E-Paper

কেয়ার গন্ধ

বিরাটি থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদা। আর সেখান থেকে হেঁটেই ওঁরা চিৎপুর এলেন। মাঝখানে সাধুর হোটেলের পাশে চা খেলেন।

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৯
ছবি: সৌমেন দাস।

ছবি: সৌমেন দাস।

পূর্বানুবৃত্তি: জনমেজয়-ফটিকদের সঙ্গে আড্ডায় পানস চৌধুরী তুলে আনলেন পুরনো কলকাতার অভিনয়ের ইতিহাসের নানা কথা। উঠে এল কলকাতার সাঁ সুসি-তে বিদেশি শিল্পীদের অভিনয় করার কথা, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ম্যাকবেথ-এর কথা, অভিনেত্রী মাদাম দারমেনভিল-এর কথা। অন্য দিকে দীপঙ্কর এক দিন অফিস না গিয়ে চলে গেলেন বিরাটিতে, তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী-র কাছে। জানতে পারলেন, দীপঙ্করের বাবা প্রায়ই দীপঙ্করের কথা বলতেন, দেখতে যেতেও চাইতেন, কিন্তু অপমানিত হওয়ার ভয়ে পারেননি। শেষ জীবনে পক্ষাঘাত এবং স্মৃতিহীনতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। নিজেকে নবকার্তিক নামে একটি চরিত্রে কল্পনা করতেন এবং কল্পনায় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন নিধুবাবুর সঙ্গে। লিখতেন টপ্পা-খেউড় জাতীয়গান। দীপঙ্করের সৎমা দীপঙ্করকে দুপুরে ভাত খেয়ে যেতে বললেন। দীপঙ্করের ‘মা’ ডাকেচোখে জল এসে যায় জ্যোৎস্নাদেবীর।

দীপঙ্কর আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, “আমি খেলে আপনার কম পড়ে যাবে তো!”

“মোটেই না, আমি তো দু’বেলার ভাত এক সঙ্গে রান্না করি।”

দীপঙ্কর হেসে বললেন, “আচ্ছা, এক সঙ্গে খাব। আপনি যখন চাইছেন, তা-ই হবে।”

ছোট একটা ডাইনিং টেবিল, রং উঠে গেছে। তবু বেশ পরিচ্ছন্ন। দীপঙ্কর খেতে খেতে বললেন, “আপনারা পুব বাংলার?”

“হ্যাঁ, আমরা ঢাকার।”

“বাপের বাড়ির লোকজন কোথায়?”

“আছেন এই শহরে। কেউ আসেন না। তোমার বাবাকে বিয়ে, যাত্রা আমাদের ব্রাত্য করে দিয়েছে সমাজ থেকে।”

নীরবে খেতে লাগলেন দীপঙ্কর। কত দিনের গ্লানি আজ যেন খানিকটা হলেও ধুয়ে যাচ্ছে।

খাওয়া শেষ হলে দীপঙ্কর বললেন, “এখনও যাত্রা করেন?”

“খুব কম। যেমন সুযোগ পাই।”

“আর কোনও আয়-উপার্জন?”

“শিল্পীর সরকারি পেনশন আছে।”

দীপঙ্কর বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না, ‘মা, আমি তো আছি।’

“তুমি একটু বিশ্রাম করে নাও, বৃষ্টি কমে গেছে কিন্তু রোদ উঠেছে। এই রোদ কড়া হবে।”

দীপঙ্কর ভাবলেন, অফিসে যখন যাওয়া হল না, আর একটু কাটিয়ে গেলে মন্দ হয় না।

“আমাদের বার-বারান্দায় একটা তক্তপোশ আছে। তোমার বাবা ওখানে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতেন আর বানিয়ে বানিয়ে কাল্পনিক সংলাপ বলতেন নিধুবাবুর সঙ্গে। কখনও টপ্পা গেয়ে উঠতেন এমন ভাবে, যেন নিধুবাবু খুব মন দিয়ে শুনছেন।”

“আপনি আশ্চর্য হতেন না?”

“প্রথম-প্রথম হতাম, তার পর গা-সওয়া হয়ে গেছিল। গানগুলি অপূর্ব লিখেছিলেন।”

“আপনি গাননি কোনও দিন?”

“গেয়েছি। তবে সে সব গান যাত্রাপালায় গাওয়ার নয়। অনেক উঁচু দরের টপ্পা। একটা রেকর্ডও করেছিলাম।”

“আপনার রিহার্সাল নেই? আপনার টপ্পার রেকর্ড আমি দেখেছি।”

“সে সব শব্দ হারিয়ে গেছে। চিৎপুরে যাব, যদি কোনও দল নেয়! আমার টপ্পার রেকর্ড দেখেছ বলে বেশ লাগছে। এখন তো রেকর্ড আর কেউ কেনে না। সিডি-ক্যাসেট সবই তো হারিয়ে গেল। শুনেছি সামান্য একটা পেন ড্রাইভে সব ভরা থাকে।”

“এখনও অভিনয় করে যেতে হবে?”

“আসলে বাজারদর যে ভাবে বাড়ছে...”

“আজও যাবেন চিৎপুরে?”

“হ্যাঁ, যাব।”

“আমি গেলে অসুবিধে হবে?”

“না। আমরা বাইরে চা খেয়ে নেব।”

“আচ্ছা,” সম্মতি দেন দীপঙ্কর।

“এখন একটু বিশ্রাম করে নাও।”

ক্লান্তি ছিলই, শুতেই চোখ বুজে এল। এলোমেলো কিছু স্বপ্নও দেখলেন।

তার পর ঘুম ভাঙল ওঁর ডাকে। বললেন, “যাবে চিৎপুর, নাকি বাড়ি চলে যাবে?”

দীপঙ্কর চিৎপুরেই যেতে চাইলেন।

বিরাটি থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদা। আর সেখান থেকে হেঁটেই ওঁরা চিৎপুর এলেন। মাঝখানে সাধুর হোটেলের পাশে চা খেলেন।

চিৎপুরে এসে যে ঘরে ওঁরা এলেন, সেটা খুব ছোট। তার মধ্যেই চেয়ার-টেবিল পাতা।

গলির পর গলি পেরিয়ে এখানে আসা হয়েছে। নাম লেখা সুরধ্বনি ব্যান্ডপার্টি। তালিম দেন মাখনলাল নট্ট। একটু আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন দীপঙ্কর। সুরধ্বনি ব্যান্ডপার্টি আর যাত্রার দল এক!

প্রায়ান্ধকার ঘরে একটা বাল্‌ব জ্বলছে।

লোকটা বোধহয় ম্যানেজার। ওদের দেখে বিড়িটা ফেলে দিলেন। বললেন, “ম্যাডাম, আপনি এত কষ্ট করে এলেন কেন?”

“কিছু খবর দিচ্ছেন না তো!”

“নতুন পালা নেই। আপনার মতো আর্টিস্টকে নামানো কি সহজ কথা!”

“যে কোনও রোল পেলেই করব, ভিখারিনির আবার বাছবিচার!”

“ছি ছি! এ রকম বলবেন না।”

“কোনও খবর নেই?”

“সত্যি নেই ম্যাডাম। কর্তা আর যাত্রার পিছনে টাকাপয়সা ঢালতে চাইছেন না। বলেছেন, ওই কনসার্টকে বিয়েবাড়ির বায়না পেলে যেতে বলো। ওখান থেকেই নিজেদের মাইনে তুলে নাও।”

“চলো দীপঙ্কর, আমরা অন্য কোথাও যাই।”

এ বার ম্যানেজার দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খুব চেনা লাগছে মুখটা।”

“আমার ছেলে।”

“ও তাই! একদম বাবার মুখ বসে রয়েচে। ম্যাডাম, একটু চা খাওয়াই, ওটুকু পারব।”

“থাক, পরে আসব। এক বার নন্দদুলাল অপেরায় যাব ভাবছি।”

“তাই যান ম্যাডাম, ওরা খুব রাইজ়িং। সামাজিক সব পালা করে। টলিপাড়ার আর্টিস্ট নামায়।”

বাইরে নেমে উনি বলেন, “তুমি কি আর যাবে?”

“চলুন না যাই!”

এ বার ওঁরা এলেন নন্দদুলাল অপেরায়। ঘরটা বড়। এসি আছে। এক জন মানুষ বসে আছেন। চুলগুলো সব রং করা। হাতের আঙুলে তিন রকমের পাথরের সোনার আংটি। গলায় সোনার ভারী চেন।

এঁরা হাতজোড় করলেন। ভদ্রলোক প্রতিনমস্কার করলেন না।

জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “আমি এক সময়ের নায়িকা। এখন যে কোনও রোল পেলে করব।”

“আপনি টিভি সিরিয়াল করেছেন? টলিপাড়ায় যাতায়াত আছে?”

“না। তা নেই।”

“আমদের একটাই কোয়ালিফিকেশন দরকার, টলিউডে নাম থাকতে হবে।”

“যাত্রার সঙ্গে কী সম্পর্ক সিরিয়ালের?”

“কিছু নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষ টিভির স্টারদের টানেই আসবে।”

“আমরাও তো স্টার ছিলাম। হাজার হাজার মানুষ যাত্রার টানেই আসত।”

“এখন আসবে না। ও সব সুলতানা রিজিয়া, জাহানারা মানুষ খাবে না। এখন টিভির যুগ। টিভি খুলুন। সিরিয়াল দেখে অভিনয় শিখুন।”

“ওদের দেখে অভিনয় শিখব!”

“উত্তমকুমার তো যাত্রা দেখতে আসতেন। নিজেকে সব সময় আপডেট রাখতে হয়।”

“আপডেট রাখি, এক বার নিয়ে দেখুন।”

“চলবে না। আরে মায়ের চরিত্রে এখন মেলা স্টার। টাকা দিলে উনিশ বছরের মেয়ে মায়ের রোল করবে। আপনাদের যুগ আর নেই।”

এর পর আর কথা হয় না। বেরিয়ে এলেন ওঁরা। হাঁটতে হাঁটতে এলেন কলেজ স্ট্রিট।

দীপঙ্কর বললেন, “আর এক বার কোথাও চা খেলে হয়।”

“আমিও তা-ই ভাবছিলাম। কোথায় খাবে?”

“ফেভারিট কেবিন?”

“বাহ, দারুণ! যদিও তোমার বাবা আমাকে যখন এখানে প্রথম নিয়ে যান, বসতে চাইনি। বলেছিলাম, একটুও ভাল না। নোংরা। তখন তোমার বাবা ফেভারিট কেবিনের অনেক গল্প করেছিলেন। তার পর অভ্যেস হয়ে গেছিল।”

দীপঙ্কর এ বার বললেন, “বাবা চলে যাওয়ার পর আমি গ্রামে যাত্রার দল এলে বাবাকে খুঁজতাম। মানুষগুলি বাস থেকে নামতেন, উস্কোখুস্কো চুল। চোখ দুটো রক্তাভ। গ্রামের পুকুরে লোটা নিয়ে গিয়ে স্নান সারতেন। প্রত্যেকের কাছে থাকত ফিনফিনে শৌখিন গামছা। সন্ধেবেলা যাত্রার আসরে আর চেনা যেত না। কোনও কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রী নামকরা ছিলেন। তাঁদের অভিনয় মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। বাবাকে খুঁজতাম খুব। গ্রামের কেউ কেউ বলতেন, ‘তোর বাবাকে দেখলাম, এখন তাঁর নাম অমলকুমার।’ আমার মনে হত জিজ্ঞেস করি, আমার বাবা অমলকুমার তাঁর ছেলে দীপঙ্করের কথা কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন? করা হয়নি।”

“তোমার বাবা আমাকে নিয়ে বেশ কয়েক বার তোমার পিসির বাড়িতে তোমায় দেখতে গেছিলেন। তোমার পিসি দেখতে দেননি। তোমার বাবাও ভয়ে দেখা করেননি।”

দীপঙ্কর বললেন, “পিসেমশাইয়ের একটা দোকান ছিল শ্যামবাজারে, যেতেন না। পিসেমশাইও যাত্রা করে করে ঘুরে বেড়াতেন।”

“তাই বোধহয় পিসিমার ভয় ছিল। তিনি তোমায় আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন।”

চা আর টোস্ট অর্ডার দিলেন দীপঙ্কর।

এক সময় চলেও এল টোস্ট আর চা।

পাশেই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল।

জ্যোৎস্না দেবী বললেন, “আমি উৎপল দত্তকে দেখেছি। ওঁর কাছ থেকে অভিনয়ের টিপসও পেয়েছি। কয়েকবার ওঁর লেখা আর পরিচালনায় আমি আর তোমার বাবা খুব ছোট রোলে অভিনয়ও করেছি। তখন আমরা দু’জনেই নবাগত।”

দীপঙ্কর বললেন, “আমি ওঁর অভিনয় এই হল-এই দেখেছি, ‘টিনের তলোয়ার’। পিসিমাকে নিয়ে এসেছিলাম।”

“তোমার বাবা, জানো তো, বাড়িটা কিছুতেই করতে চাননি। বলতেন, কী হবে বাড়ি করে! আমাদের তো কেউ নেই। আমি বলেছিলাম, কেন, দীপঙ্কর এক দিন না এক দিন আসবেই। ওঁর বৌ আসবে, ছেলে বা মেয়েও আসবে।”

“বাবা কী বলতেন?”

“বলতেন, কখনও আসবে না।”

ওঁরা যখন বেরোলেন, একটু রাত হয়েছে।

জ্যোৎস্না দেবী বললেন, “অনেক হেঁটেছি, এ বার চলো একটা অটোয় উঠি। শিয়ালদা স্টেশনেই যাব আমি। তুমি তো হাওড়া যাবে মনে হয়?”

দীপঙ্কর বললেন, “আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি যাব।”

রাত হয়েছে, ভিড় কম নয়। দীপঙ্কর ওঁকে ট্রেনে তুলে সামান্য দাঁড়ালেন। তার পর ট্রেন ছেড়ে গেলে মনে পড়ল, আরে, তাঁকে তো হাওড়া যেতে হবে। ওঁরও মনে ছিল না কথায় কথায়। যা-ই হোক, সন্তানের কর্তব্য না হোক, কিছুটা আন্তরিকতা তো দেখানো গেল।

দীপঙ্কর এন্টালির মোড় থেকে মিনিবাস ধরে হাওড়া এলেন। মান্থলি আছে বলে টিকিটের কাউন্টারে দাঁড়াতে হল না।

ট্রেনে তেমন ভিড় ছিল না। চন্দননগর নামতে রাত দশটা হল। ঝিলটার সামনে দিয়ে আসার সময় সর্পদম্পতিকে দেখতে পেলেন দীপঙ্কর। সাপের ঘ্রাণশক্তি নেই, ওরা দেখতেও পায় না। কিন্তু তবু মনে হল ওরা যেন ওঁকে চেনে। হয়তো দীপঙ্করের পায়ের স্পন্দন ওদের চেনা।

গানের একটা লাইন মনে এল, ‘কবে নব ঘন বরিষণে গোপনে গোপনে এলি কেয়া’।

আবার সেই মাতাল করা কেয়া ফুলের গন্ধ। হাওয়ায় হাওয়ায় আশ্চর্য সৌরভ।

রাতে এসে দেখলেন, পল্লবী ফেরেনি। কলকাতায় গেছে। দামি কিছু গিফট নিয়ে আসবে। দীপঙ্কর কখনই ও সব ছুঁয়ে দেখেননি। ছেলে যখন ছোট ছিল, এ সব পেলে খুশি হত। এখন সেও মায়ের এ সব উপহার ফিরিয়ে দিতে শিখেছে।

পল্লবী না আসায় দীপঙ্কর ও ছেলের কোনও অসুবিধে হল না। বরং দীর্ঘ দিন ঘরে আটকে থাকলে পল্লবীর শরীর খারাপ হয়, খুব মাথা ধরে। এ রকম বেরোলে ও কিছু দিন সুস্থ থাকে।

দুপুরের ট্রেনে শিয়ালদা গেছে পল্লবী। দেবল আসবে। দামি বিদেশি গাড়িতে। পার্ক স্ট্রিটের কোনও দামি হোটেলে ঘর বুক করা থাকবে। দেবল যৌনতায় যে খুব কুশল তা নয়, একটুতেই নেতিয়ে পড়ে, কিন্তু টাকাপয়সার শেষ নেই। সরকারি উচ্চপদে এখনও রয়েছে, কিন্তু ওটা কিছুটা ক্ষমতা দেখানোর জন্য। দেবল বলে, অর্থই ঈশ্বর, তার কোনও পাপ-পুণ্য থাকতে পারে না। যে কোনও ভাবে অর্থ আসতে হবে। কখনও কখনও পল্লবীকে পাশে বসিয়ে ইন্টারন্যাশনাল শেয়ার মার্কেটে ওর খেলাটা দেখায়। পল্লবী গভীর ভাবে বিশ্বাস করে দেবলকে। সে সব সময় পজ়িটিভ। তার ব্যবহারও ভাল। বিমানে যাতায়াত করে। ফাইভ স্টার হোটেলে থাকে। ডলারই তার কাছে ঈশ্বর।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy