Advertisement
E-Paper

আগুনের ভয়গান গাই...

আমি পুড়লে আপনিও কি বাঁচবেন? দেবাশিস ভট্টাচার্য আমি পুড়লে আপনিও কি বাঁচবেন? দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

আমি পেয়েছি। আপনিও পেয়েছেন। যদি না পেয়ে থাকেন, মুঠোয় ধরা স্মার্টফোনের ফেসবুক বা হোয়াটস্অ্যাপ পেজ খুলে একবার ভাল করে চোখ বোলান। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন তাদের।

ওরা আপনাকে জানাবে, কোথায়, কোন গ্রামে, কোন মহল্লায় রাম-রহিমে দাঙ্গা বেধেছে। আপনি জানতে পারবেন, রহিমের দলবল ‘বেচারা’ রামবাবুদের পাড়ায় ঢুকে কী অত্যাচারই না করছে! পিটিয়ে মারছে জোয়ান ছেলেটাকে! আপনার চোখের সামনে ভিডিয়ো ক্লিপিংগুলিতে নড়াচড়া করবে মা-বোনেদের সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দৃশ্য। দুষ্কর্মকারীদের পোশাক-আশাক, দাড়ি-গোঁফ আমাদের ভীষণ চেনা (উল্টোটাও পাবেন, তবে তুলনায় কম)।

এ সব দেখে যদি আপনার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, অসুরদলনী দুর্গার ন্যায় মুখমণ্ডল রক্তজবাবর্ণ ধারণ করে, রাবণ বিনাশে উদ্যত অযোধ্যাকুলতিলকের মতো তেজ বিকীর্ণ হতে থাকে— তবে জানবেন, ওদের ‘উদ্দেশ্য’ সফল। লক্ষ্যভেদী বাণে ওরা আপনাকে গেঁথে ফেলেছে। এ বার আপনি এবং আপনারা অন্ধ ক্রোধে রে-রে করে নেমে পড়তে পারেন পাড়ায় পাড়ায়। বদলা নিতে হবে তো! সেই বদলায় আরও কিছু প্রাণ যেতে পারে। যাক। আরও দু-চারশো ঘরবাড়ি ধ্বংস হতে পারে। হোক। বিষবৃক্ষ আরও ঝাঁকড়া হয়ে উঠে ডালপালা ছড়াতে পারে। ছড়াক। আমাদের মনের গভীর অন্ধকারে ওত পেতে থাকা আততায়ীরা তো সেটাই চায়!

আর যদি আপনি নিতান্তই ভিতু সম্প্রদায়ের হন অথবা গা বাঁচিয়ে চলা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোত্রের, রাস্তায় নেমে বদলা নেওয়ার হিম্মত যদি আপনার না থাকে, তবুও এই ক্লাবে আপনি স্বাগত। কারণ আপনার জন্য ‘প্ল্যান বি’ তৈরি। ঘরে বসেই ওই সব ফেসবুক, টুইটারের ছবি ও লেখা আরও অনেককে শেয়ার করে আপনি উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালতে পারেন।

এতক্ষণ যা বলা হল, তার সঙ্গে কেউ সমসাময়িক ঘটনাবলির মিল খুঁজে পেলে তাঁর মোবাইলে বুড়ো আঙুল তোলা ‘ইমোজি’ পাঠিয়ে বলব, কেয়া বাত! আসলে এমন একটা সময় এসেছে, যখন সোজা কথা সোজা বলাই ভাল। শব্দ এবং ছবির শক্তি বড় ভয়ঙ্কর। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার বিস্ফোরণ আরও মারাত্মক। সেটা জেনেবুঝেই এই আগুন নিয়ে খেলা। খেলোয়াড় যাঁরা, তাঁদের অনেকের গলায় আবার নেতার চাদর!

গুজব জিনিসটা অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ মুখরোচক। বিশেষ করে বাঙালি আবার গুজবপ্রিয়। চানাচুরের মতো কুড়মুড়িয়ে গুজব খায়। অন্যের দিকে একমুঠো এগিয়ে দিতেও কার্পণ্য করে না। এভাবেই গণ-হিস্টিরিয়া ছড়িয়ে গণেশকে দুধ খাওয়ানো হয়েছে। এখনও মাঝে মাঝে কোথাও না কোথাও গাছের ডালে, পুকুরের জলে, মন্দিরের চাতালে দেবদেবীদের ‘সাক্ষাৎ আবির্ভাব’ ঘটে। লোক কাতারে কাতারে ছুটে যায়। পথে মেলা বসে। প্রণামীর ভাণ্ড উপচে পড়ে। এক বার তো দুর্গাপুজোর নবমীর রাতে কলকাতার এক প্যান্ডেলে মূর্তির চোখ দিয়ে জলের ধারা বয়েছিল। সেই বার্তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। আজ সেখানে স্থায়ী মন্দির। এই শহরেই আর এক পাড়ায় গলির মধ্যে গাছের তলায় শিবের উত্থান হয়েছিল। মন্দির তৈরি হয়ে গিয়েছে সেখানেও।

উৎস গুজবে হলেও শেষ পর্যন্ত এগুলি সবই বিশ্বাসে পরিণত হয়। যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞান— সব সেখানে তুচ্ছ এবং অপ্রাসঙ্গিক। ভক্তি-স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তখন প্রায় অসম্ভব। তবু বলতেই হবে, এই সব গুজব আপাতভাবে নির্বিষ। এতে সমাজ-সংসার-দেশ-দশের জীবন বিপন্ন হয় না। কেউ গাছকে দেবতা মানতে পারেন-না পারেন, দুর্গার চোখের জলকে কেউ কারসাজি বলতে পারেন-না পারেন— তাতে অন্য কারও বেঁচে থাকার অধিকারে টান পড়ে না। পড়েওনি এত দিন। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা ভয়ানক। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তা বিষ-ইনজেকশনের মতো আমাদের রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার বিরুদ্ধে আমি, আমার বিরুদ্ধে অন্য কেউ লাঠি, কাটারি, ছুরি, বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছি, যেন খ্যাপা ষাঁড়। কৌশল একই। গুজবকে বিশ্বাসে পরিণত করা।

ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময়ও এমন অনেক চেষ্টা হয়েছিল। কিছু লোক গুজব, অসত্য এবং অর্ধসত্যে বিশ্বাস করে উন্মত্ত হানাহানিতে মেতে উঠেছিল। যুক্তির ধার ধারেনি। কোথাও আবার গুজবের আগুনে গা গরম করে বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার খেলাও হয়েছে। প্রবীণদের কাছে শুনেছি, হঠাৎ এক দিন রটনা হল যে এক দল লোক হ্যারিসন রোডের দিক থেকে দু’পাশে লোকের মাথা কাটতে কাটতে চিৎপুরের রাস্তা ধরে বাগবাজারের দিকে ধেয়ে আসছে। অতএব লাঠিসোঁটা, দা-কাটারি হাতের কাছে যার যা ছিল, তা নিয়ে পিলপিল করে পথে নেমে পড়ল লোকজন। ভাবখানা হল, এলেই পাল্টা......। বেশ দু-চার ঘণ্টা কাটল। কিন্তু কোথায়? কেউ তো মাথা কাটতে কাটতে এগিয়ে আসছে না! বর্ধমান শহরে একটি পাড়ার বয়স্ক বাসিন্দাদের স্মৃতিতে আছে, ছাদে বালতি, গামলায় ফুটন্ত গরম জল ভরে নিয়ে রাতপাহারা দেওয়া হত তখন। যাতে দাঙ্গাবাজেরা এলেই ওপর থেকে তাদের মাথায় সেই জল ঢেলে দেওয়া যায়! এমন উদাহরণ নিশ্চয়ই আরও ছিল। আর বাস্তবে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বলে চিহ্নিত ছেচল্লিশের সেই দাঙ্গা যে কী মর্মান্তিক আকার নিয়েছিল, তা ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়।

কিন্তু সেই সব ভয়াবহ স্মৃতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আমাদের রাজ্য তিলতিল করে সম্প্রীতির ঐতিহ্য তৈরি করেছে। এখানে রাজনৈতিক হানাহানি আছে, তোলাবাজি-মস্তানি আছে, সিন্ডিকেট রাজ আছে, ঘুষ আছে, দুর্নীতি আছে। তবু সাম্প্রদায়িকতাকে পশ্চিমবঙ্গ মাথা তুলতে দেয়নি। অযোধ্যা কাণ্ডের পরেও আগুন বাড়তে দেয়নি এই রাজ্যের মানুষ। সহসা সব কেমন যেন বদলে যেতে বসেছে। অন্য রকম ভুজুং দিচ্ছে অন্য রকম হাওয়া!

রাজনীতি? ক্ষমতার লড়াই? মারি অরি পারি যে কৌশলে? তাই কি ফেসবুকে, টুইটারে ভূরি ভূরি মিথ্যের পসরা সাজিয়ে বসা? খোলাখুলি কদর্য সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি? আগুন না নিভিয়ে তাকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া?

কিছু দিন আগে শুরু হয়েছিল ধূলাগড় দিয়ে। এ বার বসিরহাট তাতে আরও বড় উপাদান হল। কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পরে তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ধরনের প্রচার এবং গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তার চরিত্র ছেচল্লিশের দাঙ্গার চেয়ে খুব আলাদা কি? সেই সময় প্রচারের প্রাবল্য ছিল সীমিত। যোগাযোগের উপায় ছিল কম। এখন পৃথিবী হাতের মুঠোয়। আগুন জ্বালানোর সুযোগ বেশি। ভিন্ দেশের ছবি সাজিয়ে এখানকার দৃশ্য বলে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য ঘটনা এখন সহজেই দেখানো যায়। যেমন দেখালেন এক ‘দায়িত্ববান’ রাজনৈতিক পদাধিকারী। জনৈক রাজ্যপালের টুইটে নিন্দনীয় সাম্প্রদায়িক উস্কানিও অবলীলায় প্রচার পেয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির সক্রিয় কারবারিরাও কেউ কেউ ভুয়ো টুইটার মেসেজ ছড়িয়ে বাজার গরম করছেন। এমন আরও কত কী! কারণ সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জন্য খুলে দিয়েছে বাধাবন্ধহীন যথেচ্ছাচারের সিংহদুয়ার! কেউ কারও ধার ধারে না আর। তাই মুছে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণরেখা। আইন, সংবিধান, দায়িত্ববোধ লজ্জায় মুখ লুকনোর জায়গা পাবে?

এই লেখা শুরু হয়েছিল গুজব নিয়ে। শেষেও সেই গুজবের কথা। যা নয়, তাকে ‘হয়’ বলে চালানোর নোংরা রাজনীতি। ঘটনাচক্রে সোশ্যাল মিডিয়া সেই চক্রান্তের বাহক। শুভবুদ্ধি সমাচ্ছন্ন, চারপাশে গুপ্ত কুমন্ত্রণা। কে কাকে লাগাম পরাবে?

অতএব আসুন, আমরা আগুন-আগুন খেলি। প্রশ্ন একটাই, আমি পুড়লে আপনিও কি রেহাই পাবেন?

Social Media Facebook WhatsApp Riot Communal Clash ফেসবুক হোয়াটস্অ্যাপ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy