সাঁকো ভাঙা নদীটার পাড়ে দাঁড়ালে ঈশান কোণে দেখা যায় পুরো মন্দিরটা। চৌরাস্তা থেকে শুধু তার ত্রিকোণ চূড়াটাই দৃষ্টিগোচর হয়। দুলু সঙ্কেতে তর্জনী দেখিয়ে প্রস্তাবটা রাখল জলি সামন্তর কাছে।
ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন চরণ ভট্টাচার্য। ছ’পুরুষ ধরে তারা এই মন্দিরের সেবায়েত ব্রাহ্মণ। চৈত্র মাসটা চরণের ভয়ানক ব্যস্ততায় কাটে। ঘুম থেকে উঠে মন্দিরের চার পাশ নিজে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। মহাকাল মন্দিরের পিছনে দুধপুকুর থেকে জল এনে মন্দিরের সিঁড়ি, চাতাল ধুয়ে সাফসুতরো করে রাখেন। অদূরে বয়ে গেছে সাঁকো ভাঙা নদী। গ্রাম্য বধূর মতো শান্ত, নিস্তরঙ্গ। আপন ছন্দে সে বয়ে চলেছে সোনাডাঙা, অতসীপুর, জারুল গাঁ, ভীমপোতা, পলাশডাঙার ভিতর দিয়ে।
বাইরের কাজ সেরে নদীতে স্নান করে মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে বাকি কাজ সেরে ফেলেন চরণ। কত কাল ধরে এই কাজ করে আসছেন। চরণদাসের বয়সের গাছ-পাথর নেই। এখন যাদের পঞ্চাশ- ছাপ্পান্ন বছর বয়স, তাদের কাছে তিনি একই রকম আছেন। এই পথ দিয়ে যখন যে যায়, সকলে দেখে চরণ জেগে আছে। মোমের আলোয় একটা খাতা খুলে চরণ কী যেন লিখে চলছেন। লোকে বলে চরণ মহাকালের হিসাব-রক্ষক। খাতার পাতায় সব কিছু লিখে রাখে। গ্রামের মানুষের কাছে চরণ ঈশ্বরের প্রতিনিধি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, এক মাথা জটা, পরনে গৈরিক ধুতি। কথা বলেন খুব কম। মন্দির থেকে কয়েক ফুট দূরে একটা জীর্ণ ঘরে তার বাস। একচালা মাটির ঘর উপরে খড়ের ছাউনি। সামনে এক চিলতে বারান্দা। ফি-বছর ছাউনি না পাল্টালে দুরন্ত বর্ষায় ঘরে বাস করা অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
পাঁচ গাঁয়ের মানুষ আসে মন্দিরে পুজো দিতে। সোম আর শুক্রবারে পুজা দেয় তখন ফল-মূল, দুধ-মিষ্টি-বাতাসা আর দু’-চার টাকা প্রণামীস্বরূপ যা আসে, তাতেই চরণের কোনও মতে চলে যায়।
বহু প্রাচীন এই মহাকাল মন্দির। কবে কোন রাজা বা জমিদারের সময়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সে খবর কেউই জানে না। মন্দিরের গঠন গতানুগতিক মন্দিরের শৈল্পিক রীতির বাইরে, একেবারে অন্য রকম। যেমন কেউ জানে না বিগ্রহের চোখ দুটো অমন কেন।
দেখলে মনে হবে, কোনও দুর্বৃত্ত ধারালো অস্ত্র দিয়ে দু’টি চোখ খুবলে তুলে নিয়েছে। কে বা কারা এ কাজ করেছে, কেউই জানে না। তবে জনশ্রুতি একটা আছে। সেটা হল, চরণের বাবা লোচন ছিলেন জন্মান্ধ। তাঁর বাবা মাধবচন্দ্র ছিলেন এই মন্দিরের পূজারি। পুত্র জন্মানোর পরে যখন এ কথা জানতে পারলেন মাধবচন্দ্র, তখন তিনি মহাকালের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলেন। টানা এক মাস তিনি জলস্পর্শ পর্যন্ত করেননি। তাঁর একটাই কথা, “আমার পুত্রের চোখে আলো এনে দাও ঠাকুর।”
চৈত্রের শেষ।
সপ্তাহখানেক আগে থেকে জোর তোড়জোড় চলছে গাজন সন্ন্যাসীদের। মাধব সারারাত জেগেই ছিলেন। ভোরের দিকে কিছুটা সময় চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে।
পাখিটা মন্দিরের চাতালে ঘুরে ঘুরে ডাকছে।
মাধব উঠে পড়লেন। বেলা হয়ে গেছে দেখে তিনি টলোমলো পায়ে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে আশ্চর্য হলেন। দেখলেন তাঁর শিশুপুত্র লোচন উঠোনে একটা হাঁসের সঙ্গে খেলা করছে। হাঁসটাকে দৌড়ে ধরার চেষ্টা করছে।
মাধব অবাক হলেন। তা হলে কি তাঁর সন্তান সত্যি দেখতে পাচ্ছে?
এগিয়ে যেতেই শিশুপুত্র “বাবা!” বলে তার কাছে ছুটে এল, এ যাবৎ মাধব যা দেখেননি। মাধব বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নিয়ে দেখলেন পুত্র সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। তিনি মহানন্দে ছুটে গেলেন মন্দিরে। কিন্তু গর্ভগৃহে ঢুকে মহাকালের মূর্তির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন।
তাঁর আনন্দ মুহূর্তের মধ্যে বিষাদে পরিণত হল।
এ কী হল ভগবান! আমি তো এ রকম চাইনি...
আকুল হয়ে ভূমিতে মাথা কুটতে থাকলেন মাধব। বুঝতে পারলেন মহাকাল তাঁর নিজের চোখ দুটো পুত্রকে দান করে দিয়েছেন।
সেই থেকে মাধবের মনে সুখ নেই। তখন থেকেই লোকমুখে এই মহাকাল মন্দির ‘কানা শিবের মন্দির’ নামে পরিচিত হল।
যুগ যুগ ধরে মানুষ এই মন্দিরে পুজো দিতে আসে। মন্দিরে সামনে একটা প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ আছে, সেখানে মানত করে ভারা বেঁধে যায়। মনস্কামনা পূর্ণ হলে পুজো দিয়ে ভার মুক্ত করে। আগে বাংলাদেশ, অসম, ত্রিপুরা, বিহার থেকে প্রচুর ভক্তরা আসতেন। এখনও চড়কের সময়ে বর্ডার কিছুটা শিথিল করা হয়।
সীমান্তের পাঁচ গাঁয়ের মানুষগুলোর মনে চৈত্রের শেষ সপ্তাহ জুড়ে বানভাসি আনন্দের হিল্লোল। সারা বছর তারা এই দিনগুলোর জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে।
সোনাডাঙা এখন আর গ্রাম নয়। বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে একটু একটু করে তার গায়ে শহুরে ছোঁয়া লেগেছে। বৈভবের আভরণে সে মুড়ে ফেলেছে নিজেকে। জমির দাম আকাশছোঁয়া। বড় বড় দোকান-বাজারে কত লোকের আনাগোনা। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-দোকানপাট বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জমি মাফিয়ার দৌরাত্ম্য। আগের সোনাডাঙাকে এখন আর চেনাই যায় না।
দুলু বাছার এখানকার পরিচিত নাম। এক সময়ে সে নানা কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ওষুধ থেকে শুরু করে জাল নোট, সোনা, মাদক পাচার, এমনকি খুনের দায়েও পুলিশের খাতায় তার নাম ছিল। আজ তার অঙ্গুলিহেলনে গোটা শহর ওঠে-বসে।
কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করে ফেলেছে দুলু। সীমান্তের এই শহরগুলোয় টাকার খেলা চলে। যে যত বড় খেলুড়ে, তার তত টাকা। বহু দিন ধরেই দুলুর পাখির চোখ মহাকালের এই পোড়ো জীর্ণ মন্দির আর মন্দির সংলগ্ন প্রায় বিঘে খানেক জমি।
সকলেই জানে এটা দেবত্র সম্পত্তি।
পূজারি ব্রাহ্মণ যুগ যুগ ধরে এর মালিকানা ভোগ করে আসছেন। জমিটা ফাঁকাই পড়ে আছে। কিছু আম-কাঁঠাল, বেল-জাম-জামরুল ছাড়াও মেহগনি আর সেগুন গাছ আছে। চরণ ঘরের সামনে কিছুটা জমিতে শাক আর আনাজপাতি লাগায়। বাপ-বেটায় কোনও মতে চলে যায়।
বর্তমানে সোনাডাঙার এই প্রধান সড়কের ধারে এক কাঠা জমির দাম প্রায় কুড়ি লাখ। দুলুর হিসেবি মন। সে দেখেছে এই মন্দিরে আর তেমন কেউ আসে না। ওই চৈত্র মাস ছাড়া বাকি সময় ফাঁকাই থাকে।
জীর্ণ কুটিরে ছেলে চয়নকে নিয়ে চরণ থাকেন। চয়ন চরণের বৃদ্ধ বয়সের সন্তান। পুত্রের জন্ম আর মায়ের মৃত্যুর মাঝে এক ঘণ্টা সময়ের ব্যবধান। সময় তারিখ সব লেখা আছে চরণের খাতায়।
মলিনা সদ্যোজাতের ‘মা’ ডাক শুনে শুধু এক বার চোখ মেলে তাকিয়েছিল। এইটুকুই তার শান্তি।
ছেলেটাকে খুব কষ্টে মানুষ করছেন চরণ। লেখাপড়ায় সে খুব ভাল। শহরের স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। বই-খাতা দিয়ে মাস্টারমশাইরা খুব সাহায্য করেন। না হলে চরণের সামর্থ্য আর কতটুকু। ছেলের মুখ চেয়েই তাঁর বেঁচে থাকা।
চৈত্রের শেষ সপ্তাহ। লোকের বাড়ি বাড়ি তেল-সিঁদুর মাখা শিবের পাটা নিয়ে গাজন সন্ন্যাসীরা যায়। চাল-ডাল, ফল-মূল, টাকাপয়সা যা ওঠে, গুছিয়ে রাখে চড়ক সন্ন্যাসীরা।
শনিবার। চৈত্র মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি, সাঁকো ভাঙা নদীতে বারুণী স্নান করতে পুণ্যার্থী মানুষজন এসেছে দূর-দূরান্ত থেকে। এ বড় সুখের সময়। বড় আনন্দের দিন তাদের। চরণ জ্যোৎস্না-ভাসা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। বসন্তের বাতাস দামাল বালকের মতো কেমন ছুটে ছুটে খেলে বেড়াচ্ছে গোটা মাঠ জুড়ে।
তবে কিছু দিন ধরে একটা কোড়া পাখি ডেকে যায় বুকের ভিতরে, গুব গুব গুব...
চরণ শঙ্কিত হন। এমনই সঙ্কেত এসেছিল বৌটা মারা যাওয়ার সময়ে।
এসে গেল চড়ক উৎসব।
চয়ন মেলায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে।
চরণ মন্দিরে কাজ করছিলেন। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে তিনি চমকে ওঠেন। কেঁপে উঠল মন্দির। দুলে উঠল বিগ্রহ। মন্দিরের পিতলের ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং...
ছুটে বাইরে এলেন চরণ।
যা দেখলেন তাতে তিনি স্তম্ভিত হলেন। দেখলেন বালি বোঝাই ডাম্পার তার কুঁড়ে ঘরটাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে দ্রুত গতিতে পালাচ্ছে।
বাজারের লোকজন চিৎকার করে উঠল, “হায় হায়... গেল-গেল-গেল... ”
জীর্ণ ঘরের নীচে পিষ্ট হল চরণের বারো বছরের ছেলেটা। একটা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড। তাকে চেনার কোনও উপায় ছিল না।
আশপাশে যারা ছিল তারা রক্তলিপ্ত শরীরটা নিয়ে কোনও মতে ছুটল হাসপাতালে।
লরিটা দুলুর। এ কথা জানতে কারও বাকি রইল না। অনেকেই চিনত।
চরণ রক্তাপ্লুত শরীরটা জড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে। শুধু এক বার জনতার দিকে তাকিয়ে আর্তকণ্ঠে বললেন, “লোকে এত দিন বলত, তুমি অন্ধ। আমি মানতাম না ঠাকুর। আজ মানতে বাধ্য হলাম, তুমি অন্ধ, মহাকাল, তুমি অন্ধ... অন্ধ...অন্ধ...”
চরণের সেই বুকফাটা আর্তধ্বনি সে দিন কত দূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল কে জানে।
আজও যারা মহাকাল মন্দিরের পাশ দিয়ে গভীর রাতে চলাচল করে, শুনতে পায় চরণদাসের কান্না। গুমরে গুমরে কাঁদে মহাকাল মন্দিরের পুরোহিত চরণদাস।
এ কান্না আমৃত্যু বন্ধ হওয়ার নয়।
দুলু অনেক দানধ্যান করেছে এর পরে। হাসপাতালে রোগীদের জল খাওয়ার জন্যে ইলেকট্রিক ফিল্টার লাগিয়ে দিয়েছে, শনিমন্দির বানিয়েছে গোটা ছয়েক রাস্তার মোড়ে, স্কুলের বাচ্চাদের এ বছর পুরস্কার বাবদ বেশ কিছু টাকা দান করেছে স্কুল ফান্ডে। বাজারে একটা বত্রিশ পাইপের আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল বসিয়েছে।
এর পরও পেরিয়ে গেছে আরও অর্ধ যুগ।
সে দিন ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। এ বারে গাজন সন্ন্যাসীদের মন খারাপ। গত বছর থেকে মহাকাল মন্দিরের সামনের মাঠে গাজনের মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। মহাকাল মন্দির সংলগ্ন জমি আজ দুলুর দখলে। সেখানে বিশাল বিল্ডিং তৈরির কথাবার্তা চলছে। কেউ বলছে কর্পোরেট কোম্পানি হবে, কেউ বলছে হোটেল, কেউ বলছে সুপার মার্কেট কিংবা শপিং কমপ্লেক্স। থাকবে সিনেমা হলও।
দুলুই জানে কী হতে চলেছে।
মহাকাল মন্দিরটা এখনও আছে, সেটাও কিছু দিনের মধ্যে জায়গা বদল করে ফেলবে। দুলু চরণদাসকে নতুন মন্দিরের নকশা দেখিয়েছে। বলেছে, “তুমিই থাকবে নতুন মন্দিরের পুরোহিত। এই জীর্ণ মন্দির এই জায়গায় ঠিক মানাচ্ছে না। তোমাকে কাকা, মন্দিরের পাশে একটা পাকা ঘর বানিয়ে দেব।”
চরণ অগ্নিস্রাবী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল দুলুর দিকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে দুলুর মতো নৃশংস খুনিরও শরীর কেঁপে উঠেছিল।
আজকাল চরণদাসের ভিক্ষে করে দিন কাটে। কাঁদতে কাঁদতে সে অন্ধপ্রায়। জলশূন্য চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কে জানে কোন দিন মন্দিরটা গুঁড়িয়ে যাবে ডাম্পারের চাকায়।
পোড়ো মন্দিরের বাইরের দেওয়াল শেওলা আর আগাছায় ঢেকে গেছে। জায়গায় জায়গায় ইট পাথর খসে কঙ্কালসার চেহারা। চরণ কোনও মতে পুজোটুকু সারেন। সন্ধেবেলায় বাতি জ্বেলে আসেন। অশীতিপর বৃদ্ধের ক্ষমতা নেই উঠে গিয়ে সব জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেওয়ার।
আগামী কাল নববর্ষ। নদীর পাড়ে দুলুর নবনির্মিত হোটেলে আজ ঢালাও খানাপিনার আয়োজন। ইয়ারদোস্তদের নিয়ে বাবার মতো দুলুর ছেলেও মস্তিতে মজেছে।
দূরে মাঠের ভিতরে একটা ফাঁকা জায়গায় গাজন সন্ন্যাসীরা তাঁদের ব্রত উদ্যাপন করলেন। সকলেই মনমরা হয়ে নিয়মরক্ষা করেছেন মাত্র। সে সব এত ক্ষণে মিটে গেছে। গ্রামের মানুষ মেলা সেরে ঘরে ফিরছে। বিক্রেতারা মালপত্র গোছগাছ করে এখন ঘরমুখী।
ছেলের সামনে পরীক্ষা। তাই দুলু প্রায় জোর করে ছেলেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। এবারে পুজোয় ছেলেকে দুলু খুব দামি একটা কোরিয়ান গাড়ি উপহার দিয়েছে। ছেলে বেজায় খুশি। সে আজ বন্ধুদের নিয়ে দারুণ মস্তি করল। দামি স্কচ কয়েক পেগ সাবাড় করেছে। এখন মাথাটা বেশ হাল্কা লাগছে। শরীর পাখির মতো। রিমোট টিপে লক খুলে গিয়ারে পা রাখল ছেলেটা। মৃদু মসৃণ ভাবে স্টার্ট নিল গাড়ি। মনের আনন্দে পায়ের চাপে অ্যাকসিলারেটর মাটিতে মিশিয়ে দিল ছেলেটা।
দুলু যখন জলি সামন্তর সঙ্গে বসে মন্দির-সংলগ্ন জমির ডিল ফাইনাল করছে, এগ্রিমেন্ট পেপার তৈরির কথাবার্তা বলছে, তখন খবরটা এল।
খবর পেয়ে ছুটে গেছে দুলু। হাসপাতাল চত্বর লোকে লোকারণ্য। ভিড় সরিয়ে টলোমলো পায়ে দুলু এমার্জেন্সিতে ঢুকে চমকে ওঠে।
ঘোর লাগা চোখে দেখে উঁচু ট্রলিতে রাখা আছে একটা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না দুলু। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল রক্তে মাখামাখি সেই শরীরটা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনা গেল ঘটনাটা। বেপরোয়া গাড়িটা সজোরে ধাক্কা মারে মহাকাল মন্দিরের অশ্বত্থ গাছটার গায়ে। গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। চালকের আসনে বসা ছেলের শরীর বনেটের ভিতরে ঢুকে গেছে। গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে তবে বডি বের করতে হয়েছে।
বীভৎস দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছে সকলে।
উন্মত্ত দুলু এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে গেছে মহাকাল মন্দিরে।
পোড়ো মন্দিরের সামনে বসে চরণদাস তখন তাকিয়েছিলেন দূর আকাশের দিকে। খুঁজে চলেছেন ছেলেকে। হাজার নক্ষত্রের ভিড়ে। বিড় বিড় করছেন আপন মনে, “কোথায় চলে গেলে বাপ আমার? কেমন আছ তুমি!”
দুলু ছুটতে ছুটতে এসে চরণের পা দুটো জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে ওঠে, “তোমার পা দুটো আমার মাথায় তুলে দাও চরণকাকা। আমি লোভে অন্ধ হয়ে গেছিলাম, তোমার বুক থেকে সে দিন তোমার ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম। আর সবার মতোই ভেবেছিলাম মহাকাল অন্ধ... বুঝতে পারিনি গো কাকা, পারলে আমায় ক্ষমা করে দিয়ো...এ আমারই পাপ... আমার জন্যই ছেলেটা আজ...”
নিশ্চল পাথরের মতো বসে থাকেন চরণদাস।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)