Advertisement
E-Paper

ফ্র্যাংকেনস্টাইন ২০০

২০০ বছর আগে লেখা হয়েছিল এই অসামান্য হরর স্টোরি। তা কি মনস্টার নিয়ে? না বাবা-ছেলে, ঈশ্বর-মানুষ, স্রষ্টা-সৃষ্টির কাজিয়া নিয়ে? ২০০ বছর আগে লেখা হয়েছিল এই অসামান্য হরর স্টোরি। তা কি মনস্টার নিয়ে? না বাবা-ছেলে, ঈশ্বর-মানুষ, স্রষ্টা-সৃষ্টির কাজিয়া নিয়ে?

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৮
আদমের জন্ম দিচ্ছেন ঈশ্বর। ‘মেরি শেলি’জ ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ ছবির দৃশ্য।

আদমের জন্ম দিচ্ছেন ঈশ্বর। ‘মেরি শেলি’জ ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ ছবির দৃশ্য।

সাচ্চা ‘ভূতের গল্প’-এর আদর্শ পরিবেশ কী? ঝমঝমে বর্ষার রাত, পোড়ো বাড়ি, লোডশেডিং, এক দল বন্ধু, চা, মুড়ি-তেলেভাজা। দুশো বছর আগে মেরি শেলি নামের আঠেরো বছর বয়সি একটা মেয়ে যখন একটা ‘হরর স্টোরি’ লিখছে, এর প্রায় সবগুলোই ছিল। শুধু হাপুস বৃষ্টির বদলে হাড়হিম শীত (১৮১৬ সালটায় এত ঠান্ডা পড়েছিল ইউরোপে, লোকে নামই দিয়েছিল ‘দি ইয়ার উইদাউট আ সামার’), নিবু-নিবু মোম-আলো, নিরালা মস্ত বাগানবাড়ি, আর চার বন্ধুর আড্ডা। মেরির প্রেমিক পার্সি, আরও দুই দোস্ত বায়রন আর পলিডরি। জেনেভা-র সেই সন্ধেয়, জার্মান ভাষায় লেখা ভূতের গল্প পড়তে গিয়ে ঠিক হল, চার বন্ধুর প্রত্যেকে একটা করে ‘হরর স্টোরি’ লিখবে। মেরি দিনরাত ভাবে, তবু কলমে কিছু আসে না। তার পর, বিনিদ্র এক মাঝরাতে, টুকরো টুকরো ছবি আসে কয়েকটা। দুঃস্বপ্নের মতো, শিউরে-ওঠার মতো চিত্রকল্পরা সাদা কাগজে ঠাঁই পায়। সেই বই-ই ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’। বইটা অবশ্য প্রকাশিত হয়েছিল আরও দু’বছর পর।

আইকনিক হরর স্টোরি, গথিক নভেল বলে আজও রমরম বিকোয় মেরি শেলির ‘ফ্যাংকেনস্টাইন’। কিন্তু ভূত কোথায় সে গল্পে? আদতে এক বিজ্ঞানসাধক আর তার সাধনার কাহিনি। ভিক্টর নামের বিজ্ঞান-পাগল এক লোক প্রায়-অবসেস্‌ড, ‘জীবন’ সৃষ্টির ভাবনা নিয়ে। ঈশ্বর প্রাণ সৃষ্টি করতে পারেন, মানুষ পারবে না? বিজ্ঞানের সহায়ে মরে যাওয়া শরীরে, হৃদয়ে, পেশিতে আনতে পারবে না প্রাণের স্পন্দন? সেই নিয়েই ল্যাবরেটরিতে ভিক্টরের একের পর এক পরীক্ষা, চেষ্টা। একটা মানুষ-খোলের মধ্যে সে ঢোকায় বহু মৃত লোকের শরীর থেকে জোগাড় করে আনা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ— মগজ, যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড। তার পর এক দিন যখন প্রাণ পায়, দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সেই সৃষ্টি, ঘেন্নায়-আতঙ্কে কুঁকড়ে যায় বিজ্ঞানী নিজেই। ঈশ্বরের গড়া মানুষ-শরীর কী সুন্দর, সুঠাম, সুষম! আর ভিক্টরের সৃষ্টি কুৎসিত, কদর্য, ভয়ংকর। হলদে চোখ, চামড়ার তলায় ফ্যাটফেটে রক্তনালী, আট ফুটের একটা অতিকায় দানব। নিজের সৃষ্টির কদর্যতা দেখে ভিক্টর পালিয়ে যায়। আর মানুষ হয়েও না-মানুষের কলঙ্ক বয়ে বেড়ানো ‘মনস্টার’ ক্রমে হয়ে ওঠে হিংস্র খুনি, নির্দয় নরপিশাচ।

অনেকেই এই ভুলটাকে সত্যি বলে জানেন: এই দানবটার নাম ফ্র্যাংকেনস্টাইন। আদৌ তা নয়, ভিক্টর ফ্র্যাংকেনস্টাইন হল বিজ্ঞানীর নাম! মানেটা পরিষ্কার— বিজ্ঞানী বা স্রষ্টাই এই বইয়ের প্রধান চরিত্র। বইটার পুরো নাম খেয়াল করলেও সেটা আরও স্পষ্ট হয়। ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন, অর দ্য মর্ডান প্রমিথিউস’। পশ্চিমি মিথ বলছে, প্রমিথিউস নামের এক টাইটান সৃষ্টি করেছিল মানুষ, প্রাণ, জীবন। এ কালের প্রমিথিউস তার ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে এক অতিকায় জীবন। পুরো গল্পটাই আসলে তাকে নিয়ে— তার সৃষ্টি, তার অবজ্ঞা-উপেক্ষা-ঘেন্না-গ্লানি-অপরাধবোধ নিয়ে লেখা গল্প। গত প্রায় একশো বছরে এই বই থেকে হওয়া অগুনতি সিনেমাও সাক্ষ্য দেবে। ১৯৯৪-এর ছবি ‘মেরি শেলি’জ ফ্র্যাংকেনস্টাইন’-এ রবার্ট ডি নিরো অভিনয় করেছিলেন দানবের ভূমিকায়। হেভিওয়েট অভিনেতা, রোলটা কিন্তু সাপোর্টিং অ্যাক্টরের!

দানবটাকে নিয়েই এত কাণ্ড, অথচ গল্পে তার কোনও নামই নেই! গোটা বই জুড়ে তাকে ডাকা হয়েছে মনস্টার, ক্রিচার, ডেমন, ফিয়েন্ড, এমনকী ইংরেজি সর্বনাম ‘ইট’ দিয়ে। অথচ সে কিন্তু দিনের আলোর মতো সত্যি, সপ্রাণ, হৃৎপিণ্ড ধুকপুক-করা মানুষ একটা। ভিক্টর তাকে জন্ম দেয়, কিন্তু কোনও নাম দেয় না। নাম না দেওয়া মানে তো তার বেঁচে থাকাটাকেই স্বীকৃতি না দেওয়া। সে-ও যে রোটি-কাপড়া-মকান-আশিক-মহব্বতের অধিকারওয়ালা আস্ত একটা মানুষ, সেটাকেই প্রত্যাখ্যান করা। দানবের মতো বিকট কদাকার দেখতে বলে, ভিক্টর তাকে ত্যাজ্য করে। অথচ সে যে দেখতে এমন ভয়ংকর কুৎসিত, তাতে কিন্তু দানবটার কোনও হাত নেই, আছে তার স্রষ্টার দুটো হাত! তাই সে প্রশ্ন করে, ‘আমাকে কেন এমন করে বানালে, যাতে তোমার নিজেরই ঘেন্না হচ্ছে? ঈশ্বর মানুষকে বানিয়েছেন তাঁর নিজের চেহারার মতো করে, আর আমার মুখটা দেখো, তোমারই একটা নোংরা, ভয়ংকর আয়না-ছবি।’ অথচ সে বুদ্ধিমান, নিজে নিজেই কথা বলতে, পড়তে-লিখতে শিখেছে। সে চায় মানুষ তার কাছে আসুক, তাকে বুঝুক, ভালবাসুক। কিন্তু সবাই তাকে ভয় পায়, তাকে দেখে পালিয়ে যায়। সভ্য, সামাজিক মানুষের এই যে সহ-মানুষকে বুঝতে না-পারা, এটাই তাকে খেপিয়ে তোলে। সন্তান হয়েও বাবার ভালবাসা না পাওয়াটা তাকে নিয়ে যায় খুনখারাবির পথে। ভিক্টরকে সে বলে তার জন্য একটা সঙ্গিনী বানিয়ে দিতে, তারও যে আছে ‘রাইট টু হ্যাপিনেস’। সেটাও না পেয়ে সে বিয়ের রাতেই খুন করে ভিক্টরের প্রেমিকাকে, নববধূর শরীরটা চিরে বের করে আনে থরথর রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড। ভালবাসা না পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাওয়া এক প্রেমহীন মানুষ সে।

এর সঙ্গে আজকের ট্র্যাজিক নায়কের মিল পাওয়া যায় না? বা আমাদের? আমাদের কি মনে হয় না, এত প্রত্যাখ্যান কেন, আমায় কেন লোকে আমার ভেতরটা দিয়ে বিচার করল না? মেরি শেলির উপন্যাসকে পড়া যায় স্রষ্টা আর সৃষ্টির সম্পর্কের বুননেও। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছেন এই পৃথিবীতে। সেখানেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? মানুষ ভাল কাজ করছে না মন্দ, ন্যায়ে আছে না অন্যায়ে বাঁচছে, সেটা দেখা কি স্রষ্টার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? স্তানিসোয়াভ লেম-এর কল্পকাহিনিতে ছিল দুই বিজ্ঞানী বন্ধুর কথা। এক জন একটা বাক্সের মধ্যে বানিয়ে ফেলেছেন একটা গোটা পৃথিবী, আর অজস্র মানুষ তৈরি করে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন সেখানে। তারা সেই পৃথিবীতে ঘুরছে-ফিরছে-ভালবাসছে, আর স্রষ্টা বিজ্ঞানী ওপর থেকে আপন সৃজনানন্দে মুচকি হাসছেন। কিন্তু যে দিন সব মানুষ দুটো দলে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করবে বলে হাতা গুটোনো শুরু করল, বন্ধু বিজ্ঞানী বললেন, সে কী, তুমি এখনও শুধু দেখছ? ওরা যে যুদ্ধ করে মরে যাবে সব, থামাও ওদের! বিজ্ঞানী বললেন, ওরা যুদ্ধ করবে না যাত্রাপালা, বন্দুক ধরবে না বাঁশি, সেটা একান্তই ওদের ব্যাপার। আমি কেন নাক গলাব? সেটা তো ওদের ‘ফ্রি উইল’-এর ওপর জোরজবরদস্তি! বন্ধু শুনে স্তম্ভিত। জন্মদান করে উঠেই মা যদি অনাসক্তির সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন, তাতে তো তামাম সন্তানকুলের রোগব্যামোবিপদ সংক্রমণের আশঙ্কা কাটে না!

এই সে দিন প্যারিসে হামলার পর দলাই লামা বলেছেন, ঈশ্বরের কাছে ‘প্লিজ, টেররিজ্ম থামান’ প্রার্থনা করার কোনও যুক্তি নেই। সমাধান করতে হবে মানুষকেই, কারণ ওটা মানুষেরই তৈরি একটা সমস্যা। ঠিকই তো। ভিক্টর ফ্র্যাংকেনস্টাইনের কাছে তার সৃষ্টি মূর্তিমান টেররিজ্ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার নিজের ভুলেই। যে কোনও সৃষ্টিই তো জন্মমুহূর্তে খুব নাজুক, পলকা, চূড়ান্ত ভালনারেব্‌ল থাকে। তাকে ছায়ায়, মায়ায় আগলে রাখতে হয়— হতকুচ্ছিত, বিশ্রী হলেও। মানুষ হয়ে এসে, ভেসে, ভালবেসে তার পাশে না দাঁড়ালে তো সে একা হয়ে যাবে। ফ্র্যাংকেনস্টাইনের হাতে-গড়া মনস্টার যেমন বলে: আমার হওয়ার কথা ছিল ‘অ্যাডাম’, আমি হয়ে গেলাম ‘ফলেন এঞ্জেল’। কিন্তু শয়তানেরও তো কত সঙ্গীসাথী, আর আমি খুব, খুব একা...

iwritemyright@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy