পূর্বানুবৃত্তি: পাশের বাড়ির শীলাবৌদি পল্লবীকে বলেন, পলাশ নাকি পুরুষ ছিল না। তিনি একদিন দেখে ফেলেছিলেন পলাশ ও পল্লবীর গোপন সম্পর্ক। তাই শীলাবৌদির ইঙ্গিতে অস্বস্তি হয় পল্লবীর। পলাশের শ্রাদ্ধশান্তির জন্য পাড়ার ছেলেরা টাকা তুলছে জানতে পেরে, তাদের পাঁচশো টাকা দেয় পল্লবী। অভিনয় করতে গিয়ে কেমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন, সে কথা বাড়িতে বলেন দীপঙ্করবাবু। শুনে আন্দাজ করা যায়, সম্রাট আকবর নয়, হয়তো বা কোনও নারীচরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া হবে তাঁকে। শুনে তীব্র আপত্তি করে পল্লবী। দীপঙ্করবাবুর মুখে চপল ভাদুড়ীর উদাহরণ শুনেও তার মত বদলায় না। সে সেখান থেকে তাদের বাস ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করে। এই কথা ছড়িয়ে যায় দীপঙ্করবাবুর অফিসেও। সহকর্মী থেকে বড়বাবু, সকলেই তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করেন। দীপঙ্করবাবুকে অভিনয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী হিসেবে উঠে আসে জনমেজয়বাবুর নামও।
জনমেজয় বললেন, “সন্ধে হলে হ্যাজাকের আলোয় শুরু হত সাজ। কেরোসিন ঢেলে পাম্প করে করে হ্যাজাক জ্বালানোর চেষ্টা চলছে। স্কুলঘর ছিল গ্রিন রুম। আমাদের পরিচিত গোপালকাকুকে তখন চেনার উপায় নেই। তিনি হয়েছেন জিন্নতউন্নেসা।
“স্টেজে তখন সুরপার্টি বসে গেছে, যাকে বলে কনসার্ট। তবলা, বাঁশি, ঢোল বাজতে শুরু করেছে। অনেক ক্ষণ ধরে বাজবে।”
সুব্রত বললেন, “সেটাই তো যাত্রার গত।”
সমীরের শব্দপ্রয়োগে বাঁকড়ি ভাষার টান আছে, সে নাটকের লোক বলে গরিমাও অন্য।
সে বলল, “জনাদা, তোমাদের যাত্রা বাগানো বড় কঠিন লইকো। চেঁচাইলে হইল।”
খেয়াল করলেন না জনমেজয়, “সে বার হচ্ছে ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নাচমহল’। আমার বাবা সেজেছিলেন হেমন্ত সেন, আর দুগাইকাকু ইরাবতী। নায়ক আর নায়িকা...” বলে গেলেন আপনমনে।
সমীর বলল, “হ্যাজাকের আলোয় ওই সুবিধা।”
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কখন খড়্গপুর পেরিয়ে গেছে। মেদিনীপুরের কাছে চলে এসেছে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস।
জনমেজয় সমীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিদ্যুতের আলো চলে এসেছে। তবু নায়িকা সেই দুগাইকাকু। ফিমেল অভিনেত্রীর যুগ চলে এসেছে। কলকাতায় তো তখন সব স্টার অভিনেত্রী। স্বপ্নসুন্দরী জ্যোৎস্না চ্যাটার্জি।”
সমীর এ বার বলল, “জনাদা, তুমি কখনও লাটক করেছ?”
সুব্রতবাবু বললেন, “আমি করেছি। আমার প্রথম নাটক ‘স্বরবর্ণ’। আমলাপাড়ায় দুর্গামন্দিরে তখন খানাপুরির কানুনগো সাহেবরা থাকেন। প্রথমে বাড়ি থেকে শতরঞ্চি এনে ঝাঁট দেওয়া ছিল আমার কাজ। নাটকে চান্স আরও অনেক পরে।”
জনমেজয় বললেন, “আরে মাখনবাবুদের জন্য চা এনে এনে হাতে কড়া পড়ে গেল, তাও পার্ট দেয় না। এক দিন কল্লোলদা বলল, ‘তুই প্রম্পট কর।’”
সমীর বলল, “কবে অভিনয়ে এলে!”
“‘রাজদর্শন’। নাট্যকার মনোজ মিত্র। আমাদের পুরুলিয়াতে নির্দেশক ছিলেন কল্লোলদা। আমি সেনাপতির রোল পেলাম।”
সুব্রতবাবু বললেন, “কোনটা বেশি প্রিয়? যাত্রা না নাটক?”
“যাত্রা,” হেসে বললেন জনমেজয়।
“কারণ?” প্রশ্ন করলেন সুব্রতবাবু।
“যাত্রায় পেলাম অবাধ স্বাধীনতা। দলের প্রতি ভালবাসাও বেশি। তবে আজও কিশোরবেলায় চন্দ্রনাথদার কথাটা মনে পড়ে, ‘চল যাত্রা করি।’”
মেদিনীপুর ছাড়াতে ওরা রুটি-তড়কা খেয়ে নিল। জনমেজয় কিনে রেখেছিলেন। তার পর শালবনি পেরিয়ে গাড়ি এক সময় চন্দ্রকোনা রোড।
স্টেশনটার দিকে তাকিয়ে জনমেজয় বললেন, “এক সময় বহু যাত্রা করেছি চন্দ্রকোনা রোডে।”
সমীর বলল, “আমরা কলকাতায় অনেকনাটক করিচু।”
এ বার জনমেজয় বললেন, “কলকাতার নাটকেও করিচু?”
সমীর বলল, “না। তখন স্টেজে সব ঠিকঠাক হয়ে যেত। কত দিন ধরে বাগাতে হত।”
জনমেজয় বললেন, “কাউকে বাখান দিতিসনা তো?”
সমীর এ বার লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, “যাত্রার চেয়ে নাটক যাকে বলে আধুনিক।”
জনমেজয় বললেন, “সিনেমা আরও আধুনিক। এক দিন সিনেমাহলগুলিও উঠে গেল। চলে এল ভিডিয়ো হল।”
সুব্রতবাবু বললেন, “নাটক করার কাউকে পাই না। থিয়েটার কেউ করবে না।”
জনমেজয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যাত্রাও বদলে গেছে। কী সব নাম আজকে পড়তে পড়তে আসছিলাম চিৎপুরে।”
সুব্রত বললেন, “মানুষের রুচি কি একেবারে বদলে গেছে!”
“বুঝতে পারছি না। তবে এই পুজোয় নামাব, ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।”
সমীর বলল, “শের আফগান!”
“হতে পারে।”
“সাহেবটা কি ফিমেলের অভিনয় করবেন?”
“অত সোজা নয় বাগানো,” হাসলেন জনমেজয়।
গাড়ি গড়বেতা ছাড়িয়ে বিষ্ণুপুর ঢুকল। এখনও অনেকটা রাস্তা। সুধাময়ী ঘুমিয়ে পড়েছে।
সুব্রত আর সমীর বিষ্ণুপুর নামল। নামার সময় সুব্রত বলল, “আসছি দাদা।”
জনমেজয় বললেন, “আমরা যাব বহু দূরে। হয়তো, আমি চললেম একা।”
সুব্রত হাসল।
পুরুলিয়া যত এগিয়ে আসবে, শাল-পিয়ালের অরণ্য বাড়তে থাকবে। একটু বৃষ্টি শুরু হল। সামান্য বৃষ্টি। জানলাটা খুলেই রাখলেন জনমেজয়। মাটিতে পড়ে থাকা শালপাতা বৃষ্টির জলে ভিজে এক অদ্ভুত গন্ধ তৈরি করে। তাই নাকে এসে লাগল। বুক ভরে নিলেন জনমেজয়। অন্ধকারেও টের পাওয়া গেল, ট্রেনটা ছোট ছোট টিলার পাশ দিয়ে চলেছে। এই পাথরগুলি বুঝি খুব আদি। সৃষ্টির প্রথমে কি ওরা ছিল! কোন যুগের ওরা? মেসোজ়োয়িক যুগের?
তখনও কি যাত্রা হত! হয়তো অন্য ফর্ম।
অন্ধকার গাঢ় হতে হতে ট্রেন গভীর অন্ধকারে ঢুকে গেল। কিছু ক্ষণ এ রকম চলার পর শহরের সভ্যতার আলোর রেখা দেখা গেল।
পুরুলিয়া স্টেশন চলে আসছে। সুধাকে জাগিয়ে দিলেন জনমেজয়।
কখনও কখনও কাজের চাপে বিষ্ণুপুরে থেকে যেতে হয় বলে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হয়েছে দীপঙ্করকে। দুটো বেডরুম, একটা ডাইনিং। ফ্যান অফিস থেকে দিয়েছে। তিনি কিনেছেন দুটো তক্তপোশ। বড় বড় দুটো ঘরে শুধু তক্তপোশ থাকায় ঘরদুটো অনেকটাই শূন্য থাকে। ডাইনিংও শূন্য, কারণ তাঁর কোনও ডাইনিং টেবিল নেই। বাজার-দোকান-হাট এখান থেকে অনেকটা দূরে, ফলে রাতে এক রকমের উপোস হয়ে যায়। তাতে ওজনও কমে না, পেটও নয়। জলও এখন দীপঙ্করের মেদবাহুল্য ঘটায়। থাকলে রাতে ঘুম হয় না, শুধু পেচ্ছাপ পায়। পল্লবীর সঙ্গে কোনও যৌনসম্পর্ক নেই, মন-দেহ কোনও কিছু জাগে না। ফলে পুরুষাঙ্গ অব্যবহারে প্রায় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এটা টের পাওয়া যায় পেচ্ছাপ করার সময়। এই ভাবে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়াটা বিলাসিতা হলেও পল্লবী আপত্তি করেনি, যে কোনও ফ্ল্যাটবাড়ির প্রতি তার আশ্চর্য মোহ রয়েছে।
বুকের স্তনে চাপ দিলে দুধ নিঃসৃত হয়। এ সব পল্লবীকেও বলতে পারেন না দীপঙ্কর। ফ্ল্যাটটার চার দিকে বাড়ি আর বাড়ি। সবই রাজপ্রাসাদ। চমৎকার সব অলিন্দে কোনও কাব্য বা নাট্যচর্চা হয় না। মানুষগুলি কেন এত সুরম্য করে করেছিল বুঝতে পারেন না দীপঙ্কর। রাতে লোডশেডিং হলে ফ্ল্যাটে জেনারেটর আছে। এ সব বাড়িতে এসি থাকলেও ইনভার্টার নেই। খুব অল্প দিন হল এখানে বাংলা পায়খানা ছেড়ে কমোড বসেছে। বহু বাড়িতে এখনও কমোড নেই। প্লাস্টিকের একটা জিনিস পাওয়া যায়, অনেক কলকাতার মানুষ অর্থাৎ ভাড়াটে এ সব কিনে নিয়েছেন। ফ্ল্যাটে অবশ্য কমোড রয়েছে। এটাও একটি কারণ ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার।
গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় কখনও কখনও বারান্দায় এসে দাঁড়ান দীপঙ্করবাবু। খুব ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের কোনও নাটকে রানি সুদক্ষিণা হয়েছিলেন তিনি। বড়পিসি সাজিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমার সোনার গোপালের দুই রূপ, রাজা আর রানির। ভগবান অর্ধনারীশ্বর কি না!”
চন্দননগরের বাড়িতে একটা গুদামঘর রয়েছে। বাবা-মায়ের সময়ের আলনা, রংচটা ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, কিছু ট্রাঙ্ক ও সব ঘরে রয়েছে। সেই ঘরে বসলে সর্পদম্পতির অস্তিত্ব টের পান দীপঙ্করবাবু। আর কেয়া ফুলের গন্ধ। সর্প এবং সর্পিণীর মধ্যে যে বেশি সুন্দর দেখতে, সেই বোধহয় সর্পিণী। অপূর্ব চিত্রল বর্ণের ত্বক। রোদের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। কেয়াবনে ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রথম প্রথম সর্পিণী ফণা বিস্তার করে হিংস্রতা দেখাত। এখন ও সব করে না। বুঝতে পারে, অর্ধনারীশ্বর মানুষটি নির্বিষ ও নিরীহ। তাই আর কিছু করে না।
ঘরে ঢুকে সুধাময়ী স্নান সেরে নিলেন। চুল এখনও সমস্যার। দীর্ঘ চুল রাতে খোঁপা বা বেণি না করলে চুলে জট লেগে যায়। এই কাজটা এখন করেন জনমেজয়বাবুও। কষ্ট হয়, পারেন না। তবে আস্তে আস্তে রপ্ত করছেন।
কলকাতা থেকে ফিরে, বিশেষ করে চিৎপুর থেকে ফিরে আবার যাত্রার কথা মাথায় ঘুরছে। দীপঙ্কর সাহেবকে ফিমেল ক্যারেক্টার মানাবে ভাল, কিন্তু যতই হোক আধিকারিক। অভিনয় তেমন করেননি। এর উপর অভিনেত্রী সত্তা আনয়ন করা বেশ কঠিন। চরিত্রটা এ রকম ভেবেছেন জনমেজয়বাবু, আনারকলির বিশ্বস্ত বাঁদি। আকবর জ্যান্ত সমাধি দিচ্ছেন আনারকলিকে, কিন্তু সেলিম সুড়ঙ্গ করে রেখেছেন আর সেই গোপন পথে আনারকলিকে সেলিমের কাছে নিয়ে আসছেন বাঁদি বিলকিস। তার পর সেলিম বাঁদিকে হত্যা করবেন। মুছে যাবে সাক্ষ্য। সেলিম তো স্ত্রৈণ ছিলেন।
মেহেরুন্নেসা কে? আনারকলি নয় তো! ইতিহাসের গোপন বিবরে লুকিয়ে থাকা এক কাহিনি যাত্রার আঙ্গিকে জীবন্ত হবে স্টেজে। বাজবে ঢোল, বাঁশি। ক্ল্যারিয়োনেটের সুরের আবেশ আবার ফিরিয়ে আনবে যাত্রাকে। কাউন্টারে অসংখ্য মানুষের লাইন। তিনি হবেন সেলিম। সম্রাট জাহাঙ্গির। আনারকলির প্রেমিক।
যদিও মোগল দরবারে প্রেম শব্দটা হাস্যকর। বর্বর মোগল সম্রাটদের রক্তে রয়েছে নারীসম্ভোগের উল্লাস। চিকিৎসকরা রয়েছেন সম্রাটের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য। নারীর ত্বক মার্জনার জন্যও অপূর্ব সব ব্যবস্থা। স্টেজে এ সব দেখানো হবে না, কিন্তু বিলকিসের বর্ণনায় উঠে আসবে মোগল হারেম।
বিলকিস চরিত্র রূপায়ণের জন্য এক জন ফিমেল আর্টিস্ট ভাড়া করা খুব কস্টলি। এ ছাড়াও সাহেবের নির্লোম দেহত্বকে রয়েছে নারীর আকুতি আর আহ্বান। তিনিও জাগছেন, কিন্তু বাধা সমাজ, সংস্কার, এমনকি সরকারি পদও।
৮
পল্লবী এল সাইকিয়াট্রিস্ট রণেন সেনের কাছে। গঙ্গার ধারের বাড়ি। আজ রোববার। দীপঙ্কর বাড়ি আছেন। কাউকে কিছু না বলে খলিসানি থেকে রিকশা করে বাগবাজার। তার পর একটু হেঁটে ডাক্তারবাবুর বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। গেটের মুখেই ডোরবেল বসানো। বাজাতেই কুকুর ডেকে উঠল। নিশ্চয়ই বিদেশি কুকুর। কুকুরকে খুব ভয় করে পল্লবীর। তবে ডোরবেল, কুকুরের আওয়াজের সঙ্গে বোধহয় কোনও রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম আছে। বাইরের সিংহদুয়ার খুলে গেল। ঢুকেই পল্লবী দেখতে পেল কেয়ারি করা ফুলের বাগান। কেয়া ফুলও রয়েছে মোচার মতো থোকা থোকা। চমৎকার গন্ধ। আজকাল কেয়া ফুল ভাল লাগে না পল্লবীর। মনে হয় সাপ আছে কোথাও। সাপের দংশনে পলাশের মৃত্যুর পর থেকে এটা হয়েছে।
এ বার মূল দরজা। নীচে মনে হয় চেম্বার। এখানেও ডোরবেল রয়েছে। আবার কুকুরের ডাক। উপরের বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ডোবারম্যান দেখা গেল। লকলকে জিভ বার করে ঘ্রাণ নিচ্ছে। এদের তো পাগলের ডাক্তারও বলে। এখানে এলে মানুষ এমনিতেই পাগল হয়ে যাবে। পাগলের সঙ্গে মিশতে মিশতে ডাক্তারগুলোও পাগল নিশ্চয়ই। একটা আধপোড়া বিড়ির টুকরো উপর থেকে পড়ল। আর একটু হলেই পল্লবীর শাড়িতে এসে পড়ত।
এই বার বারান্দায় ডক্টর রণেন সেনকে দেখা গেল। মাথার চুল সব সাদা। সৌম্য চেহারা। উপর থেকে বললেন, “নীচের ঘরে বসুন। আমি আসছি।”
এ বার পল্লবী দেখল, নীচের ঘরটা খোলা। জুতো বাইরে খুলে ঘরে গিয়ে বসল। লাল মেঝে, আগেকার দিনের বাড়িতে যেমন ব্যবহার হত।
পল্লবী চেয়ারে বসতেই এক বয়স্কা মহিলা এক পেয়ালা চা দিয়ে গেল। মুখে দিতে মন্দ লাগল না। সকালে চা খেয়ে আসা হয়নি। অকর্মণ্য দীপঙ্কর কিছু করতে জানে না, তার নাকি আবার মাতৃত্ব জাগছে। ওটা অবশ্য ফাঁকিবাজি কথা।
ডাক্তারবাবু সৌম্যদর্শন। হাসি-হাসি মুখ।
গম্ভীর গলায় বললেন, “কী বিষয়?”
“আমার স্বামীর বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।”
“যৌন মিলনে অনাগ্রহ? নাকি খুব তাড়াতাড়ি স্খলন হয়ে যাচ্ছে?”
“এ সব কি মানসিক সমস্যা থেকে হতে পারে?” সলজ্জ মুখে বলল পল্লবী।
“হতে পারে। হয়।”
“আমাদের একটি সন্তান রয়েছে।”
“তা হলে কী সমস্যা?”
“ইদানীং ও মনে করছে, ওঁর পুরুষ শরীরে নারীসত্তা জাগছে।”
সামান্য হাসলেন ডক্টর। বললেন, “লিঙ্গ, অণ্ডকোষ অভ্রান্ত হলেও এ রকম হতে পারে। মনে করছেন কি তিনি গর্ভবতী হয়েছেন? বা তাঁর ঋতুস্রাব শুরু হবে?”
পল্লবী বলল, “না, এতখানি নয়। যাত্রাপালায় ফিমেল রোল করতে চাইছেন। চাকরি করতে ভাল লাগে না, বলছেন। বলছেন, অভিনয়েই মুক্তি।”
ডাক্তারবাবু বললেন, “শের আফগান বা সম্রাট আকবর হলে আপনার আপত্তি ছিল না, তাই তো!”
পল্লবী বলল, “হ্যাঁ।”
“স্বামীকে ভালবেসে আটকে রাখুন। পরপুরুষে আকর্ষণ আছে ওঁর?”
“না, একদমই নয়।”
“আপনার পরপুরুষে আকর্ষণ থাকা তো স্বাভাবিক। আপনি সুন্দরী। তাই না?”
“ও যদি এ রকম করে, আমি নিজেকে আটকে রাখব কী করে!”
“অভিনেতাকে কিন্তু চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে হয়। উনি সেই সততা স্পর্শ করতে চাইছেন। দেখতে হবে ওঁকে। আপনার কথা শুনে চিকিৎসা করলে সবটাই অনুমান-নির্ভর হবে। ভয় করবেন না। বরং উৎসাহ দিন। বলুন, ‘তুমিও হতে পারো চপল ভাদুড়ী’।”
“মানে!” অবাক হয় পল্লবী।
“আপনার স্বামী তখন ঘাবড়ে যাবেন। তিনি যতটা সহজ ভাবছেন, অভিনয় অত সহজ নয়। গলায় মেয়েলি ভাব আনলেই হবে না। গর্ভযন্ত্রণা অনুভব না করে জননীর অভিনয় এক দুর্গম পথ। তবু নিয়ে আসবেন। কথা বললে বুঝতে পারব।”
আর কিছু জিজ্ঞাস্য না থাকায় পল্লবী জানতে চায়, “আপনার ফি, ডাক্তারবাবু?”
“এখন কিছু লাগবে না। ওঁকে আনলে চিকিৎসা শুরু করা যাবে।”
“যদি আসতে না চান?”
“জোর করবেন না। সময়কে সময় দিলে প্রার্থিত ফল পাওয়া যায়। মনোরোগীদের চিকিৎসা আসলে ধৈর্য, সহমর্মিতার উপর অনেকটাই নির্ভর করে।”
রাতে কেয়ার বাগানের স্বপ্ন দেখেছেন দীপঙ্কর। সর্পিল গতিতে ক্রীড়া করছে চেনা সাপ দুটো। সর্পিণী প্রথমে ওঁকে দেখে ফণা তুললেও এখন স্বাভাবিক ছন্দময়তায় দু’জনে প্রণয়ে লিপ্ত হচ্ছে। কেয়া ফুলের গন্ধ কেমন যেন বদলে দিচ্ছে দীপঙ্করকে। জাগছে অন্য এক সত্তা, যা এত দিন সুষুপ্তিতে ছিল।
সুধাময়ীর চুল বেঁধে দেওয়ার সময় গতরাতে জনমেজয় বলছিলেন, “ছোট ফণীবাবু কী বলতেন জানো?”
সুধাময়ী বলল, “জানি মনে হয়, তবু বলো।”
“বলতেন, যত দিন রূপযৌবন, তত দিন খদ্দের। যাত্রা আর বেশ্যালয়ের একই ব্যাপার।”
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)