ছবি কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবন্ধ ‘শিক্ষার মিলন’ নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। রবীন্দ্রনাথ কি তা হলে গান্ধীবিরোধী? হাওড়া জেলা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিবাদ করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জবাবে লিখলেন আর একটি প্রবন্ধ, ‘শিক্ষার বিরোধ’। আলফ্রেড থিয়েটার হলে প্রবন্ধ পাঠ সেরে বেরোচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে প্রণাম করে শশিকান্ত আর হরপার্বতী। ওরা রবি ঠাকুরের বক্তৃতা শুনতেই এসেছিল। সেখান থেকে হরপার্বতী শশিকান্তকে নিয়ে গেল ‘বিজলী’ পত্রিকার অফিসে। সেখানে শশিকান্তর সঙ্গে দেখা হল ‘ঊনপঞ্চাশী’-র লেখক উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেখানে সুভাষচন্দ্র বসুকেও সামনে থেকে দেখল শশিকান্তরা।
৩৫
সুর ও সুরা, এখন দুটোই চলছে এ বাড়িতে। বনমালী ও রমানাথের জীবদ্দশায় মাঝে মধ্যে সুরের আসর বসলেও, সুরার চল ছিল না। উমানাথ সেটাও চালু করে দিল। আদিত্যনাথের সেই পরিত্যক্ত ঘরে আর যেতে হয় না উমানাথকে। বাড়ির বৈঠকখানায় চলে গান ও মদের আসর। উমানাথের ইয়ার-বন্ধুরা আসে। আর আসে দু’-এক জন গাইয়ে ও বাজিয়ে। রমানাথ পাখোয়াজ বাজাতে পারতেন। হাতের চাপড়ে পাখোয়াজ কথা বলে উঠত। উমানাথের সে গুণ নেই। তার হাত ব্যস্ত থাকে মদের গ্লাসে। নেশার মাত্রা বেশি হয়ে গেলে গান থামিয়ে দেয় সে। তার পর নিজেই গান গাইতে থাকে। বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে উমানাথ কোমর দোলায়। ইয়ার-বন্ধুরা উৎসাহ দেয়। তাদের উৎসাহ পেয়ে উমানাথের নাচের বহর বেড়ে যায়। ধুতি ঘরের মেঝেতে লুটোয়। চাকর রঘু এসে হাত ধরে উমানাথকে ঘরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। এমন রাতে পারুল স্বামীর সঙ্গে শোয় না। ছেলেমেয়েদের নিভাননীর কাছে শুতে পাঠিয়ে সে বিছানা করে মেঝেয় শুয়ে পড়ে। উপায় থাকলে, সে-ও ঘরের বাইরে শুত। উমানাথকে সে ঘেন্না করে।
এ বাড়িতে আরও একটা লক্ষণীয় বিষয় হল, নিভাননীর সঙ্গে তার ভাজের সম্পর্ক এখন ভাল। দু’জনে সুখ-দুঃখের গল্প করে। দুঃখের গল্পই বেশি। নীলমণি যে আর কোনও দিন বাড়ি ফিরবে না, এ ব্যাপারে এক রকম নিশ্চিত বিভাবতী। দেশোদ্ধারে মেতে ছিল লোকটা, তখন তবুও মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসত। এখন তো গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। বিভাবতী চোখের জল ফেলে নিভাননীর কাছে। নিভাননী সান্ত্বনা দেয়। বলে, “পুরুষমানুষ এ রকমই হয় রে। নিজের কথা ছাড়া কারও কথা মনে রাখে না।”
বিভাবতী চুপ করে থাকে। তার পর উত্তর দেয়, “দেশ নিয়ে যখন মেতে থাকতেন, তখনও আমাকে ভুলতেন না। কত বার কালীঘাটে গিয়ে আমার মান ভাঙিয়ে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন, তা আমি ভুলি কী করে? আমার জন্যই উনি গৃহত্যাগী হয়েছেন। আমি যে বাঁজা মেয়েছেলে।”
ননদ-ভাজের কথোপকথনের মাঝেই কখনও সখনও শশিকান্ত এসে হাজির হয়। দু’জনেরই নয়নের মণি সে। দু’জনেরই চিন্তা, বাপ-মা হারা এই ছেলেটি যেন কোনও ভাবে বঞ্চিত না হয়। শশিকান্তকে নিজের জায়গা বুঝে নিতে পরামর্শ দেয় তারা। শশিকান্ত বুঝতে পারে না ঠিক কোনটা তার জায়গা। সে জায়গা বলতে বোঝে, তার নিজের ঘরটা। এটাই তার পৃথিবী। এ বাড়ি এখন দাপিয়ে বেড়ায় উমানাথের দুই ছেলে-মেয়ে। দু’জনেই টলমল পায়ে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়ি। কখনও পড়ে গিয়ে কাঁদে। নিভাননী তৎক্ষণাৎ পারুলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে ওঠে, “ও বৌমা, করছটা কী? ছেলে যে পড়ে গিয়ে কাঁদছে!”
পারুল না এলে, নিজেই ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে তার কান্না থামায়। উমানাথের মেয়েটিও তার ন্যাওটা। সব সময় গায়ে গায়ে সেঁটে আছে। বিভাবতীও তাকে কম ভালবাসে না। দোরে খেলনা বিক্রি করতে এলে কিনে দেয়। দিদির খেলনা দেখে ছেলেটিও কেঁদে ওঠে। তাকেও যা হয় কিছু কিনে দিতে হয়।
আজ এ বাড়িতে উৎসবের মেজাজ। সকাল থেকেই নানা রকম পদ তৈরিতে লেগে গেছে বিভাবতী ও নিভাননী। পারুলও সমান তালে হাত লাগিয়েছে তাদের সঙ্গে। অনেক দিন পর রমানাথের মেয়ে-জামাই আসছে। উমানাথ গদিতে বেরিয়ে গেলেও কী কী রান্না হবে তা বলে গেছে। শশিকান্ত আজ আপিস যায়নি। সেও রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করছে, কখন পিসি তাকে ডেকে মাংস সেদ্ধ হয়েছে কি না, চেখে দেখতে বলবে। ঠিক এমনই সময়, একটা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল শশিকান্ত। হই-হট্টগোলটা আসছিল লাবণ্যদের বাড়ির দিক থেকে।
শশীর মন কু গাইল। ভাবল, তা হলে কি অবিনাশ জেঠার কিছু হল! এক দৌড়ে লাবণ্যদের বাড়িতে এসে যা শুনল, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। সকাল থেকে লাবণ্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুকুরে নাইতে গেছিল, আর ফেরেনি। “বোধহয় জলেই...” বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন লাবণ্যর মা বিজয়া দেবী। বাড়িতে সবাইকে শুনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “এই সামনের মাঘেই বে ঠিক করেছিলাম মেয়ের। পাত্রপক্ষ কালকেই কথা কয়ে গেল। আর আজকেই মেয়েটা...” আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
সমস্ত পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল শশিকান্তর কাছে। মনে হচ্ছিল সে আর দাঁড়াতে পারবে না। যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যাবে। তবু কোনও রকমে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। লক্ষ করল, অবিনাশ জেঠা পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছেন। হাতের কাছে ছড়ানো কিছু বইপত্র, হিসাবের খাতা। শশিকান্ত উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। ধীরপায়ে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। টলতে টলতে এগিয়ে চলল পুকুরধারে।
পুকুরধারে অনেক লোকের জটলা। নানা জনে নানা রকম কথা বলছে। শশিকান্ত নিজের নামও শুনতে পেল তাদের কারও কারও কথায়। মেয়েটিকে নাকি অনেক সময়ই শশিকান্তর সঙ্গে এই পুকুরপাড়ে বসে থাকতে দেখা গেছে।
লজ্জায় শশিকান্তর কান গরম হয়ে উঠল। রাগও হল খুব লোকগুলোর উপর। এরা প্রত্যেকেই তার কাকার ইয়ার-বন্ধু। তাদের বাড়িতেও আসে। শশিকান্ত আর দাঁড়াল না, দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির পথে অগ্রসর হল। তা ছাড়া, তার বাড়ি ফিরে আসার আরও একটা কারণ ছিল। পুকুরে ডুবুরি নামানো হয়েছে, খানিক ক্ষণের মধ্যেই হয়তো লাবণ্যর প্রাণহীন দেহ নিয়ে ওরা উঠে আসবে। এ দৃশ্য সে দেখতে পারবে না কিছুতেই।
বাড়ি ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে ডুকরে কেঁদে উঠল শশিকান্ত। কেন এমন হল? কেন দুঃখ তার পিছু ছাড়ে না? কেন ভালবাসার মানুষগুলো তার জীবন থেকে সরে যায় বার বার? লাবণ্যর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল? সে জানল না কেন? মনের মধ্যে এই প্রশ্নগুলোর মাঝেই, দরজার বাইরে কনকবালার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। খুব মৃদুস্বরে সে শশিকান্তর নাম ধরে ডাকছে। অনেক ক্ষণ বাদে দিদির কথা মনে পড়ল শশিকান্তর। তার যে আজ আসার কথা।
যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত করে দরজা খুলল শশিকান্ত। ঘরে ঢুকল কনকবালা। শাড়ির আঁচল ভাল করে কোমরে জড়িয়ে তক্তপোশে উঠে বসল সে। তার মুখও থমথমে। ভাবতে পারেনি এ বাড়িতে এসে এমন খবর তাকে শুনতে হবে। লাবণ্য তার থেকে বয়সে ছোট হলেও, তার ছোটবেলার খেলার সঙ্গী। কনক এসেছে শুনলে এত ক্ষণে সে এ বাড়িতে চলে আসত। কেন যে এমন হল! শশিকান্ত দিদির কাছে তার সজল চোখ এড়ানোর জন্য জানালার কাছে দাঁড়িয়েছে। কনকবালা তাকে কাছে ডাকল। বলল, “এ দিকে আয় শশী।”
শশিকান্ত কোনও উত্তর না দিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়েই রইল।
কনকবালা আবার ডাকল। বলল, “আমার কাছে আয়, শশী। না হলে আমি চলে যাব।”
শশিকান্ত ঘুরে দাঁড়াল। ধীর পায়ে কনকবালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে।
কনকবালা তক্তপোশে তার পাশে একটা জায়গা দেখিয়ে শশিকান্তকে বলল, “আয়, বোস এখানে।”
শশিকান্ত যন্ত্রের মতো বসে পড়লে, কনকবালা তার মাথায় হাত রেখে বলল, “ভালবাসার মানুষ হারিয়ে যায় না রে, ঠিক ফিরে আসে।”
চমকে দিদির দিকে তাকাল শশী।
কনকবালা বলল, “পুকুর থেকে ডুবুরিরা শুধু হাতে উঠে এসেছে। তার মানে, লাবণ্য পুকুরে ডুবে মরেনি। ও বেঁচে আছে। আমি বলছি, লাবণ্য বেঁচে আছে। ও এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে গেছে। এক দিন দেখিস, তোর সঙ্গে ঠিক লাবণ্যর দেখা হয়ে যাবে।”
“লাবণ্য যদি বেঁচে থাকে, আমি ঠিক ওকে খুঁজে বার করব, তুই দেখিস। কিন্তু দিদি, তুই এত নিশ্চিত হয়ে কী করে বলছিস যে, লাবণ্য বেঁচে আছে?” শশিকান্ত বলল।
কনকবালা হাসল এ কথায়। বলল, “ও বাঁচতেই ঘর ছেড়েছে শশী। কবিরাজ জেঠার পছন্দ করা একটা বুড়ো ওর বর হবে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। ওর হৃদয়ের দখলদার যে এক জনই। তাকে ছাড়া ওর জীবন যে বৃথা। আমি সব জানি, শশী। মেয়েদের চোখকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। তোরা যে পরস্পরকে ভালবাসিস, এ আমি অনেক দিন থেকেই জানি।”
শশিকান্ত অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কিন্তু দিদি, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। তুই এ সব জানলি কী করে?”
“লাবণ্য আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে। ওর বিয়েতে মত নেই, আমাকে লিখেছে।”
“আমাকে কিছু বলল না কেন লাবণ্য?”
“তোকে বলে কী হবে? তুই কী করতে পারতিস? পারতিস লাবণ্যকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে?”
শশিকান্ত এ কথার উত্তর দিল না। চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। সত্যি তো, সে তো কিছুই করতে পারত না যদি লাবণ্য তাকে তার অসহায়তার কথা জানাত! শশিকান্তকে চুপ করে থাকতে দেখে কনকবালা আবার শুরু করল। বলল, “লাবণ্যকে আমি চিনি শশী। নিজে পুড়ে মরবে, তবু আগুনের কাছে অন্যকে আসতে দেবে না। অসম্ভব জেদি মেয়ে লাবণ্য। ও জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচবে না। বেঁচে লড়বে। তোর জন্যই বেঁচে থাকবে। তুই যদি সত্যিই তাকে ভালবেসে থাকিস, তা হলে ওকে খুঁজে বার করে ওর যন্ত্রণা দূর করিস।”
শশিকান্ত কোনও উত্তর দিল না। চুপ করে থাকল। তার চোয়াল শক্ত হল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, লাবণ্যকে সে খুঁজে বার করবেই। হয়তো সে কাছাকাছি কোথাও আছে। তার নাগালেরই মধ্যে। কনকবালা তাকিয়েছিল শশিকান্তর মুখের দিকে। বোধহয় তার মুখের অনুক্ত ভাষা পড়ার চেষ্টা করছিল। শশিকান্ত বলে উঠল, “দিদি, আমার সঙ্গে যাবি এক বার লাবণ্যদের বাড়ি?”
কনকবালা বলল, “কী হবে গিয়ে? তার চেয়ে ওবেলা যাব’খন। তুই হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। সকাল থেকে কিছু মুখে দিসনি! একটু আগে পিসি জিজ্ঞেস করছিল তোর কথা। বলছিল, ‘শশীটা গেল কোথায়? একটু আগে রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করছিল মাংস চাখবে বলে!’ যা এক বার পিসির সঙ্গে দেখা করে আয়। তোর জামাইবাবুও তোর কথা বলছিলেন। একটু দেখা না করলে, তিনি আবার কী না কী মনে করেন! কত দিন পর আসছেন, আর এ দিকে শ্যালক বেপাত্তা!”
“এক্ষুনি যাচ্ছি...” বলে শশী ঘর থেকে বেরোয়।
কনকবালা হাসে, যদিও তার হৃদয়ের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে কষ্টে। মেয়েটা যে কোথায় গেল...
৩৬
প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। লাবণ্যময়ীর সংবাদ নেই কোনও। এই বিশাল মানবসমুদ্রে একটা মেয়ে কেমন করে যেন হারিয়ে গেল! শশিকান্ত এখনও আশা রাখে যে, সে লাবণ্যকে খুঁজে পাবে। লাবণ্যহীন এই পৃথিবীতে তার এতটুকু বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। কোনও কাজেই সে মন থেকে সায় পায় না। যেন করতে হয় বলে করছে। আপিস যেতেও তার আজকাল ইচ্ছে করে না। সাহেবি কোম্পানি। না গেলে চাকরি চলে যাবে, তাই যায়। আবার বাড়িতে থাকতেও শশিকান্তর খুব একটা ভাল লাগে না।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy