ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
ঘুমের মধ্যেই নিত্যবাবু টের পেলেন, সমস্যাটা আবার শুরু হয়েছে। রেগুলেটর, গায়ের চাদর, সরস্বতী পুজোর আগের আবহাওয়া— এইতিনটের অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারেন না এক সময়ের জাঁদরেল অঙ্কের শিক্ষক নিত্যবাবু। অথচ সুরমা ঠিক পারত এই হিসাব মেলাতে, কবে লেপ ঢুকে গিয়ে পাতলা কাঁথা বেরোবে, তা নিয়ে যেন শীতের আর সুরমার বোঝাপড়া ছিল। শীতের সঙ্গে সুরমার বোঝাপড়া— কথাটা নিজের মনের মধ্যেই বারদুয়েক চালাচালি করলেন নিত্যবাবু বাথরুম থেকে ফিরতে ফিরতে। গত শীতেই তো সুরমা চলে গেল।
সুরমা না থাকুক, শীত শেষে যে বসন্ত আছে তা রেগুলেটর টের পেল, যখন পোড়-খাওয়া শিক্ষকের কানমলায় তাকে চার থেকে পাঁচে উঠতে হল। ঘুম আসছে না, যেমন আজকাল আসে না মাঝে মাঝেই। গোটা বাড়িতে বাচাল ঘড়িটার কাঁটা ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। এক সময় ক্লাসে কথা বেশি হলে তিনি হুঙ্কার দিতেন ‘সাইলেন্স!’ বলে, এখন সাইলেন্স তাঁকে সারা দিন জড়িয়ে ধরে থাকে, ঘুরতে এসে বাড়ি না ফিরতে চাওয়া আত্মীয়ের মতো।
এই মাঝরাতে বারান্দায় এসে চাদর জড়িয়ে বসতে বসতে মনে হল, বাড়িটা অহেতুক এত বড় না বানালেও হত। অথচ তিনি আর সুরমা বাড়ি বানিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন ছোট হয়ে গেল ভেবে। সবাই বড় হবে, বিয়ে করবে, সবার কুলোবে? কুলিয়ে তো বেশ যাচ্ছে, একটা মোবাইল থাকলে তার মধ্যেই কুলিয়ে যাচ্ছে সব সম্পর্ক। অথচ দোষ কি আদৌ আছে কারও! নিত্যবাবু চেয়েছেন, তাঁর ছেলে প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দৌড় তাকে ভৌগোলিক ভাবে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ছেলে শমীককে নিয়ে তাঁর গর্ব কম নয়। সে এখন ডাবলিনে প্রতিষ্ঠিত। বৌ, ছেলে, মেয়ে নিয়ে তার ভরা সংসার। সুরমা বেঁচে থাকতে দিনে এক বার ফোন করতই। এখন সপ্তাহে এক বার। তাতেও এক মিনিট পর শমীক এবং নিত্যবাবু কথা খুঁজে পান না, বরং নাতি-নাতনিদের মুখে ইংরেজি-মেশানো ভাঙা বাংলা শুনতে তাঁর খুব মজা লাগে। কিন্তু ওরা সরে গিয়ে মোবাইল স্ক্রিনে নিজের ছেলের মুখ ভেসে উঠলেই তাঁরা দু’জনেই কেমন থমকে যান, স্মার্টফোনটা কেমন ব্ল্যাকবোর্ডের মতো দেখতে হয়ে যায়, যেখানে সময়ের চক দুষ্পাঠ্য ভাষায় নীরবতা লিখে দিয়ে গেছে।
তবে স্মার্টফোন যে বেশ কাজের জিনিস, তা তিনি খুব বুঝতে পারছেন এই সত্তরে এসেও। ২০০০ মাধ্যমিক ব্যাচ জোর করে না গছালে তিনি এ জিনিস নিতেনই না। ওদের ব্যাচের সুপ্রিয় চিরকাল ডাকাবুকো। সে এসে যখন ধমকাল, “আপনি চিরকাল টেকনোলজি-টেকনোলজি করে এসেছেন, আর এখন নিজেই গুটিয়ে যাচ্ছেন তো?” বুঝলেন, এরা ঠিক করেছে যখন উপহার দেবে, তখন দেবেই। শেষ এবং মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়লেন, “একা থাকি, শিখব কার কাছে?”
ভেবেছিলেন মুক্তি পাবেন, ফল হল উল্টো! রোজ সন্ধেবেলা ফ্লাস্কে চা নিয়ে স্মার্টফোনের এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার স্যরকে শেখাতে হাজির সুপ্রিয় স্বয়ং। পরে বন্ধু তানাজি ফোনে বলেছিল, “তুই কি কিছুই বুঝিস না নিত্য? সুরমা চলে যাওয়ার পর তোর যাতে একা না লাগে, তাই ওরা এটা করেছে।”
এখন সুপ্রিয়ই আবার ফোন করে ধমকায়, “মান্না দে-র ছোটবেলার গান ভেবে আপনি নধর রায়ের গান পাঠাচ্ছেন কেন সবাইকে?”
কিন্তু সবারই তো জীবন আছে। সেই জীবনে তাকে ফিরতেই হয়, স্মার্টফোন নামক খেলনাটা মশগুল রাখে একটু, খবরের চ্যানেল আর সিরিয়াল দু’-তিনটে, রাতে শোওয়ার আগে সুরমার উদ্দেশে এক পাতা লেখা। কিন্তু সুরমা চলে যাওয়ার পর থেকে বুকের কাছে একটা ভারী পাথরের মতো ওজন বসে থাকে— ‘আমি একা’—এই বিশ্রী অনুভুতিটা সরে না কিছুতেই।
সবাই বলে আবার কোচিং শুরু করতে, কিন্তু নিত্যবাবু দশ বছর আগে যে কারণে স্কুল ছাড়ার দু’বছরের মধ্যে কোচিং ছেড়ে দেন, সেই কারণ কমেনি তো বটেই, বরং বেড়ে চলেছে। যে ছাত্রদের জটিল ক্যালকুলাস বোঝাতে পেরেছিলেন, তাদের অনেককেই চাকরির অঙ্ক বোঝাতে পারছিলেন না। যারা বুঝছিল, তারা থাকছিল না আর এ পোড়া শহরে। কিছুটা অপরাধবোধ থেকেই কারও কথা, এমনকি সরমার কথাও না শুনে কোচিং বন্ধ করে দেন। এখন মনে হয় ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। শুতে যাওয়ার আগে ক্যালেন্ডারে দেখলেন, সরস্বতী পুজোর তারিখ আর বেশি দূরে নেই। আলো নিবিয়ে দিলেন। এক সময় সরস্বতী পুজোয় কী মজাই না হত! নিজের মনেই ভাবলেন। গভীর রাতের টিকটিকি সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক, ঠিক, ঠিক!”
সরস্বতী পুজো ১৯৯৬
শমীককে সুরমা দূর্বা তুলে আনতে বললে বেচারা বুঝতে পারে না। এক গোছা ঘাস তুলে আনে, তাই নিত্যবাবু স্নান করেই ছেলেকে নিয়ে গেলেন দূর্বা চেনাতে, সেটা করেই চলে গেলেন বাড়ির পুজোর জন্য টাটকা দই, দুধ, ফুলমালা, মিষ্টি আনতে। ফিরে এসে দেখলেন শমীক বীরের মতো চন্দন ঘষছে, মিশন দূর্বা অ্যাকমপ্লিশড। ঠাকুর বরাবরই কোচিং-এর ঘরেই রাখা হয়। সকালে তেমন জমায়েত হয় না, কয়েক জন আসে যাদের বাড়িতে পুজো হয় না, স্কুলও দূরে। তারা সকলে সুরমার জোগাড়যন্ত্রে সাহায্যও করে বিস্তর।
সাড়ে ন’টা নাগাদ পুরোহিতমশাই চলে এলেন। পুজো শুরু হল নিরুপদ্রবে। শেষ মুহূর্তে সুরমা ঘাবড়ে গিয়ে হয় সলতে, নয় ভুজ্যিপাত্র, কিছু না কিছু আনতে ভুলে যান, তা এ বারও হল যদিও। ঝামেলা হল অঞ্জলি দিতে বসে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অঞ্জলি দিতে বসলেই শমীক হাসতে শুরু করে। এ বারও তা-ই হল। একটা বাচ্চা হাসলে সেটা সমস্যা নয়, কিন্তু শমীকের হাসি এতই ছোঁয়াচে, কোচিং-এর ছেলে, মেয়ে থেকে সুরমা এবং সবাইকে ধমক দিতে গিয়ে শেষে নিজেও হেসে ফেললেন নিত্যবাবু। পুরোহিতমশাই এক জন শিক্ষকের অবিমৃশ্যকারিতা দেখে কটমট করে তাকিয়ে থাকলেন শুধু।
পুজো হয়ে গেলে পুরোহিতমশাই শান্তির জল ছিটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তার পর সুরমা রামঠাকুরের পাঁচালি পড়ে সবাইকে এক এক করে প্রসাদ দিলেন। সদ্য রামঠাকুরের দীক্ষা নিয়েছেনসস্ত্রীক নিত্যবাবু।
তিনি কোনও রকমে প্রসাদ খেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এই দিনটা স্কুলে মন পড়ে থাকে, সব ছাত্ররা আসে, শিক্ষকেরা আসেন, প্রদর্শনী হয়, খাওয়াদাওয়া... কত কিছু হয়। সব থেকে বড় কথা, এই দিনগুলোতে শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে আগল কিছুটা হলেও কমে যায়। আর যে হেতু উল্টো দিকের বিল্ডিং-এ মেয়েদের মর্নিং স্কুলের পুজো হয়, একটা বয়সের পর কিছু ছাত্রের যে সে দিকেও মন পড়ে থাকে, তা তিনি বিলক্ষণ বোঝেন। কিন্তু তিনি যা বোঝেন, তা তিনি ছাত্রদের বুঝতে দেন না। যে ভাবে প্রাক্তন ছাত্রের গায়ের সিগারেটের গন্ধ গায়ে মাখতে নেই, সে ভাবেই এগুলো এত না দেখলেও চলে, তা তিনি এত দিনে বুঝে গেছেন।
সন্ধের পর কোচিং-এ জমায়েত শুরু হয়। সব ব্যাচের ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে হয়ে গান-বাজনা শুরু। কেউ কেউ আবৃত্তি করে, কেউ নিজের লেখা পড়ে শোনায়, চুটকি বলে, নিত্যবাবু এক কোণে বসে সব দেখেন, হাসেন, বুক ভরে যায়। আজ টিচার্স রুমে একটা সিগারেট খেয়েছেন, বছরের এই একটা দিনই খান। ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে রাত আর শরীর দুই-ই ভেঙে আসে। সুরমা আর নিত্যবাবু, দু’জনেরই। বিছানায় শুয়ে সারা দিনের গল্প আর হয়ে ওঠে না। নীচে রাখলে বেড়াল কী করবে, এই ভয়ে উপরে নিয়ে আসা মুড়কির হাঁড়ি খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে তার উপর ওজন বসানো। নিত্যবাবু আর সুরমার না-বলা পরিশ্রান্ত গল্পেরা পাখার হাওয়ার উড়ালে ওই হাঁড়ির খবরের কাগজকে পেয়ে বসে। নীল নাইটল্যাম্প খবরের কাগজের ওড়ার ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিয়ে তাকে পরি সাজিয়ে দেয়। পলকা ওজনের বাধায় পরি তার ডানা ঝাপটায়। সেই ডানার হাওয়ায় মেঝেতে এসে পড়ে নিত্যবাবু আর সুরমার না বলতে পারা ক্লান্ত কথাগুলো। সকালে সুরমা উঠে জিভ কাটেন, যখন দেখেন ঘরে কুচো ফুল ছড়িয়ে রয়েছে।
২০০১, শমীকের সরস্বতী পুজো
ঘুম থেকে উঠেই শমীক টের পেল, বাড়ির আবহাওয়া অন্য বছরের পুজোর থেকে গম্ভীর। কারণটা অবশ্য সে-ই। আসলে বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পাড়ার পুজোয় এই প্রথম রাত জেগেছে শমীক। যত না দরকারে তার চেয়ে বেশি জেদে, কারণ নিত্যবাবুর মতামত শমীকের দমবন্ধ করে দিচ্ছে। না হলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল না শমীকের বিন্দুমাত্র, বাবার জোরাজুরিতে পড়তে হচ্ছে। বাড়ির পুজো মিটে গেলে বাবা সাইকেল নিয়ে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।
শমীকও স্কুলে যাবে, কিন্তু একটু ঘুরপথে। বি ডি মেমোরিয়ালের পিছনে একটা অন্ধগলি আছে। সেই গলিতে অপেক্ষা করছে প্রথম প্রেমের প্রতিশ্রুতি, সরস্বতী পুজোর শাড়িতে ইন্দ্রাণী। ছায়া-ছায়া ধূসর রঙের শাড়ি পরে রাস্তায় অপেক্ষা করছিল সে। রোদের জন্য ভুরুটা কুঁচকে ছিল বোধ হয়, গলির মুখে শমীকের হলুদ পাঞ্জাবিটা দেখে ভুরু ঠিক হল। মুখে ফুটে উঠল সেই ফিচেল হাসি, যার সামনে যে কোনও মানুষের গাম্ভীর্য ভেঙে পড়তে বাধ্য।
শমীকের সেই অর্থে নিয়মনিষ্ঠ জীবনে ইন্দ্রাণী যেন এক মূর্তিময়ী বেনিয়ম। না হলে ডাকসাইটে অঙ্কের শিক্ষক নিত্যপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে শমীক সরস্বতী পুজোর দিন কোনও মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে, তা যেন অকল্পনীয়। বাবা যদি শমীকের এই বেহিসাবের কথা জানতে পারেন, তা হলে কী হবে তা শমীক কল্পনা পর্যন্ত করতে পারছে না। বাবা যে স্কুলে পড়ান, শমীক সেই স্কুলেই পড়ে। বন্ধুদের মতে, তার মতো সুখী কেউ নয়! কেউ বুঝত না, এ রকম অঘটন যেন শত্রুর জীবনেও না ঘটে। শমীকের স্কুল-জীবনে কোনও দুষ্টুমি নেই, নেই রেনি-ডে’তে স্কুলের মাঠে নেমে বন্ধুদের সঙ্গে ঝুপ্পুস ভেজা। সে যে অঙ্কশিক্ষকের ছেলে! বাকিরা দুষ্টুমি করলে তাদের রোল নম্বর পৌঁছয়, তার পৌঁছয় বাবার নাম। তাই গুটিয়ে নিতে নিতে শমীক নিজেকে একটা খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছে।
খোলসের ভিতরের মানুষটা কেমন, তা নিজেই ভুলে গেছিল শমীক। ওকে নিজের ভিতরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রাণী। তা থেকেই কালকে হালকা অগ্ন্যুৎপাত, এবং বাবার নির্দেশ অমান্য করে পাড়ায় রাত জাগা। ইন্দ্রাণী যেন পাহাড়ি খরস্রোতা নদী, যার সামনে শমীকের যাবতীয় ওজর-আপত্তি খড়কুটোর মতো ভেসে বেরিয়ে যায়। ওর সঙ্গে শমীকের আলাপ বাবারই কোচিং-এ। এমন দস্যি মেয়ে, প্রথম দিন জিয়োমেট্রিক প্রোগ্রেশন শিখতে গিয়ে শমীকের হাত চেপে ধরেছিল। শমীকের হৃদয়ের ট্রেন রাতের অন্ধকারে সশব্দে লোহার পুল পেরোচ্ছিল। ইন্দ্রাণীর যেন কোনও হেলদোলই নেই।
শমীক বরাবর গান চালিয়ে অঙ্ক করে। সে দিন বাড়ি ফিরে ওর অঙ্কে মন বসল না। শাহরুখের ছবির গান নতুন ভাবে বেজে উঠল পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারে। শমীকের সে দিন খালি মনে হচ্ছিল, ওঁর বুকের আওয়াজ বাবা-মা শুনে ফেলবে না তো? চিনে ফেলবে না তো?... ‘তুম আয়ে তো হাওয়াও মে রংগ সা হ্যায়…’ ইন্দ্রাণী তার কথা ভাবছে কি না, সেটা ভাবতে ভাবতেই রাতের রং হালকা হয়ে এল ক্রমশ। তার পর আর কী, টেলিফোনে পরস্পরের নিঃশ্বাসের শব্দ চেনা, তার পর সেই ডানায় ভর দিয়ে বেকুবের মতো বলে ফেলা, “ভালবাসি।”
বিভিন্ন কোচিং-এর আগে-পরে সাইকেল নিয়ে বেপাড়ার অলিগলিতে তারা খুব অল্প ঘুরেছে, কিন্তু দু’জন সেজেগুজে স্কুলকে অজুহাত করে শুধু দু’জনের জন্য বেরোনো এই প্রথম। শমীক নিজের পাঞ্জাবির পকেটে হাত চালিয়ে একটা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট দিল ইন্দ্রাণীকে।
“আমার পছন্দের কয়েকটা গান, তোর জন্য রেকর্ড করিয়েছি। সময় করে শুনিস...” শমীক হাঁটতে হাঁটতে বলল।
“এমনিতেই ক্যালকুলাস মাথায় ঢুকছে না, এখন গান শুনতে গিয়ে ধরা পড়লে আর রক্ষে থাকবে না...” ইন্দ্রাণী হাসতে হাসতে বলল।
“থাক, শুনতে হবে না, ক্যাসেট ফেরত দে।”
“বাবা! নিত্যস্যরের ছেলে কী রাগী রে, কথায় কথায় ঠোঁট ফুলে যায়!” ইন্দ্রাণীর হাসিতে রোদ্দুর টুকরো টুকরো হয়ে গলিতে ছড়িয়ে পড়ল।
শমীকের ঠিক এই সময় মনে হল, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর শাহরুখের মতো যদি ও এক দিন ইন্দ্রাণীর জানলায় মুখ বাড়িয়ে চমকে দেয়? কেমন হবে ইন্দ্রাণীর মুখ? ও কি চমকে উঠবে রানি মুখার্জির মতো? ইন্দ্রাণীর ধাক্কায় সম্বিত ফিরল শমীকের।
“কী রে, এখনও রেগে রয়েছিস? বললাম তো বাবা, শুনব।”
অভিমান মুলতুবি রেখে রিকশায় উঠল দু’জন। এক অলীক সুখ এই বাসন্তী দুপুরে ঘিরে রইল ওদের। এক মনগড়া সংসারের দম্পতি যেন মিষ্টি হাতে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছে রবিবারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। নিজেদেরই মনে হওয়া, নিজেরাই গোপন আনন্দে শিউরে ওঠা। এক মিষ্টি বোকামির আবির ছড়াতে ছড়াতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল রিকশাটা। স্কুল আসার দশ মিনিট আগে রিকশা থেকে নেমে গেল শমীক। এ বার দু’জন দুই পথে। যে যার নিজেদের স্কুলে, কিন্তু আজকের দেখা এখানেই শেষ নয়, সন্ধেবেলা বাবার কোচিং-এ আবার। স্কুলে গেল শমীক, হুল্লোড়ও করল বন্ধুদের সঙ্গে, কিন্তু আশ্চর্য আনন্দের দুঃসহ তিরতিরে অনুভুতি তার বুকের নরমকে ছুঁয়ে ছিল। এ রকম কিছু আগে ওর হয়নি, সরস্বতীর আদলে ও খুঁজেছে ইন্দ্রাণীর মুখ।
কোচিং-এ সরস্বতী-ধোওয়া সন্ধে নামল। শতরঞ্চিতে নামল হারমোনিয়াম, তবলা। আসর জমজমাট হয়ে উঠল সবার গলায়, হাসিতে। শমীক যদিও বাকিদের দেখতে পাচ্ছিল না। চোখের আস্পদ্দারও বলিহারি, সবার সামনে সে চুরি করে নিচ্ছিল তুঁতে শাড়ি-পরা ইন্দ্রাণীর দৃষ্টি। ইন্দ্রাণী যখন ‘নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ আকাশে’ গেয়ে উঠল, তখন শমীক ভাবছিল, এ রকম একটা বসন্তসন্ধ্যায় তাকে পূর্বজন্মে কেউ কথা দিয়েছিল, তাই তার বড় হওয়া। এই সন্ধেটার জন্য, শুধু এই সন্ধেটার জন্যই।
সবাই চলে যাওয়ার পর মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছিল শমীক।
“কেমন কাটল এ বারের পুজো?” কাজ করতে করতে সুরমা জিজ্ঞেস করলেন।
কাঠের বারকোশ পরিষ্কার করতে করতে নিজের মনেই শমীক বলল, “ভাল, কেন?”
যেন কিছুই নয়, এমন ভাবে সুরমা ডেকচি নিয়ে যেতে যেতে বললেন, “বলছি, আমার কিন্তু ইন্দ্রাণীকে খুব ভাল লাগে।”
শমীকের বুকে যেন বোমা বিস্ফোরণ ঘটাল কেউ। তাও মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, “ও, তা আমাকে বলছ কেন?”
মা কী ভীবলেন নিজের মনে, শুধু বললেন, “আর যা-ই করুক, গান যেন না ছাড়ে...” বলে নিজের কাজে চলে গেলেন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শমীক, এ সব কী বলছিল মা? কিছু বুঝতে পেরেছে নাকি? কে জানে, মা সব বুঝতে পেরে যায়। মা, শমীকের বন্ধু— বাবার সঙ্গেই ক্রমশ কথা ফুরিয়ে আসছে। বাবার আর শমীকের অঙ্ক মেলা বহু দিন আগে বন্ধ হয়েছে। আজকাল বাবা যা বলেন সেগুলোই আর করতে ইচ্ছে করে না। ঘর খালি হয়ে যাওয়ার পর পকেট থেকে শমীক একটা ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বের করে সরস্বতীর পায়ে ঠেকাল। বেরোনোর সময় এটা ইন্দ্রাণী ওকে দিয়েছে।
সরস্বতী পুজোর আগের দিন, এই বছর
সুরমা চলে যাওয়ার পর হিসাবমতো দ্বিতীয় বছর এটা। কিন্তু আগের বারের সরস্বতী পুজো সুরমার মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে ছিল, তাই পুজো কোথা থেকে এল, কোথায় গেল নিত্যবাবু টের পাননি। কিন্তু এ বারের পুজোয় একাকিত্বটা যেন বুকে এসে ধাক্কা মারছে। স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। স্কুলে চেনা মুখ কমে গেছে, পোষা ক্যারম বোর্ড পেয়েছে নতুন প্রভু, ভাল লাগত না। কোচিং বন্ধ করে দেওয়ার পর বুড়োবুড়ি ছোট করে পুজো করতেন। দুপুরে এক সঙ্গে বসে খেতেন খিচুড়ি, লাবড়া। এই বার আর কার জন্য কী? একটু আগেই ঘুরে এলেন ‘বালক সঙ্ঘ’-র সামনে থেকে। টিমটিম করছে সরস্বতী পুজোর ক্ষমাপ্রার্থী মণ্ডপ। ‘নতুন দল’-এর অবস্থাও তাই। আসলে দুটো ক্লাবই এখন বড় করে গণেশ পুজোর দিকে ঝুঁকেছে। নিত্যবাবু বোঝেন, এর মধ্যে কোথাও একটা হতাশা কাজ করছে। মা সরস্বতী বড়জোর কয়েক বছর মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করতে পারছেন। তার পর কী? মোবাইল রিপেয়ারিং? না, তার থেকে গণেশই ভাল। তাঁর গুদামে ইঁদুরে বিদেশি ফোন কাটে। বাঙালি বাবা-মা আজকাল আর নিত্যবাবুর মতো মানুষকে সন্তানদের দেখিয়ে বলে না, ‘ইনি নিত্য স্যর, এঁর মতো বিদ্বান হতে হবে।’ সবাই বলে, ‘অমুকবাবুকে দেখ, ওঁর কলকাতায় তিনটে বাড়ি, চারটে গাড়ি। তোমাকে ওঁর মতো হতে হবে।’
আজ সকালে শমীক ভিডিয়ো কল করেছিল এয়ারপোর্ট থেকে। ও ব্রাজিলে যাচ্ছে অনসাইটে। দু’মাসের কাজ, ওখানে সেটল করতে কয়েক দিন লাগবে, তাই ফোন না-ও করতে পারে। নিত্যবাবুর খুব জানতে ইচ্ছে করে, শমীকের মেয়ে ঐশানী বা ছেলে তথাগত আদৌ জানে, সরস্বতী পুজো কেমন? কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয় না, জিজ্ঞেস করা যায় না। সেই সেতু দু’জনেই বন্ধ করে দিয়েছেন বহু দিন। নিজের ছেলেটাই কবে যেন দূর সম্পর্কের হয়ে গেল। নিত্যবাবুর হঠাৎ মনে হল, সরস্বতীরও বুঝি তাঁর মতো বয়স হয়েছে। তাই নিজের প্রিয় শহরে তাঁর আদর কমে গেছে।
নিত্যবাবুর নিজের দায়ও তো কম নয়, শমীক যখন পাড়ার পুজোয় রাত জাগতে গেছে, তিনি হিড়হিড় করে টেনে এনেছেন এই বলে যে, তাদের বাড়ির ছেলেরা এ সব করে না। আর আশা করেছেন, অন্য বাড়ির ছেলেরা পাড়ার পুজো বাঁচিয়ে রাখবে। এই ভাবনায় এক দিন মণ্ডপ খালি হয়ে গেছে। সবাই ভেবেছে, তাদের পরিবারের ছেলেমেয়ে এ সব করে না। আজ হা-হুতাশ করলে হবে? নিত্যবাবুর চার পাশ দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, সরস্বতী হয়তো এ শহরে হেরে গেছেন। এ সব কথাই সুরমার উদ্দেশে ডায়েরিতে লিখতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় দরজার বেল বেজে উঠল।
রাত প্রায় ন’টা, এই অসময়ে কে এল? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে চমকে উঠলেন। প্রমাণ সাইজ়ের সরস্বতী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু লোক। কারা এরা! ভাবার আগেই ধমক খেলেন, “আর কত ক্ষণদরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবেন স্যর? আমরা আপনার ছাত্র, এই বছর আমরা আপনার বাড়িতে পুজো করব।”
তিনি হতভম্ব অবস্থায় সরে গেলেন। একে একে ঢুকতে লাগল ২০০০ ব্যাচের ব্রতীন, ৯৮-র অনির্বাণ, ২০০৪-এর ঋজুমন, ৯৭-এর সম্পূর্ণা, ৯৯-এর অংশুমান।
নিজের হতভম্ব ভাবটা কোনও রকমে কাটিয়ে নিত্যবাবু প্রশ্ন করলেন, “তোদের সবাইকে জড়ো করল কে?”
দরজার কাছে একটা গলা রিনরিন করে উঠল, “আমি করেছি। ইন্দ্রাণী পাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০০-এর ব্যাচ।”
হতভম্ব নিত্যবাবু দেখলেন, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে তাঁর বৌমা ইন্দ্রাণী। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর ছেলে শমীক, তথাগতকে কোলে নিয়ে। নাতনি ঐশানী মায়ের কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে, মুখে লজ্জা। এই সব দেখে এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অঙ্কশিক্ষক যা করলেন, তা জীবনে কেউ কখনও ভাবেনি। এক ঘর ছাত্রছাত্রীর সামনে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন।
রাত্রে ডায়েরিতে সুরমার সামনে স্বীকার করলেন, এই বাংলায় সরস্বতী হারে না, হারতে পারে না। কারণ বাঙালির কাছে শুধু দেবী নয় সরস্বতী, বাঙালির বুকের মধ্যে বয়ে চলা একটা নদী। আর বুকের মধ্যে বয়ে চলা নদী কখনও মজে না। তা নিঃশেষ হয় না কোনও দিন, বাইরের দূষণ তাকে ছুঁতে পারে না।
এক গাল হাসি নিয়ে নিত্যবাবু যখন ঘুমোতে গেলেন, তখন তিনি মনে মনে শমীকের ব্রাজিলের মিথ্যেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলেন।
সরস্বতী পুজোর সকাল
সকাল থেকে ছাত্রছাত্রীদের আওয়াজে বাড়ি সরগরম। নিত্যবাবুও সকাল-সকাল উঠে পড়েছেন। তাঁর উপর গুরুদায়িত্ব, নাতি তথাগতর হাতেখড়ি হবে নিত্যবাবুর হাতে। নিত্যবাবু স্নান করে তৈরি। ইলাস্টিকের ধুতি আর ছোট্ট পাঞ্জাবি পরে বাবার কোলে করে নামল তথাগত, সঙ্গে মেরুন ঘাঘরা পরে নাতনি। এ রকম অত্যাশ্চর্য ফুল এতগুলো বসন্তে দেখেননি, মনে হল নিত্যবাবুর। নাতিকে কোলে বসিয়ে খাগের কলম দিয়ে হাতেখড়ি দিতে গিয়ে টের পেলেন নিত্যবাবু, তাঁর নাতির গায়ে অবিকল শমীকের সেই বয়সের গন্ধ!
সম্পূর্ণা, অংশুমান, বরুণ, সুপ্রিয়, ব্রতীন, ঋজুমন— সবাই পরিবার, সন্তান নিয়ে এসেছে। সবাই অঞ্জলি দেবে, পুরোহিতমশাই যথোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বিষয়টা পরিচালনা করছেন। আর নিত্যবাবুর ছাত্রছাত্রী হলেও, বেশির ভাগই মাঝবয়সে পৌঁছনো কেউকেটা। বাচ্চাদের স্বভাবোচিত উচ্ছ্বাস ছাড়া পরিস্থিতি গম্ভীর। অঞ্জলি শুরু হল, ভালই চলছিল, হঠাৎ মুরগির হাঁচির মতো কোঁত করে শব্দ হতে নিত্যবাবু তাকিয়ে দেখলেন, শমীকের বেজায় হাসি পেয়েছে, ও প্রাণপণ চেষ্টা করছে চাপার। এ তো আচ্ছা বিপদ, অঞ্জলি দিতে বসলেই হাসি! এত বছরেও সারেনি? শমীকের হাসিটা বোমার মতো ফেটে পড়ল এক সময় ঘরে। ব্যস, এটা হতে যত দেরি, পুরো ঘর হাসতে শুরু করল। অবাক হয়ে নিত্যবাবু দেখলেন— উকিল, আমলা, উচ্চপদস্থ কর্মচারী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সবাই সব কিছু ভুলে দুলে দুলে হাসছে। কারও ভুঁড়ি কাঁপছে, কারও টাক ঘেমে গেছে, কিন্তু কোনও হুঁশ নেই। কিছু কিছু জিনিস কখনও বদলায় না ভাগ্যিস। যেমন শমীকের হাসি... আজও একই রকম ছোঁয়াচে। নিত্যবাবু জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সুরমার আঁচল, রোদ সেজে ঘরের মধ্যে লুটিয়ে পড়ছে।
এ রোদের অঞ্জলি চিনতে পারে ক’জন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy