পূর্বানুবৃত্তি: পোড়ামাটির হাটে দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল জনমেজয়ের। জনমেজয়ের কথায় তাঁর সঙ্গে মা ঠাকরুন মেসে এসে উঠলেন দীপঙ্কর। সেখানে জনমেজয় তাঁকে খাওয়ালেন ডিম-আলু-পেঁয়াজের ভর্তা আর ভাত। তার পর ছাদে অনেক ক্ষণ গল্প করলেন তাঁরা। কথায় কথায় উঠে এল দীপঙ্করের বাবার খেরোর খাতার কথা। সেখান থেকে নানা পদ দু’জনে মিলে গাইলেন। অন্য দিকে, রামবিলাস অপেরায় দেখা করতে গেছেন জ্যোৎস্নাদেবী। সেখানকার ম্যানেজার রাখহরি তাঁর গান শুনে, নাচ দেখে পরীক্ষানিরীক্ষা করে নিচ্ছেন। রাখহরিকে প্রথমে খুব সুবিধের লোক বলে মনে না হলেও, পরে দেখা গেল মানুষটি খারাপ নন। সাম্মানিক হিসেবে পাঁচশো টাকা তুলে দিলেন জ্যোৎস্নাদেবীর হাতে। তাঁকে গাড়ি করে পৌঁছেও দিতে চাইলেন, কিন্তু জ্যোৎস্নাদেবী রাজি হলেন না। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন শিয়ালদা স্টেশন।
হঠাৎ কেউ যেন ডেকে উঠল, “মা, ও মা!”
পরিচিত কণ্ঠস্বর, খুব আন্তরিক।
ঘুরে তাকিয়ে অবাক হলেন জ্যোৎস্নাদেবী। দীপঙ্করকে এই সময়এখানে দেখবেন, ভাবেননি তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এখানে?”
“অফিস থেকে ফিরছিলাম। কলেজ স্ট্রিটে এসেছিলাম। ভাবলাম এক বার শিয়ালদা স্টেশনে যাই, যদি আপনার দেখা পাই।”
দীপঙ্কর প্রণাম করলেন সামাজিক পরিচয়ের সৎ মা-কে। শিহরিত হলেন জ্যোৎস্নাদেবী। কী যে অনুভূতি হল তাঁর!
সদ্য পাওয়া পাঁচশো টাকা হাতে দিয়ে বললেন, “বাড়ির জন্য মিষ্টি নিয়ে যেয়ো।”
দীপঙ্কর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “কোনও দিন বুঝতে দাওনি তুমি, আড়াল থেকে আমার পড়াশোনার খরচা দিয়ে এসেছ, সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে কাছে আসোনি কখনও, জানতে দাওনি এক যুবককে, আজ সে প্রবীণ না হলেও খুব কাছাকাছি রয়েছে সেই প্রাজ্ঞতার।”
দীপঙ্কর হাজার টাকা বার করে প্রণাম করে বললেন, “এটা তোমাকে নিতে হবে, মা। ফেরানো যাবে না...”
তার পর ট্রেনে তুলে দিলেন জ্যোৎস্নাদেবীকে। প্রিয়জনকে দেওয়ায় যে কী আনন্দ, আজ উপভোগ করছেন দীপঙ্কর।
মানুষটির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা খুব অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে অনেকটাই গড়ে উঠেছে। বদল হচ্ছে তাঁর, যে পৃথিবী ছিল অবিশ্বাসের, ভালবাসাহীনতার, সেই পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে ভালবাসা। এই ভালবাসা এক সন্তানের, তাঁর নতুন মায়ের প্রতি। এক অপার ভালবাসা এক পুত্রের, তাঁর বাবার প্রতি। এক মানব বা মানবীর, পৃথিবীর প্রতি।
১৫
শিয়ালদহ থেকে বাসে চেপে হাওড়া এলেন, তখন বেশ রাত। তবে শেষ ট্রেনের দেরি আছে। ব্যান্ডেল লোকাল পেয়ে গেলেন।
ট্রেনের কোলাহল, ধাক্কাধাক্কি তাঁর কানে পৌঁছল না। এক সময় তিনি মানকুণ্ডু স্টেশনে চলে এলেন। ট্রেন একেবারে ফাঁকা। চন্দননগরের এক পরিচিত সহযাত্রী বললেন, “ও দীপঙ্করবাবু, অনেক বার ডেকেছি আপনাকে। কী ভাবছিলেন এত! অফিসে কিছু হয়নি তো?”
দীপঙ্কর বললেন, “না, না। সব ঠিক আছে।”
“চলুন, চন্দননগর আসছে।”
উঠলেন দীপঙ্কর।
প্ল্যাটফর্মে নেমে কেয়াবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই টের পেলেন, ওরা জেগে ছিল। সর্পদম্পতি দীপঙ্করকে পাহারা দিয়ে ঘরের দরজায় নিয়ে এল।
পল্লবী দরজা খোলার আগে ওরা চলে গেল।
দীপ জেগে ছিল বাবার জন্য। তার ভয় করছিল। বাবা যদি তাদের ছেড়ে চলে যায়! অবশ্য সে জানে হরি মাঝির নৌকো, হুগলি, চন্দননগরের গঙ্গার ঘাট আর দীপকে ছেড়ে বাবা কোথাও যেতে পারবে না।
মাকে ছেড়ে বাবা যেতেও পারে। আস্তে আস্তে সে অনুভব করে, কেন বাবা-মায়ের সম্পর্ক এত আলগা। মা খুব একটা বাবাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। মায়ের প্রচুর পুরুষ-বন্ধু। বাবা চলে গেলে তাদের সঙ্গে কথা হয়। মা রান্নাটুকু করে দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। অনেক সময় ফেরে অনেক রাত্তিরে। মায়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়েছে দীপ।
মা অবশ্য দীপের রেজ়াল্টের বিষয়ে সচেতন, পড়াশোনার বিষয়ে অতখানি নয়। বাবা বাড়িতে থাকলে অঙ্ক করায়। অসম্ভব ধৈর্য, রেগে যায় না।
সে দিন মা ছিল না, বাবাও অফিসে, বাবার খেরোর খাতাটা দেখছিল দীপ। হাতের লেখাটা ঠাকুরদার। খুব সুন্দর হাতের লেখা।
তিনি লিখেছেন, ‘কলিকাতা সত্যি কমলালয়। কত রাজবাড়ি এখানে। শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণের প্রাসাদ। তিনি কলিকাতার কবিদের বড় পৃষ্ঠপোষক। রাম বসু, হর ঠাকুর, রামপ্রসাদ ঠাকুর— বড় বড় কবিয়ালদের ঠাঁই হয়েছে এই রাজবাড়িতে। এখন তাঁর দেখাদেখি অনেক বড় মানুষ কবিয়ালদের আশ্রয় দিচ্ছেন। পোস্তার রাজবাড়ি, বড়বাজারে সিংহি বাড়ি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বড় বড় কবিয়ালের ঠাঁই হয়েছে।
‘গঙ্গার ঘাটে সপ্তডিঙা মধুকরী। কত বাণিজ্যতরীর নিত্য আনাগোনা কলকাতা বন্দরে। অনেক আলোর রোশনাইয়ের মধ্যে আছে দারিদ্রের অন্ধকার কাঁসারিপাড়া, কুমোরটুলি, তাঁতিপাড়া আর দর্জিপাড়ার মহল্লায়।
‘শোভাবাজারে আছে একটি বটতলা। বটবৃক্ষের তলায় ছাপাখানা। ওর নাম বটতলা।...’
দীপের বেশ লাগছে পড়তে।
বাবা এল, দীপও দৌড়ে গেল। মা গা ধুয়ে সেজেগুজে রয়েছে। বলল, “এত দেরি!”
বাবা বলল, “আজ তো খুব দেরি হয়নি।”
দীপঙ্করের হাতে একটা সন্দেশের বাক্স। সেটা ছেলের হাতে দিলেন।
পল্লবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাকে হয়তো বাড়িতে দেখতে পাব না ভেবেছিলাম।”
পল্লবী বলল, “আমাকে দেখতে পাবে না ভেবেছিলে কেন?”
“তুমি তো প্রতিদিন বেরোও।”
“দীপ বলেছে বুঝি।”
“না, দীপ বলবে কেন! আমি অনুভব করেছি। ভাল তো, বাড়ির মধ্যে বসে না থেকে একটু খোলা হাওয়ায় ঘোরা মন্দ কী!”
পল্লবী একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যদিও সে জানে, কথাটার মধ্যে কিছু হলেও খোঁচা আছে।
“চা খাবে?”
“এত রাতে!”
“আমারও খেতে ইচ্ছে হয়েছে।”
“দীপ, তুই চা খাবি?”
দীপ হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
“তুই তো পড়া থেকে রেহাই পেলেই হল। তোর বাবা একটুও দেখে না তোকে।”
দীপ তর্ক করল না। সে বলতে পারত, ‘তুমি তো বাড়িতেই থাকো না।’ বলল না। অনেক কিছু বলতে নেই, দেখতেও নেই।
বাবা স্নান সেরে ফিরলে সে বলল, “ঠাকুরদার খেরোর খাতাটা দেখছিলাম। পুরনো কলকাতার কথা রয়েছে।”
দীপঙ্কর ছেলেকে বাবার খেরোর খাতা দেখতে বাধা দিলেন না। ভাল, মন্দ সবটাই জানলে ক্ষতি কিছু হয় না। বেশি নিষেধ করলেই সমস্যা।
পল্লবী সকলের জন্য চা করে নিয়ে এল। চা খেতে খেতে পল্লবী কয়েক বার কপালে হাত দিল।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
“মাথাটা ধরেছে।”
দীপঙ্কর কিছু বললেন না। শুধু বললেন, “আমি কি আজ ভাতটা বসিয়ে নেব?”
পল্লবী বলল, “করলে ভাল হয়।”
রান্নাবান্না একেবারেই জানতেন না দীপঙ্কর। বিয়ের পর কিছুটা কাজ চালানোর মতো শিখেছেন। চাল সেদ্ধ করার সময় তিনটে ডিম দিয়ে দিলেন। ভাত হওয়ার পর দীপ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দিল।
ভাত, ডিমসেদ্ধ, মাখন আর নুন থালায় থালায় বেড়ে পল্লবীকে ডাকলেন।
পল্লবী এসে চুপচাপ খেয়ে নিল। তার পর নিজের ঘরে চলে গেল। আজও দীপঙ্কর আর ছেলে এক সঙ্গে শুয়ে পড়লেন।
পল্লবী আর মাঝরাতে উঠে এই ঘরে এল না দেখে এক সময় দীপঙ্কর আলোটা নিবিয়ে দিলেন।
১৬
টানা তিন দিন জ্বরে পড়েছিলেন জ্যোৎস্নাদেবী। জল ছাড়া আর কিছু খাননি। আজ উঠে দাঁড়ালেন নিজেই। গতকালও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। আজ বেশ ঝরঝরে লাগছে। তিন দিনের উপোস শরীরটাকে তরতাজা করেছে। বাইরের উঠোনে এসে একটা টুলে বসলেন। একটা চেয়ারও আছে। উনি বসতেন।
বাইরের আকাশটা বেশ লাগছে। জানলা দিয়ে দেখেছিলেন, যখন মেঘের মধ্যে একটা কালো রং ছিল। এখন সেই কালো রং আর নেই। সবটা মুছে গিয়ে নীল আর সাদা। নীলের দিগন্তমালায় সাদা-সাদা মেঘ ভেসে চলেছে। প্রকৃতি অনাবিল আজ। মিষ্টি রোদ উঠেছে।
উনি তো শুধু স্বামী ছিলেন না, গুরুও ছিলেন। তিনি ছিলেন অনুগামিনী। কখনও কখনও বারান্দায় চেয়ারে বসতেন। সর্দি নয়, জ্বর নয়, পেট খারাপও নয় শুধু স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে তাঁর জ্যোৎস্না নামটা মনে থাকত। কখনও কখনও অবশ্য তাও ভুলে যেতেন, ডাকতেন গোলাপসুন্দরী বলে, কখনও বা তারা বলে। জ্যোৎস্নাদেবী মজা করে বলতেন, “কোন তারা! তারা ব্রহ্মময়ী?”
তিনি বলতেন, “না না, তারাসুন্দরী। আজ শেষ রিহার্সাল আছে। কালকে শো।”
হাসতেন জ্যোৎস্নাদেবী।
আজ চুলে শ্যাম্পু করতে হবে। দীঘল চুল তাঁর। এক-আধটা পেকেছে। বয়স কম হল না। মাঝে মাঝে হেনা করেছেন। চুলে যদি সাদা ভাব আসে, ক্ষতি কী!
জামরুল গাছটা, পেয়ারাতলা, টগর গাছগুলো কী যে অপূর্ব লাগছে আজকে। টিয়ার ঝাঁক উড়ে গেল। তারে দুটো পাখি এসে বসেছে। ওদের ডানায় জল লেগে আছে, তার মানে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। এত গভীর ঘুমে ছিলেন টের পাননি। ছেলের দেওয়া টাকাটা বালিশের তলায় যত্ন করে রেখেছেন। এর আনন্দই আলাদা। হাওড়া নেমে সে এসেছিল শিয়ালদহ, ভেবেছিল হয়তো মায়ের দেখা পাবে!
তিনি নিজেকে ভাবতেন নবকার্তিক। টপ্পা গাইতেন আপন মনে।
“যাবৎ জীবন রবে কারেও ভালবাসিব না।/ ভালবেসে এই হল, ভালবেসে কী লাঞ্ছনা!/ আমি ভালবাসি যারে— সে কভু ভাবে না মোরে, / তবে কেন তার তরে নিয়ত পাই এ যন্ত্রণা।...”
বার বার গাইতেন। গান শেষ হলে ডাকতেন, “গোলাপ, গোলাপ!”
দৌড়ে আসতেন জ্যোৎস্নাদেবী। একটু সেজেই আসতেন। দেখে খুব হেসে উঠতেন, বলতেন, “যাবৎ জীবন রবে কারেও ভালোবাসিব না।”
কখনও কখনও তিনিও গাইতেন একা একা, আবার দোহারও ধরতেন ওঁর সঙ্গে। এক জন মানুষের মধ্যে আর এক জন মানুষের আবির্ভাব। যাত্রায় যখন নট ছিলেন, তখন এক রকম, আর স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যেন কোন সুদূরকালে ফিরে যেতেন। নিধুবাবুদের যুগে।
বড় নিউরোলজিস্ট দেখানোর সামর্থ্য ছিল না, তবুও সাধ্যমতো ডাক্তার দেখিয়েছেন। ফিরে আসেনি সেই নটসম্রাট। ফিরে এলে কষ্ট পেতেন। কোথাও ঠাঁই পেতেন না। রঙ্গমঞ্চ এখন শূন্য। শুধু প্রকৃতির দিকে তাকালে কিছু বোঝার উপায় নেই। মনে হবে নর-নারীর মৃত্যুতে আনন্দধারায় কোনও ফাঁক তৈরি হয় না। মানুষ নশ্বর, আর তাঁর চলে যাওয়াটা অবিনশ্বর। কোথাও না কোথাও সে থাকেই। অন্তত জ্যোৎস্নাদেবীর স্মৃতিতে তিনি চিরভাস্বর। এ রকম মানুষ কোথাও না কোথাও থেকে যায়।
দীপের স্কুল ছুটি আজ। বেশ কয়েক দিন ছুটি থাকবে। স্কুল থেকে নোটিস দেওয়া হয়েছে। মিড-ডে মিলের খাবার নিয়ে সমস্যা, তাই ছুটি মনে হয়।
যাই হোক, বাবা অফিসে গেছেন। মা-ও বাইরে। কখন ফিরবে ঠিক নেই।
দরজায় আওয়াজ হল।
উঠে গেল দীপ। না, দরজায় নয় জানলার শার্সিতে দুটো পাখি ঠুকঠুক করে শব্দ করছে। সে ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হয়। অঙ্কের খাতা নিয়ে বসল। পারমুটেশন-কম্বিনেশনের কিছু অঙ্ক গতকাল হচ্ছিল না। দীপ মন দিয়ে কষতে বসল। মন আজ অঙ্কে নিবদ্ধ থাকছে না। বাগবাজারে একটা যাত্রার পোস্টার দেখেছে। নাম ‘গভীর রাতে উড়োচিঠি’। ভৈরব অপেরা। আরও একটা দেখল সে দিন, ‘বাবু গো! স্বামীর ভাগ দেব কাকে!’
এখানেও একটি অপেরার নাম।
চিরঞ্জয় ক্লাসের সেকেন্ড বয়। সঙ্গে ছিল। বলল, “কী সব বোকা-বোকা নাম! তাই না?”
মাথা নেড়েছিল দীপ। বলেছিল, “ভিড় হয়?”
“প্রচুর। তুই কোনও দিন যাত্রা দেখিসনি?”
দীপ বলল, “না। তবে আমার ঠাকুরদা নাকি যাত্রা করতেন। খুব নামী শিল্পী ছিলেন।”
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)