জলদগম্ভীর স্বরে হাঁক পাড়লেন শ্রীমন্ত চট্টরাজ, ‘বিজু...’। সেই আওয়াজে বোধ হয় নীল আকাশেও হঠাৎ মেঘের সঞ্চার হল। শরতের খামখেয়ালি প্রকৃতির এই রূপ, কখনও হাসি, কখনও কান্না— সকলের কাছেই সমধিক পরিচিত।
‘বলুন কর্তাবাবু।’ ময়দা মাখছিল বোঝাই যায়। কিন্তু, দাদুর আহ্বান এড়ানো দায়। কাগজ পড়তে পড়তে প্রশ্ন করলেন, ‘আজ ব্রেকফাস্টে কী মেনু?’
‘মোহন ভোগ, আলুর দম, লুচি।’
‘রাসকেল। কোনটার পর কোনটা বলতে হয় আজও শিখল না! তো, তোমাদের নিত্যকার এই টিপিকাল মেনুর কি অদলবদল হতে পারে না স্পেশাল দিনেও?’
‘আমি কী করব, কর্তামাই তো বললেন।’ মাথা নিচু করে জবাব দিল বিজু, ওরফে বিজয়কুমার দাস, পুরী আদি নিবাস। ওর স্ত্রী পার্বতীও এ বাড়ির এক জন জরুরি সদস্যা কাম অন্দরমহলের অপরিহার্য সহায়িকা।
‘ঠিক আছে। তুমি যেতে পারো।’
কাগজ ভাঁজ করে যথাস্থানে রাখলেন শ্রীমন্ত চট্টরাজ। তক্তপোষে আসীন এ বাড়ির তিন খুদে সদস্যের দিকে এক বার ঝাড়ি মারলেন। ওটুকুই কাফি যাদের কাছে।
প্রথম জন: তিতাস চট্টরাজ। ক্লাস এইট। পিতা: বিভাস চট্টরাজ। এবং তস্য পিতা: শ্রীমন্ত চট্টরাজ।
দ্বিতীয় জন: তিয়াস চট্টরাজ। ওরফে গাবলু। চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া। পিতা: ললিত চট্টরাজ। এবং তৃতীয় জন: আশাবরী চট্টরাজ। ওরফে তিন্নি। গাবলুর একমাত্র বোন। তৃতীয় শ্রেণি।
আকাশে তখন ফাজিল রোদ। লুকোচুরি খেলছে পাল তোলা মেঘেদের সঙ্গে।
এ পাড়ায় তাদের পেল্লাই বাড়ি। হেডস্যরের বাড়ি বলে সকলে। দাদু স্থানীয় বয়েজ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রধান ফটকের মুখে শিউলি গাছটা ফুলের বিছানা পেতে দিয়েছে নীচে।
‘ফুল তুলিসনি আজ?’
‘হ্যাঁ, এক সাজি।’
‘ওমা, তাও তো কত পড়ে আছে।’
গাবলু এবং তিন্নির কথোপকথনের মাঝে বাড়ির ছোট ছেলে বাজার সেরে ফিরছিল। রিকশা থেকে নামতে নামতে, বাইরে বের হতে উদ্যত বাবা সহ তিন খুদে সদস্যকে দেখে তার অবাক প্রশ্ন, ‘কী ব্যাপার, কোথায় চললে তোমরা?’
‘খুব কি দরকার আছে তোমার?’
‘না। স্কুল ছুটি। মহালয়ার দিন। সব ঠিক আছে। কিন্তু, তাই বলে এত সকালে?’
বাংলার টিচার ছোট ছেলেকে আগাপাস্তলা মেপে নিয়ে শ্রীমন্ত চট্টরাজ বললেন, ‘যাও, ভেতরে যাও। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, সব আমার সঙ্গে বেরিয়েছে।’
‘কখন যে বড়মা কুটনো কাটবে, কখন যে রান্না হবে...। বাজার হাতে রাস্তাতেই বেলা বয়ে যাচ্ছে’— তিন্নির উদাস-ফিচেল মন্তব্যে ললিত তাকালেন মেয়ের দিকে। ‘আচ্ছা! ঠিক আছে, বাড়ি এসো, তার পর দেখছি।’
তিন্নি ততক্ষণে দাদুর কব্জায়।
একটা টোটোকে দাঁড় করিয়ে দাদু বললেন, ‘স্টেশন’।
তিন খুদের দাদুময় এই সাম্রাজ্য একান্ত নিজস্ব। আজ যেমন তাদের ভোর চারটের সময় উঠিয়ে দিয়েছিল ঠাম্মা। কাল রাতে তো দাদু-ঠাম্মার ঘরে ঢালাও বিছানায় সবাই শুয়েছিল। উপলক্ষ: মহালয়া শোনা। তিতাস-গাবলু-তিন্নির ভেতর আকাশবাণীর সেই প্রবাদপ্রতিম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ মহালয়া শোনার রোমাঞ্চ-আনন্দটা জারিত করতে পেরেছেন শ্রীমন্ত এবং মহামায়া চট্টরাজ। তাদের দাদু-ঠাম্মা।
মহালয়া শেষে বিছানায় খুনসুটি, ঠাম্মার চাপে হাতমুখ ধুয়ে চলছিল গুলতানি। আজ টিউশন নেই এবং স্কুল ছুটি। দাদু তখন ইজিচেয়ারে আধ শোয়া হয়ে কাগজ পড়ছিলেন। ঠাম্মা ইতিমধ্যে উঠে গিয়েছে। তখন বিজুদাকে আহ্বান এবং পরবর্তী ঘটনাপরম্পরার সূচনা। বাকিটা এখনও অবধি পুরোটা অজানা।
স্টেশনে এসে টোটো থেকে নামল ওরা। ওভার ব্রিজ দিয়ে উঠতে উঠতে দাদুর সাবধান বাণী, ‘তিতু, ভাইবোনকে সামলে ওঠো।’ তিতুর এ সব নির্দেশ মুখস্থ। দাদা হিসেবে গাবলু আর তিন্নি মেনে নেয় ওর কর্তৃত্ব।
স্টেশনে এখন জনঅরণ্য। খুশিয়াল রোদ উঠেছে আবার। উৎসবপাগল মানুষ বেরিয়ে পড়েছে কেনাকাটায়। গন্তব্য: গড়িয়াহাট, হাতিবাগান...।
ওপারে গিয়ে ভ্যানে চাপল ওরা। তিতাস একটু অবাক। ওরা সবাই জানে, প্রশ্ন করা বৃথা।
চার মাথার মোড়ে এসে ভ্যান ছাড়া হল। ঠিক কাছাকাছি বিখ্যাত কচুরির দোকানটায় যখন দাদু নিয়ে গেলেন ওদের, তখন তিন জনের চোখ-মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিন খুদে এবং বয়স্ক খদ্দেরকে দেখে দোকানের ছেলেগুলো একটা বেঞ্চ সাফসুতরো করে বসতে দিল। আর ওরা তিন জন গপাগপ চারটে করে কচুরি-আলুর তরকারি সাবাড় করে দিল।
দাম মিটিয়ে ব্যস্ত রাস্তাটা পার হয়ে, লরি স্ট্যান্ডের বিখ্যাত বিশাল কালীবাড়ি ছাড়িয়ে, ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে হাঁটছিল ওরা দাদুর সঙ্গে।
রেললাইনটা সতর্ক হয়ে পার হল সবাই। তার পর বিখ্যাত কাপড়ের দোকানটায় ঢুকলেন শ্রীমন্ত চট্টরাজ। অভিজাত এই বস্ত্রবিপণিতে ভিড় সব সময়। তবু দাদুকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে উঠে এলেন এক ভদ্রলোক। ‘মাস্টারমশাই, আপনি এলেন কেন? একটু বাদেই তো আপনার বাড়িতে মাল পৌঁছে যাবে।’
‘সে জানি। এই এ দিকে এসেছিলাম। ভাবলাম একটু ঢুঁ মেরে যাই। সব রেডি তো?’
অঙ্গুলি নির্দেশে কয়েকটা বড় বড় প্যাকেট দেখালেন।
দুপুরেই সব প্রস্তুতি সারা। বিকেল হতে তখনও দেরি। কিন্তু, ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে ভিড়। পাড়ার ছেলেরা একটা লিস্ট দেখে দেখে সবাইকে দাঁড় করাচ্ছে লাইনে।
তিতাস দেখল, বরাবরের মতো মা এবং ছোটমা অপূর্ব সাজে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পিছন পিছন ধুতিপাঞ্জাবি পরিহিত বাবা এবং কাকামণি।
মহালয়ার বিকেল এখন। আকাশ পরিপূর্ণ মেঘমুক্ত। শান্ত স্নিগ্ধ চরাচর।
‘তোরা সব রেডি তো?’ দাদু জিজ্ঞাসা করলেন ছেলেদের।
‘হ্যাঁ।’ সমস্বরে জবাব দিল ওরা। ‘ললিতদা তুমি আর বিভাসদা, তোমাদের লিস্ট থেকে নামগুলো মিলিয়ে নেবে। তিতাস অ্যান্ড কোম্পানি রেডি?
‘হ্যাঁ’। সমস্বরে জবাব তিন জনের।
‘আমরাও’। জবাব দিল বিজুদা, পার্বতীবৌদি।
পাড়ার ছেলেরা নাম ডাকছিল। বাবা এবং কাকামণি মিলিয়ে নিচ্ছিল। মা এবং ছোটমা একটা করে প্যাকেট তুলে দিচ্ছিল ওদের হাতে। খুদেরা মিষ্টির প্যাকেট। গড় হয়ে প্রণাম করছিল ওরা দাদু এবং ঠাম্মাকে। খুশির ঝলক ঠিকরে পড়ছিল ওদের চোখেমুখে।
জ্ঞান হওয়া ইস্তক তিতাস দেখে আসছে এই কর্মযজ্ঞ। দাদু এ পাড়ার সব বাড়ির পরিচারিকা-সহায়িকা-পরিষেবিকাদের পুজোর আগে কাপড় দেন। তাদের বাড়ির কর্তার জন্যও লুঙ্গি-পাঞ্জাবি বরাদ্দ থাকে। মিষ্টির বাক্স সঙ্গে। পাড়ার ছেলেরা লিস্ট করে। দেখিয়ে নেয় বাবা এবং কাকামণিকে।
সুশৃঙ্খল ভাবে সব কাজ মিটল। এর পর পাড়ার ছেলেদের মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ করলেন দাদু নিজে।
সন্ধের আঁধার ঘনিয়ে আসছিল। শাঁখ বাজছিল আশপাশের বাড়িতে। সরস্বতীবৌদি সবার জন্য চা-মুড়ি-তেলেভাজা নিয়ে এল রান্নাঘর থেকে।
হঠাৎ মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে সবাই হতচকিত।
‘কী হল বড়বৌমা? বিস্মিত প্রশ্ন ঠাম্মার।
চোখের জল মুছে মা বলল, ‘আমরা যেনো এ কাজটা আজীবন চালিয়ে যেতে পারি বাবা, এই আশীর্বাদ করুন।’
‘ঠিক পারবে। আমরা ওপর থেকে সব দেখব। এ দিক ও দিক হলেই...।’
‘থাক। বছরকার দিনে অলুক্ষণে কথা বলতে হবে না।’ দাদুকে থামিয়ে বলে ঠাম্মা।
ঠাম্মাকে দেখে, মাকে দেখে, ছোটমাকে দেখে এবং সামগ্রিক পরিবেশে তিতাস কেমন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছিল। আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়— এই বোধে শিক্ষিত করেছেন দাদু ওকে।
‘বড়মা, তোমাকে ঠিক মা দুগ্গার মতো লাগছে গো।’
তিন্নির কথায় হেসে অস্থির সবাই। মা ওকে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ‘সোনা মেয়ে’।