আমাদের হস্টেলের ছেলেদের ‘উঠল বাই তো সিনেমা যাই।’ সে দিন ‘কিক’ দেখতে যাওয়ার হুজুগ উঠেছিল। কিছু ক্ষণ পরেই নাইট শো, যদিও হলটা কাছেই। অনেকেই বলল, ‘ভাইজানের সিনেমা, টিকিট পাবি না।’ হল-এ হাজির হয়ে দেখি সত্যিই, কাউন্টারে ফুল ফুটেছে, ‘হাউসফুল’! আগে ‘হাউসফুল’ লেখা ইলেকট্রিক বোর্ড ছিল, লাল লাইট জ্বলত। এখন বহু দিন ব্যবহার না হয়ে, খারাপ হয়ে গেছে, তাই লাল আলতা দিয়ে লেখা হাউসফুলের বোর্ড। চলে আসছি, হঠাৎ দেখি এক জন দাঁড়িয়ে। চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি। গাঁজারু যেমন সহজ চোখের ইশারায় বুঝে নেয় কার সাইডব্যাগে জিনিস আছে! লোকটা হলে ঢোকার মুখে একটা কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল দেওয়ালে হেলান দিয়ে। ওর কাছ থেকে রিয়ার স্টলের দশটা টিকিট জোগাড় হয়ে গেল, চল্লিশের টিকিট আশি। লোকটার মুখ থেকে ভকভক করে বাংলা মদের গন্ধ বেরচ্ছে, অতিরিক্ত হলদেটে চোখ, ক্ষয়াটে চেহারা, এন্তার বিড়ি ফুঁকে তুবড়ে যাওয়া গাল। হস্টেলে ফিরে বুক ফুলিয়ে বললাম, ‘ব্ল্যাকে টিকিট কেটেছি, বুঝলি?’ কেউ তেমন পাত্তা দিল না। ‘টরেন্টে নামিয়ে নেব’ বা ‘কয়েক দিন পর ফাঁকায় দেখে নেব’ গোছের উত্তর দিয়ে দরজা টেনে দিল।
ত্রিশ-চল্লিশ বছর পিছিয়ে গেলে সময়টা অন্য রকম ছিল। তখন মানুষ সিনেমা দেখত না, বই দেখত, বলা উচিত গিলত। হলগুলো চলত রমরমিয়ে। সঙ্গে ছিল ব্ল্যাকারদের দাপট । প্রথম কয়েক দিন সাধারণ মানুষ এমনি টিকিটে দেখতেই পেত না, সব ব্ল্যাক! হলগুলোয় ছিল বাঁধাধরা ব্ল্যাকার। হলমালিকরাই ওদের হাতে বেশির ভাগ টিকিট তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রাখতেন । সিনেমা হিট না ফ্লপ, তা ঠিক করার লিটমাস পেপার ছিল এই ব্ল্যাকের টিকিটগুলি। ব্ল্যাকার আবার দু’রকম হত। প্রফেশনাল আর অকেশনাল। আমি আর আমার বান্ধবী ধর্মতলার একটি হলে ‘ওম শান্তি ওম’ ছবিটা প্রথম দিনেই দেখতে গিয়ে ব্ল্যাকে টিকিট কিনেছিলাম। যার থেকে ষাট টাকার টিকিট একশো কুড়িতে পেয়েছিলাম, তিনি ছিলেন আমার জীবনে দেখা একমাত্র মহিলা ব্ল্যাকার, হয়তো অকেশনাল। পরে এই মহিলাকে দেখেছিলাম, ‘ রিগাল’ হলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে, পথচলতি কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করতে, ‘দাদা, মেয়ে লাগবে?’ অকেশনাল ব্ল্যাকারদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কাউন্টার থেকে চেনা ব্ল্যাকার ছাড়া বেশি টিকিট দিতে চায় না। হলের সামনে কাজ করাও চাপ। পুলিশ ঝামেলা করবে, নইলে কোনও প্রফেশনাল এসে অকেশনালের কলার চেপে ধরবে। কাজেই হল থেকে একটু দূরে, চারটে কেনা টিকিটের একটা নিজের জন্য রেখে, বাকি তিনটে বেচে দাও। নিজের টিকিটের দামও উঠে এল, সঙ্গে উপরি কিছু পয়সা।
মন্টুর সঙ্গে প্রেম ছিল শম্পার। উত্তর কলকাতার একটি হলে মন্টু বাঁধাধরা ব্ল্যাকার, এক ডাকে সবাই চেনে। বেলবটম প্যান্ট, কান-ঢাকা চুল, হিপ পকেটে রামপুরি চাকুর মতন দেখতে লম্বা চিরুনির বাঁট, রেলাই আলাদা। ক্লাস সেভেন অবধি পড়লেও ইনকাম মন্দ নয়। বাড়ি থেকে পালিয়ে শম্পা ঘর বাঁধল ওর সঙ্গে। কিন্তু, হাতে কাঁচা টাকা এলে, তা সব সময় পাকা হয় না। পাতাখোর মন্টু সংসার সামলাতে পারল না। শম্পা ভেগে পড়ল অন্য কারও সঙ্গে। তার পর এক দিন নেশার ঘোরে রাস্তা পেরোতে গিয়ে, মন্টু ট্রাকের নীচে। নব্বই দশকের মাঝখান থেকে টিকিট ব্ল্যাকে রিসেশন শুরু হয়, যা কখনও থামেনি। কেউ সামলে নিয়েছে নিজেকে, বেশির ভাগই পারেনি। কমল এই লাইনে থেকে ভালই কামাত, বউ ঝিগিরি করত। রেললাইনের ধারে বস্তিতে টালির ঘর, সেখানে বচ্চনের ছবি, যার সামনে নিয়ম করে ধূপ দেখাত কমল। ব্ল্যাকের ধান্দায় মন্দা শুরু হওয়ার পরও সে অন্য কিছু করেনি। সারা দিন হলেই পড়ে থাকত, রাত হলে বাংলার ঠেকে। ধারদেনা করেছিল বিস্তর, তার পর এক দিন রেলে মাথা।
অনেকে অবশ্য অন্য কারবারও করত। মোটা পঞ্চু যে হলে ব্ল্যাক করত, তার কাছেই একটা পান-বিড়ির দোকান দিয়েছে, মন্দ চলছে না, সঙ্গে দালালিও। অনেকেই বাস কন্ডাক্টর হয়েছে, সবজি বিক্রি করছে, কিংবা সিজন অনুযায়ী ঠেলাগাড়িতে আম অথবা পেয়ারা। এই যেমন খোকাদা বাজার বিক্রি করে সংসারটা মোটামুটি দাঁড় করিয়েছেন। আগের বছর ইদের দিনে বউ-ছেলে-মেয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে টিকিট পাননি। টিকিট কিনেছিলেন এক বয়স্ক ব্ল্যাকারের কাছ থেকে। দুজনেই দুজনকে মোটামুটি চিনতেন, কিন্তু কেউ কথা বলেননি কারও সঙ্গে, ওঠেনি চেনা মুখের জন্য ডিসকাউন্টের প্রসঙ্গও।
আমাদের ক্যাম্পাসের পেছনে করিমদার চায়ের দোকান। বিকেলের দিকে রোজই কয়েক জন আড্ডা দিতে যাই। এক দিন আশির দশকের সিনেমা নিয়ে গপ্পো জমেছিল। কে এক জন বলে বসল, ‘গ্রেফতার’ সিনেমাটা তেমন চলেনি। করিমদা চা করা ফেলে হেঁকে উঠলেন, কে বলল তোমায়? ‘অনন্যা’ হল-এ যখন গ্রেফতার এসেছিল, প্রায় গুলি চলার অবস্থা। আমরা তখন হেবি ব্ল্যাক করেছি। জানতাম না করিমদা টিকিট ব্ল্যাক করত যুবক বয়সে। তার পর শুনলাম, তখনকার দিনে কিছু কলেজের ছাত্রও ব্ল্যাক করত পকেটমানির জন্য। করিমদাও এই লাইনে নেমেছিল, তবে প্রফেশনাল নয়। ‘বই দেখতে খুব ভালবাসতাম, বুঝলে। তার পর এক দিন তিনটে টিকিট কিনে ব্ল্যাক করে দিলাম, সেই পয়সায় জীবনের প্রথম মোগলাই পরোটা হয়ে গেল। তার পর সুযোগ পেলেই কিছু টিকিট জোগাড় করে হল থেকে একটু দূরে ধান্দা জমিয়ে দিতাম। পুলিশের লাঠিও খেয়েছি। তখন জমানা ছিল অন্য রকম। সিনেমা চলত পঁচিশ সপ্তাহ! এখন পঁচিশ দিন দুরে থাক, পঁচিশ ঘণ্টাও চলে না। মাঝে মাঝে মন খারাপ করলে, অনন্যা হল-এর ওখানে চলে যাই। দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি খাই।’ করিমদার চোখ ছলছল করছিল। অনন্যা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। একটা ভাঙা হল আর তার সামনে এক প্রাক্তন ব্ল্যাকার, দিব্যি ছবিটা ভেসে উঠল মনের স্ক্রিনে।
sumansarkar21@gmail.com