E-Paper

কেয়ার গন্ধ

কান দুটো লাল হয়ে গেছিল দীপের। বাবাকে বলতে গিয়েও বলেনি। বাবা যদি চলে যান! দীপ কী করবে তখন!

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৯
ছবি: সৌমেন দাস।

ছবি: সৌমেন দাস।

পূর্বানুবৃত্তি: শিয়ালদা স্টেশনে জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে দেখা হল দীপঙ্করের। মাকে প্রণাম করে তাঁর হাতে হাজার টাকা দিলেন দীপঙ্কর। তার পর তাঁকে ট্রেনে তুলে দিলেন। বাড়ি ফেরার পর পল্লবীর করা চা খেতে খেতে শুনলেন তার শরীর ঠিক নেই, মাথা ধরেছে। রাতের খাবার নিজেই করে নিলেন দীপঙ্কর। ছেলে সে দিনও তাঁর কাছে শুয়ে পড়ল রাতে। অন্য দিকে ঠাকুরদার খেরোর খাতাটি বেশ মন দিয়ে পড়ছে দীপ। তার ভাল লাগছে। চিরঞ্জয় নামে স্কুলের এক বন্ধুর সঙ্গেও যাত্রা নিয়ে নানা কথা হয়েছে তার। অন্য দিকে তিন দিন জ্বরে ভুগে উঠলেন জ্যোৎস্নাদেবী। নানা কাজের ফাঁকে মনে পড়তে লাগল স্বামীর কথা। বিস্মৃতিতে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি জ্যোৎস্নাদেবীর আসল নামভুলে গিয়ে নানা কল্পিত নাম ধরে ডাকতেন।


অবাক হয়েছিল চিরঞ্জয়। জিজ্ঞেস করেছিল, “তাই? তোর ঠাকুরদার নাম কী?”

“দুটো নাম তো আলাদা হয়।”

চিরঞ্জয় বলেছিল, “ঠিক বলেছিস, উত্তমকুমারের আসল নাম তো অরুণকুমার। অরুণকুমার ফ্লপ করার পর নাম নিয়েছিলেন উত্তমকুমার।”

“কী জানি, আমার দাদুও হয়তো ফ্লপ করার পর অন্য নাম নিয়েছিলেন,” দীপ বলল, “আমি যাত্রা সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।”

“সেটা জেনে কী হবে! তুই তো পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অঙ্ক জানিস। কো-অর্ডিনেট জিয়োমেট্রি জানিস।”

দীপ বলেছিল, “দাদুর একটা খেরোর খাতা আছে, আমি পড়ি মাঝে মাঝে।”

চিরঞ্জয় বলল, “আমাকে এক দিন দেখাবি?”

দীপ বলেছিল, দেখাবে।

স্কুল থাকলে বেশি ভাল লাগে। ভাল ছেলে বলে তার একটা অহঙ্কার আছে। টিচাররা স্নেহ করেন। কিন্তু বাড়িতে খুব একা লাগে। হঠাৎ কখনও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে হলে ভয় করে, মা-কে কী অবস্থায় দেখা যাবে, কে জানে!

পলাশদাকে অনেক দিনই ওদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখত দীপ। মা-কে খুব স্বাভাবিক লাগত না তখন। যদিও পলাশদার মৃত্যুর পর মা বেশ স্বাভাবিক হল। যেন আপদ বিদায় হল। আবার মায়ের নতুন কোনও সঙ্গী হয়েছে, সব সময় ওয়টস্যাপে কথা বলে। কিছু কিছু কথা পড়ে ফেলেছে দীপ।

মা লিখেছে, “তুমি তো বিবাহিত!”

“তাতে কী, তুমি কি বিবাহিত নও?”

“হ্যাঁ, আমিও। পাপ করছি না তো!”

“এই পাপ তো তোমার নতুন নয়, তাই না!”

মা লিখেছে, “যৌনতা একটা স্থূল বিষয়, কিন্তু না হলেও চলে না।”

“ওটাই আসল।”

কান দুটো লাল হয়ে গেছিল দীপের। বাবাকে বলতে গিয়েও বলেনি। বাবা যদি চলে যান! দীপ কী করবে তখন!

১৭

দুপুরে সচরাচর ঘুমোন না জ্যোৎস্নাদেবী। গত কয়েক দিন ভাল করে ঘুমনোর পর ভেবেছিলেন জেগে থাকবেন, কিন্তু চোখ লেগে গেছিল। বাইরে বাজ পড়ার শব্দ হতে। ঘুম ভেঙে গেল।

ছোট বইয়ের আলমারি থেকে মহাভারত বার করলেন জ্যোৎস্নাদেবী। সামনের বারান্দায় বোগেনভিলিয়াকে দেখলেন। আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। আবার বৃষ্টি শুরু হল। পেয়ারা গাছটা ঝুঁকে পড়েছে। এক নাগাড়ে কিছুক্ষণ হয়ে থেমে গেল। পাখিরা ডাকছে। আলো একটু স্পষ্ট হল আবার। এই হচ্ছে শ্রাবণের আকাশ।

যাত্রার জগতেও ছিল নিরন্তর সম্পদ, অর্থ আর খ্যাতির পিছনে ছোটা। বিরামহীন সেই দৌড়। তার মধ্যেও ক্ষমতার লড়াই ছিল। জ্যোৎস্না আলালের ঘরের দুলালি ছিলেন। বাবা ছিলেন ব্যাঙ্ক অফিসার। হঠাৎ ব্যাঙ্কে হল লক-আউট। ব্যাঙ্ক মালিক নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করলেন। সে এক অবিশ্বাস্য সময়। অনেক ভাইবোন থাকলেও জ্যোৎস্না ছিলেন বাবার সবচেয়ে আদরের।

প্রথমে পাড়ার নাটক, তার পর শখের থিয়েটার। তার পর যাত্রা। কিছু টাকা আসতে শুরু করল। বদলে গেল সবটা। একের পর এক স্টারের সঙ্গে অভিনয়। দিকপাল সব অভিনেতা। পাড়াগাঁয়ে গেলে মানুষ ভাবত, এঁরা কি সব রক্তমাংসের নরনারী! জ্যোৎস্না তখন অপ্সরা। তাঁর মুখ দেখেই টিকিট বিক্রি, হাউসফুল।

এই সময় এক জনের সঙ্গে অভিনয় জমে গেল। মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেল। ওরকম তো হয়। এক সঙ্গে থাকলে ওসব হয়, আবার কেটেও যায়। বাড়ির বাইরে দীর্ঘ দিন থাকলে মানব-মানবীর জৈবিক সম্পর্ক হয়েই যায়। কিন্তু মনের সাড়া সহজ নয়।

এ ক্ষেত্রে তা হল। জ্যোৎস্না বললেন, “আমরা বিয়ে করলে হয় না?”

তিনি বললেন, “আমি তো বিবাহিত। আমার একটি ছেলেও আছে।”

জ্যোৎস্নার যে কী হল, তিনি বললেন, “সেই সংসার কি আমার চোখের কাছে, ভালবাসার কাছে মিথ্যে নয়?”

তিনি বললেন, “আমার বৌ যদি বাধা দেয়, বিয়ে কিন্তু হবে না।”

জ্যোৎস্না তাতেই রাজি হলেন। সত্যি সত্যি ওর বৌ কোনও প্রতিবাদ করলেন না। বরং যেন খুশি হলেন। ছেলেটার দিকে চোখ যেতেই খারাপ লেগেছিল। তার ব্যবস্থা পিসির কাছে করা হল।

জ্যোৎস্না বাড়িতে জানাতে আগুন জ্বলে উঠল। বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে প্রেম! তাকে বিয়ে!

বাবার বজ্রনির্ঘোষ, “তুমি আর এই বাড়িমুখো হয়ো না। তুমি এখন থেকে আমার কাছে মৃত।”

পিতৃ-অভিশাপ মাথায় নিয়েও তাঁদের দিনগুলি খারাপ কাটেনি। যাত্রার পর যাত্রা হিট হয়েছে। খুব কম জনই জানতেন ওঁরা বিবাহিত। ছেলে-মেয়ে না হওয়া ছিল শর্ত। মানলেন এটাও জ্যোৎস্না। এক সময় তাঁর নায়কের রূপ ফুরোল, অভিনয়ও তাই। নতুন নায়কেরা এলেন। জ্যোৎস্নার রূপ তখনও রয়েছে, তিনি তখনও নায়িকা হতে পারতেন। সিংহাসন ছেড়ে দিলেন স্বেচ্ছায়। সংসারে কিন্তু সুখের অভাব ছিল না। দু’জনে দু’জনের কাছে কখনও ফুরোলেন না।

বাইরে আর এক বার তাকালেন জ্যোৎস্না। আকাশ স্বচ্ছ, সাদা। কোথাও কালো মেঘের অশনি সঙ্কেত নেই, কিন্তু লুক্কায়িত আছে সেই মেঘ। অনাদরে অবহেলায় এক স্টার, এক নায়ক ভুলতে লাগলেন বর্তমানকে। তিনি শুধু অতীতে বাস করেন না, এমন সুদূর অতীতে চলে যান, যা কালাতীতও বটে। প্রথম প্রথম ভয় করত, যেন কোনও অতীত জীবাশ্মকে বহন করে চলেছেন। অভিনয় তাঁকে করতেই হচ্ছে, না হলে খাবেন কী!

কখনও কখনও ফিরে এসে দেখতেন, উনি নেই। মধ্যরাতে হয়তো কোন ক্লাবঘর থেকে উদ্ধার করা হল। হোম ডেলিভারির যুগ তখন শুরু হয়েছে। সেই হোম ডেলিভারিতে খাবার আসে। কখনও খান, কখনও খান না। দুধের প্যাকেটও দেখতে পাওয়া যায়। কুড়িয়ে আনেননি গেট থেকে।

এক সময় আর বেরোতেন না। জ্যোৎস্নার অভিনয়ের ডাক কমল। সরকার শিল্পীবৃত্তি চালু করল। লোকাল কাউন্সিলরকে ধরে তা পাওয়া গেল। রেশন কার্ডেও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গেল। এক দিনে হয়নি, অনেক লড়াই একা লড়তে হয়েছিল।

তিনি আর বাইরে হারিয়ে যান না। নিজের একটি স্বকল্পিত জগৎ নির্মাণ করলেন। নবকার্তিক। টপ্পা খেউড় গায়ক। মুখে মুখে গান রচনা শুরু করলেন। কিছু কিছু খেরোর খাতাতেও লেখেন। অদৃশ্য শ্রোতা। গুরু, সমঝদার রামনিধি গুপ্ত। নিধুবাবু। স্বাভাবিক অবস্থায়ও চমৎকার টপ্পা গাইতেন। নিধুবাবুর গীতিময় সৃজনের কথা বলতেন। এখন তিনি বর্তমানের প্রবাহে বসিয়ে নিলেন সেই কালকে, যা স্বাভাবিক মানুষের কাছে অধরা। খাতা ভরতে লাগল নতুন, পুরাতন গীতিতে। সে এক অদ্ভুত সময়।

মহাভারতে মহাবীর কর্ণের অধ্যায়ে এলেন তিনি। মাতা রাধার অভিনয় করেছিলেন জ্যোৎস্নাদেবী। আর কর্ণ স্বয়ং উনি। অপূর্ব লেগেছিল ওঁকে। সূর্যপুত্রের কান্তিও সূর্যের মতো দীপ্যমান হওয়া প্রয়োজন। দীপঙ্করের বাবাকে সে রকমই সুবর্ণকান্তি লাগছিল। স্টেজে রথ উঠেছিল। স্টেজ বিশ্বরূপাকে অনুসরণ করে রিভলভিং করা হয়েছিল।

চোখ দুটো বারংবার অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠছে। এল সেই সন্ধিক্ষণ, কর্ণ বধ হবেন।

হল সেই দৈববাণী, পৃথিবী এখন তোমার রথের চাকা গ্রাস করতে চাইছে। তুমি ভুলে যাবে পরশুরামের প্রদত্ত সেই শিক্ষা। ব্রাহ্মণের অভিশাপ ফলে যাবে। ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষার মহামন্ত্র তুমি বিস্মৃত হবে। নেপথ্যে সেই দৈববাণী করেছিলেন জ্যোৎস্নাদেবী স্বয়ং। তিনি কি তখন জানতেন, তাঁর প্রিয় স্বামী ও প্রেমিক এক দিন সব কিছু বিস্মৃত হবেন!

অভিশাপ অনুযায়ী কর্ণের রথের চাকা বসে যেতে থাকল স্টেজে। অসম্ভব কুশলতায় এটি সম্ভব করেছিলেন বৈশ্বানরদা। গ্রামের মানুষ উত্তাল। হাজার হাজার দর্শক যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। পুলিশকে অনেক কষ্টে ব্যারিকেড সামলাতে হচ্ছে। কর্ণের রথের চাকা মেদিনী গ্রাস করতে থাকল। শেষ চেষ্টা করে অন্যান্য বাণ নিক্ষেপ করলেন কর্ণ।

এ বার কৃষ্ণ বললেন, “পার্থ, রাধানন্দন একে একে তোমার বাণসমূহ নষ্ট করে দিচ্ছে। এ বার তুমি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করো।”

অর্জুন শিবের উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করে সেই মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ কর্ণের মস্তক কর্তন করল।

সেই দৃশ্যও স্টেজে দেখানো হল মায়াবী আলোয়, চার দিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে। কর্ণের কর্তিত মস্তক স্টেজে গড়াগড়ি খেতে লাগল। পরের দৃশ্য আলোকশিল্পীদের পক্ষে আরও চ্যালেঞ্জিং। স্টেজে রক্তের ধারা বহতা, আর অন্য দিকে কর্ণের সেই কর্তিত মস্তক তেজঃপুঞ্জ নির্গত করে সূর্যমণ্ডলে বিলীন হয়ে গেল।

বেজে উঠল শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য। পাণ্ডব শিবিরে উল্লাস শুরু হল।

এ বার স্টেজে এলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং সঞ্জয়। সঞ্জয় শেষ ধারাভাষ্য শুরু করলেন, “মহারাজ, কর্ণের মৃত্যু সমস্ত কৌরবদের ভীত করে তুলল। মহারাজ দুর্যোধন শোকে মুহ্যমান হয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন। কৌরবেরা বোধহয় রাজ্য ও জীবন উভয়ের আশা পরিত্যাগ করলেন।”

কিন্তু সেই পালায় আসল জয় হল মহামতি কর্ণের। কর্ণের সেই শেষ কথাগুলি আকাশে বাতাসে স্পন্দিত হল।

“তুমিই ভগবান কৃষ্ণ! আমার নিধনের কারণে তুমিও আজ হলে কুচক্রী।”

কর্ণের শব কোলে নিয়ে তিনি যখন স্টেজে ক্রন্দন শুরু করলেন, গ্রামের মেয়েরা যাবতীয় প্রোটোকল ভেঙে স্টেজের কাছাকাছি ছুটে এল। সে এক বিহ্বল পরিস্থিতি। মহাকাব্যিক যাত্রার আঙ্গিকে সেই নিবেদন গ্রাম-গ্রামান্তরকে প্লাবিত করেছিল। কর্ণের অভিনয়ের দীপ্তিতে তিনি হয়ে উঠলেন সময়ের চেয়েও দীপ্যমান।

সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। বিবস্বানকে প্রতিদিন প্রণাম করতেন তিনি। এমনকি ভয়ঙ্কর বিস্মৃতির সময়েও তিনি সূ্র্যপ্রণাম বিস্মৃত হননি। কে জানে, কোন অচ্ছেদ্য বন্ধন দিবাকরের সঙ্গে তাঁর ছিল! পৃথিবীতে সব কিছু তো জানা যায় না। সূর্য মানে প্রাণ। প্রাণের বিকাশ। সূর্য যে দিন লয় পাবে, প্রাণের ইতি হবে সে দিন। কখনও কখনও আলোচনা করতেন, যাবতীয় মুগ্ধতা নিয়ে শুনতেন জ্যোৎস্নাদেবী।

যে দিন দীপঙ্কর প্রবল অনিচ্ছায় পিতার মুখাগ্নি করলেন, সেও যেন এক ঐশী লীলা। পুত্র বৃষকেতুর অগ্নিপ্রদানে শুদ্ধ হলেন কর্ণ। সেই ক্ষণে তাঁর অন্ত্যেষ্টি হল সূত নয়, এক ক্ষত্রিয়োচিত মর্যাদায়। পুত্রের প্রতি কৃত অপরাধে তিনি জীবনভর এক গ্লানিতে ভুগেছেন। মৃত্যু তাঁকে মুক্তি দিল সেই গ্লানি থেকে। আর জ্যোৎস্নাদেবীকে ‘মা’ বলেস্বীকৃতি দিয়ে দীপঙ্কর যেন পিতাকে শাপমুক্ত করলেন অজানতেই।

এ বার আলো মরে যাবে। নামবে সন্ধ্যা। রান্না বসাতে হবে। ঘর জুড়ে থাকবে স্মৃতি। ওরা হাঁটবে, কথা বলবে। সারা রাত জেগে থাকবেন জ্যোৎস্নাদেবী। অনেকেই বলেছেন, এই গৃহ ত্যাগ করতে। তিনি যাবেন না। স্মৃতির প্রদাহই জীবনের এক গূঢ় মর্মকথা।

চোখে-মুখে জল দিলেন। বেশ গরম আজ। স্নান করতে গেলেন বাথরুমে। অঝোরে স্নান করলেন। এই স্মৃতি নিয়ে বাঁচা-ই কি শুধু জীবনের সার্থকতা! আর কিছু তাঁকে করতেই হবে। খুঁজে নিতে হবে জীবনের মানে।

এক দিন কথাচ্ছলে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, ‘ম্যাকবেথ’ করেছিলেন আপনারা যাত্রায়?”

“হয়নি। গিরিশবাবুর তিনকড়ি দাসীর পর আর কেউ লেডি ম্যাকবেথ করেননি।”

ভাত নামাতে গিয়ে খানিকটা গরম ফেন হাতে পড়ল। পোড়ার মলম লাগানোর আগে ভাল করে জল দিয়ে ধুয়ে নিলেন। ডিমের ডালনা বসালেন।

আকাশ আজ নক্ষত্রখচিত। বোগেনভিলিয়ায় গন্ধ নেই। খুব অল্প বয়সে বলতেন কাগজফুল। সৌরভ আসছিল কেয়া থেকে। মাতাল করে দেওয়ার মতো সৌরভ।

ভাত খেয়ে উঠোনে বসলেন। একটি দল কিছু দেখে ফিরছে।

এক জন বললেন, “কী গো দিদি, কী করছেন?”

জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “এমনি বসে আছি। ঘরে খুব গরম। তোমরা কোথায় গেছিলে?”

“বিশ্বরূপায়।”

“কোন থিয়েটার?”

“যাত্রা গো দিদি। ‘নটী বিনোদিনী’।”

একটু বিমর্ষ হয়ে গেলেন তিনি। এই যাত্রা দেখে ঠাকুর খুঁজেছিলেন, কে সেজেছে নিমাই!

দেখা গেল নিমাই এক জন মেয়ে, তাঁর নাম নটী বিনোদিনী। তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “তুমি আমায় ঠকালে বেশ!”

বিনোদিনী বলেছিলেন, “ঠাকুর, অভাগিনীকে আশীর্বাদ করবেন।”

ঠাকুর তাঁর মাথায় হাত রেখেছিলেন।

“ও দিদি!” ভদ্রমহিলা বললেন।

সম্বিৎ ফিরল ওঁর। বললেন, “হ্যাঁ বলো।”

“তুমি আর অ্যাক্টিং করো না?”

“তেমন কিছু আর পাই না।”

“ইস! এখনও চোখে লেগে আছে তোমার অভিনয়! কী সুন্দর মানাত তোমাদের দু’টিকে, যেন রাম-সীতা!”

“সময় কি থেমে থাকে, রূপা?” এত ক্ষণে ভদ্রমহিলার নাম মনে পড়ল জ্যোৎস্নাদেবীর।

“ইস ভাবি তাই, বয়স হলে তোমার মতোই সব রূপ হারিয়ে ফেলব! তখন যে কেমন দেখাবে!”

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy