Advertisement
E-Paper

লাদাখ থেকে অরুণাচল পায়ে হেঁটেছিলেন তিনি

৪৩ বছর আগের সেই দুঃসাহসিক অভিযানে বিদ্যুৎ সরকার ট্রেক করেছিলেন ৪০০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ। স্বীকৃতি, প্রচার পাননি, সে আকাঙ্ক্ষাও ছিল না। পাহাড়ই ছিল ভালবাসা।হিমালয়কে নিজের মতো করে জানতে ১৯৭৬ সালে লাদাখ থেকে সুদূর অরুণাচল অবধি সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন।

পীযূষ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১
বিস্মৃত: বিদ্যুৎ সরকার। আত্মজনের ‘ছোড়দা’

বিস্মৃত: বিদ্যুৎ সরকার। আত্মজনের ‘ছোড়দা’

মৃত্যুর কয়েক মাস আগের কথা। বেহালার পর্ণশ্রীর স্যাঁতসেঁতে ভাড়াবাড়ির এক চিলতে ঘরের আবছা আলোয় খাটিয়ায় ঘুমিয়ে আছেন এক উপেক্ষিত কিংবদন্তি। সত্তর বছরের বিদ্যুৎ সরকার ‘ছোড়দা’ বলেই পরিচিত। ক্ষয়ে যাওয়া শরীরে হাড়গুলো বিবর্ণ চামড়ায় মোড়া। জীবনের শেষ প্রান্তে সঙ্গী স্মৃতিভ্রংশ, অশক্ত শরীর, নির্বান্ধব দিনরাত্রি। দায়িত্ব নেওয়ার বিপদ বুঝে ‘ঘনিষ্ঠ’রা সটকে পড়েছে। ঘুমই একমাত্র সঙ্গী। ভুলে যাওয়া ছাড়া ছোড়দার জীবনে নতুন কিছু ছিল না। পঞ্চাশ বছরের বন্ধুতা, তবু আমাকেও চিনতে পারলেন না। ডিমেনশিয়া। প্রশ্ন করলাম, ‘‘হিমালয়ে যাবে?’’ নির্বাক দু’চোখে শূন্য দৃষ্টি। কাঁপা গলায় উল্টে প্রশ্ন করলেন, ‘‘হিমালয় কোথায়?’’ যে পাইন-দেবদার-ওক গাছের সঙ্গে যাঁর সখ্য, মেরু-তরাই এর সঙ্গে যাঁর দহরম-মহরম, তারা আজ অনাত্মীয়, বিস্মৃত। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘মনে পড়ে তোমার সোলো ট্রান্স-হিমালয় ট্রেকিং এক্সপিডিশনের কথা?’’ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। বড় মর্মস্পর্শী সেই চাহনি।

হিমালয়কে নিজের মতো করে জানতে ১৯৭৬ সালে লাদাখ থেকে সুদূর অরুণাচল অবধি সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন। সহায়-সম্বলহীন, একা। এমন কৃতি পৃথিবীতে প্রথম কেউ সম্পন্ন করল। নিজের সেই মহাকাব্যিক কীর্তিও কি ভুলে গিয়েছেন তিনি?

১৯৭৫-এ স্বপ্ন দেখা শুরু, পরের বছর বেরিয়ে পড়া। কল্পনাতেও কেউ ভাবেনি, সাহসে কুলোয়নি কারও। যে স্বপ্ন দেখে না, সে মৃত, এই বিশ্বাস ছিল ছোড়দার। কিন্তু এ যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! অচেনা প্রকৃতি, হিমবাহ, গিরিপথ, খর নদীর ঝুঁকি। বৃষ্টি, পাথর, কাদামাটির বিভীষিকা। বন্যজন্তুর ভয়। ছোড়দা কিন্তু ভয় পাননি। এমনই ছিল বুকের পাটা। একা এক মানুষ হিমালয় চষে ফিরে এলেন দীর্ঘ ন’মাসে। তখন সামান্য হইচই হয়েছিল। পরে এই কৃতিত্ব নিয়ে আর কেউ গলা ফাটায়নি। বছর দশেক আগে রাজীব মণ্ডল ছোড়দার জুতোয় পা গলিয়ে একই পথের পথিক হয়। তারও অনেক আগে ১৯৭৯-ও গাঁধীবাদী সমাজকর্মী সুন্দরলাল বহুগুনা পশ্চিম হিমালয় জুড়ে জঙ্গল ধ্বংসের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে পদব্রজে রওনা হন। ১৯৮২ সালে পিটার হিলারি ও গ্রেম ডিঙ্গল ও পরে বাচেন্দ্রি পাল সরকারি আনুকূল্যে ছোড়দার ফেলে আসা পথে হিমালয়ে পাড়ি দেন। ইতিহাসে, ইউটিউব আর গুগল জুড়ে এঁদের নাম থাকলেও পরিব্রাজক ছোড়দা ব্রাত্য!

ছোড়দা বাঁচতে জানতেন। পাহাড়-পাহাড় খেলা ছাড়াও তাঁর ছিল এক বর্ণময় জীবন। আজীবন হিমালয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর সভ্য ছোড়দার ডালপালা ছড়িয়ে ছিল বহু ক্লাবে। আজকাল বিভিন্ন ক্লাবের তত্ত্বাবধানে বাচ্চাদের হাতে-কলমে প্রকৃতিপাঠ শেখানোর আসর বসে। ছোড়দা এর পথিকৃৎ, তাঁর হাত ধরেই অযোধ্যা পাহাড়ে এ জিনিস শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকে। বাচ্চাদের উদ্বুদ্ধ করতেন; বলতেন, প্রকৃতিই আসল মা। ইচ্ছে ছিল, বাচ্চাদের জন্য ‘স্কুল অব নেচার স্টাডি’ ইন্সটিটিউট বানানোর। হল না, এ কাজে সঙ্গী তেমন কাউকে না পাওয়ায়। নব্বইয়ের দশকে ফি বছর সিকিমের জোংরিতে ট্রেকে যেতেন দৃষ্টিহীন মানুষেরা। উদ্যোক্তা ‘সোসাইটি ফর দ্য ভিসুয়ালি হান্ডিক্যাপড’, কিন্তু কান্ডারি ছোড়দা। জোংরির কঠিন চড়াইপথে ট্রেকারদের বুকে আগলে পরিচয় করাতেন প্রকৃতির সঙ্গে।

পর্বতারোহণের বেসিক, অ্যাডভান্সড কোর্স করা সত্ত্বেও ‘সেলেব্রিটি’ পর্বতারোহী হওয়ার উচ্চাশা ছিল না তাঁর। তবুও উজা তিরচে, বোম্বাধুরা, খরচাকুন্ড, মাইকতলি অভিযানে নিজের জাত চেনালেন। সে সময় মাইকতলি অভিযানের পরে শেরপা বা পোর্টার ছাড়া অ্যালপাইন স্টাইলে পর্বতারোহণের জোর হাওয়া উঠেছিল, যার প্রবর্তক ছোড়দা। এখনকার দড়ি ধরে অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিহীন পর্বতারোহণের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী প্রবণতা অ্যালপাইন স্টাইল। ১৯৮২-তে কাব্রু ডোমে প্রাক-এভারেস্ট অভিযানে বেপরোয়া ইঁদুরদৌড়ে সামিল না হয়ে জীবনের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে অসুস্থ সহযাত্রীকে নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেওয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল ওঁর কাছে। ছোড়দার তাই কাব্রুতে চড়া হল না। এভারেস্ট অভিযানে বাতিল। ঘনিষ্ঠ সহযাত্রীরা বলতেন, দড়ি ছাড়াই ওঁর এভারেস্টে ওঠার হিম্মত ছিল। কোনও দেখনদারি নেই, বিখ্যাত হওয়ার কাঙালপনা নেই। ছিল ফকিরি, সাধুসুলভ চালচলন।

বেহালার পর্ণশ্রীর চিলতে ঘরই ওঁর ডেরা ছিল। একাকিত্ব পেয়ে বসেছিল ছোড়দাকে। মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে বেখেয়ালে কোথায় হারিয়ে যেতেন। হিমালয়ের প্রতিটি ঘাসের সঙ্গে যাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল, সেই মানুষ বাড়ির বাইরে গেলেই যেন গোলকধাঁধায় পড়তেন।

এমন নয় যে ছোড়দা আর্থিক ভাবে দেউলিয়া ছিলেন। রাজ্য সরকারি কর্মী হওয়ার সুবাদে প্রাপ্য পেনশনে জীবন কেটে যেত। কিন্তু পার্থিব সম্পদ উপভোগের প্রতি ছিল তাঁর অনাসক্তি।

গত ১৭ জানুয়ারি ছোড়দা চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। শেষের দিনগুলো কেটেছে কল্যাণীর এক বৃদ্ধাশ্রমে। সারা জীবন ধরে যে প্রকৃতির টানে বেরিয়ে পড়েছেন থেকে থেকেই, অন্তিমকালে তাঁরই জীবন ছিল ঘরবন্দি। বাঙালি পর্বতারোহী অভিযাত্রীরা যখন সরকারি-বেসরকারি স্বীকৃতি ও আনুকূল্যের রোশনাইয়ে উজ্জ্বল, ছোড়দা তখন ছিলেন নীরব, উদাসীন। নবীন প্রজন্ম ছোড়দাকে চেনে না। হয়তো তারা ভবিষ্যতে ইতিহাসে পড়বে তাঁর হিমালয়কে ভালবাসার গল্প, যদি সেই ইতিহাস আদৌ লেখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম প্রকৃত দুঃসাহসিক অভিযানের পতাকা উড়েছিল ছোড়দার ‘সোলো ট্রান্স-হিমালয় ট্রেকিং এক্সপিডিশন’ দিয়েই, এই সত্য মুছবে না কোনও কিছুতেই।

Bidyut Sarkar Arunachal Pradesh Ladakh Expedition
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy