রঘুর শীত করছে। এত ঠান্ডা ঘরে এত ক্ষণ ধরে সে থাকেনি কখনও। এই ঘর-সহ গোটা ফ্ল্যাটটা, শুধু ফ্ল্যাটটাই নয়, চল্লিশ তলা এই বাড়িটাই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত।
বাড়ি নয়, এটাকে ওরা বলে টাওয়ার। পুরো চত্বরটা জুড়ে এমন সাতটি টাওয়ার আছে। রঘু শুনেছে, এখানে আগে ওদের ‘চওল’ ছিল। ঝুপড়ি। এত বড় এলাকা জুড়ে, বা এলাকা ছাড়িয়ে আরও অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল বস্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বস্তি। এক দিন সেই বস্তি কিনে নেন খুব বড় এক জন ব্যবসায়ী। ওরা বলে, শিল্পপতি। ধনকুবের। এই টাওয়ারগুলো তাঁর সংস্থাই নাকি তৈরি করেছে।
মুম্বইয়ের এমন একটি ধনী এলাকায়, এত বড় একটা ফ্ল্যাটের দাম কত হতে পারে? আন্দাজ নেই রঘুর। সে ওই ধ্বংস হয়ে যাওয়া বস্তির একটি ঝুপড়িতে থাকত। কতই বা বয়স হবে তখন ওর! আট কি দশ! তার পরে এক রাতে বুলডোজ়ার এসে বস্তি সাফ করে দিল। রাতারাতি তারা বেঘর। রঘুর মনে আছে, সে রাতটা ছিল ১৪ অগস্ট। স্বাধীনতা দিবসের মোটে কয়েক ঘণ্টা আগে তাদের নড়বড়ে বাসস্থানটা মিশে গেল মাটির সঙ্গে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আকাশ জুড়ে রোশনাই দেখা দিল। স্বাধীনতা দিবসের উদ্যাপন।
রঘু তখন বাবা-মায়ের হাত ধরে মুম্বইয়ের রাজপথে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মাথায়, কোলে, কাঁখে পোঁটলা, ছোট ভাইবোনেরা। তার পর থেকেইরঘুরা ফুটপাতবাসী।
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় রঘু। আজও ১৪ অগস্ট। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। একটু পরে আবার আলোর রোশনাই শুরু হবে। এ বারে একটু আলাদা। ২০৪৭ সাল। স্বাধীনতার একশো বছর। রঘুর ছোট মাথায় বড় ভাবনা আসে না। তবু সে মাঝে মাঝে চিন্তা করে, সে কি স্বাধীন?
“নিশ্চয়ই স্বাধীন!” তাকে বুঝিয়েছে গণপত। লোকটি পার্টি করে। এখন অবশ্য পার্টির কাজ কমে গিয়েছে। পাঁচ বছরে এক বার মোটে ভোট হয়। প্রচারে আর প্রার্থীরা আসেন না। বদলে তাঁদের এজেন্টরা এসে জেনে যান, কোন ঘরে কত ভোটার আছে। যারা ফুটপাতে থাকে, যাদের মাথার উপরে নির্দিষ্ট ছাদ নেই, তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে কাটার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই রঘুকে কয়েক জন মিলে জিজ্ঞাসাবাদ করে গিয়েছে এক দিন। সে কে, বাড়ি কোথায়, বাবা-মা কোথায় থাকেন, তারা বাংলাদেশি কি না, পাকিস্তানে তাদের কোনও আত্মীয় আছে কি না, তামিল বলতে জানে কি না— এমন কত কী!
গণপত বলে, “তোর আর কী! তিন কুলে কেউ নেই। ঝাড়া-হাত-পা। তুই বরং বন্দরে কাজ শুরু কর। আমার চেনা আছে। বলিস। কাজে লাগিয়ে দেব।” তার পরে কানের কাছে মুখে এনে বলে, “ঘাঁতঘোঁত জেনে নিলে প্রচুর উপরি। বন্দর মানেই তো, জানিস...” কথাটা মাঝপথে থামিয়ে মুখে বাঁকা হাসি টেনে রাখে।
আজ গণপতের সঙ্গে বসেই সে চা খাচ্ছিল। গণপতই খাওয়াচ্ছিল। আর বলছিল, “এখন কত সহজে সব কাজ হয়ে যায়, দেখ। পাঁচ বছরের মধ্যে ভোটের বালাই নেই। বিরোধী দল বলে প্রায় কিছু নেই। যারা আছে, তারাও নাম-কা-ওয়াস্তে। তাই কাজ আটকাতে বিরোধিতাও নেই। আগে কী যে ছিল সব, ভাবতে পারবি না। এই পার্লামেন্ট ভোট, তো এই বিধানসভা। এই মিউনিসিপ্যালিটি ভোট, তো এই পঞ্চায়েত। নেতারা ভোটের কাজ করবে, নাকি দেশের কাজ?”
গণপত একাই বকে যায়। রঘু এ-সব ভাবে না। সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে উদাস হয়ে। কী হবে এই সব ভোটের কথা ভেবে? তার জীবনে শুধু একটাই শব্দ, খিদে। খিদে পেলে রঘুর মাথার ঠিক থাকে না ছোটবেলা থেকে।
হঠাৎ চটকা ভাঙে একটি মেয়ের কণ্ঠস্বরে,“এই শোন।”
রঘু মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে। সাজপোশাক দেখে বোঝাই যাচ্ছে, রইস। টাকার জৌলুস তার শরীর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। রঘু শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। মেয়েটি তাকে বলল, “এই শোন, তোকেই বলছি।”
গণপতের ধাক্কায় নড়ে বসে রঘু। তা-ও তার ঘোর কাটে না। কী সুন্দর মেয়ে রে! রঘুর জীবনে গার্লফ্রেন্ড বলে কিছু নেই। সে-সবের ধারও ধারতে চায় না সে। নিজে কোথায় থাকে তার ঠিক নেই, আবার শঙ্করাকে ডাকা!
গণপত ফিসফিস করে বলে, “তোকে বলছে।”
এবার সম্বিত ফেরে রঘুর। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, “বলুন দিদি।”
“দেখ না,” মেয়েটার গলায় নরম বন্ধুত্বের সুর, “গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। অ্যাপ ক্যাবও পাচ্ছি না আধ ঘণ্টা ধরে। এতগুলো লাগেজ। এক জনকেও দেখতে পাচ্ছি না, যাকে ভরসা করা যায়। আমাকে একটু সাহায্য করবি?”
“কী করতে হবে?”
“একটা অটো ধরে দিবি?”
রঘুর কাছে এটা বাঁ হাতের কাজ। সে তিন মিনিটের মধ্যে একটা অটো ডেকে আনল, ‘‘দিদি, উঠে পড়ুন।’’
মেয়েটির সঙ্গে তিনটে ট্রলিব্যাগ। সে বলল, “এতগুলো ব্যাগ টেনে আমি নিয়ে যেতে পারব না। আমার সঙ্গে যাবি একটু? ফেরার ভাড়া দিয়ে দেব।”
রঘু একটু দ্বিধা নিয়ে গণপতের দিকে তাকায়। গণপত ওকে ইশারা করে যেতে। নিজেও এগিয়ে এসে বলল, “দিদি, রঘু ভাল ছেলে। ও আপনাকে এগিয়ে দেবে।”
অটোয় বসতে বসতে মেয়েটি এক বার দ্বিধাগ্রস্ত গলায় জানতে চাইল, “তোর আধার কার্ড আছে?” তার পরে মনে মনে কী যেন হিসাব কষে বলল, “ঠিক আছে, লাগবে না। চল, আমি কথা বলে নেব গেটের সিকিয়োরিটির সঙ্গে।”
অটোর পিছনের আসনে তিনটে ট্রলিসমেত বসল মেয়েটি। সামনে চালকের পাশে রঘু। অটো গড়াতে গড়াতে এক সময়ে এসে দাঁড়াল আবাসনটার সামনে।
চোখ ধাঁধিয়ে গেল রঘুর। বেশির ভাগ টাওয়ার রাতের আলোয় ঝলমল করছে। নীচ থেকে মাথা পর্যন্ত সোজা আকাশমুখো হয়ে সে হাঁ করে দেখছিল। পিছন থেকে মেয়েটি বলল, “কী রে, ট্রলিগুলো ধর!”
অটো থেকে ট্রলি নামিয়ে তারা এগিয়ে গেল আবাসনের সিংদরজার দিকে। বহু দিন পরে এখানে এল রঘু। ছোটবেলার আবছা স্মৃতিতে এই জায়গা জুড়ে থাকা বস্তির অংশ কিছুটা লেগে আছে। কখনও ঘুমের মধ্যে তার মনে হয়, মা সন্ধ্যায় রান্না বসিয়েছে। সুবাস বেরিয়েছে খুব। সে আর ছোট ছোট ভাইবোনগুলো মিলে নাক টানছে শুধু। বাবা রাতে কাজ থেকে ফিরলে সবাই এক সঙ্গে খেতে বসবে। তাদের মনে হচ্ছিল, কখন বাবা ফিরবে!
যে রাতে তাদের উচ্ছেদ করা হয়, তার দু’দিনের মধ্যে কাজটাও চলে যায় বাবার। একটা আবাসন তৈরির কাজে ঠিকাদারের সহকারী ছিল বাবা। কিছুটা লেখাপড়া ছিল পেটে। আর ছিল লোক সামলানোর বুদ্ধি। তাতেই অ্যাসিস্ট্যান্ট। রঘু শুনেছিল, বস্তির যেখানে যারা কাজ করত, তাদের সকলেরই চাকরি গিয়েছিল। তার পরে রাতের অন্ধকারে আবার সাফাই অভিযান। পুলিশ এসে ধরে ধরে তাদের শহরের সীমা পার করে দিয়েছিল। বলেছিল, ফের শহরে ঢুকলে মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেবে, বা গাঁজা কেসে অন্দরে চালান করে দেবে।
সে শহর ছাড়তে চায়নি। তাই লুকিয়ে দলছুট হয়ে ফিরে এসেছিল।
রঘুর মাথার মধ্যে হঠাৎ দপদপ করতে শুরু করল। একটা আগুনের শিখা যেন শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়েছে।
“কী রে, কত ক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি? চল!” তাড়া দিল মেয়েটি। রঘু চুপচাপ ট্রলিব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
মেয়েটি ওর কাছ ঘেঁষে হাঁটছে এখন। চাপা স্বরে বলল, “কেউ প্রশ্ন করলে জবাব দিবি না। আমি বলেছি, আমার গ্রামের সম্পর্কে আত্মীয়, বাড়ি ছাড়তে এসেছে।” তার পরে একটু হেসে বলল, “ম্যানেজ করতে হয়েছে বস! না হলে এখন এই আবাসনে আধার কার্ড ছাড়া গেস্ট অ্যালাউড নয়।”
এখানে সব কিছুই যেন শান্ত। ঠান্ডা। মসৃণ। পাশাপাশি হেঁটে তারা এল লিফ্টের সামনে। এক বার পুরসভার অফিসে গিয়েছিল রঘু। কোল্যাপসিবল গেটের সেই লিফ্ট উঠতে-নামতে হ্যাঁচকা টান দেয়। দরজা টেনে বন্ধ করতে ঢকঢক শব্দ হয়। এই লিফ্ট মসৃণ। এবং বড়ও। এখন আপাতত ওরা দু’জন।
মেয়েটি তার হাতের মোবাইল থেকে বিশেষ চোখ সরাচ্ছে না। তার মধ্যেই বলল, “এখানে প্রচণ্ড কড়াকড়ি। প্রতিটি কোণে সিসিটিভি-ক্যামেরা রয়েছে। প্রতিটি ইঞ্চিতে নজর রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা সব মনিটরিং হচ্ছে।”
রঘু বুঝতে পারে না, কেন তাকে এই সব কথা বলছে মেয়েটি। যেমন বুঝতে পারে না, তাকে কেন নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাচ্ছে সে। তবু চুপ করে সে চলেছে মেয়েটির সঙ্গে। বেশি কথা বলা বা প্রতিবাদের অভ্যাস তার নেই। যে চায়ের দোকানটায় এর আগে কাজ করত, সামান্য দোষে সেখান থেকে কাজ গিয়েছিল। সে কিছু বলতে পারেনি। গণপত বলেছিল, “এরা সব জোচ্চোর। না হলে তোর মতো ভাল ছেলেকে বার করে দেয়!”
গণপতই আর একটা কাজ জোগাড় করে দেবে বলেছে। একটা চওল-ও খুঁজে দিয়েছে তার জন্য। রঘুর মনে হয়, তাদের এত বড় বস্তি উঠিয়ে দেওয়ার পরেও লাভ হল কি! সেই তো জায়গায় জায়গায় ঝুপড়ি আর চওল রয়েই গিয়েছে।
রঘু তার জামাকাপড়ের জন্য সঙ্কুচিত ছিল এত ক্ষণ। তবে লিফ্ট থেকে বার হয়ে লবিতে কাউকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা স্বচ্ছন্দ হয় সে। মেয়েটি তাকে নিয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে।
মেয়েটিকে সহজ-সরল মনে হয় তার। মেয়েটি বলে, “আমাদের ফ্ল্যাটটার দু’ভাগ। এটা আউটহাউস। মূলত অতিথি বা কাজের লোকেদের জন্য। ভিতরে আসল ঘরগুলো। আমরা এখানে কখনও সখনও থাকি। আমি আজই লন্ডন থেকে এলাম। তাই কাজের লোক কেউ নেই। বাবা-মা তো সে দেশেই রয়েছে।”
ঘরে ঢুকে সুইচ দিতেই ঘরটা উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। এ বারে রঘুর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল মেয়েটির, “তোর জামাকাপড় এত নোংরা কেন? আমি ময়লা-নোংরা একদম সহ্য করতে পারি না। দেখেছিস, এত দিন ঘর ফাঁকা, তাও কোথাও ধুলো-ময়লা নেই!” মেয়েটির চোখ গেল রঘুর চটিটার দিকে। হাঁ-হাঁ করে উঠল মেয়েটি, “কী নোংরা তোর চটিতে! যা যা... বাইরে রেখে আয় শিগগির।”
চটি রেখে ঘরে ঢুকে রঘু বুঝতে পারছিল না কী করবে। তার কি এখন চলে যাওয়া উচিত? মেয়েটি তাকে আগাপাশতলা জরিপ করছে তখন। ক্লিষ্ট মুখটায় চোখ পড়ে যায় তার। দৃষ্টি নরম হয় মেয়েটির। জিজ্ঞেস করে, “কিছু খাবি?”
রঘু মাথা নাড়ে। মেয়েটি অ্যাপ খুলে অর্ডার করে। তার পরে বলে, “এই আবাসনের নিজস্ব রেস্তরাঁ আছে। এখনই খাবার এসে যাবে। বিরিয়ানি বলেছি।” মৃদু হাসে সে। সেন্টার টেবিলের পাশে মেঝেতে বসতে বলে রঘুকে। তার পরে নিজে ভিতরে চলে যায়।
রঘু দেখে, মেয়েটির পিছনে একটি বড় দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সেই দরজার গায়ে সবুজ রঙের বোতাম এবং স্বয়ংক্রিয় লক রয়েছে। আঙুলের ছাপ বা পাসওয়ার্ড ছাড়া দরজা খুলবে না। খিদেটা ভিতরে চাগাড় দিতে থাকে। রঘুর হাতে ঘড়ি নেই। পকেটে মোবাইলও নেই। সে বুঝতে পারে না, রাত তখন ক’টা। কিন্তু রাত যে ঘনিয়েছে, তা বেশ টের পায় খিদের চোটে।
আর খিদে পেলে রঘু দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে তার ওই একটিই দুর্বলতা, খিদে। এক বার রাতে বাবার ফিরতে দেরি হয়েছিল। খিদের চোটে ঘুমিয়ে পড়েছিল রঘু। রাতে ঠুকঠাক শব্দে ঘুম ভেঙে দেখে, বাবা আর মা টিমটিমে আলোয় বসে কথা বলছে। রঘু বলেছিল, “মা, খেতে দাও... খুব ভুখ লেগেছে।”
মা বলেছিল, “তুই তো বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলি। আমরা সব খেয়ে ফেলেছি। আর তো কিছু নেই।”
রঘুর মাথায় যেন বাজ ফেটেছিল। তার চিৎকারে ভাইবোনগুলো উঠে কাঁদতে শুরু করে। লাথি মেরে রঘু জলের পাত্রটা ফেলে দেয়। তার পর সেটা তুলেই সজোরে ছুড়ে মারতে গেছিল মাকে লক্ষ করে। বাবা আটকে দিয়েছিল। রঘুর ছোট্ট শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল। বার বার মাকে বলছিল সে, “কেন আমাকে খাবার দিলে না? কেন?’”
আজ অবশ্য তাকে বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। ডোরবেল বাজে। মেয়েটি ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের পোশাক বদলে ফেলেছে। বাড়ির ছিমছাম পোশাকে সে এখন যেন আর পাঁচটা মেয়ের মতোই। এত ক্ষণ এক সঙ্গে রয়েছে, তা-ও রঘু এক বারও মেয়েটিকে ভাল করে দেখেনি। শুধু এইটুকু আন্দাজ করেছে, মেয়েটি হয়তো তারই বয়সি।
একটা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে মেয়েটি। তার পরে বলে, “আমি প্লেটে রেডি করে দিচ্ছি।”
এত ক্ষণে রঘুর গলায় আওয়াজ ফোটে। সে বলে, “দিয়ে দাও দিদি। আমি বাক্স থেকেই খেয়ে নেব। খুব খিদে লেগেছে।”
মেয়েটি কী ভাবে, তার পরে প্যাকেট খুলে একটা বাক্স এগিয়ে দেয় রঘুকে। অন্য বাক্সটি রাখে খাবার টেবিলের উপরে। প্যাকেটের নীচে কাটলারি রয়েছে। সেটা থেকে একটি চামচ এগিয়ে দেয় সে রঘুকে। তার পরে বলে, “তোকে পাঁচশো টাকা দিচ্ছি। এতটা এসেছিস। চলবে তো?”
খেতে খেতে মাথা নাড়ে রঘু। মেয়েটি চামচ ধরিয়ে দেয় তার হাতে। তার পরে পাঁচশো টাকার নোটটি রাখে রঘুর সামনের টেবিলে। রঘুর সে দিকে খেয়াল নেই। খাবার ছাড়া কোনও দিকে নজর নেই তার।
শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার নিদান যে দিন ঘোষিত হয়েছিল, রাতে খিদেয় নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছিল তার। হাঁটতে হাঁটতে রঘু দেখেছিল, এত রাতেও একটা খাবারের দোকান খোলা। সুযোগ বুঝে বাবার হাত ছাড়িয়ে দে ছুট। পিছনে পড়ে ছিল মায়ের ডাক। এক ছুটে সেই দোকানে এসে হাত পেতেছিল রঘু, “একটা পুরি দাও না গো!”
দোকানদার তাকে দূর-দূর করে খেদিয়ে দিয়েছিল। সে যায়নি। একটা ইট জোগাড় করে একটু দূরে অন্ধকারে বসে অপেক্ষা করছিল। দোকানে খদ্দের কমতেই আচমকা এগিয়ে এসে সেই ইটের ঘায়ে ভেঙে দেয় কাচের দেরাজ। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বার করে আনে গোটা তিনেক পুরি। তার পরে আবার ছুট। ভাঙা কাচে লেগে হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে। পিছনে চোর-চোর চিৎকার। কিন্তু তার ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকটা ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বসে সে দম নেয়। তার পরে কাছের ট্যাপ-কলের জলের সঙ্গে একে একে শেষ করে শুকনো পুরি তিনটে।
আজও তার খিদে বাগ মানছিল না। হামলে পড়ে গপগপ করে খাচ্ছিল রঘু। মেয়েটি ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠল, “এ কী করেছিস!”
খাওয়া থামিয়ে রঘু খেয়াল করে, চার দিকে সে ছড়িয়ে ফেলেছে বিরিয়ানির ভাত। খাওয়ার তোড়ে ছিটকে পড়েছে মাংসের ছোট টুকরোও। মখমলের মতো কার্পেটটার অনেকটা জায়গা জুড়ে।
সে বলে, “দিদি, সাফ করে দিয়ে যাব।”
“তোকে সাফ করতে হবে না। বেরো, এখনই বেরো বলছি,” চিৎকার করে ছুটে আসে মেয়েটি। তার হাত থেকে কেড়ে নিতে চায় বিরিয়ানির বাক্সটা। টানের চোটে ছিটকে পড়ে সবটা। কার্পেট-ভর্তি ভাত আর আধখাওয়া মাংস। সে দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকায় রঘু। মেয়েটি তখনও চিৎকার করছে, “ভিখিরির বাচ্চা, এই জন্য তোকে ঘরে আনা আমার ঠিক হয়নি। সব নোংরা করে দিল, ক্লিনার ছাড়া কিছু পরিষ্কার হবে না! এখন কে করবে এত ঝামেলা! সব এই রাস্তার ছেলেটার জন্য... বেরো, বেরো বলছি,... দূর হ চোখের সামনে থেকে! অনেক খেয়েছিস, আর খেতে হবে না...”
রঘুর মাথায় আগুন জ্বলে যায়। পেটের মধ্যে খিদে চনচন করছে তখনও। সবে তো কয়েক গ্রাস খেয়েছে মাত্র। সে অন্ধের মতো হাত বাড়ায়। সেন্টার টেবিলের এক পাশে রাখা কাচের শো-পিসটা হাতে ঠেকে। সেটা তুলে উঠে দাঁড়িয়ে সে সর্বশক্তিতে মেয়েটির মাথায় বসিয়ে দেয়।
অবশেষে
ভিতরঘরের খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রঘু। একটু আগে মনে হয় বৃষ্টি হয়েছে। গুমোট একটু কম।
কুড়ি তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রঘু ভাবতে থাকে। জীবনে প্রথম বার খুব জরুরি ভাবনা। তার সামনে দু’টো পথ খোলা। সে মেয়েটির লাশ ডিঙিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে পারে। তার পরে লিফ্ট ধরে সোজা মিশে যাবে মুম্বই শহরে।
কিন্তু এত সিসিটিভি, লোকজনের নজর? সে-সব তো ফাঁকি দিতে পারবে না। কোথাও তো সে নিজেকে লুকোয়নি। লুকোবেই বা কেন? যে রঘু ঘরে ঢুকেছিল, সে শান্ত এক যুবক।
তা হলে কি সে সোজা থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করবে? কিন্তু সেখানেও তো মার ছাড়া কিছু জুটবে না। এনকাউন্টার করে দেয় যদি!
দ্বিতীয় আর একটি পথ দেখতে পায় রঘু। খোলা বারান্দা। অনেক নীচে কংক্রিটের পথ শুয়ে আছে, নিথর, নিস্তব্ধ। সেখানে অপেক্ষা করে আছে ঠান্ডা, সুশীতল মৃত্যু।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রঘু। ঘরের মধ্যে খুব ঠান্ডা। বারান্দা থেকে দূরে শোনা যাচ্ছে বাজি-পটকার আওয়াজ। শততম স্বাধীনতা দিবসের উদ্যাপন। রাত বারোটা কি তবে বেজে গেল?
রঘু ভাবতে থাকে...
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)