Advertisement
E-Paper

জঙ্গলে টানা সাতাশ বছর একা কাটিয়ে ফিরলেন ইনি

স্বপ্ন নয়, শূন্য নয়, ভালবাসা নয়। ক্রিস্টোফার নাইটের মাথার ভিতরে তখন কাজ করছিল অন্য বোধ। গাড়িটাকে পথের প্রান্তে রেখে সভ্যতাকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে গেলেন জঙ্গলে। পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়স্বপ্ন নয়, শূন্য নয়, ভালবাসা নয়। ক্রিস্টোফার নাইটের মাথার ভিতরে তখন কাজ করছিল অন্য বোধ। গাড়িটাকে পথের প্রান্তে রেখে সভ্যতাকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে গেলেন জঙ্গলে। পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ১০:৩০
বন্দি: জঙ্গল ছেড়ে এ বার পুলিশের হাতে ক্রিস্টোফার নাইট

বন্দি: জঙ্গল ছেড়ে এ বার পুলিশের হাতে ক্রিস্টোফার নাইট

আর এক জন রিপ ভ্যান উইংকল মোটেও নন ক্রিস্টোফার নাইট। মিল বলতে, দুজনেই কুড়ি বছরের বেশি সময় পৃথিবীর চোখে স্রেফ ‘নেই’ হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। ব্যস। নাইট ঘর ছেড়েছিলেন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয়। নির্জনে সঙ্গীহীন হলে জীবন কাটাবেন বলেই। ওই জেদেই তো জঙ্গলের গভীরে ২৭টা বছর কাটিয়ে দিলেন তিনি। একদম একলা হয়ে।

কতই বা বয়স তখন তাঁর? সবে কুড়ি পার হয়েছে। ঠিক সেই সময়ই উধাও হলেন তিনি। ঘরের প্রিয় কোণ, মোটা মাইনের চাকরি, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, প্রেম, যৌনতা— এক কুড়ি-বছুরের জীবনে যা কিছু দেখতে অভ্যস্ত মানুষ, সবটুকু পিছনে ফেলে সুতো ছিঁড়ে ভোলা চললেন জঙ্গলে। একা। ঝোলায় রইল সামান্য জিনিস আর সঙ্গী হল গাড়িটা। এক দিন-দু’দিনের জন্য নয়, বছরখানেকের জন্যও নয়। ২০১৩ সালে পুলিশের হাতে যখন ধরা পড়লেন, তখন কেটে গেছে সাতাশটা বছর। যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের দিকে গুটিগুটি এগোচ্ছে জীবন। অত দিন ধরে জঙ্গলের গভীরে তিনি পরিপাটি সংসার করেছেন, ঘুমিয়েছেন, খেয়েছেন, চান করেছেন। এমনকী চুরিও করেছেন। কিন্তু সবটাই মানুষজনকে এ়ড়িয়ে।

আদতে তিনি মার্কিন মুলুকের মেইনে-র বাসিন্দা। পরে কাজের সূত্রে আসেন বস্টন। সেখানে বাড়ি আর গাড়িতে অ্যালার্ম বসানোর কাজ করতেন। বছরখানেকও অবশ্য ঘুরল না। কোনও নোটিস ছাড়াই দুম করে কাজটা ছেড়ে দিলেন। বেতনের শেষ চেকটা ভাঙিয়ে টাকা তুলে শহর ছাড়লেন। নিজের পরিবার, সহকর্মী— কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়েই। আমেরিকায় তখন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন-এর জমানা। সদ্য পরমাণু বিপর্যয় ঘটেছে রাশিয়ার চেরনোবিল-এ। সে সব পিছনে ফেলে নাইট-এর গাড়ি চলল আমেরিকার পূর্ব উপকূল ধরে।

কেমন ছিল তাঁর সেই অজানা যাপনের দিনগুলো? সাংবাদিক মাইকেন ফিনকেল-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তারই টুকরো টুকরো ছবি। আর সেই সব ছবি বুনেই ফিনকেল লিখে ফেলেছেন এক বই: ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার ইন দ্য উড‌্স।’ এক সদ্য যুবকের অন্য রকম বাঁচতে চাওয়ার গল্প। একেবারে উধাও হওয়ার আগে, নাইট গাড়ি নিয়ে ঘুরেছেন জর্জিয়া, ক্যারোলিনা আর ভার্জিনিয়া। খাওয়া: ফাস্ট ফু়ড আর শোওয়া: সবচেয়ে সস্তার মোটেল। তার পর পাড়ি দেন মেইনে-র উত্তরে। তাঁর বেড়ে ওঠার জায়গায়। দূর থেকে নিজের বাড়িটাকে শেষ বারের মতো বিদায় জানাতে। তার পর ফের উজিয়ে চলা। এ বার মুজহেড লেক-এর ধারে। এখান থেকেই মেইনে ক্রমশ নির্জন হবে। আর নাইট এগোবেন যত ক্ষণ তাঁর গাড়িতে গ্যাস মজুত থাকে।

গ্যাস ফুরোনোর পর জঙ্গলের ধারে গাড়ি রেখে হাঁটা শুরু আরও গভীরে। কত দূর, কোথায়? জানতেন না। কম্পাস, ম্যাপ কিছুই তো নেই সঙ্গে। শুধু ছিল সামান্য খাবার, অল্প জামাকাপড় আর তাঁবু তৈরির সামান্য সরঞ্জাম। তবু, সূর্যের চলাফেরা দেখে নাইট আন্দাজ করেছিলেন, জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে হাঁটছেন তিনি। সপ্তাহখানেকের জন্য এক-একটা জায়গায় তাঁবু ফেলেন। এক বার রাত কাটালেন এক ফাঁকা বাড়িতে। সে এক অসহ্য অভিজ্ঞতা, বলেছেন নাইট। প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। ঘুম হল না। এর পর থেকে তিনি আর এক রাতও পাকা ছাদের তলায় ঘুমনোর আরাম কুড়োতে যাননি, সে যত খারাপ আবহাওয়াই হোক না কেন। বরং খুঁজে বের করলেন জঙ্গলের গভীরে পাকাপাকি থাকার একটা জায়গা। আবহাওয়া মোটের ওপর সহনশীল। কিছু দূরেই মেইনে-র বিখ্যাত লেক। সবচেয়ে সুখের কথা, জায়গাটা বিচ্ছিরি রকমের পাথুরে। সাধারণ মানুষও তো বটেই, হাইকার-দেরও তেমন পছন্দের নয়। এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু খাবার? সঙ্গে যেটুকু ছিল, কবেই ফুরিয়েছে। মেইনে-র জঙ্গল বড্ড নিষ্ঠুর। ফলের গাছ প্রায় নেই। শিকার করা অথবা মাছ ধরার ব্যবস্থা না থাকলে উপোস করে মরাই নিয়তি। ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন নাইট। বন্দুক দূরে থাক, একটা লোহার রডও সঙ্গে ছিল না। এক বার একটা পাখির মৃতদেহ পেলেন। কিন্তু সেটা খেতে গেলে তাকে ঝলসাতে হয়। এ দিকে আগুনটুকু জ্বালার মতোও কিছু নেই। অগত্যা কাঁচা মাংস। কিন্তু তাতে শরীর গেল বিগড়ে। সুতরাং, ঠিক করলেন, চুরি করতে হবে। এই কাজই পরে তাঁকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে। চৌর্যবৃত্তির গোড়াটা অবশ্য হাঁটা শুরুর প্রথম থেকেই হয়েছিল। জঙ্গল-লাগোয়া বাগান থেকে ভুট্টা, আলু, কাঁচা সবজি তুলতে তুলতেই এগোচ্ছিলেন তিনি। এ বার নিশানায় এল জলাশয়-লাগোয়া বাড়িগুলো। শুরু হল নিখুঁত পরিকল্পনা, আর হাতের কারিকুরির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা।

ফিনকেল লিখছেন, দূর থেকেই নাইট লক্ষ করতেন, বাড়ির বাসিন্দাদের জীবন। গাড়ির ঢোকা-বেরনো, পার্টি করা, ছুটি কাটানো— সব কিছু। ঘড়ির সময় মিলিয়ে। মরশুম ধরে। খেয়াল করলেন, প্রবল বৃষ্টিতে বাসিন্দারা জঙ্গল ছাড়ে। বাড়িগুলো পড়ে থাকে অরক্ষিত। ওই জঙ্গলে কে-ই বা আসবে চুরি করতে! আর ঠিক এই ফাঁকটার সুযোগই নিলেন নাইট। প্রতি বাড়িতেই একাধিক বার তিনি ঢুকেছেন। লেকের ধারে সময় কাটাতে আসা মানুষের ডিঙি নৌকো কিছু ক্ষণের জন্য সরিয়ে তাকেই কাজে লাগিয়েছেন চোরাই জিনিস তাঁবুতে বয়ে আনার জন্য। কিন্তু ‘কেউ একটা সব সময় বাড়ির দিকে লক্ষ রাখছে’-গোছের অস্বস্তি ছাড়া তাঁর অস্তিত্বটাই কেউ কখনও ধরতে পারেননি।

লাগাতার চুরি হয়েছে, চোর ধরতে নানা ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব এড়িয়ে যে নিখুঁত ভঙ্গিতে তিনি তালা ভেঙে বাড়ির ভিতর ঢুকতেন, তা চমকে দিয়েছে পোড়-খাওয়া পুলিশকর্তাদেরও। সাতাশ বছরে তাঁর চুরির সংখ্যা হাজারেরও বেশি। এক বার প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন, তবু মসৃণই ছিল জীবন।। আটক করা চোরাই মালের তালিকাও সেই কথাই বলে।

কিন্তু নির্জন জঙ্গলে এই স্বাচ্ছন্দ্যই ক্রিস্টোফার নাইটের ওই সাতাশটা বছরকে ‘খুব আশ্চর্য রকম’ হতে দিল না। হতে পারে, তিনি এতগুলো বছরে এক জন হাইকারকে হঠাৎ দেখে ‘হাই’ বলা ছাড়া আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি, হতে পারে তিনি কখনও জোরে হাঁচেননি, কাশেননি, এমনকী বিড়বিড়ও করেননি ধরা পড়ার ভয়ে, হতে পারে তিনি প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়াতেও তাঁবুর আশ্রয় ছাড়েননি। কিন্তু এটাও ঠিক, তাঁর তাঁবু থেকে পাওয়া টিভি, বই, ডেনিম, রেডিয়ো, ব্যাটারি, ম্যাট্রেস, সানগ্লাসের পাশে তাঁর ‘শিকারি-সংগ্রাহক’ খেতাব বড্ড বেমানান ঠেকে। তাঁর একলা থাকার জেদকে কুর্নিশ জানাতে হয় ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে মেইনে-র কুখ্যাত মশার দলকে ঠেকালেন কী করে— এই প্রশ্নের উত্তরে যখন তিনি নিরস ভঙ্গিতে বলেন, ‘কেন, পোকা মারার স্প্রে দিয়ে’, তখন ধাক্কা লাগে বিলক্ষণ।

হয়তো তিনি সমাজ ছাড়তে চেয়েছিলেন, লোকের সঙ্গ ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনায়াস জীবনের লোভটা ছাড়তে পারেননি। তাই জঙ্গলের গভীরে আধপোঁতা তার হলদে গাড়িটা দেখে শুধুই একটু গা ছমছম করে। কিন্তু যাঁরা ‘ধুত্তোর দুনিয়া’ বলে, গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে নিজের দমে বাঁচতে চান, তাঁদের কোনও ভরসা হয়ে ওঠেন না ক্রিস্টোফার নাইট।

Christopher Thomas Knight
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy