Advertisement
E-Paper

জেঁকে বসল সোলার হিটার

মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমের কাছে দুটি গ্রামে। সৌজন্যে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের জনাকয়েক প্রাক্তনী। দরিদ্র মানুষদের জ্বালানির জন্য আর কাঠ কাটতে হয় না, রক্ষা পায় বনজ সম্পদ। ইংল্যান্ডে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে আলাপ হয় ক্যাপ্টেন জেমস হেনরি সেভিয়ার ও তাঁর স্ত্রী শার্লট এলিজ়াবেথ সেভিয়ারের। স্বামীজির সর্বত্যাগী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন সেভিয়ার দম্পতি। তাঁদের সঙ্গে আল্পস পর্বতমালা ভ্রমণের সময় স্বামীজি ইচ্ছেপ্রকাশ করেন ভারতে এমনই এক পাহাড়ের কোলে একটা আশ্রম তৈরি করার।

সন্দীপ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
সবুজ পাহাড় আর বনের মধ্যে গ্রামে চলছে কর্মযজ্ঞ

সবুজ পাহাড় আর বনের মধ্যে গ্রামে চলছে কর্মযজ্ঞ

হায় হায়, গিয়ে দেখি বুড়ো সেখানেও জেঁকে বসে আছেন,’’ বেলুড় মঠে গুরুভ্রাতাদের বলছেন স্বামী বিবেকানন্দ। বলছেন, তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের বিষয়ে। সময়টা ১৯০১-এর জানুয়ারি। দিন-পনেরো মায়াবতী আশ্রমে কাটিয়ে সদ্য ফিরেছেন তিনি। স্বামীজির জীবনের শেষ হিমালয়যাত্রা। তাঁর স্বপ্নের আশ্রম, যেখানে কোনও রকম পূজার্চনা করা ছিল নিয়মবিরুদ্ধ। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন কয়েক জন আশ্রমিক ঠাকুরের প্রতিকৃতিতে মালা পরিয়ে, ধূপধুনো জ্বালিয়ে পুজো করছে। অধ্যক্ষ স্বামী স্বরূপানন্দকে মৃদু তিরস্কার করেছিলেন স্বামীজি। সেই থেকে আর কখনও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। ১৮৯৯-এ মায়াবতী আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় কর্মসূচিতে স্পষ্ট ছিল স্বামীজির নির্দেশ— ‘‘এখানে শুধু ‘একত্বের শিক্ষা’ ছাড়া অন্য কিছুই শিক্ষা দেওয়া বা সাধন করা হইবে না। যদিও আশ্রমটি সমস্ত ধর্মমতের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিসম্পন্ন, তবুও ইহা অদ্বৈত— কেবলমাত্র অদ্বৈত— ভাবের জন্যই উৎসর্গীকৃত হইল।’’ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অদ্বৈতসাধনার এই মূল শাখাটিতে আজও মেনে চলা হয় সেই ভাবধারা।

ইংল্যান্ডে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে আলাপ হয় ক্যাপ্টেন জেমস হেনরি সেভিয়ার ও তাঁর স্ত্রী শার্লট এলিজ়াবেথ সেভিয়ারের। স্বামীজির সর্বত্যাগী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন সেভিয়ার দম্পতি। তাঁদের সঙ্গে আল্পস পর্বতমালা ভ্রমণের সময় স্বামীজি ইচ্ছেপ্রকাশ করেন ভারতে এমনই এক পাহাড়ের কোলে একটা আশ্রম তৈরি করার। আর হয়তো এই জন্যই পুত্রসম গুরুর এই আদেশ ফেলতে পারেননি দম্পতি। ভারতবর্ষে এসে আল্পসের মতো জায়গা খোঁজা শুরু হয় তাঁদের। অবশেষে সন্ধান মেলে হিমালয়ের আলমোড়া-সংলগ্ন এলাকায়। বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ঘন পাইন ও দেবদারুর জঙ্গলে ঘেরা এক চা-বাগানের কিছুটা অংশ কিনে তৈরি হল আশ্রম। এখান থেকে দেখা যায় নন্দাদেবী, ত্রিশূল, ধবলগিরি, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদার, বদ্রী আর পঞ্চচুল্লির পাঁচটি শৃঙ্গ। বসন্তে রডোডেনড্রনের আগুনে রাঙা হয়ে থাকে গোটা জঙ্গল। চারিদিকে অপার শান্তি, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন স্বামীজি। রামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথিতে বিবেকানন্দের শিষ্য স্বামী স্বরূপানন্দকে আশ্রম-প্রধান করে আশ্রমের কাজ শুরু করেন সেভিয়ার দম্পতি। কিন্তু এক দিকে ভগ্নস্বাস্থ্য, অন্য দিকে কর্মব্যস্ততার জন্য কিছুতেই সময় করে মায়াবতীতে আসতে পারছিলেন না স্বামীজি। অবশেষে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে জানুয়ারি মাসের প্রচণ্ড শীতে চলে আসেন।

এখন মায়াবতী আশ্রমের ভিতরে আছে একটি সুন্দর ফুলের বাগান। এর তত্ত্বাবধানে আছেন আকিরা মহারাজ, যিনি ‘জাপানি মহারাজ’ নামেই বেশি পরিচিত। বাগানের দু’দিকে দুটো দোতলা বাংলো বাড়ি। একটি আশ্রম, অন্যটি ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার দপ্তর। স্বামীজির পছন্দের পত্রিকা। ১৮৯৬ সালে চেন্নাই থেকে প্রকাশিত হয় এই ইংরেজি মাসিক পত্রিকাটি। কিন্তু হঠাৎ সম্পাদকের মৃত্যুর পরে ১৮৯৮ সালে সম্পাদক হয়েছিলেন স্বামী স্বরূপানন্দ। এখানে এখনও আছে সেই বিখ্যাত প্রিন্টিং মেশিনটি, যা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে সেভিয়ার দম্পতি নিয়ে এসেছিলেন। আশ্রমের পাশে জঙ্গলের মধ্যে আজও আছে স্বামী স্বরূপানন্দের ধ্যান কুটির। শোনা যায়, এক দিন ধ্যানমগ্ন স্বরূপানন্দ চোখ খুলে দেখেন, তাঁর মুখের সামনে একটা বাঘ বসে আছে। বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে আবার ধ্যানে মগ্ন হন স্বরূপানন্দ। বাঘটাও কিছু ক্ষণ পর চলে যায় নিঃশব্দে! আজও আশ্রমের আশেপাশে চিতাবাঘের ঘোরাঘুরি টের পাওয়া যায়। তাই সন্ধের পর আশ্রমের ভিতরেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময় আলো জ্বেলে দেওয়া হয়। আশ্রম থেকে বেশ কিছুটা নীচে সারদা নদী। যার ধারে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারকে দাহ করা হয়েছিল, তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী। আশ্রম থেকে হাজারখানেক ফুট উপরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছনো যায় ধরমগড়ে। মায়াবতীতে থাকার সময় ওখানে বসে ধ্যান করতেন স্বামীজি। তাঁর ধ্যানের জায়গাটিতে একটা ছোট্ট কটেজ তৈরি করা হয়েছে।

ঐতিহ্য: আদি মায়াবতী আশ্রম।

এত বছর পরেও, এমনকি অচ্ছে দিন আসার পরেও এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের জন্য সরকারি ব্যবস্থা খুবই নগণ্য। অধিকাংশ গ্রামে নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্ত্রীরোগ, ত্বকের সমস্যা এবং চোখের অসুখে জর্জরিত এখানকার অধিকাংশ মানুষ। তাঁদের বিরাট ভরসার মায়াবতী আশ্রমের আধুনিক ব্যবস্থাসম্পন্ন দাতব্য চিকিৎসালয়টি। শুধু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়, এখানে নেই কোনও স্কুল। রাস্তাঘাটও তথৈবচ। জ্বালানি কাঠ পুড়িয়ে রান্না ও স্নানের জল গরম করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এর জন্য পরিবারপিছু বছরে প্রায় গড়ে এক টন কাঠ পোড়ানো হয়। ধোঁয়ায় ক্ষতি হয় ফুসফুসের। গাছ কাটা পড়ে অসংখ্য। পড়াশোনা ফেলে ছোটরা জ্বালানি সংগ্রহের জন্য সময় নষ্ট করে। এক দিকে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য, অন্য দিকে পরিবেশ— দুই-ই বিপদের মুখে। পরিস্থিতিটা কি বদলানো যায়? প্রশ্নটা সামনে রেখে আলোচনা শুরু করেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয় ‘প্রজেক্ট সানশাইন’। সমস্যার সমাধান হয় সোলার ওয়াটার হিটারের মাধ্যমে। উৎস শুধুমাত্র সূর্যের আলো। কোনও রকম দূষণ ছাড়াই উত্তাপ আসবে গরিব মানুষগুলোর জীবনে। ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসাবে আপাতত হরোড়ি ও সিরমোলি, এই দুটি ছোট্ট গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে সোলার ওয়াটার হিটার। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও সম্প্রতি হয়ে গেল।

নরেন্দ্রপুরের প্রাক্তনীদের প্রায় বর্ষব্যাপী প্রচেষ্টার ফসল এই প্রকল্প। নেতৃত্বে আছেন মায়াবতী আশ্রমের স্বামী একদেবানন্দ। যিনি বেশি পরিচিত ‘দেবুদা’ নামে। প্রায় প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছনো প্রাক্তনীরা অর্থ ও সময়ের পাশাপাশি ‘প্রজেক্ট সানশাইন’-এর সাফল্যের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন কর্মজীবনের যাবতীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। হিটারের পাশাপাশি প্রাক্তনীরা মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছেন বেশ কয়েক বার। উপকৃত হয়েছেন চারপাশের গ্রামের মানুষজন। প্রাক্তনীরা আশা রাখেন, ভবিষ্যতে আরও অনেকেই এগিয়ে আসবেন, তখন সুফল ছড়িয়ে পড়বে দাবানলের মতো। রামকৃষ্ণ এখানে জেঁকে বসেননি ঠিকই, কিন্তু নরেন্দ্রপুরের প্রাক্তন ছাত্রদের কল্যাণে এখানকার গ্রামে গ্রামে সোলার হিটার জেঁকে বসতে দেখলে বিবেকানন্দের যে আনন্দের অবধি থাকত না, বলা বাহুল্য।

Solar Water Heater Narendrapur Ramakrishna Mission Swami Vivekananda Advaita Ashram Mayavati
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy