E-Paper

কেয়ার গন্ধ

জোড়াসাঁকো নেমে রবিঠাকুরের বাড়িতে এলেন জনমেজয়। এই সেই ঐতিহাসিক জোড়াসাঁকোর নাটমঞ্চ। এক সময় মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ও অভিনীত হয়েছে।

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৫ ০৮:১৬
ছবি: সৌমেন দাস।

ছবি: সৌমেন দাস।

পূর্বানুবৃত্তি: শেষরাতে বাড়ি ফিরলেন জনমেজয়। সুধাময়ী জেগেই ছিলেন। খেতে খেতে নানা কথা হল স্বামী-স্ত্রীর। অফিসের কাজ, আসন্ন নির্বাচন, রথযাত্রা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে। দীপঙ্করবাবু যাত্রা করবেন জেনে অবাক হলেন সুধাময়ী। সকালে এসে পৌঁছয় তাঁদের ছেলের চিঠি। সে চিঠিতে কথায় কথায় বাবার অভিনয়-জীবন নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ছেলের গর্ববোধ। অন্য দিকে অফিস না গিয়ে নিজের পছন্দমতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন দীপঙ্করবাবু। রিকশা নিয়ে বেড়ালেন নানা জায়গা, শেষে এসে বসলেন গঙ্গার ঘাটে। তিনি জানেন তাঁর স্ত্রী পল্লবীর গোপন প্রেমিকের আনাগোনার কথা। তাই হুট করে বাড়ি গিয়ে পড়েন না, পল্লবীকে গুছিয়ে নিতে সময় দেন। স্ত্রী পল্লবীর প্রতি আর কোনও রকম আকর্ষণ অনুভব করেন না বলে, স্ত্রীর পরকীয়া বিষয়েও তিনি উদাসীন। পল্লবীর গোপন প্রেমিকের নাম পলাশ। সে এরকম বহু নারীর কাছেই গোপন অভিসারে যায়। সে শারীরিক সুখের কারবারি। মনের জটিলতাকে সে এর মধ্যে আনে না। পল্লবীর শুধু শরীর তৃপ্ত হয়, মনের গভীরে জেগে থাকে স্বামীকে ঠকানোর জন্য অনুচ্চারিত পাপবোধ।

পল্লবী লুচি-তরকারি দিয়ে বলল, “এই যে ভবঘুরের মতো আদাড়-বাদাড়ে ঘুরছ, চাকরির ক্ষতি হবে না তো!”

দীপঙ্কর আনমনে বলেন, “আমাকে কিন্তু অনেকটা চোল রাজাদের মতো দেখতে।”

দীপ বলে উঠল, “বাবা, তোমাকে রাজেন্দ্র চোলের মতো দেখতে হলে ভাল হয়।”

পল্লবী বলে, “একতলার বাড়ি, সিঁড়ি সবে হল, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা। একেবারে রাজা-বাদশা!”

দীপঙ্কর বললেন, “মঞ্চের রাজা।”

দীপ বলল, “বাবা, তুমি অভিনয় করবে?”

দীপঙ্কর বলল, “চেষ্টা করব বাবা।”

সুধাময়ীর হাতের প্লাস্টার কাটার পরও মাসখানেক লাগল হাত ঠিক হতে। তখনও শ্রাবণ শেষ হয়নি।

সেপ্টেম্বর মাসে বা ভাদ্রের শুরুতে আশ্বিনের মেঘ সবে আকাশে ঘোরাফেরা শুরু করে। মানুষজন বলে পচা ভাদ্র। তবুও সুধাময়ীর একান্ত ইচ্ছেয় ওকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে এলেন জনমেজয়।

দক্ষিণেশ্বর অনেক বদলে গেছে। সেই গ্রাম্য ভাবটা নেই। এক সময় বেশ পাড়াগেঁয়ে ভাব ছিল দক্ষিণেশ্বরের। পঞ্চবটী আছে, কিন্তু পতিতপাবনী গঙ্গা আগে যে ভাবে দেখা যেত, তেমনটা নেই।

সুধাময়ী পুজো দিতে গেছে। ফিরলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ওকে দেখানোর ইচ্ছে রয়েছে। সুধাময়ী পুজো দিয়ে বেরোল। কপালে লাল মাতৃটীকা।

ওরা দু’জনে বসে হিঙের কচুরি খেল, আর রাজভোগ। কিছু খেলেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ইসরো-তে নিশ্চয়ই ভাল আছে, কিন্তু সবটাই দক্ষিণ ভারতীয় খাবার। বাঙালি খাবার পাওয়া যায় না। বাড়ি এলে সুধাময়ী ছেলেকে পেট পুরে খাওয়াবে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ওরা ইনড্রাইভ-এ গেল। সুধাময়ী স্বামীর বিষয়ে দারুণ গর্বিত। কত কিছু জানেন উনি!

জোড়াসাঁকো নেমে রবিঠাকুরের বাড়িতে এলেন জনমেজয়। এই সেই ঐতিহাসিক জোড়াসাঁকোর নাটমঞ্চ। এক সময় মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ও অভিনীত হয়েছে। নতুন বৌঠানের ছাদটা দেখতে দেখতে তরুণ কবির নতুন বৌঠানের সাহচর্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা শোনার সেই সমস্ত দিন যেন মুখর হয়ে উঠছিল। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উঠতেই সুধাময়ী আর থাকতে চাইল না। উত্তরে মদনমোহন মন্দির। সংলগ্ন দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দির। সেই থেকেই কি নাম চিৎপুর! অনেকে বলে চিতু ডাকাতের নামে চিৎপুর।

যাই হোক, এখানেই তো যুবক বয়সে পড়ে থাকতেন জনমেজয়বাবু। বড় ফণীবাবু, ছোট ফণীবাবু, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়— সব যেন এখনও চলমান স্মৃতি।

এখানেই প্রথম বাংলা নাটকের অভিনয়। মধুসূদন সান্যালের বাড়িতেই অভিনীত হয়েছিল ‘নীলদর্পণ’। তার পর বাঙালির জাতীয় নাট্যশালা গড়ে তোলার উন্মাদনা। পেশাদারি যাত্রার বেড়ে ওঠা। পাঁচশো বছরের ইতিহাস। একটা সময় ছিল, যখন এলেন গোপাল উড়ে, সুকণ্ঠ ও অভিনয়ে কলকাতার মন জয় করলেন। তার আগে নিধুবাবুর বাড়ির সামনে ‘কলা চাই, কলা চাই’ ডাক দিতে দিতে চলে যাওয়া কলাবিক্রেতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শিল্পীকে খুঁজে নিলেন নিধুবাবু।

দাশরথি রায় আর গোপাল উড়ে কলকাতায় একটু অন্য রকম যাত্রা শুরু করলেন। গোপাল উড়ের বিদ্যাসুন্দরের পালা কলকাতা মাতিয়ে দিল। একটু স্থূল, আদিরসাত্মক, কিন্তু দর্শক টানল প্রচুর। গোপাল উড়ের যাত্রা থেকে রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা নাট্যমঞ্চে আসার প্রেরণা পেয়েছিলেন।

জনমেজয় হঠাৎ গেয়ে উঠলেন, “ভয় কী মরণে/ রাখিতে সন্তানে/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে/ তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দং দং —”

মুকুন্দদাস শুরু করলেন স্বদেশি যাত্রা। গান শেষ হতে না হতেই মুকুন্দদাসকে গ্রেফতার করা হল। কাজী নজরুল ইসলাম নাম দিয়েছিলেন ‘চারণকবি’।

জনমেজয়ের উদাত্ত কণ্ঠের গানের আর কোনও শ্রোতা নেই চিৎপুরে। কেউ ফিরেও তাকাল না।

আশপাশে পোস্টার কিছু রয়েছে। ‘লোটাকম্বল জীবনের শেষ সম্বল’। রবীন্দ্র-অপেরা। ‘বাংলার ঘরে ঘরে জাগছে দুর্গা’। দেবযানী অপেরা। ‘গভীর রাতে উড়ো চিঠি’। ভৈরব অপেরা।

পোস্টার জুড়ে টেলিভিশনের স্টারদের ছবি।

সুধাময়ী বলল, “এই সবগুলোই আজকের নামীদামি যাত্রা?”

জনমেজয় বললেন, “হ্যাঁ।” বলতে কষ্ট হল।

আহা! সেই সব পালা। ‘শের আফগান’। উৎপল দত্তের ‘রাইফেল’ও ওঁরা যাত্রা করেছিলেন। এক জনের কথা মনে পড়ে, রিহার্সালের সময় গলা ভেঙে ফেলতেন কিন্তু নায়কের পার্ট তাঁর চাই। পুজোর সময়ের অ্যামেচার যাত্রায়। পানস চৌধুরী।

এই সময় এক জনের কথা কানে এল, “কেমন আচু জনমজয় বাবু!”

বাঁকড়ি ভাষা সহজে চেনা যায়।

“আরে সমীর, তুমি এখানে!”

“নাটকের বই লিতে।”

সঙ্গে রবীন্দ্র নাট্যসংস্থার সুব্রতও রয়েছেন।

জনমেজয়কে দেখে হাসলেন সুব্রত, বললেন, “গানটা ভাল গাইছিলেন।”

চার পাশের পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে উদাত্ত গলায় হেসে উঠলেন জনমেজয়।

সমীর বলল, “জনুদা, তোমায় বেশ চ্যাঙচ্যাঙা লাগচে গো! লায়ক বটে।”

ওর পিঠে একটা চাপড় দিলেন জনমেজয়। জিজ্ঞেস করলেন, “হাওড়া যাবে?”

“সুমুখে ডুরুডুরি জ্যাম। বাস বাগিয়ে লাভ কিচু হবিনি মনে লয়।”

জনমেজয় বললেন, “চলো সবাই মিলে হাঁটি। সুধাময়ী পারবে তো!”

“না, ট্যাক্সি নাও। সকলে মিলে যাই।”

জনমেজয় বললেন, “তথাস্তু। যাবি তো সমীর!”

ওঁরাও রাজি হয়ে গেলেন।

পল্লবী সকাল-সকাল স্নান সেরেছে। কেয়া ফুল দিয়ে ঘরটা সাজিয়েছে। অপূর্ব সুবাসে ঘুম ভেঙে গেল দীপঙ্করের। সর্প ও সর্পিণী ওদের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই রয়েছে। কেয়া ফুলের গন্ধ ওদের আটকে রেখেছে এই বাড়িটায়। কখনও কখনও ফণা বিস্তার করে দংশন করছে ছোট ছোট কীটপতঙ্গকে। ওদের বিষের নীলাভ রেখা গণ্ডি টেনে দিয়েছে ‘অভিষিক্তা’ নাম লেখা বাড়িটাকেই।

“ওঠো এ বার,” পল্লবী বলল দীপঙ্করকে।

দীপঙ্কর বললেন, “ক’টা বাজে?”

“ন’টা। তুমি তো এত ঘুমোও না, শরীর খারাপ?”

দীপঙ্কর বললেন, “না। ছুটির দিন তো, উঠতে ইচ্ছে করছে না,” আবার বললেন, “রোদ উঠেছে?”

“হ্যাঁ। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে।”

“কেয়া ফুলের গন্ধ পাচ্ছি।”

“গন্ধটা কেমন!”

“খুব সুন্দর। কোথায় পেলে!”

“ঝিলের ধারে একটা কেয়া ফুলের গাছ রয়েছে, অনেক কাঁটাও রয়েছে।”

দীপঙ্কর বলল, “কেয়ার কাছে সাপও থাকে।”

পল্লবী হেসে বলল, “তাতে কী হয়েছে!”

“লতায় কাটলে সেই মৃত্যুকে অপঘাত বলে। তুমি এত সুন্দর, কেন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে!”

চোখে জল এসে গেল পল্লবীর।

কোনও ক্রমে চোখের জল আটকে বলল, “তুমি কখনও আমায় তাকিয়ে দেখেছ!”

“এই তো দেখছি।”

“আদর করেছ!”

হাসলেন দীপঙ্কর। বললেন, “গতকাল বিষ্ণুপুরে একটা জায়গাতে গেছিলাম।”

পল্লবী নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”

“বিজয়-আশ্রম। লালবাঁধের ধারে। বেশ সুন্দর।”

“আশ্রমে কেন গেছিলে? সন্ন্যাসী হবে নাকি?”

দীপঙ্কর হেসে বললেন, “না। তা হব না। ভাল লাগছিল বেশ। ওখানে একটা জায়গা আছে, নাম হাওয়া মহল।”

“তাই!” পল্লবী বলল, “কেন এমন নাম?”

“ওখানে সব সময় হাওয়া থাকে। বছরের যে কোনও ঋতুতে।”

সর্পদম্পতি ওদের জানলা বেয়ে খানিকটা উঠল। কেয়ার গন্ধে ওদের রমণেচ্ছা জেগে উঠল। রোদ আবার নিভে গেল, বৃষ্টি শুরু হল। ঝমঝম বৃষ্টিতে ওরা রমণে মগ্ন হল। আর রমণাবসানে হিসহিস শব্দ তুলে ঝিলপারের দিকে চলে গেল।

পল্লবী চমকে উঠল, বলল, “সাপের হিসহিস শব্দ শুনলে?”

“কই, না তো!” দীপঙ্কর বললেন।

পল্লবী বলল, “আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনলাম।”

দৌড়ে ছেলের ঘরে গেল পল্লবী। দীপ পড়তে বসেছে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিল ও।

বলল, “আমি যদি কোনও দিন না থাকি, তোর অসুবিধে হবে?”

“না, যাও না! কোথাও ঘুরতে যাবে! বাবাকেও নিয়ে যেয়ো।”

“তুই একা থাকতে পারবি?”

“হ্যাঁ। কেন পারব না!”

সাপের হিসহিস আওয়াজ স্পষ্ট শুনেছে পল্লবী। ছেলেকে একা ফেলে কোথাও যাওয়া যাবে না।

দীপঙ্করের কাছে এসে বলল, “কোথাও ঘুরতে যাবে? ছেলেকেও নেব।”

দীপঙ্কর হেসে বললেন, “ওকে ছাড়া আমরা কোথাও গেছি! কোথায় যাবে? বেশ বৃষ্টি পড়ছে।”

“হোক, আমরা বৃষ্টিতে ভিজব। তোমরা তৈরি হতে হতে বৃষ্টি থেমে যাবে।”

তা-ই হল। বাবা আর ছেলে তৈরি হতে হতে বৃষ্টি থেমে গেল। ওরা একটা অটো নিল, চলে এল হুগলির জোড়াঘাটে।

একটা চেনা নৌকো পেয়ে উঠে পড়ল। হরিমাঝির নৌকো। সুন্দর মাছ-ধরা নৌকো, তবে ছাউনি আছে। নৌকো বাইতে লাগল হরি মাঝি। ওরা যেতে থাকল নদীপথে ত্রিবেণীর দিকে।

তীরের দু’পাশে সবে কাশফুল আসতে শুরু করেছে। নির্মেঘ আকাশ। শ্রাবণের আকাশের সামান্য কালোটুকুও অপনীত হয়ে গেল।

পল্লবী বলল, “আজকের দিনটা তোমারমনে ছিল!”

দীপঙ্কর বললেন, “মনে আছে।”

“কী করে বুঝব, মনে আছে?”

পল্লবীর জন্যে একটা আংটি কিনেছিলেন। আংটিটা পল্লবীর হাতে পরিয়ে দিলেন দীপঙ্কর।

এক সময় ওদের খিদে পেল।

নৌকো নিয়ে ওরা নামল রানি রাসমণির ঘাটে।

একটা দরমা দেওয়া হোটেলে খুব খেতে ইচ্ছে হল দীপঙ্করের। একেবারে দামি কিছু নয়, গরিব মানুষদের হোটেল। বিকেল তিনটে তখন। অপ্রস্তুত হোটেল-মালিক যত্ন করে মোটা চালের ভাত বসাল, ডিমের অমলেট, কুচো মাছের ঝাল। পদ্মপাতায় কুণ্ঠিত হয়ে খেতে দিল, হয়তো গরিব মালিকের বৌ।

হরি মাঝি বলল, “বাবু, কেমন খেলেন!”

দীপঙ্কর হেসে বললেন, “ভালই তো!”

ওরা তিন জনেই বলল ভাল লাগার কথা।

হরিমাঝি বলল, “ভয়ে ভয়ে নামিয়েছিলুম, ভাবতে পারিনি আপনারা এখানে খাবেন।”

আবার নৌকো করে ওরা যখন জোড়াঘাটে নামল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অমাবস্যার রাত কিন্তু তারাভরা আকাশ।

সর্পদম্পতি যখন আবার ঝিল পেরিয়ে হিসহিস শব্দ তুলে ওদের বাড়ির আশপাশে এল, কেয়া ফুলের গন্ধ আরও তীব্র হয়েছে।

রাতে পল্লবী ঘন হয়ে কাছে এল। বলল, “আমায় একটু আদর করবে!”

দীপঙ্কর যান্ত্রিক ভাবে পল্লবীকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ওঁর শরীর, মন জাগল না। পল্লবীও টের পেল তা।

খুব তাড়াতাড়ি কাজটা মিটে গেলে পল্লবী বলল, “তুমি কী করে সম্রাট আকবর করবে!”

দীপঙ্কর বললেন, “কেন?”

“জানো, সম্রাট আকবরের হারেমে কতনারী ছিল?”

দীপঙ্কর বললেন, “পাঁচ হাজার।”

“এটা বোধহয় বাড়াবাড়ি, তাই না!”

“আসলে পাঁচ হাজার জনকেই যে সম্রাট ভোগ করত তেমনটা নয়, এদের অনেকেই হারেমের নানা কাজে যুক্ত থাকত।”

পল্লবী বলল, “তুমি অনেক কিছু জানো, কিন্তু নিজের বৌকে জানো না।”

দীপঙ্কর বললেন, “জানি তো।”

“তোমার ভয় হয় না, আমি যদি অন্য পুরুষের সঙ্গে কিছু করি!”

“না, হয় না।”

“কেন হয় না! তোমার অধিকারবোধ নেই?”

“নেই-ই বলতে পারো, আমি কখনও জোর করতে পারি না।”

“মোগল হারেমে খোজারা থাকত, তারা ওদের পাহারা দিত।”

“আমি মঞ্চের সম্রাট হব। সত্যি কিছু নয়।”

এ দিকে কেয়া ফুলের গন্ধে আবার মাতাল হল সর্পদম্পতি। এই সময় এক জন কেউ যাচ্ছিল, তখন তারা রমণে উন্মত্ত।

পলাশ অজান্তে মাড়িয়ে দিয়েছিল জোড়বদ্ধ দম্পতির লেজ। নাগিনী যাবতীয় ক্রূরতায় হিংস্র হয়ে উঠল। যাবতীয় বিষ ঢেলে দিল পলাশের শরীরে।

রাতে আবার বৃষ্টি শুরু হল। কেয়া ফুলের গন্ধ তীব্রতর হল।

সারা রাত পলাশের দেহ দীপঙ্করদের বাড়ির পাঁচিলের পাশটায় পড়ে থাকল।

ভোর হলে বিষে জর্জরিত পলাশকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, চিকিৎসার কোনও সুযোগ রইল না।

পল্লবী পলাশের মৃত্যুর খবর পেল বেশ বেলায়। তখন দীপঙ্কর অফিসে চলে গেছেন। বাসি কেয়া ফুলগুলি আবর্জনার গাড়িতে ফেলে দিল পল্লবী। পলাশের মৃত্যুর সংবাদে তেমন দুঃখ পেল না সে। বরং খুশি হল এক রকম।

গত রাতেই পলাশকে দংশনের পর রমণ অসমাপ্ত রেখে সর্পদম্পতি উধাও হয়ে গেল। এটাও টের পেল পল্লবী। কোনও হিসহিস শব্দ আর চার পাশে নেই। একটা মৃত্যু, একটা শিকারের পর কিছু দিন সর্পিণী হলাহলহীন হয়ে থাকে। হয়তো সর্পিণীর রজঃস্বলা পর্বও শুরু হয় তখন।

পলাশের প্রাণহীন দেহ প্রথম দেখতে পেয়েছিল কিছু কিশোর। পলাশদা মন্দ লোক ছিলেন না, তবে একা কাউকে পেলে জাপ্টে ধরে বিশ্রী সব কাণ্ড করতেন। তবে এই নিয়ে কোনও অভিযোগ ওরা করেনি। আজ ওঁর নিথর মৃতদেহ নীলাভ রঙে সেজে রয়েছে। পলাশের তেমন আপন বলতে কেউ ছিল না। থাকলেও কেউ তেমন খোঁজ করত না।

এক বার পলাশ ওদের নিয়ে পুরুলিয়া গেছিল। বীণাপাণি অপেরায় পার্ট করত। সেই অভিনয় দেখাতে নিয়ে গেছিল ওদের।

সবে গ্রিনরুমে সাজো সাজো রব উঠেছে। উৎসাহী যারা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দেখছে তাদের মধ্যে ওরাও ছিল। দেখল, পলাশদা মেকআপে মেকআপে ক্রমশ নারী হয়ে উঠছেন। এর পর কনসার্ট শুরু হল। তার পর স্টেজে যখন পলাশদা এলেন, কণ্ঠে এক মায়াবিনী নারীর উচ্চারণ! সেই পলাশদা আজ চলে গেলেন। চোখের জল ফেলারও কেউ ছিল না।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy