ধ এক গায়কের।

ভোর হল। বিবস্বান প্রকাশিত হচ্ছেন। জ্যোৎস্নাদেবী সূর্য প্রণাম করলেন। সাপ দুটো চলে যাচ্ছে। কেন তারা এসেছিল এত দিন পর! নতুন কী কোনও সৌভাগ্যসূচনা ওরা দিয়ে গেল!

সামান্য লোভী হলেন জ্যোৎস্নাদেবী। মাতৃত্বের আস্বাদ। পরক্ষণেই মনে হল দীপঙ্করের বৌ কেমন ভাবে নেবে তাকে! সন্তানের মুখে নাতির কথা আসে বার বার, কিন্তু ওর স্ত্রীর কথা আসে না একদমই।

জনমেজয় আজ দীপঙ্কর সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় গেলেন। একই ট্রেনে বৌও আছে। হাওড়া নেমে দেখা হবে। ছেলে কোচি থেকে দমদম নামতে রাত এগারোটা হবে। ইসরো-য় প্রশিক্ষণ শেষ, এ বার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা। পরদিন সকালে সকলে মিলে বেহালা ছাড়িয়ে জোকা যেতে হবে। জনমেজয়ের খুড়তুতো দাদার বাড়ি সন্তোষপুর। আজ রাতে সেখানে
থাকা। খাওয়াদাওয়া। দাদার সঙ্গে বহু দিন পর দেখা হবে। সার্ভে বিল্ডিং-এ ছিলেন তিনি।

হাওড়া স্টেশনে নেমে জনমেজয় দেখলেন, ডিজে নামক দৈত্যকে সঙ্গে করে এক দল শিঙা ফুঁকতে ফুঁকতে চলেছে। বিজয় উৎসব হয়তো বা কোনও রাজনৈতিক দলের। বৌকে সঙ্গে নিয়ে বেশ অসহায় লাগল। কী করে সন্তোষপুর যাবেন!

দীপঙ্কর সাহেব প্ল্যাটফর্ম বদলে চন্দননগরের ট্রেন ধরতে গেছেন।

২০

দীপঙ্কর বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই পল্লবী ফোন করল দেবলকে, “হ্যালো।”

দেবল ফোন ধরল না। ও পাশ থেকে প্রমীলাকণ্ঠ ভেসে এল, “কে বলছেন?”

পল্লবী তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিল। খানিকটা হাঁপ ধরেছে তার। একটু জিরিয়ে নিয়ে ভাবতে থাকল। সবটা দেবলের প্ল্যান নয় তো! ফ্ল্যাট দিতে হবে বলে সে-ই হয়তো এ সব করাচ্ছে। এত দিন ওর বৌ তো কোথাও ছিল না।

একটু পরে আবার ফোন এল মোবাইলে। নম্বর ভেসে উঠল দেবলের।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy