E-Paper

বাড়ির পুজোর ভবিষ্যৎ

আলো-ঝলমলে বারোয়ারির উল্টো দিকে টিমটিম করে জ্বলছে অনেক সাধারণ বাড়ির পুজো। অর্থবল, লোকবল নেই। নিভে আসছে উৎসাহও। ক্রমশ বিলুপ্তিই কি এই পুজোগুলির ভবিতব্য?

সুজিত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৪
জনহীন: দুর্গাদালানে লোকসংখ্যা হাতে গোনা।

জনহীন: দুর্গাদালানে লোকসংখ্যা হাতে গোনা।

সংখ্যা, আবেদন, জৌলুস ও আকর্ষণে সর্বজনীন দুর্গাপুজোরা চিরকালই মানুষের মন টানে। বিপরীতে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে সাধারণ বাড়ির পুজোরা। বিভিন্ন মঠ, মিশন এবং বনেদি বাড়ির পুজো আইনানুগ, সুগঠিত ট্রাস্টের হাতে পরিচালিত। সুনিশ্চিত আয় ও লোকবলে, এই সব পুজোর স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত।

বরাবরই দেখা গিয়েছে, সর্বজনীন পুজোগুলি খুবই সঙ্ঘবদ্ধ। এদের অর্থনীতি–– বিজ্ঞাপন, চাঁদা ও স্পনসরশিপ নির্ভর এবং বর্তমানে সরকার-পোষিত। প্রয়োজন অনুযায়ী ধার্য চাঁদা আদায় হয়। মানুষের হাতে এখন টাকাপয়সা এসেছে, ফলে শহরাঞ্চলে চাঁদা ওঠে ভালই। ইউনেস্কো-র তকমার পরে, এই পুজোর এখন একাদশে বৃহস্পতি।

কিন্তু পুজোর আলোয় মোড়া রাস্তায় চলতে চলতে শহরে মফস্সলে কিংবা গ্রামেও আমাদের চোখে পড়ে কোনও না কোনও সাধারণ বাড়ির পুজো। ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে ঠাকুরদালান। ঠাকুরদালানে একচালায় সপরিবার দুর্গা। খুব পুরনো, বা একটা ভাড়া করে আনা ঝাড়বাতির টিমটিমে আলোয় প্রতিমার মুখে ঘনীভূত বিষাদ। আর কত দিন এই ‘বাপের বাড়ি’তে আসতে পারবেন তিনি? টিভিতে-সিনেমায় দেখা বাড়ির পুজোগুলোর মতো লোকবল, অর্থবল কোনওটিই আর নেই। পুজোর কাজ সারার মতো হাতে গোনা লোকজন নমো-নমো করে পুজোর জোগাড় করছেন। নতুন প্রজন্ম গ্রাম, শহর বা দেশ ছেড়েছে উন্নত কর্মসংস্কৃতির খোঁজে। যাঁরা আছেন, তাঁরা কোনও মতে নিয়মরক্ষা করছেন। তাঁরা চোখ বুজলে কী হবে— দেবা ন জানন্তি।

আগেকার দিনে জন্ম-মৃত্যুর মতো, প্রায় সব পুজোই হত বাড়িতে। সুদূর অতীতে কৃষিভিত্তিক, সম্পন্ন, ধর্মপ্রাণ ও একান্নবর্তী পরিবারের কোনও এক পুণ্যাত্মা পূর্বপুরুষ হয়তো পুজো শুরুর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। স্বপ্নাদেশে সূচিত পুজোর কয়েক প্রজন্ম পরের উত্তরপুরুষরাও বিশ্বাস করতে ভালবাসতেন— ‘দেবী স্বয়ং তাঁর পূজার আয়োজন করে থাকেন।’ বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে, সেই বিশ্বাস পরিবর্তিত।

দুর্গাপূজা মহাপূজা, একক ভাবে তা সম্পাদন অসম্ভব। অসাধারণ এই মহাপুজোর চাহিদা বিত্তবান, চিত্তবান, সহৃদয়, সগোত্র বংশধর, কৃতী, জ্ঞাতি, বন্ধু, পড়শি সবার সহৃদয় সার্বিক সহযোগিতা। দেবী নিজে যেমন দশভুজা, তেমনই দশ জন হাত না লাগালে তাঁর পুজো হওয়াও রীতিমতো কঠিন। অল্প অর্থে, অল্প লোকবলে ‘পুজো তোলা’ও যে দিন দিন কঠিনতর হয়ে উঠছে।

সাধারণ ভাবে বাড়ির পুজোর অর্থনীতি দুর্বল। প্রায়ই পুজো নির্বাহ করতে মানুষকে অর্থবানের কাছে ধার করতে হয়, শহরাঞ্চলে ব্যাঙ্ক ইত্যাদি থেকে ‘ফেস্টিভ্যাল লোন’ও নেন অনেকে। বর্তমানের বদলে-যাওয়া আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনে সৃষ্ট ছোট ছোট পরিবার, দাপুটে কর্তাদের অবসান সুনিশ্চিত করেছে বাড়ির পুজোর ধীরগতি বিলুপ্তি।

দেশভাগের পর জমি ও সর্বস্ব হারিয়ে ও-পারের ভূস্বামীরা এ-পারে আসতেই পড়লেন সমাজতন্ত্রের খপ্পরে। জমিদারি প্রথা বিলোপ হল বর্গা, ভূমির ঊর্ধ্বসীমা, রেন্ট কন্ট্রোল, জবরদখল, সাব টেনান্সি ও অ্যাডভার্স পজ়েশন-এর ত্রাসে। লক্ষ্মীস্বরূপা জমি রেয়াত করল না এ-পারের বিত্তবানদেরও।

জমিহারা, ত্রস্ত, একদা-সম্পন্ন একান্নবর্তী পরিবারে অর্থনৈতিক বৈকল্যের সঙ্গে, সময়ের স্রোতে ক্রমাগত শরিকের সংখ্যাবৃদ্ধিতে পারিবারিক বন্ধন প্রথমে হল শিথিল, পরে তা ছিন্ন হয়ে ভিন্ন হল পরিবার। শুরু হল নতুন প্রজন্মের বিদেশযাত্রা। ফলে কমতে শুরু করল পুজোয় পরিশ্রম এবং আনন্দ করার তরুণ প্রজন্মের লোকজন।

“বাড়ির পুজোর সংখ্যা ক্রমশই কমছে, তাই পুরোহিতদের এখন পছন্দ সর্বজনীন পুজো,” জানালেন হালসীবাগানের ঠাকুরমশাই ত্রিপুরাপ্রসন্ন গঙ্গোপাধ্যায়। পুরোহিতদের দিক থেকে ভাবলেও বোঝা যায় যে, দুর্গাপুজো কোনও পুরোহিত একা করতে পারেন না। সঙ্গে তন্ত্রধারক সহ আরও এক-দু’জন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়। আবার দুর্গাপুজোয় খেপ খাটাও যায় না, এক-এক বছরে একটির বেশি পুজো ধরাও সম্ভব নয়। ফলে তাঁরাও তো তাঁদের আখেরের কথা ভাববেন। সুতরাং স্তিমিত হয়ে আসা বাড়ির পুজোর নানা সীমাবদ্ধতায় তাঁদের প্রয়োজন পোষানো মুশকিল হয়ে ওঠে।

অথচ পুজোয় বিভিন্নতার সম্পূর্ণ দর্শন কিন্তু বাড়ির পুজোতেই দেখতে পাওয়া যায়। যেমন পূজার্চনার বহুধা উপচার, প্রথা ও গ্ৰন্থ— চতুর্বেদ, অষ্টাদশ মহাপুরাণ, তন্ত্রের অনুষঙ্গ, সপ্তকল্পারম্ভ ইত্যাদি। উপাসনা হয় ঘটে, পটে বা মূর্তিতে, পঞ্চোপচার থেকে ষোড়শোপচারে। উদ্দেশ্য এক, পন্থা অনেক। বাড়ির পুজোর কোলাজ যেন এক বহুবর্ণের আলপনা। বারোয়ারি পুজোর বাহুল্য বা আড়ম্বর অনুপস্থিত থাকলেও, এতে আছে প্রাণ ও প্রথাসিদ্ধতার সমন্বয়। কিন্তু সনাতন গার্হস্থ উপাসনার ঐতিহ্য ক্রমশই দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু। সেই ‘স্বার্থ’রক্ষার্থেও ‘বাড়ির পুজো’ সংরক্ষণীয়।

ধ্বংস ও অপবিত্রতা থেকে বাঁচতে, বাংলাদেশের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্গাবিগ্ৰহকেও উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। স্বয়ং দেবী যদি উদ্বাস্তু হন, বরিশাল জেলার নলছিটি থানার স্বরমহল গ্রামের তিন-মন্দির’সহ চার-শরিকি সেনশর্মা-বাড়ির জ্যেষ্ঠপুত্র মহেন্দ্রনাথবাবুর কপাল কি অন্য রকম হবে? সর্বস্ব ছেড়ে সপরিবার চলে এলেন কলকাতায়। মহেন্দ্রবাবু ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত পুজো বহাল রেখেছিলেন কলকাতার আত্মীয় ও শরিকদের বাড়িতে, ১৯৫৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত স্থানীয় ক্লাব-পরিচালিত পুজোয় ঘটস্থাপনে। তাঁর সফল ও প্রতিষ্ঠিত জ্যেষ্ঠ পুত্র, পার্থপ্রতিম, বালিগঞ্জের ফার্ন রোডের পারিবারিক বাড়িতে ২০১২ সাল থেকে শুরু করলেন দুর্গাপুজো, “আমার সৌভাগ্য যে মা দেখে গেছেন, আমাদের বংশের পুজো আমাদের বাড়িতেই,” সবিনয়ে জানালেন পার্থপ্রতিমবাবু।

কিন্তু তার পর? বাড়ির পুজোর তিন প্রতিবন্ধকতা— স্থান, অর্থ ও লোক। পার্থবাবুর প্রথম দুইয়ের অভাব না-থাকলেও, অভাব লোকবলের। তাঁর দুই ছেলেই প্রবাসী। ফি-বছর তাঁরা সপরিবার এসে পুজোর যাবতীয় কাজে দায়িত্ব ও অংশ নেন। তবুও তাঁর দুশ্চিন্তা— পুজোর ঐতিহ্য কি বহমান থাকবে!

বীরভূম জেলার ব্লক খয়রাশোলের পাঁচড়া গ্ৰামের এক যজমান, কুবেরবাবু জানালেন, তাঁর ঠাকুরদার প্রপিতামহ, পূর্ণশশী গোস্বামী, তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ ও স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তাঁদের পারিবারিক সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে শুরু করেন তন্ত্র ও বৈদিক মতে দুর্গাপূজা। তাঁদের মতে, বেদ ও তন্ত্র যথাক্রমে পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক ধারা এবং পরস্পরের পরিপূরক। জীবনে, পূজনে ও সাধনেও চাই বেদ ও তন্ত্রের যৌথ প্রয়োগ। দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ, বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ, তোড়লতন্ত্র ও মুণ্ডমালাতন্ত্র থেকে নির্বাচিত অংশ নিয়ে পূর্ণশশীবাবু-লিখিত ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ আজও অনুসৃত হচ্ছে। দেবী এখন পালা করে পূজিত হন ।

গ্ৰামের লোকের সাহায্যে মেলে শুধুই স্বেচ্ছাশ্রম। অদূর ভবিষ্যতে অর্থাভাবে পুজো বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা জোরালো। কুবেরবাবু দ্বিধাহীন ভাবে পুজোয় সরকারি অর্থসাহায্য চান। না হলে ঐতিহ্য রক্ষা করে যাওয়া দুঃসাধ্য হবে।

তৃতীয় পুজোর যজমান অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী বিভাস চক্রবর্তী। বাড়ি দক্ষিণ কলকাতার আঞ্জুমান আরা বেগম রো। আদিবাড়ি জয়নগর থেকে আশি বছর আগে তাঁর বাবা পুজোর ‘শাখা’ এনেছিলেন। এখানকার পুজো এখন সংক্ষিপ্ত। তাঁর দুই ছেলে কলকাতায় কর্মরত, তিনিও চিন্তিত পুজোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। “ছোট ও সাধারণ পরিবারে পুজো টিকিয়ে রাখা সমস্যার। লোক ও স্থানাভাব আছেই, তার উপর তলানিতে এসে পৌঁছচ্ছে পারিবারিক সঞ্চয়। পুজো এক সংস্কার, যত দিন পারি চালিয়ে যাব...” বিভাসবাবুর বিষাদ-বিলাপ। করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের অবচেতনে ঢুকে গিয়েছে ব্যয়-সঙ্কোচনের নিরন্তর প্রচেষ্টা। ফলে মানুষ যেন পুজোতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।

সরকারি সাহায্যের প্রশ্নে, তিনি জানালেন, “প্রয়োজনে পুজো আরও ছোট হবে, সরকারি সাহায্য কখনওই নয়।” যতটুকু পারেন, নিজেরাই করার পক্ষপাতী তিনি।

তবু যাঁদের সরকারি সাহায্য বিনা উপায়ান্তর নেই, ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে সরকার কি সেই অপারগ যজমানদের ‘বাড়ির পুজো’ চলমান রাখতে কোনও অনুদানের কথা ভাববেন কখনও?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja 2025

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy