ছবি কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: চন্দ্রমোহনের বাড়ির গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে বেশ অসুস্থ শরীরেই গিয়ে পৌঁছেছিলেন রমানাথ। সেখানে বুকে বেশ ব্যথা হতে শুরু করায় ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তারবাবু অবস্থা ভাল নয় বলে রমানাথকে কারমাইকেল হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। রাজি হন না রমানাথ। তিনি বাড়ি ফিরতে চান। তাঁর গাড়ি যখন বেলঘরে গিয়ে পৌঁছল, তখন তিনি আর নেই। অন্য দিকে উত্তর ভারতে পরিভ্রমণকালে নীলমণির সঙ্গে দেখা হয় অমরেন্দ্রনাথের। নীলমণি তাঁকে কলকাতা ফেরার কথা বললে, প্রথমে রাজি হন না অমরেন্দ্রনাথ। পরে তিনি ঠিক করেন কলকাতা নয়, আগে যেতে হবে পণ্ডিচেরি। সেখানে ঋষি অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করে তার পর ইতিকর্তব্য স্থির করতে হবে। পণ্ডিচেরির আশ্রমে পৌঁছেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় বারীন ঘোষের। ওঁদের অনুরোধে বারীন, দাদা অরবিন্দকে নিয়ে আসেন ওঁদের কাছে।
অমরেন্দ্রনাথ দেখলেন, ধীর পায়ে তাঁর বিপ্লবগুরু অরবিন্দ এগিয়ে আসছেন তাঁর দিকে। মুখে স্মিত হাসি।
অমরেন্দ্রনাথের কাছে এসে দাঁড়ালেন ঋষি অরবিন্দ। দুই বাহু মেলে আলিঙ্গন করলেন তাঁকে। তার পর, বারীন্দ্রনাথের উপর নীলমণির দেখাশোনার ভার দিয়ে অমরেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর উপাসনাকক্ষের দিকে পা বাড়ালেন।
৩০
বেজওয়ারায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল যে, ‘তিলক স্বরাজ্য ভান্ডার’ গঠন করে মহাত্মা গান্ধীর হাতে এক কোটি টাকা তুলে দিতে হবে। এই টাকার উপর নির্ভর করছে স্বরাজ পাওয়া। এই টাকা পেলে নাকি মহাত্মা গান্ধী ন’মাসের মধ্যে স্বরাজ এনে দেবেন।
সারা দেশ জুড়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। কলকাতাও মেতে উঠেছে এই টাকা সংগ্রহ করতে। সকলের হাতেই ভিক্ষার ঝুলি। যুবক-যুবতীদের মধ্যে এই উন্মাদনা সবচেয়ে বেশি। বারাঙ্গনারাও বেরিয়ে এসেছে পথে। তারা তাদের শেষ সম্বল তুলে দিচ্ছে সংগ্রহকারীদের হাতে। শুধু টাকা নয়, অনেকে তাদের দেহ থেকে স্বর্ণালঙ্কার খুলে তুলে দিচ্ছে সংগ্রহকারীদের হাতে।
শশিকান্ত এসেছে কলেজ স্ট্রিটে দু’-একটা বই কিনতে। রমানাথ মারা যাওয়ার পর প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তবুও বাবার মৃত্যুটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। এমন হঠাৎ একটা মানুষ চলে যেতে পারে! পড়াশোনায় নিবিষ্ট থাকলে মন ভাল থাকে, তাই সর্বক্ষণ বই মুখে গুঁজে বসে থাকে। কিন্তু একটু পড়াশোনা করলেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ছাদে উঠে পায়চারি করে, নয়তো পুকুরধারে একা বসে থাকে। কোনও কোনও দিন লাবণ্যময়ীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। পৃথিবীর সব একাকিত্ব ভুলে যায় সে।
বাবার মৃত্যুর পর শশী একটা জিনিস লক্ষ করেছে যে, বাড়ির পরিবেশও কেমন যেন বদলে গেছে। আগে যে বাড়িতে পিসির মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারত না, সেখানে কাকা পিসিকে নানা কথা শুনিয়ে যায়। পিসির অপরাধ, তিনি বাপের বাড়িতে থাকেন। শশীর এ সব ভাল লাগে না। গত রাতে আকণ্ঠ মদ খেয়ে এসে কাকা পিসিকে অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছে। শশিকান্তর ভাল লাগেনি। আবার প্রতিবাদ করতেও পারেনি। কাকা নিজের ঘরে ফিরে গেলে, শশিকান্ত পিসির কাছে এসে বসেছে। বলেছে, “তুমি কিছু বলতে পারলে না?”
আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে পিসি বলেছে, “আমার বলার আর কী আছে? এখন ওর সংসারে আছি। ও যা বলবে, তা হজম করেই থাকতে হবে। তোর বাবাটাও অসময়ে চলে গেল। সে ছিল আমার ভরসা। নীলুটা তো বোধহয় নিরুদ্দেশই হয়ে গেল।”
শশিকান্ত অভয় দিয়েছে পিসিকে। বলেছে, “তুমি কিছু ভেবো না পিসি। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা নেই তো কী হয়েছে, আমি তো আছি।”
সজল চোখেও পিসি হেসেছে। বলেছে, “তুই থেকে কী করবি? তুই কি উপায় করিস?”
শশিকান্ত চুপ করে গেছে। সত্যিই তো! সে তো কোনও রোজগার করে না। এক অর্থে, সে-ও তো পিসির মতোই কাকার উপর নির্ভরশীল।
শশিকান্তকে চুপ করে থাকতে দেখে, নিভাননী বলে ওঠে, “আজ আমাকে বলেছে, দু’দিন পর তোকে বলবে। নিজেরটা না বুঝলে, ডাহা ঠকবি।”
শশিকান্ত অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেছে পিসির দিকে। পিসি কী বলছে, তা কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
“বুঝতে পারলি না তো?” পিসি বলেছে।
শশিকান্ত মাথা নেড়ে জানিয়েছে যে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইশারায় শশিকান্তকে আরও কাছে ডেকেছে নিভাননী।
শশিকান্ত কাছে এলে, কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলেছে, “পাটের কারবারের মূল অংশীদার ছিল তোর বাবা। রমার অবর্তমানে সেই দাবিদার এখন তুই। অন্য কেউ নয়। নিজের অধিকার আদায় করে নে। কালই এক বার বড়বাজারে চলে যা। ঘনশ্যামজির সঙ্গে দেখা কর। কাল উমা গদিতে যাবে না। অন্য কী কাজ আছে শুনেছিলাম।”
তাই শশিকান্তর আজ কলকাতায় আসা। বড়বাজারে যাওয়ার আগে দুটো দরকারি বই কিনতে কলেজ স্ট্রিটে এসেছে। বই দুটো কেনাও হয়ে গেছে তার। এ বার সে হ্যারিসন রোড ধরে বড়বাজারের দিকে রওয়ানা দেবে। যাওয়ার আগে হাঁ করে তাকিয়েছিল এক দল কংগ্রেসি যুবকের দিকে। তারা একটা বড় সাদা কাপড়ের চার প্রান্ত ধরে এগিয়ে আসছিল। কাপড়ের মধ্যে রাশি রাশি টাকা। যে যা পারছে, দান করছে ওই কাপড়ের মধ্যে।
শশিকান্তর ইচ্ছে করল কিছু দান করতে। কিন্তু তার কাছে খুব সামান্যই টাকাপয়সা আছে। মনে মনে একটা হিসাব করে নিয়ে বাড়ি ফেরার পয়সা রেখে বাকিটা দান করে দিল কাপড়ের ঝোলায়। আর তখনই ঘটনাটা ঘটল। কৃশকায় এক যুবক তার বাহুর কাছটা চেপে ধরে বলল, “শশী না?”
শশিকান্ত মুহূর্তেই চিনে ফেলল তার ছেলেবেলার বন্ধু বিশুকে। বলল, “তুই এখানে? তুই তো অনুশীলন সমিতিতে ছিলি। তারা তো শুনেছি, অনেকেই গান্ধীবিরোধী। প্রকাশ্যেই গান্ধীকে গালিগালাজ করে। কিন্তু তুই...”
শশিকান্তকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বিশু বলে উঠল, “সে অনেক কথা। এ দিকে আয়, বলছি। তুই কি এখন বাড়ি ফিরবি?”
“না, আগে বড়বাজারে যাব। সেখানে একটা কাজ সেরে বাড়ি ফিরব,” শশিকান্ত উত্তর দিল। তার পর আবার বলল, “তুই কী বলবি বলছিলি?”
হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিশু বলল, “যুগান্তর, অনুশীলনের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে রে। বারীনদা, অবিনাশদা, উল্লাসকর দত্তরা যাবজ্জীবন কারাবাসে যাওয়ার পর সব কেমন যেন ভেঙে গেল। আমাদের মধ্যেও আর আগের মতো উৎসাহ রইল না। নিয়ম করে যেতাম ঠিকই, কাজও করতাম। কিন্তু ভিতরের তাগিদটা আর থাকল না। তার মধ্যে এক বছর জেল খাটলাম। ফিরে এসে দেখলাম, সবাই গান্ধীর কথা বলছে। গান্ধীই নাকি পারবেন দেশের স্বাধীনতা আনতে। ভিড়ে গেলাম কংগ্রেসে। যে পথই হোক, আমাদের লক্ষ্য তো এক। দেশের মুক্তি। নয় কি?”
শশিকান্ত মাথা নাড়ল। কোনও উত্তর দিল না। খানিক ক্ষণ পর বলল, “তুই বাড়ি যাস না?”
“কোথায়?”
“কেন, বেলঘরে?”
“না, সেখানে কার কাছে যাব? কে আর আছে আমার? বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছেন। আমি তখন জেলে। জ্ঞাতিরা আছেন, তবে তাঁদের কাছে যাওয়ার থেকে বাইরে থাকাই ভাল।”
“তা হলে তুই আছিস কোথায়?”
“কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে যোগিনী মায়ের কাছে।”
যোগিনী মা-র নামটা শুনে চমকে গেল শশিকান্ত। বলল, “যোগিনী মা মানে, আমাদের সেই ভূতের বাড়ির...”
“হ্যাঁ,” বিশু উত্তর দিল, “যোগিনী মা-ও জেলে ছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার খবরটা পেয়েছিলাম। এক দিন বাড়ি খুঁজে দেখা করতে গেলাম। অনেক ক্ষণ কথাবার্তার পর আমি উঠব-উঠব করছি, যোগিনী মা বলল, ‘বাড়িতে তো যাস না। থাকিস কোথায়?’ আমি মাথা চুলকে বললাম, কলেজ স্ট্রিটের কাছে একটা মেসে। আমাকে বলল, ‘আজ থেকে এখানেই থাকবি। এই মার কাছে।’ সেই থেকে ওখানেই আছি। তোর কথা এক দিন বলছিল মা। আসবি এক দিন আমাদের বাড়িতে?”
শশিকান্ত বলল, “যাব। নিশ্চয়ই যাব। তুই বাড়ির ঠিকানাটা দে।”
বিশু পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে তার উপর যোগিনী মা-র বাড়ির ঠিকানাটা লিখে শশিকান্তকে দিতেই, শশিকান্ত বলল, “আমি এ বার ডান দিকে যাব। তুই কি ও দিকেই যাবি?”
“না না, আমি তোর সঙ্গে কথা বলব বলেই এলাম। এ বার যাই, বাকিরা বোধ হয় অনেকটা এগিয়ে গেল...” উল্টো দিকে হেঁটে চলে গেল বিশু।
সে দিকে খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে শশিকান্তও বড়বাজারের দিকে পা বাড়াল।
ঘনশ্যাম অ্যান্ড রমানাথ জুট ব্রোকার অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হল না শশিকান্তকে। দু’-এক জন লোককে জিজ্ঞেস করতেই খোঁজ পেয়ে গেল অফিসের। অফিসে ঢুকতেই এক ভদ্রলোকের মুখোমুখি হতে হল তাকে। রোগা ছোটোখাটো চেহারা। পানখেকো মুখ। দাঁতে লাল-লাল ছোপ। বলল, “কাকে চান?”
শশিকান্ত এই লোকটিকে না চিনলেও, এই লোকটির সম্বন্ধে কিছুটা জানে। এর নাম নিবারণ। তার কাকার খাস চাকর।
শশিকান্ত জিজ্ঞেস করল, “এখানে ঘনশ্যাম আগরওয়াল আছেন?”
শশিকান্তর আপাদমস্তক ভাল করে নিরীক্ষণ করে লোকটি বলল, “আছেন। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে কথা বলুন।”
শশিকান্ত তবু দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি দরজার উপর, যেখানে একটা ফলকে লেখা— ঘনশ্যাম অ্যান্ড রমানাথ জুট ব্রোকার কোম্পানি লিমিটেড।
লোকটি শশিকান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কী হল, দাঁড়িয়ে রইলেন যে, যান। উনি আবার বেরিয়ে যাবেন।”
শশিকান্ত এগিয়ে গেল দরজার দিকে। একটু ঠেলতেই একটা শব্দ হল। ভিতর থেকে ঘনশ্যাম আগরওয়ালের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “আইয়ে।”
শশিকান্ত ভিতরে ঢুকে ঘনশ্যাম আগরওয়ালের মুখোমুখি হল। এই প্রথম দেখছে সে ঘনশ্যামজিকে। ফরসা, টুকটুকে গায়ের রং। মাঝারি উচ্চতা। দাড়িগোঁফহীন মুখটি গোল। মাথায় একটা পাগড়ি।
তাকে দেখে ভদ্রলোক বললেন, “আপ কৌন?”
শশিকান্ত নিজের পরিচয় দিতেই ঘনশ্যামজি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “তুমি রমাবাবুর লেড়কা আছ, সাচ?”
শশিকান্ত মাথা নাড়ল।
“লেকিন, উমাবাবু যে বলল, রমাবাবুর কোনও লেড়কা নেই?” ঘনশ্যাম আগরওয়াল বলল।
শশিকান্ত খানিক ক্ষণ অধোবদনে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আমরা দুই ভাই-বোন। কয়েক বছর আগে আমার দিদির বিয়ে হয়ে গেছে।”
“সচ বাত। আমি ওই শাদিতে যেতে পারিনি। বিমার থা। লেকিন রমানাথ কা কোই লেড়কা হ্যায়, এ তো মালুম নহি থা। রমানাথ ভি কভি মুঝে নহি বোলা। আজিব আদমি থা রমানাথ...” ঘনশ্যামজি বলে। তার চোখে জল চিকচিক করে। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বার করে, চোখের জল মুছে ঘনশ্যামজি আবার বলেন, “দেখিয়ে শশিকান্ত, আপনার পিতাজির পর আপনি এই কারবারের শেয়ারহোল্ডার। আমার পার্টনার। শুধু একটা ল’ইয়ার লাগবে। কোর্টে যেতে হবে। কিছু চিন্তা করবেন না। সব আমি করে দেব। রমাবাবুর লেড়কা। জানতামই না! কেয়া বেয়াকুব আদমি ম্যায় ভি...”
এর পর ঘনশ্যামজি যেটা করলেন, সেটা ভাবতেই পারেনি শশিকান্ত। পাশের ঘর থেকে নিবারণকে ডেকে, শশিকান্তর জন্য মিষ্টি আনতে দিলেন। শশিকান্তর কোনও আপত্তি গ্রাহ্য করলেন না। বললেন, “তুম রমাবাবু কা লেড়কা। মু মিঠা করে বিনা চলা যাওগে? অ্যায়সা নেহি হোগা।”
মিষ্টি-জল খেয়ে, যখন শশিকান্ত বাইরে এল, দেখল নিবারণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শশিকান্তকে দেখে বলল, “চলুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
শশিকান্ত অবাক হল। বলল, “আমার সঙ্গে?”
‘‘হ্যাঁ, আপনার সঙ্গেই,” বলেই লোকটি লাল ছোপ-ছোপ দাঁত বার করে হাসল।
শশিকান্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “বলুন।”
“বড় ভাল মানুষ ছিলেন আপনার বাবা। আমাকে এখানে উনিই নিয়ে এসেছিলেন। এমন হঠাৎ করে চলে গেলেন...” বলে চোখ মুছল লোকটি।
শশিকান্ত কী করবে, ভেবে না পেয়ে বলল, “আপনি কী যেন বলবেন বলছিলেন?”
লোকটি পিছনে তাকাল এক বার। তার পর শশিকান্তর হাত ধরে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে এসে বলল, “বলছিলাম, কী দরকার আবার এর মধ্যে ঢোকার? বাবার জায়গায় কাকা পার্টনার হলে অসুবিধে কোথায়? উমাবাবু তো লোক মন্দ নন। আপনাকে তো স্নেহই করেন, তাই না?”
শশিকান্ত বলল, “আপনি আর কিছু বলবেন?”
লোকটি বলল, “না না, আর কী... রমাবাবুর ছেলে বলে, একটু উপদেশ দিলাম, না হলে...”
শশিকান্ত কোনও উত্তর না দিয়ে সামনে হ্যারিসন রোডের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
৩১
উত্তরপাড়ার রামনিধি চ্যাটার্জি লেনে অমরেন্দ্রনাথের এই বাড়িতে আজ যেন চাঁদের হাট বসেছে। যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির পুরনো সভ্যরা তো আছেনই, আছেন জাতীয় কংগ্রেসের কিছু সদস্যও। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে থাকা আন্দামান-ফেরত বিপ্লবীদের উপস্থিতি। সকলের লক্ষ তাদের দিকে। সকলেই জানতে চান তাঁদের আন্দামানে থাকার অভিজ্ঞতা।
কোথাও হয়তো হৃষীকেশ কাঞ্জিলালকে ঘিরে ভিড়, কোথাও উল্লাসকরকে ঘিরে। কোথাও আবার হেমচন্দ্র কানুনগো তাঁর জেলজীবনের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন দু’-এক জনকে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা। তবে উল্লাসকরের কাছে ভিড় কিছুটা বেশি। কারও কাছে গোপন নেই, কতটা অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল উল্লাসকরকে দ্বীপান্তরের কারাগারে। জেলার ব্যারি সাহেবের নির্দেশে, তাঁর উপরেই অত্যাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ জেলে প্রথম থেকেই উল্লাসকর ছিলেন প্রতিবাদে সরব। প্রথম দিন জেলার সাহেব যখন কয়েদিদের সতর্ক করে দিচ্ছিল, “এখানে তোমরা কেউ আমাদের সঙ্গে চালাকি করে পার পাবে না। যা কাজ দেওয়া হবে, তা যত কঠিনই হোক না কেন, করতে হবে, না করলে তিরিশ ঘা বেত। যত ক্ষণ না চামড়া ফেটে মাংস দেখা যাচ্ছে, আমার হাত থেকে নিস্তার নেই...” সবাই নীরবে জেলার সাহেবের কথা শুনছিল, হঠাৎ উল্লাসকর গর্জে উঠলেন, “তিরিশ ঘা বেত কেন, আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও, তুমি শুনে রাখো সাহেব, আমাকে দিয়ে কোনও কাজ এক ফোঁটাও করাতে পারবে না, যদি আমি সেটাকে অন্যায় মনে করি।”
তার পর থেকেই উল্লাসকরের উপর নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy