E-Paper

স্মৃতির চলচ্চিত্রে ১৬ মিলিমিটার

দেশ তখন পরাধীন। সেন্ট জ়েভিয়ার্সের অধ্যাপক আমদানি করলেন চলমান ছবি দেখানোর যন্ত্র। মানুষের চোখে লাগল মায়ার কাজল। আগ্রহী হল বাঙালিরা। লন্ডন থেকে এল বায়োস্কোপ মেশিন। খবর পৌঁছল বোম্বাইয়ে। উৎসাহী হলেন পার্সি ব্যবসায়ীরা। ৩৫ মিমি ফিল্ম বদলে গেল ১৬ মিমিতে। সে যেন এক যুগসন্ধির বিস্ময়!

প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫ ০৬:৫৭

ছবি: প্রীতম দাশ।

ফরাসি দেশের এক রেলস্টেশনে ধোঁয়া উড়িয়ে একটা ট্রেন এসে থামল। যাত্রীরা নেমে যে যার গন্তব্যের দিকে চলে গেলেন। ১৮৯৫ সালের ২২ মার্চ ফরাসি দুই ভাই, অগস্ত আর লুই লুমিয়ের এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার মাহেন্দ্রক্ষণকেই বলা হয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সূচনালগ্ন। সে বছর ২৮ ডিসেম্বর অর্থের বিনিময়ে প্রথম জনগণের বিনোদন হিসেবে সিনেমা প্রদর্শন করেছিলেন ওঁরা, ‘লুমিয়ের ব্রাদারস’। দিনটি এখন পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল সিনেমা ডে’ হিসেবে। মজার বিষয়, এখনও পর্যন্ত ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস বলে নির্দিষ্ট কোনও তারিখ নেই। কোভিড-অতিমারির পর দর্শকদের ফের হলমুখী করার উদ্দেশ্যে ভারতের মাল্টিপ্লেক্স অ্যাসোসিয়েশন (এমএআই) ২০২২-এর ২৩ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস’ উদ্‌যাপন করে। ২০২৩-এ ১৩ অক্টোবর, গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর একই উদ্দেশ্যে পালিত হয়। সে দিন বছরের সফল ছবিগুলি কম টিকিট-মূল্যে দেখানোর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ওটিটি-র বিপ্রতীপে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে ফের জনপ্রিয় করে তোলা।

বায়োস্কোপের পদধ্বনি

আমাদের এই শহরে ১৮৯৬ সালে প্রথম বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে সর্বসমক্ষে বায়োস্কোপের জাদুতে দর্শকদের মায়াচ্ছন্ন করেন মিস্টার স্টিফেন্স। তাঁর আগে সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ তাঁর ছাত্রদের শিক্ষার্থে বিদেশ থেকে একটি চলমান ছবি-প্রদর্শনযন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। বায়োস্কোপের আকর্ষণে সে সময় স্টিফেন্স সাহেবের কাছে কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন হীরালাল সেন। স্থিরচিত্র সম্পর্কে হীরালালের যথেষ্ট জ্ঞান ও চর্চা থাকা সত্ত্বেও তাঁর বায়োস্কোপের উৎসাহকে সাহেব অবজ্ঞায় এড়িয়ে যান। দমবার পাত্র ছিলেন না হীরালাল। লন্ডন থেকে ‘আর্বান বায়োস্কোপ’ যন্ত্র আনিয়ে ভাই মতিলাল, দেবকী লাল ও ভাগ্নে ভোলানাথ গুপ্তকে নিয়ে ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’। দেশের চলচ্চিত্র-ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান।

ইডেন গার্ডেনস এবং সেখান থেকে গঙ্গার ধার ধরে একটু এগিয়ে হাওড়া ব্রিজের পার্শ্ববর্তী এলাকা, এই দুই অঞ্চলের মধ্যে তখন সীমাবদ্ধ কলকাতার বিদ্যুৎ-পরিষেবা। শহরের অন্যান্য অঞ্চলে ছবি দেখানো হত গ্যাসের আলোয়। বাংলা-বাজারে বায়োস্কোপের এই জনপ্রিয়তার খবর অচিরেই পৌছে যায় সুদূর বোম্বাইয়ে। ১৯০১ সালে সেখান থেকে জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডান নামে এক পার্সি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে তৈরি করেন বায়োস্কোপ প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানি’— গড়ের মাঠে, টাউন স্কুলে, হাতিবাগানে ঘুরেফিরে ছবি দেখাতে থাকেন। ইতিমধ্যে রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি ১৯০৩ সালে তাদের দীর্ঘ চলচ্চিত্র ‘আলিবাবা’ দেখিয়ে আলোড়ন ফেলেছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালীন প্রতিষ্ঠিত কয়েক জন বাঙালি ব্যবসায়ী হীরালাল সেনকে তাঁদের কোম্পানির তৈরি স্বদেশি পণ্য প্রচারের উদ্দেশ্যে সিনেমা বানানোর দায়িত্ব দেন। সেই দায়িত্ব গ্রহণ ও পালনেই প্রমাণ হয়, হীরালাল সেন ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র-নির্মাতা। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে ভিত্তি করে তিনি একটি রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করেন, চলচ্চিত্র-ইতিহাসকারদের বিবেচনায় যা ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। ১৯০০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নিখিল ভারত শিল্প-প্রদর্শনীতে বায়োস্কোপ দেখিয়ে হীরালাল স্বর্ণপদক পান। ম্যাডান কোম্পানি চলচ্চিত্রে মুনাফার আঁচ পেয়ে তাদের সিনেমা-ব্যবসা বর্মা, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর এমনকি মালয়েশিয়া পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলে। অন্য দিকে ১৯১৭ সালে হীরালাল-মতিলালের রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানিতে আগুন লেগে তাঁদের নির্মিত ও সংগ্রহের সব চলচ্চিত্র ধ্বংস হয়ে যায়।

টুকরো টুকরো, স্বল্পদৈর্ঘ্য দৃশ্যেই নিহিত ছিল সিনেমার বীজ। সেখান থেকে মহীরুহ হয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্যের সর্বাঙ্গীণ চলচ্চিত্রে রূপান্তর সম্ভব হয় ১৯১৫ সালে, প্রতিভাবান প্রয়োগশিল্পী ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথ-এর পরিচালনায় ‘দ্য বার্থ অব আ নেশন’ চলচ্চিত্রে। ছবির বিষয় উনিশ শতকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্বেতাঙ্গদের শক্তি ফিরিয়ে আনা আর কৃষ্ণাঙ্গদের ভয় দেখিয়ে দমন করা। সিনেমায় দেখানো হয় উগ্রপন্থী সংগঠন ‘কু ক্লুক্স ক্লান’-এর অভ্যুত্থানও। এই নির্বাক ছবিটি প্রদর্শিত হতেই তখনকার শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা সরব হয়ে চলচ্চিত্রে সেন্সরশিপ চালুর দাবি জানিয়ে আন্দোলনে শামিল হয়। সিনেমার প্রকৃত জনক বলে খ্যাত পরিচালক গ্রিফিথ আদালতে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। সে দিনই প্রমাণ হয়েছিল সমাজ-দর্শনে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব, তার শক্তিশালী প্রভাব।

বিরাট ক্যামেরা, ৩৫ মিমি ফিল্ম

এই লেখা অবশ্য সিনেমার ইতিহাস নিয়ে নয়, বরং সিনেমায় ব্যবহৃত ক্যামেরা ও ফিল্ম (সেলুলয়েড) নিয়ে। সে প্রসঙ্গে বলতে গেলে সিনেমার গোড়ার ইতিহাস কিছুটা মনে রাখলে সুবিধে হবে, সে কথা ভেবেই এই অবতারণা।

স্টিফেন্স সাহেব ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বায়োস্কোপ এনে, কিছু টুকরো ছবি দেখিয়ে তাঁর কাজ বাংলার রঙ্গমঞ্চেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু হীরালাল সেনের নিজস্ব ক্যামেরা ছিল, ফলে নাট্যমঞ্চে আবদ্ধ না থেকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে মন দেন। গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের লেখায় উল্লেখ আছে, ১৮৯৭ সালে তিনি লন্ডন থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের যাবতীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন এবং ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল, রবিবার রাতে তাঁর তোলা ছবি ক্লাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়। কালীশ মুখোপাধ্যায়ের তথ্যমতে, ১৯০৩ নাগাদ সময় থেকে হীরালাল রীতিমতো চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, দাদাসাহেব ফালকের প্রথম ছবি ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’-এর নির্মাণকাল কিন্তু অনেকটা পরে, ১৯১৩ সাল।

শুরুর সময়ে ক্যামেরা ছিল বিরাটাকার। তখন ছিল কাঠের ক্যামেরা, সঙ্গে চওড়া গেজ অর্থাৎ ‘লার্জ ফরম্যাট’-এর ফিল্মের ব্যবহার হত। ১৮৮০-এর দশকে এডওয়ার্ড মাইব্রিজ-এর তৈরি ‘জ়ুপ্র্যাক্সিস্কোপ’ যন্ত্রে যে ছবি দেখানো হয়, তা ছিল ঘূর্ণায়মান কাচের উপর তোলা। ‘কাইনোটোস্কোপ’-এর অনুকরণে লুমিয়ের ভাইয়েরা ‘সিনেমাটোগ্রাফ’ যন্ত্রে ফিল্মের সাহায্যে চলমান ছবি তুলে ১৮৯৫-এর ২৮ মার্চ প্যারিসে জনসমক্ষে দেখান। পরে আমেরিকায় মার্লবোরো হাউসে নিউ ইয়র্কের রাস্তা ও নায়াগ্রা জলপ্রপাতের চলমান খণ্ড-ছবি দেখানো হয়। কারিগরি দিক থেকে তখনকার ক্যামেরায় লম্বা দৈর্ঘ্যের ফিল্ম ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। ১৯০২ সালে জর্জ মেলিয়েস-এর পরিচালনায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের, বিশ্বের প্রথম কাহিনি-আশ্রয়ী চলচ্চিত্র ‘আ ট্রিপ টু দ্য মুন’ তৈরি হয়, টানা ন’মাস চলে ছবিটি। চলচ্চিত্রে যে ছবির মাধ্যমে গল্প বলা যায়, ১৯০৩ সালে পরিচালক এডউইন এস পোর্টার তা প্রমাণ করেন তাঁর ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’ ছবিতে, যা ছিল প্রায় ৮০০ ফুট দীর্ঘ।

টমাস এডিসন ও তাঁর সহকারী উইলিয়াম ডিক্সন ১৮৯০-এর শুরুতে সিনেমায় ব্যবহৃত ফিল্ম তৈরি করেন। তার মাপ বা ফরম্যাট ছিল ৩৫ মিমি (মিলিমিটার), অর্থাৎ ফিল্মের প্রস্থ ৩৫ মিমি এবং ফ্রেমের দুই পাশে চারটি করে ছিদ্র থাকত। এই ছিদ্রকে ফিল্মের ভাষায় ‘পারফোরেশন’ বলা হয়। তখন ১.৩৩:১ ‘ফিল্ম অ্যাস্পেক্ট রেশিয়ো’-তে সর্বোচ্চ ছবি ধারণের অংশ বা ‘এক্সপোজ়ার এরিয়া’ ছিল ২৪.৮৯ মিমি/১৮.৬৭ মিমি। ১৯২৭ সালে ওয়ার্নার ব্রাদারস-এর প্রযোজনায় তৈরি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য জ্যাজ় সিঙ্গার’-এ প্রথম চলমান ছবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শব্দ অর্থাৎ ‘সিঙ্ক সাউন্ড’-এর সূত্রপাত হল। নির্বাক যুগে ফিল্মে কোনও সাউন্ডট্র্যাক ছিল না, পুরো ফ্রেমটাই ছবি ধারণে ব্যবহৃত হত। সবাক যুগে সাউন্ড যুক্ত হতেই অ্যাস্পেক্ট রেশিয়ো-র উপর সরাসরি প্রভাব পড়ল। ছবি ও শব্দ এক সঙ্গে জোট বেঁধে একই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রদর্শিত করার সহজ পদ্ধতি নির্ণয়ের ফলে শব্দের জন্য (অপটিক্যাল সাউন্ডট্র্যাক) পজ়িটিভ ফিল্মের এক পাশে ছোট্ট জায়গা চিরস্থায়ী হল। সে ক্ষেত্রে ছবির জন্য বরাদ্দ জায়গা কমে যাওয়ায় নতুন অ্যাস্পেক্ট রেশিয়ো বদলে হল ১.৩৭৫:১। ‘দ্য জ্যাজ় সিঙ্গার’-এর সাফল্যের ফলে ১৯৩২-এ ‘অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস’ এই অ্যাস্পেক্ট রেশিয়ো-কে ‘স্ট্যান্ডার্ড রেশিয়ো’ বা ‘অ্যাকাডেমি রেশিয়ো’ ঘোষণা করে।

৩৫ মিমি ফিল্ম ফরম্যাট চলচ্চিত্র এতটাই নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর হয়ে ওঠে যে এই স্ট্যান্ডার্ড ফিল্ম ফরম্যাট বহু কাল সিনেমাজগতে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। একই ভাবে সাম্প্রতিক কালে ‘ক্যানন’ সংস্থা মূলত স্টিল ফোটোগ্রাফির জন্য ডিএসএলআর ক্যামেরা তৈরি করলেও, আজ সেটাই ডিজিটাল ফিল্ম নির্মাণের যুগে অন্যতম প্রধান সহায়। অ্যাকাডেমি রেশিয়ো নির্ধারণের আগে ৯০ মিমি, ৩৮ মিমি, ২১ মিমি, ১৪ মিমি এমনকি ১১ বা ৯.৫ মিমি, এমন নানা রেশিয়োর নাইট্রেট-বেস ফিল্ম সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১৬ মিমি ফিল্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘কোডাক’ কোম্পানি কখনও নাইট্রেট ব্যবহার করেনি। আগে নাইট্রেট-বেস থাকার কারণে ফিল্ম-নেগেটিভ উচ্চ দাহ্যক্ষমতা বহন করত, ফলে সামান্য তাপে ফিল্মে আগুন জ্বলে উঠত বা তা গলে যেত। ফিল্ম সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নাইট্রেট-বেস অন্তরায় হওয়ায় ১৯৫২ থেকে ফিল্মে নাইট্রেট ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে সমস্ত ফিল্ম সেলুলোজ় অ্যাসিটেট এবং পলিয়েস্টার-বেস ফিল্ম।

হালকা সস্তা ১৬ মিমি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চলচ্চিত্র নতুন সমস্যার মুখে পড়ে। একে বিশাল আকারের ক্যামেরা, তদুপরি দুর্বহ। রণাঙ্গনে ক্যামেরার অবস্থান পরিবর্তনে রীতিমতো লোকবল প্রয়োজন, তা ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যামেরা লুকিয়ে ছবি তোলা প্রায় অসম্ভব। পরিস্থিতি সামলাতে ‘ইস্টম্যান কোডাক’ কোম্পানি ১৯২৩ সালে বিকল্প ক্যামেরা হিসেবে ১৬ মিমি ক্যামেরা আবিষ্কার করে। ৩৫ মিমি ক্যামেরার তুলনায় ১৬ মিমি ক্যামেরার গঠন ও ফিল্ম অনেকাংশে হালকা, সস্তা ও বহনযোগ্য হওয়ায় অচিরেই এই ক্যামেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে গুরুত্ব পায়। গবেষণার কাজে, সংবাদমাধ্যমে ও বিজ্ঞাপন-জগতেও ১৬ মিমি ক্যামেরার চাহিদা ক্রমশ বাড়ে। শুরুতে চলচ্চিত্র নির্মাণে যে হেতু ১৬ মিমি ফরম্যাট ব্যবহার হয়নি, এই ক্যামেরাকে তাই ‘অপেশাদার ক্যামেরা’ বলে চিহ্নিত করা হয়। কোডাক-এর ১৬ মিমি আবিষ্কারের পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল, শৌখিন মানুষেরা তাঁদের নিজস্ব সময় ও ইচ্ছে মতো যেন ঘরে বসে সিনেমা দেখতে পারে। পরবর্তী কালে সেই উদ্দেশ্য ৮ মিমি অনেকটা সামলেছিল।

বিশ শতকের ব্রিটিশ তথ্যচিত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইটালির নব্য-বাস্তববাদী আন্দোলন ও ১৯৫০-এর দশকের ব্রিটিশ ‘মুক্ত’ তথ্যচিত্রের প্রেক্ষিতে ফ্রান্সে ‘সিনেমা ভেরিতে’ নামের এক চলচ্চিত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়। সেখানে ছবিতে প্রাত্যহিক পরিস্থিতির মুখোমুখি মানুষের নিজস্ব কথা ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। শব্দ ও ছবি এক সঙ্গে শুটিং করার স্বাভাবিক কৌশল অনুসরণের বদলে, চলচ্চিত্র-নির্মাতারা প্রথমে বাস্তব কথোপকথন, সাক্ষাৎকার, মতামত রেকর্ড করে, পরে নির্বাচিত সেরা মুহূর্তের সঙ্গে শব্দের মানানসই দৃশ্য সাজিয়ে বিষয়টি চিত্রায়িত করতেন। এই আন্দোলনে শৈল্পিক ভাব প্রকাশের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি খুলে যায়। এই আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার ছিল ১৬ মিমি ক্যামেরা। ১৯৬১ সালে ফরাসি পরিচালক জঁ রাউচ তৈরি করেন ‘ক্রনিকল অব আ সামার’, গ্রীষ্মে সে দেশের গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ে পর্যবেক্ষণমূলক ছবি। আলজিরিয়ান যুদ্ধের পরে প্যারিসের সাধারণ মানুষের ৫৫ ঘণ্টার কথা সংগ্রহ করে ১৯৬৩-তে পরিচালক ক্রিস মার্কার তৈরি করেন ‘দ্য লাভলি মান্থ অব মে’। আমেরিকায় ষাটের দশকের ‘কাউন্টার-কালচার’ আবহে প্রায় একই ধরনের আন্দোলন হয়। কয়েকটি ছবির কথা বলতে হয়: ১৯৬০-এ জন এফ কেনেডি ও হুবার্ট হামফ্রির নির্বাচনী লড়াইকে কেন্দ্র করে রিকি লিকক-এর ছবি ‘প্রাইমারি’; সংশোধনাগারের বাসিন্দা ও হাসপাতালের কর্মীদের নিয়ে ফ্রেডরিক ওয়াইজ়ম্যানের ‘টিটিকাট ফোলিজ়’, ডন অ্যালান পেনবেকার-এর ‘মন্টেরে পপ’ ও মেজ়েল্‌জ় ব্রাদার্স-এর ‘সেলসম্যান’। ব্রিটেনে ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বেশির ভাগ টিভি ফুটেজ ১৬ মিমি-তেই শুট করা হয়। অনেক নাট্যানুষ্ঠান এবং তথ্যচিত্র পুরোপুরি ১৬ মিমি-তে তৈরি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ব্রাইডশিড রিভিজ়িটেড’, ‘দ্য জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’, ‘দ্য অ্যাসেন্ট অব ম্যান’, ‘লাইফ অন আর্থ’ ও ‘পোয়রো’-র গোড়ার মরসুম। অতি সম্প্রতি ওয়াইডস্ক্রিন টিভির আবির্ভাবে আবার ‘সুপার ১৬’-র ব্যবহার শুরু হয়েছে, এখনকার বহু জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ় সুপার ১৬-তে শুট করা হয়।

আন্দোলনের হাতিয়ার ১৬ মিমি

১৬ মিমি ফিল্ম ফরম্যাট ভারতীয় ছবিতে শুধু এক প্রযুক্তিই ছিল না, তা ছিল এক আন্দোলনের প্রতীক। এই ফরম্যাটের সাহায্যে যে সমাজমনস্ক, বাস্তবতাভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তা ভারতীয় সিনেমাকে নতুন ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। আজকের ডিজিটাল যুগেও ১৬ মিমি ফিল্মের সেই অবদান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ষাট ও সত্তরের দশক ছিল ভারতীয় সিনেমার বৈপ্লবিক কাল। এই সময়ে মূলধারার পাশাপাশি গড়ে ওঠে এক বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন, যার অন্যতম প্রধান অস্ত্র এই ১৬ মিমি ফিল্ম ফরম্যাট। কম খরচ, সহজলভ্যতা ও বহনযোগ্যতার গুণে এই ফরম্যাট সহজেই দেশের নবীন, সমাজ ও রাজনীতি-সচেতন চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের মতপ্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে ওঠে। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি যখন গ্ল্যামারসর্বস্ব ও সস্তা বিনোদনে ডুবে, তখন কিছু ভারতীয় চলচ্চিত্র-নির্মাতা সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতা সবার সামনে তুলে ধরতে চাইলেন। এঁদের অন্যতম হরিসাধন দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, কুমার সাহনি, জন আব্রাহাম, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, জহ্নু বরুয়া, মণি কউল, কেতন মেহতা, আনন্দ পটবর্ধন সহ আরও অনেকে।

হরিসাধন দাশগুপ্তের বেশির ভাগ কাজ যদিও ৩৫ মিমি ফিল্মে তৈরি, কিন্তু শিক্ষামূলক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নির্মিত তাঁর প্রামাণ্যচিত্রগুলি ১৬ মিমি ফিল্ম-মাধ্যমে ভারতের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরেছে। সত্তর দশকে কলকাতার সমাজ-রাজনীতির অবক্ষয় তুলে ধরেন মৃণাল সেন, ‘ইন্টারভিউ’ ও ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতে তিনি চলচ্চিত্রের এক নতুন ভাষা সৃষ্টি করেন। ১৬ মিমি ফরম্যাট, ভারতীয় সিনেমায় ক্যামেরার চঞ্চলতা ও ইচ্ছেমতো অবস্থান পরিবর্তন করে নবীনদের প্রতিবাদকে বাস্তব রূপ দিয়েছিল। ‘হাংরি অটাম’ তথ্যচিত্রে গৌতম ঘোষ তৎকালীন বাংলার খাদ্য সঙ্কট ও দারিদ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন; ছবির শুটিংয়ে তিনি ১৬ ‘রিভার্সাল ফিল্ম’ ব্যবহার করেছিলেন, ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে এই ছবির কোনও নেগেটিভ ছিল না। কুমার সাহনির ছবি ‘দ্য গ্লাস পেন’ ভারতীয় চলচ্চিত্রে অন্য এক ভাষা তুলে ধরে। মণি কউলের ‘উসকি রোটি’ ছবিতে দেখা যায় এক বাসচালক ও তাঁর স্ত্রীর জীবনের বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি। এই ছবির প্রাথমিক সংস্করণ ১৬ মিমি ফরম্যাটে তোলা।

সিনেমাহলগুলো যখন প্রবল ব্যয়সাধ্য হয়ে ওঠে, তখন গ্রামাঞ্চলে ১৬ মিমি প্রিন্টের মাধ্যমে এক সমান্তরাল বিতরণ ব্যবস্থা চালু হয়। পরিবেশকরা গ্রামে-শহরে ১৬ মিমি প্রোজেক্টর ও ফিল্ম প্রিন্ট নিয়ে গিয়ে রাতভর সাদা পর্দায় ছবি দেখাতেন। ১৬ মিমি ফিল্ম প্রিন্ট এই ‘ট্যুরিং টকিজ়’-এর ক্ষেত্রে উপযুক্ত হয়ে ওঠে। অতি সহজে বাস্তবধর্মী চিন্তাভাবনা ও রাজনৈতিক বার্তা গ্রামীণ ভারতে পৌঁছে দেওয়া যেত। একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। ছোটবেলায় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর গাড়িতে মাইক ঝুলিয়ে দু’-তিন জনের একটা দল আসত, পাড়ার মাঠে সাদা পর্দা টাঙিয়ে ১৬ প্রোজেক্টর (পরে বুঝেছি) দিয়ে সাত দিনে সাতটা সিনেমা দেখাত। মাঠে বসে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ দেখে আমি হঠাৎ ‘তফাত যাও’ বলে গর্জে উঠে বাড়ির সবাইকে চমকে দিতাম। সেই মাঠেই প্রথম উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রাজ কপূর, দিলীপকুমার, ধর্মেন্দ্র, বিনোদ খন্না, সাধনা, আশা পারেখকে চিনেছিলাম। আমার চলচ্চিত্র-শিক্ষক ফাদার রোবের্জ এক বার কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলেন, ১৯৬১ সালে তিনি মন্ট্রিয়ল থেকে নিউ ইয়র্ক আসেন, সেখান থেকে জাহাজে চড়ে প্রথম ভারতে। জাহাজ ছাড়ার পরে জানতে পারেন, যে দেশের উদ্দেশে যাত্রীরা রওনা হয়েছে, সে দেশের কিছু সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা জাহাজে রয়েছে। বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে ফাদারের প্রথম পরিচয় সত্যজিৎ রায়ের সূত্রে, জাহাজে বসেই তিনি (১৬ প্রোজেক্টরের মাধ্যমে) ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’ দেখেন।

আশির দশকের আগে পর্যন্ত বাংলা মূলধারার সিনেমায় এই ফরম্যাটের সীমিত ব্যবহার থাকলেও, ডিজিটাল ক্যামেরা পাকাপাকি ভাবে বাজার দখলের আগে ভারতীয় টিভির উল্লেখযোগ্য অধিকাংশ কাজ ১৬ মিমি ক্যামেরাতেই শুট করা হয়। ১৯৮২ সালে দূরদর্শনের জন্য ১৬ মিমি-তে নির্মিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি’ ছবিটি উল্লেখযোগ্য: সময়, স্মৃতি আর মানবিক সম্পর্কের গভীর সংযোগের বার্তা ছিল তাতে। ‘টু: আ ফিল্ম ফেবল’ ছবিটি সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন ১৯৬৪ সালে। সাম্প্রতিক কালে ছবিটির ডিজিটাল সংরক্ষণের সময় অস্ট্রিয়ান ফিল্ম মিউজ়িয়ম থেকে ১৬ মিমি প্রিন্ট উদ্ধার হওয়ার ফলে অনেকের ধারণা, সত্যজিৎ ছবিটি ১৬ মিমি-তে শুটিং করেছিলেন। বাস্তবে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন তাঁদের চলচ্চিত্রজীবনে ৩৫ মিমি ছাড়া কোনও ফরম্যাট ব্যবহার করেননি।

ক্যামেরায় হাতে-খড়ি

আমার সিনেমাজীবনের হাতেখড়ি ১৬ মিমি ক্যামেরা দিয়ে। কলকাতায় তখন বেশ কয়েকটি ১৬ মিমি ক্যামেরা ছিল। লাভলক স্ট্রিটের ‘ইমেজ ইন্ডিয়া’, নারকেলডাঙার ‘অরোরা স্টুডিয়ো’, বেহালায় ‘এনএফডিসি’, এ ছাড়াও টালিগঞ্জের দেলু নাগ, রানিকুঠির বিজয় চট্টোপাধ্যায়, ডোভার লেনের নারুবাবু, যামিনী রায়ের নাতি দেবব্রত রায় ও চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের নিজস্ব ১৬ মিমি ক্যামেরা ছিল। প্রয়োজনে তাঁদের ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। ১৯৯১ সালে বন্ধু অসীম রায়চৌধুরীর উদ্যোগ ও পরিচালনায় আমরা কয়েকজন ছত্তীসগঢ় মুক্তি মোর্চা আন্দোলন নিয়ে তথ্যচিত্র বানাব মনস্থির করি। হাতে সময় কম, দিন কয়েকের মধ্যে রায়পুর পৌঁছতে হবে। অথচ পকেটে ফুটো পয়সাটিও নেই। এক বিকেলে চিত্রবাণী-তে জড়ো হলাম, আমাদের অর্থাভাব শুনে বীরেন দাসশর্মা-দা ফাদার রোবের্জের কাছে আমাদের হয়ে দরবার করলেন। ফাদার চিত্রবাণীর নিজস্ব ‘১৬ বোলেক্স’ ক্যামেরাটি ব্যবহারের অনুমতি দেন।

টাকা ধার করে পার্ক স্ট্রিটে কোডাক থেকে এক রিল ১৬ মিমি ফিল্ম কেনা হল। ফিল্ম রিলে চক্রাকারে গোটানো থাকে চারশো ফুট ফিল্ম, অথচ বোলেক্স ক্যামেরার পেটে একশো ফুটের বেশি ফিল্ম ধরে না। সেলুলয়েডের ধর্ম, কোনও ভাবে আলোর ছোঁয়া বা উত্তাপ লাগলে তা অকেজো হয়ে যাবে। অথচ আমাদের শুটিং দিনের আলোয়, শুটিংয়ের মাঝে বেশ ক’বার ক্যামেরার ফিল্ম ম্যাগাজ়িন বদলাতে হবে। এই কাজের জন্য ক্যামেরার সঙ্গে বেশ কয়েকটা পুরনো ফিল্মের খালি কৌটো, কালো কাগজ ও ফিল্ম চেঞ্জিং ব্যাগ নিতে হল। তখন আমরা যারা ক্যামেরা-সহকারী ছিলাম, আমাদের রাস্তাঘাটে দিনের আলোয় চেঞ্জিং ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে চোখে না দেখে শুধু হাতের স্পর্শে ক্যামেরা-ম্যাগাজ়িনে ফিল্ম লোড করতে হত, প্রত্যেক সহকারী ক্যামেরাম্যানের এই কাজ জানা বাধ্যতামূলক ছিল। চেঞ্জিং ব্যাগে ‘ফিল্ম লোডিং’ কথাটা শুনে সহজ মনে হলেও এতে যথেষ্ট ধৈর্য, সতর্কতা ও দক্ষতা প্রয়োজন। একটা ১০০০ বা ৪০০ ফুটের, গোল হয়ে গুটিয়ে থাকা ফিল্ম রিলের কোনও অংশের বাঁধন চ্যুত হলে তাকে গুটিয়ে শুধু আগের পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনলেই হবে না। এ সব ক্ষেত্রে ফিল্মে ঘষা খেয়ে দাগ ও হাতের আঙুলের ছাপ লাগার আশঙ্কা থাকেই, সেটা সামলাতে হত। স্টিল ফোটোগ্রাফি চর্চার সময় এটা দারুণ রপ্ত করেছিলাম। আমাকে মাঝেমধ্যে ১০০০ ফুটের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনে রিল থেকে স্টিল ফোটোর জন্য ৩৬টা ফ্রেম কেটে ছোট ক্যাসেটবন্দি করতে হত। ১০০০ ফুট সিনে ফিল্ম থেকে সাড়ে চার ফুটের ছোট টুকরো করে কাটা ‘কাট ফিল্ম’ ব্র্যান্ডেড ফিল্মের থেকে দামে সস্তা হওয়ায়, বাজারে এর চাহিদা ছিল বেশি।

ভিলাই পৌঁছলাম। কিন্তু শুটিং শুরুর আগে নতুন সমস্যা। তখন ‘ডেলাইট টাইপ’ ফিল্ম বাজারে ছিল না। যে ফিল্ম সহজে পাওয়া যেত সেটা ‘টাংস্টেন’ ফিল্ম, অর্থাৎ ইনডোরে টাংস্টেন লাইট ব্যবহার করে শুটিংয়ের উপযুক্ত। এই ফিল্মের ‘রঙের তাপমাত্রা’ সাধারণত ৩২০০ কেলভিন। আমাদের আউটডোর পুরো দিনের আলোয় শুটিং, দিনের আলোর রঙের তাপমাত্রা সাধারণত ৫৫০০ কেলভিন। এ ক্ষেত্রে ৩২০০ থেকে ৫৫০০ কেলভিনে রং পরিবর্তনের সহজ উপায়, ক্যামেরার লেন্সের সামনে ৮৫ বা ৮৫বি নামের একটা কমলা রঙের ফিল্টার লাগিয়ে শুট করা। এই ফিল্টারের কাজ নীল আলোর তীব্রতা কমিয়ে ছবিতে উষ্ণতা যোগ করা, ফলে ছবিতে সব রং স্বাভাবিকের মতো দেখায়। ভুলবশত সেই ফিল্টার সে বার আমাদের সঙ্গে ছিল না। রায়পুর স্টেশনে পা রেখে বন্ধু মধু শী আর আমার মাথায় হাত। এত কিছুর পরে একটা ভুলের জন্য কি তীরে এসে তরী ডুববে! শেষে আমার স্টিল ক্যামেরার ব্যাগ হাতড়ে কিছু কালার প্রসেস নেগেটিভ পেলাম। এই নেগেটিভ হালকা কমলারংয়ের হওয়ায় সেটা মাপমতো টুকরো করে, ক্যমেরার লেন্স খুলে তার পিছন দিকে সেঁটে দিয়ে শুটিং শুরু করলাম। কলকাতায় ফিরে ফিল্ম প্রসেস হওয়ার আগে পর্যন্ত বিষয়টা শুধু আমার আর মধুর মধ্যেই ছিল। পরে ডিজিটাল ক্যামেরা এলে দেখলাম, আলাদা করে ফিল্টারের বাক্স নিয়ে ঘোরার প্রয়োজন নেই। ক্যামেরাতেই প্রয়োজনীয় সব ফিল্টার; আলো অনুযায়ী বোতাম টিপে দিলেই ক্যামেরায় ফিল্টার আপনা-আপনি লেন্স জুড়ে বসবে।

ছবি: প্রীতম দাশ।

পরিচালনার চোখ ১৬ মিমি

১৯৮৯-এ ১৬ মিমি-তে আমার পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘অব্যক্ত’। নির্মলকুমার-মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনীত সে ছবি ছিল মাত্র সাড়ে আট মিনিটের। এই ছবিতে ফুজি ফিল্ম ব্যবহার করেছিলাম। তখন শুটিংয়ে অনুমানিক কত ফুট ফিল্ম প্রয়োজন হবে তা উল্লেখ করে ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এ দরখাস্ত দিতে হত। আমিও দিলাম, নিদিষ্ট দিনে কর্তারা ছবির বিষয় শুনে ফিল্ম পারমিট লিখে দিলেন। ১৬০০ ফুট ফিল্মের আবেদন করে বাস্তবে সে দিন আমায় মাত্র ৮০০ ফুট ফিল্ম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেই পারমিট দেখিয়ে ফিল্ম সংগ্রহ করে অঞ্জন দাস, মহাদেব শী ও অনুপ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় ছবিটি সম্পন্ন হয়। ‘অব্যক্ত’ পরিচালনার পর কিছু দিন ভারতের নানা প্রান্তে নানা সিনেম্যাটোগ্রাফারের সহকারী হয়ে কাজ করি। কাজ বলতে শুধু শুটিংয়ের সময় ক্যামেরা চালানো নয়। নানা ক্যামেরাশিল্পী চিত্রনাট্যকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে অথচ সিনেমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দৃশ্যে আলোর ব্যবহার, ক্যামেরা মুভমেন্ট ও শট কম্পোজ়িশন ঠিক করছেন— শুটিং শুরুর আগেই সে সব আমি খাতায় ও মাথায় ধরে রাখতাম। বছরের পর বছর নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের সব নির্দেশ পালন করেছি, আমার চলচ্চিত্র-শিক্ষালাভের সেটাই ছিল একমাত্র সহায়।

তখন স্বাধীন ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেছি, বন্ধু অশোক বিশ্বনাথন ‘কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ’ ছবির জন্য ডাকল। ১৬ মিমি-তে শুট হয়েছিল, ছবিতে বন্ধু শুভাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (লালু) সঙ্গে আমি ‘স্ট্যান্ডবাই ক্যামেরাম্যান’ ও সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলাম। ১৯৯৯ সালে গৌতমদার (ঘোষ) ১৬ মিমি ক্যামেরাতে বড় পরিসরে তথ্যচিত্র শুট করি, ‘বাসা’। নন্দনে বসে সে ছবির পরিকল্পনা, বিভিন্ন প্রযোজকের মুখোমুখি হয়ে অর্থ জোগাড়, ছবি শুট করে সেন্সর অবধি সুপ্রিয় সেনের সঙ্গে সে ছবিতে আমার বিশেষ ভূমিকা ছিল।

২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর ভেঙে পড়ল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। সে দিন মুর্শিদাবাদে ডকুমেন্টারি শুটিং করছিলাম। রাতে হোটেলের টিভিতে দৃশ্যটি দেখার পর মাথার মধ্যে তার রেশ রয়ে গেল। তখন আমি সোনারপুরের বাসিন্দা, বেশি রাতে শুটিং শেষ হলে প্রোডাকশনের গাড়ি গড়িয়া বাসরাস্তা পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। মাঝরাতে বাড়ি ফেরার একমাত্র সম্বল ছিল দুধের গাড়ি। সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে দুধের গাড়ির ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পড়তাম। যাতায়াতের এই অসুবিধায় কলকাতায় বাসা ভাড়া নিলাম। এক সকালে ভাড়াবাড়ির ফোন বেজে উঠল, ও-প্রান্তে অশোক বিশ্বনাথন, “চলো, পেন্টাগনের বিষয়টা নিয়ে একটা কিছু করি।” এ বারের ছবি ‘অন্য স্বপ্ন’। ওড়িশার এক ১৬ মিমি ক্যামেরায় আমার কর্মজীবনে প্রথম স্বাধীন পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। ৯/১১-এর দুর্ঘটনার সময়ে কলকাতায় একটি পরিবারের উপর তার প্রভাব, এ-ই ছিল মূল বিষয়।

আশির দশকে বাংলা ও ভারতীয় আঞ্চলিক সিনেমা বাঁচিয়ে রাখার পিছনে ১৬ মিমি ফিল্ম ও ক্যামেরার ভূমিকা অনস্বীকার্য। উত্তমকুমারের মৃত্যুর কিছু কাল আগে থেকেই হিন্দি সিনেমার দাপটে বাংলা সিনেমার বাজারে বেশ মন্দা দেখা দেয়। বাংলা সিনেমায় লগ্নি তখন তলানিতে। সে সময় ৩৫ মিমি এক রিল (৪০০ ফুট) ফিল্মের বাজারদর ১৬ মিমি এক রিল (৪০০ ফুট) ফিল্মের বাজারদরের প্রায় আড়াই গুণ ছিল। শুধু দামের তফাত নয়। ৩৫ মিমি ৪০০ ফুটে শুট করা যেত মাত্র চার মিনিটের ফুটেজ, সেখানে ১৬ মিমি ৪০০ ফুটে প্রায় দশ মিনিটের। তাই তখন বেশ কিছু আঞ্চলিক, কয়েকটি সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক ছবিতেও ১৬ মিমি ফিল্ম ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিক ভাবে ১৬ মিমি থেকে সরাসরি সিনেমা প্রদর্শনে একটা সমস্যা দেখা দেয়। ১৬ আর ৩৫ মিমি-র অ্যাস্পেক্ট রেশিয়ো আলাদা হওয়ায় সিনেমাহলের পর্দা ও প্রোজেক্টর মেশিনের স্থায়ী দূরত্বে প্রদর্শিত ছবি আকারে অনেক ছোট দেখাত। তখন মুম্বইয়ের অ্যাডল্যাবস-এর মনমোহন শেট্টীর চেষ্টায় ১৬ মিমি নেগেটিভ থেকে ব্লো-আপ প্রিন্টে ৩৫ মিমি হয়ে যাওয়ায় প্রোজেকশনে অ্যাস্পেক্ট রেশিয়ো-র সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হয়। দর্শকের চোখে অরিজিনাল ও ব্লো-আপ প্রিন্টের বিশেষ তফাত ধরা না পড়ায় প্রযোজক ও পরিচালকেরা পূর্ণ বিশ্বাসে মূলধারার বাংলা ছবিতে নিয়মিত ১৬ মিমি ফিল্মের ব্যবহার শুরু করেন।

১৬-এর বাজার জমে উঠতেই হাজির হল নতুন সুপার-১৬ ক্যামেরা। এই ক্যামেরার জন্য ফিল্মের গেজ অনেকটা বড় হল, ইমেজ কোয়ালিটি উন্নত হল। সাধারণ ১৬ ফ্রেমের আয়তন ছিল চওড়ায় ১০.২৬ মিমি, লম্বায় ৭.৪৯ মিমি, দু’পাশে মোট চারটে ফুটো যার সাহায্যে ক্যামেরাতে ফিল্মটা চলত। সুপার ১৬-এর ক্ষেত্রে ফ্রেম চওড়ায় ১২.৫২ মিমি যা সাধারণ ১৬-এর থেকে প্রায় আড়াই মিমি বড়— সিনেমার ফ্রেমে সেটা যথেষ্ট। লম্বায় একটু ছোট, ৭.৪১ মিমি। ফিল্ম গেজ এক রেখে ইমেজের জন্য অতিরিক্ত জায়গা করা সম্ভব হয়েছিল দু’দিকে চারটে ফুটোর বদলে এক দিকের দু’টো ফুটো বন্ধ করে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিশেষত ‘ডিজিটাল ইন্টারমিডিয়েট’-এর জন্য ১৯৭০ সাল থেকে এই ফরম্যাটের ছবির গুণমানে অকল্পনীয় উন্নতি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘ভেরা ড্রেক’ ফিল্ম রেকর্ডারের মাধ্যমে ৩৫ মিমি ফিল্মে মুদ্রিত হয়েছিল। ডিজিটাল এই প্রক্রিয়ার কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে ৩৫ মিমি প্রিন্টের মান এতটাই ভাল হয় যে, অনেক পেশাদার চলচ্চিত্রকারও এটি ৩৫ মিমি-তে শুট করা হয়েছে বলে ভুল করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে অ্যাকাডেমি পুরস্কারজয়ী ‘লিভিং লাস ভেগাস’ ছবির পরিচালক মাইক ফিগিস ছবিটি সুপার ১৬ মিমি-তে চিত্রায়িত করেছিলেন। পরবর্তী কালে আলেহান্দ্রোগনজ়ালেজ় ইনারিতুর ‘ব্যাবেল’, ক্যাথরিন বিগেলো-র ‘দ্য হার্ট লকার’, ড্যারেন অ্যারনফস্কির ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ এবং টড হেইঞ্জের ‘ক্যারল’ ছবিগুলি ১৬ মিমি-তে তোলা।

১৯৯০ সালে নীতীশ রায়ের পরিচালনায়, স্বপন নন্দীর চিত্রগ্রহণে ‘এক পশলা বৃষ্টি’ ছবি সফল হওয়ায় এই জুটি ১৯৯৪ সালে আবার একই মাধ্যমে ছবি করলেন ‘তবু মনে রেখো’। ১৬-এর নেগেটিভ আকারে ছোট ও দুর্বল হওয়ায় তা থেকে বেশি প্রিন্ট তৈরি সম্ভব হত না। এই কারণে ১৬ ছবি নেগেটিভ থেকে সরাসরি ৩৫ ব্লো-আপ নেগেটিভ তৈরি করে নিয়ে তা থেকে হল-প্রিন্ট করা হত। ১৯৯১ সালে বাংলা সিনেমার মরা গাঙে বান নিয়ে এল মতিউর রহমান পানু-র ছবি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। এই ছবি তৎকালীন বাংলার চল্লিশটা হল-এ রিলিজ় করে, পঁচিশটাতে রজতজয়ন্তী সপ্তাহ চলেছিল। বাকি হল-এ দিনে তিনটে করে শো, টানা একশো দিন। প্রযোজক লাভের অঙ্ক দিয়ে পরে ১৬ ব্লো-আপে তৈরি করেন ‘প্রাণ সজনী’, সে ছবিও সুপারহিট।

ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে স্বাধীন চিন্তাশীল সৃষ্টির, সীমিত বাজেটে বাস্তব গল্প বলার আর বহু উদীয়মান পরিচালকের প্রথম ধাপ ছিল ১৬ মিমি ফিল্ম। নভরোজ কন্ট্রাক্টর, বেণু গোপাল, অনুপ জাঠওয়ানি, বীরেন্দ্র সাইনি, জাহাঙ্গীর চৌধরী, বিনোদ প্রধানের মতো সিনেম্যাটোগ্রাফাররা ১৬ ক্যামেরার মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেন মণি কউল (দুবিধা), সঈদ মির্জা (অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিউঁ আতা হ্যায়), গোবিন্দ নিহালনী (আক্রোশ, তমস), বিপ্লব রায়চৌধুরী (মহাপৃথিবী), গৌতম ঘোষ (দখল), জোছন দস্তিদার (প্রাগৈতিহাসিক) কেতন মেহতা (হোলি), জন আব্রাহাম (আম্মা আরিয়ান), জহ্নু বরুয়ার (হাল্ধিয়া চরায়ে বাওধান খায়ে) মতো এক দল তরুণ পরিচালকের সঙ্গে। তাঁদের হাত ধরে আধুনিক ভারতীয় সিনেমার ভাষা পৌঁছে গেল আন্তর্জাতিক সিনেমার আসরে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian Cinema Indian films Camera Bengali Theatre

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy