যন্ত্রসভ্যতা: ১৯৩৬-এ ‘মর্ডান টাইমস’ ছবির একটি দৃশ্যে চার্লি চ্যাপলিন
লিমুজিনের দরজাটা খুলতে না খুলতেই ধেয়ে এল সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, ও ভক্তের সমুদ্র। সঙ্গে নামল প্রশ্নের ঢল।
“মিস্টার চ্যাপলিন, আপনি ইউরোপ কেন যাচ্ছেন?”
“ছুটি কাটাতে।”
“আপনি কি ওখানে সিনেমা করবেন?”
“না।”
“আপনি আপনার পুরনো ছড়িগুলো কী করেন?”
“ফেলে দিই।”
“আপনি আপনার পুরনো জুতোগুলো কী করেন?”
“ফেলে দিই।”
টানা সাত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার রোদ ও জনপ্রিয়তার আগুনে দগ্ধ তিনি। হলিউডের কোলাহল ছেড়ে ঠিক করেছেন ছুটি কাটাবেন ইউরোপে। কিন্তু সবার আগে যাবেন এক দশক আগে ছেড়ে আসা নিজের শহর লন্ডন। যাত্রার আগের দিনটা ভেবেছিলেন নির্জনে প্যাকিং করবেন। কিন্তু ডাগ ও মেরি আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের ছবি ‘দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ -এর উদ্বোধনে। কাছের মানুষদের অনুরোধ ফেরাতে পারেন না তিনি।
জনসমুদ্র ঠেলে থিয়েটারের সামনে এগোবার চেষ্টা করলেন চ্যাপলিন। পারলেন না। ভিড়ের ঠেলায় তাঁর শখের টুপি ছিটকে গেল। সেটি কুড়োবার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেল ভক্তদের মধ্যে। অসহায় হয়ে ডাগ আর মেরিকে খোঁজার চেষ্টা করলেন তিনি। লক্ষ মানুষের ভিড়ে তখন তাঁরাও নিরুদ্দেশ। তাঁর জামা ধরে টানলেন এক ভক্ত। ছিটকে গেল বোতামগুলো, ছিঁড়ে গেল টাই, সুট, কলার। ততক্ষণে পুলিশের হাত থেকে নিয়ে তাঁকে কাঁধে তুলে উল্লাস শুরু করেছেন কিছু মানুষ। অসহায় হয়ে দেখলেন, এক মহিলা ভক্ত কাঁচি দিয়ে কেটে নিচ্ছেন তাঁর প্যান্টের একটি অংশ! শেষমেশ জনতার কাঁধে চেপে কী ভাবে যেন পৌঁছে গেলেন থিয়েটারের গেটের কাছে। এত কিছুর পরও তাঁর মুখে লেগে তাঁর বিখ্যাত ‘প্রপ স্মাইল’। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আমেরিকা ছাড়বেন তিনি। তাই এ দেশের মানুষের পাগলামি হাসিমুখে মেনে নিলেন মেগাস্টার।
রাত একটা। অন্ধকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ভেসে চলেছে প্রকাণ্ড বিলাসবহুল জাহাজ ‘অলিম্পিক’। নিজের কেবিনে একা বসে চ্যাপলিন। এখন তিনি একান্তই নিজের। টুপি, গোঁফ, ছড়িহীন চ্যাপলিন। বিছানায় পিঠটা এলিয়ে দিলেন। কাল সকালে ইংল্যান্ড পৌঁছবে অলিম্পিক। খবর পেয়েছেন, ঘরের ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাতে বহু আয়োজন হয়েছে সেখানে। লন্ডনের মেয়র থেকে ওয়েলসের যুবরাজ, সবাই মুখিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তার আগে কিছুটা ঘুমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ঘুমনোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু একটা শব্দ কানে এল। কানে এল তাঁর নিজের নামটা। কান পাতলেন, কিছু শোনা গেল না। আবার কানে এল এক মহিলার কণ্ঠস্বরে গুনগুন করে একটা গানের সুর। জাহাজে আলাপ হয়েছিল এক অপেরা গায়িকার সঙ্গে। নিশ্চয়ই তিনি। তবে এত রাতে তো তাঁর গান গাওয়ার কথা নয়। শোনার ভুল নিশ্চয়ই। হঠাৎ বাতাসে হারিয়ে গেল সেই গলা। যেমন সে দিন স্টেজে হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর মায়ের কণ্ঠস্বর।
মা হ্যানা চ্যাপলিন ছিলেন অপেরা গায়িকা। বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলেও, পাঁচ বছরের চার্লি ও ন’বছরের সিডনিকে নিয়ে সচ্ছল ছিল সুন্দরী হ্যানার পরিবার। কিন্তু ল্যারিঞ্জাইটিসের প্রকোপে দুর্বল হয়ে আসছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। একদিন স্টেজে গাইতে উঠেছিলেন মা। হঠাৎ গানের মাঝে গলা ভেঙে বিশ্রী সরু হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। হাসাহাসি শুরু করলেন শ্রোতারা। কিছুক্ষণের মধ্যে তা পরিণত হল টিটকিরিতে। স্টেজ ছাড়তে বাধ্য হলেন মা। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছিল পাঁচ বছরের চার্লি। উদ্বিগ্ন ম্যানেজার শ্রোতাদের মন ভোলাতে, ছোট্ট চার্লিকে তুলে দিলেন স্টেজে গান গাইতে। বেশ মজাই লাগছিল তার। স্টেজে উঠে মনের আনন্দে গান গাইতে শুরু করলেন। হাততালির ঝড় বয়ে গেল। স্টেজের উপর পয়সা পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। ছোট্ট চার্লি গান থামিয়ে বললেন, ‘‘আমি আগে পয়সা কুড়োব, তার পর তোমাদের গান শোনাব’’। সেই শুনে আরও হাসিতে ভরে গেল হল। সে দিনটাই ছিল চার্লির প্রথম স্টেজ পারফর্ম্যান্স এবং তাঁর মায়ের শেষ।
গায়িকা হ্যানার অন্য কোনও কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই কাজও জুটল না আর। বসন্ত কেটে শীত আসতে না আসতেই ফুরিয়ে গেল জমানো টাকা। বন্ধক রাখতে হল গয়না। তিন বেডরুমের ঘর ছেড়ে দুই, তার পর তা ছেড়ে ৩ পাওনাল টেরাসের বস্তিতে এক চালাঘরে আশ্রয় নিল চ্যাপলিন পরিবার। সেলাইয়ের কাজ করে মা চালাতে থাকলেন সংসার। তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়াল অসহ্য মাইগ্রেনের যন্ত্রণা। প্রায়ই অন্ধকার ঘরে চোখে চা পাতার ব্যান্ডেজ জড়িয়ে শুয়ে থাকেন তিনি।
সে দিনও শুয়ে ছিলেন তাই। হঠাৎ বড় ছেলে সিডনি হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকল ঘরে। তার হাতে একটি পার্স। বাসে কাগজ বিক্রি করতে গিয়ে ওটা পেয়েছে সে। পার্সটা উপুড় করতেই বিছানায় পড়ল এক মুঠো রুপো ও তামার পয়সা। বেড়িয়ে পড়ল সাতটা সোনার মুদ্রা। চার্লি লক্ষ করলেন মা খুশি হয়েও, পরমুহূর্তেই চুপ করে গেলেন। শঙ্কিত হয়ে কী একটা খুঁজলেন পার্সটার মধ্যে। ঈশ্বরবিশ্বাসী হ্যানা আশঙ্কা করছিলেন, ভিতরে কোনও ঠিকানা থাকলে ফিরিয়ে দিতে হবে সব কিছু। পার্সে ছিল না মালিকের ঠিকানা। শেষমেশ হাসি ফুটেছিল মায়ের মুখে। দুই ছেলেকে নতুন জামা কিনে দিলেন। তার পর বেড়াতে নিয়ে গেলেন সাউথএন্ড সি- তে। সেই চার্লির জীবনে প্রথম সমুদ্রদর্শন। ছোট রাস্তা বাঁক নিয়ে যখন প্রথম দেখা গেল সমুদ্রটা, তাঁর মনে হয়েছিল সেটা যেন তাকে তাড়া করে আসছে। অবাক হয়ে দেখেছিলেন সৈকতের পাড়ে রঙিন ছাতা আর উলটানো নৌকোগুলো। খালি পায়ে তিনজনে হেঁটেছিলেন বালির উপর দিয়ে। ভিজে বালি, আর সমুদ্রের উষ্ণ ঢেউয়ে ক্ষণিকের জন্য ধুয়ে গিয়েছিল দারিদ্রের অনুভূতি।
ছোটবেলায় লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চার্লি দেখতেন, তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল রিৎজ হোটেল। সেই রিৎজ-এর বাইরে আজ লক্ষ মানুষ অপেক্ষারত তাঁর জন্য। হোটেলের ম্যানেজার নিজে তাঁকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ঘর ভর্তি গোলাপের স্তবক আর শুভেচ্ছাবার্তা। হোটেলের নীচের রাস্তায় পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে জনসমুদ্র সামাল দিতে। পাশে বাড়িগুলো ঢাকা দৈত্যাকার সব প্ল্যাকার্ডে। বিশাল অক্ষরে লেখা ‘চার্লি অ্যারাইভ্স’। বারান্দায় আসতেই তাঁকে দেখে উত্তাল হল জনতা, ‘‘গুড লাক চার্লি’’, ‘‘ওয়েল ডান চার্লি’’, ‘‘গড ব্লেস ইউ চার্লি’’। যেন বিশ্বজয় করে রাজা ফিরেছেন ঘরে। আনমনা হয়ে গেলেন চ্যাপলিন। এত ভালবাসা কি তাঁর প্রাপ্য? মাথা নত করে এই অভ্যর্থনা গ্রহণ করা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই তাঁর। জনতার উদ্দেশ্য হাত নাড়লেন তিনি। চুম্বন ছুড়ে দিলেন আকাশের দিকে। ঘরে থেকে নিয়ে এলেন কয়েকটি গোলাপ। একটি ছুঁড়ে দিলেন ভক্তদের দিকে। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল সেই গোলাপ কুড়োতে। দ্বিতীয় গোলাপটি ছুড়তে গিয়েই আটকে গেল হাত।
অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল সে দিন। সেন্ট থমাস হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে চার্লি ও মা। ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে বলে গেলেন, মারা গিয়েছেন বাবা। তখন বাবার বয়স মাত্র সাঁইতিরিশ, জল জমে শরীরটা ফুলে উঠেছিল বেলুনের মতো। শেষবারের মতো বিছানায় শুয়ে সে দিন বাবা বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়েছিলেন চার্লিকে। এ দিকে সৎকারের জন্য মায়ের কাছে একটা টাকাও নেই। মা ঠিক করলেন চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হবেন। আপত্তি তুললেন এক কাকা। পরিবারের মান রাখতে সৎকারের টাকা দিলেন তিনিই। সে দিন বাবার কফিনে দেওয়ার জন্য একটা গোলাপও কেনার পয়সা ছিল না মা’র। চার্লির কালো জরি দেওয়া রুমালটাই ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
গোলাপগুলি নিয়ে হোটেলের বারান্দা থেকে ঘরে চলে এলেন চ্যাপলিন। সাংবাদিক, সিনেমাজগতের লোক, ক্যামেরাম্যান... গমগম করেছে হোটেল। সবাই চান চ্যাপলিনের সঙ্গে দেখা করতে। অথচ কিছুই ভাল লাগছে না তাঁর। ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুটে চলে যেতে ৩ পাওনাল টেরাস-এর ছেলেবেলার বাড়িটার সামনে। চ্যাপলিন ঘোষণা করলেন, তিনি খুব ক্লান্ত, তাই একটু ঘুমোবেন। রাতে ডিনারের পর দেখা করবেন সবার সঙ্গে। সবাই চলে যেতেই, জামাটা বদলে ফেললেন। বেরোতে হবে হোটেল থেকে। কিন্তু সবার চোখ এড়িয়ে বেরোবেন কী করে? হোটেলের মালবাহী লিফট দিয়ে নীচে নামলেন চ্যাপলিন। হোটেল থেকে বেরিয়েই সামনে একটা ট্যাক্সি। ভিতরে বৃদ্ধ ড্রাইভার। লাফিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বললেন, ‘‘ল্যাম্বেথ যাব’’। কী ভাগ্যি, ড্রাইভার চিনতে পারেননি তাঁকে!
হে মার্কেট হয়ে ট্র্যাফালগার স্কোয়ার, পার্লামেন্ট স্ট্রিট হয়ে ট্যাক্সি উঠল ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে। ব্রিজ পেরিয়ে মোড় ঘুরতেই, যেন ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে গেল দশ বছর। চোখে পড়ল বোহেমিয়ান কোয়ার্টার, লন্ডনের উঠতি সঙ্গীতশিল্পীরা ভিড় করেন এখানেই। তার পর কেনিংটন রোড। শিশুর মতো দেখছেন চ্যাপলিন। প্রায় কিছুই যেন বদলায়নি। ওই তো চেস্টার স্ট্রিটের কেনিংটন পাব। তার কিছুটা দূরে সেই নাপিতের দোকান, যেখানে ছেলেবেলায় কাজ করেছেন তিনি। ৩ পাওনাল টেরাসে ঢোকার মুখে ট্যাক্সি থেকে নেমে চ্যাপলিন ধীর গতিতে হাঁটতে থাকলেন। কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। মনে হল এ যেন তাঁর শৈশবের বাড়ি নয়, এ এক
জীর্ণ কঙ্কাল। মনে পড়ল সেই রবিবারের কথা।
দাদা সিডনি তখন একটি জাহাজে কাজ নিয়ে গিয়েছে সমুদ্রে। প্রায় ছ’সপ্তাহ কোনও খবর নেই তার। যতই দিন যাচ্ছে চার্লি দেখছেন, মা কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছেন। সারা দিন জানালায় বসে তাকিয়ে থাকেন রাস্তার দিকে, সিডনির অপেক্ষায়। অবসাদগ্রস্ত মা বন্ধ করে দিয়েছেন সেলাইয়ের কাজও। ধার মেটাতে খোওয়া গেল সেলাই মেশিনটাও। রবিবার ভোর হলেই ঘর গুছোতেন মা। তার পর চার্লির ঘুম ভাঙলে, বিছানাতেই খাইয়ে দিতেন জলখাবার। অথচ সেই রবিবারটা যেন একদম অন্য রকম। সে দিন ঘরে ঢুকে মাকে দেখে চমকে উঠলেন চার্লি। শীর্ণকায় শরীর যেন ঝুঁকে পড়েছে মাটিতে। চোখ দুটো যেন হারিয়ে গিয়েছে কোটরের মধ্যে। অন্য দিন চার্লি চলে যেতেন প্রতিবেশী ম্যাকার্থিদের বাড়িতে খেলতে। সে দিন মাকে দেখে যেতে মন চাইল না তার। অথচ মা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললেন, ‘‘ম্যাকার্থিদের বাড়িতে যাও সোনা। এখানে কোনও খাবার নেই।’’
দুপুরে ম্যাকার্থিদের বাড়িতে খেয়ে আর খেলতে মন চাইল না চার্লির। বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন মাকে দেখতে। বাড়ির সামনে আসতে দেখলেন দরজার সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে পাড়ার কিছু ছেলেমেয়ে। কাছে যেতেই তারা চার্লিকে জানাল তার মা পাগল হয়ে গিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে কয়লা বিলি করে আসছেন। আর একটা শব্দও না শুনেই এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে ঢুকলেন চার্লি। দেখলেন আগের মতোই মা বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে।
‘‘মা’’, ডাকলেন চার্লি। ‘‘কী হয়েছে?’’ শান্ত ভাবে উত্তর
দিলেন মা।
‘‘সবাই বলল, তুমি নাকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছ?’’
‘‘হ্যাঁ, সিডনির খোঁজ নিচ্ছিলাম। ওরা সবাই মিলে সিডনিকে আটকে রেখেছে। আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সিডনিকে।’’
আর থাকতে পারেনি ছোট্ট চার্লি, কেঁদে লুটিয়ে পড়েছিল মার কোলে। হ্যানার বাকি জীবনের অনেকটাই কেটেছিল মানসিক হাসপাতালে।
মানুষের ফিসফিসানিতে ঘোর ভাঙল চ্যাপলিনের। ‘‘ওই তো। ওটাই চার্লি চ্যাপলিন!’’ বাড়তে থাকল ভিড়। একটু ভয় পেলেন চ্যাপলিন। তিনি একা। তাঁকে চিনতে পেরে হঠাৎ মানুষের ঢল নামলে কী করে সামলাবেন? দূরে এক পুলিশকর্মীকে দেখে এগিয়ে গেলেন। উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন, ‘‘আমি চার্লি চ্যাপলিন। আমাকে লোকে চিনতে পেরে গিয়েছে এখানে। দয়া করে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিন আমায়।’’ তাকে দেখে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলেন সেই পুলিশ, ‘‘চিন্তা করবেন না, মিস্টার চ্যাপলিন। আমি এ পাড়াতেই থাকি। এদের সবাইকে আমি চিনি, সবাই খুব ভাল মানুষ, কোনও ক্ষতি করবে না আপনার।’’ কথাটায় বুকের মধ্যে লাগল চ্যাপলিনের। সত্যিই তো। এটা তো তাঁরই পাড়া! এরা যে তাঁরই প্রতিবেশী। এঁদের মাঝেই তো বড় হয়েছেন তিনি। এঁদের কেন ভয় পেলেন তিনি? সাফল্য মানুষকে এত ভিতু করে দেয়? নিজের আচরণে নিজেরই মাথা হেঁট হয়ে গেল তাঁর। আবেগ সামলে নিয়ে হাসিমুখে মানুষগুলির দিকে তাকালেন চ্যাপলিন। এতক্ষণ সঙ্কোচে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এগিয়ে এলেন ধীরে ধীরে। তিনি ভয় পেলেন না এ বার। কোনও কোলাহল নেই এখানে। সবাই শান্তভাবে এসে হাত মেলালেন তাঁর সঙ্গে। ‘‘অনেক শুভেচ্ছা রইল চার্লি।’’ ‘‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুক চার্লি।’’ খেয়াল করলেন এখানে কেউ তাঁকে ‘মিস্টার চ্যাপলিন’ বললেন না। কেনিংটন রোড ধরে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো তিনি হাঁটছেন সামনে, পিছনে তাঁর অতীতের মানুষগুলো। সেই পুলিশকর্মী এ বার ডেকে দিলেন একটি ট্যাক্সি।
সে দিন রিৎজে ডিনারের সময়, টম মজা করে চার্লিকে একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এই অভূতপূর্ব অভ্যর্থনার পর তাঁর এ বার মরে যাওয়া উচিত। খ্যাতির শিখরে থাকাকালীন চলে যাওয়াটাই সেরা মৃত্যু। এক সন্ধেবেলার কথা মনে পড়ল চার্লির। জ্বরে আক্রান্ত পাঁচ বছরের চার্লির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, যিশুর গল্প শোনাচ্ছিলেন মা। মানুষকে এত ভালবাসার পরও নির্দোষ যিশুকে কী ভাবে মাথায় কাঁটার মুকুট পরিয়ে, ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল কিছু মানুষ। সে দিন চার্লির মনে হয়েছিল, মরে গিয়ে যিশুর কাছে চলে যেতে। মাকে বলেছিল সে কথা। মা বলেছিলেন, ‘‘যিশু চান, তুমি আগে পৃথিবীতে তোমার লক্ষ্য পূরণ করো।’’
১৯৭২ সালে ৮৩ বছর বয়সে যখন অস্কার নিতে মঞ্চে ওঠেন চার্লি, টানা বারো মিনিট হাততালির ঝড় বয়ে যায় অস্কার মঞ্চে। অস্কারের ইতিহাসে সেটাই ছিল দীর্ঘতম অভ্যর্থনা। আবেগে প্রায় কিছুই বলতে পারেননি সে দিন চার্লি। যিশুর ইচ্ছে বোধহয় পূর্ণ হয় সে দিন। ঠিক পাঁচ বছর পর বড়দিনের দিনই, শান্ত ঘুমের মধ্যে পৃথিবী ছাড়েন স্যর চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy