Advertisement
E-Paper

হীরকের রাজা vs আওয়ারা

তাঁরা দুজনেই ভারতের শিল্পজগতের দুই দিকপাল। এক জন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অসম্ভব বিখ্যাত অভিনেতা এবং ‘শোম্যান’। আর এক জন ভারতীয় নাট্য জগতের এবং সিনেমা জগতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রথম জন রাজ কপূর এবং দ্বিতীয় জন উৎপল দত্ত।

সৌম্যজিৎ ভৌমিক

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
রাজ কপূর ও উৎপল দত্ত। ‘নদীর এপার কহে...’?

রাজ কপূর ও উৎপল দত্ত। ‘নদীর এপার কহে...’?

তাঁরা দুজনেই ভারতের শিল্পজগতের দুই দিকপাল। এক জন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অসম্ভব বিখ্যাত অভিনেতা এবং ‘শোম্যান’। আর এক জন ভারতীয় নাট্য জগতের এবং সিনেমা জগতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রথম জন রাজ কপূর এবং দ্বিতীয় জন উৎপল দত্ত।

সালটা ১৯৭৩। আমি তখন শুল্ক অফিসার হিসেবে দমদম এয়ারপোর্টে কাজ করি। এক দিন সন্ধ্যায় দেখি, দুজনে বম্বের (তখনও মুম্বই নয়) প্লেন ধরবেন বলে এয়ারপোর্টে এসেছেন। রাজ কপূর কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর প্রযোজিত এবং পরিচালিত ‘ববি’ ছবির রিলিজ উপলক্ষে। ও দিকে উৎপল দত্ত তখন নাটক, বাংলা সিনেমা ছাড়াও বম্বেতে পুরোদমে হিন্দি ফিল্ম করছেন।

ছোটবেলা থেকেই রাজ কপূরের নাম শুনে আসছি। তাঁর অভিনীত ছবির গানগুলো রেডিয়ো আর লোকের মুখে শুনে শুনে কণ্ঠস্থ। আবার কলেজ জীবন থেকে উৎপল দত্তের লেখা ও অভিনয় করা নাটকগুলো দেখে দেখে মুগ্ধ। সেই দুজনকেই ওই প্রথম সামনাসামনি দেখছি। সেলফি নয়, তখন সই নেওয়ার যুগ। তাই, এমন দুজনের অটোগ্রাফ নেওয়ার সুযোগটা তো ছাড়া যায় না!

দুজনে কিন্তু আলাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজ কপূরকে ঘিরে বেশ কিছু লোক, আর উৎপল দত্ত আলাদা। এবং একা। দেখে মনে হচ্ছিল দুজনে দুজনকে যেন চেনেনই না। অটোগ্রাফ চাইতে গিয়ে ভুল ভাঙল। বুঝলাম, দুজনেই দুজনের উপস্থিতি সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন।

প্রথমে গেলাম রাজ কপূরের কাছে। অটোগ্রাফ চাওয়াতে একটু অদ্ভুত হেসে বললেন, ‘আরে, আমার কাছে আগে এলেন কেন? আমি তো শুধুই স্টার। অভিনেতা তো ওইখানে দাঁড়িয়ে আছেন। আগে ওঁরটা নিয়ে আসুন।’

গেলাম উৎপল দত্তর কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যর, একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে উত্তর পেলাম— ‘নিশ্চয়ই দেব ভাই। তবে আমি তো শুধু এক জন লেখক আর অভিনেতা। ওই যে স্টার দাঁড়িয়ে আছে, আগে ওর কাছে যাও।’

আমার অবস্থা সঙ্গিন। কী আর করি? আবার গেলাম রাজ কপূরের কাছে। ‘কী হল, দত্ত সাহেবেরটা নিয়েছেন?’ উত্তরে আমি বললাম উৎপল দত্ত কী বলেছেন। আবার হাসলেন। এ বারের হাসিটা বেশ অর্থপূর্ণ মনে হল আমার কাছে। যেন, এটাই ভাবছেন, তোমাকে লোকে যত বড় অভিনেতাই ভাবুক, অটোগ্রাফ নেওয়ার সময় তারা আগে স্টারের কাছেই আসবে। অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন।

ফিরে গেলাম উৎপল দত্তর কাছে। ‘স্টারেরটা নিয়েছ?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তবে রাজ কপূর যে বলেছিলেন, তিনি শুধুই স্টার, আর উৎপল দত্ত হচ্ছেন অভিনেতা, তাই আগে উৎপল দত্তর কাছে যেতে— সেটাও জানালাম। এ বার তাঁর হাসির পালা। শব্দ না করে চওড়া হাসি। যেটা তাঁর অভিনয়ে প্রায়ই দেখেছি। সে সময় হাসির অর্থ আমার অন্তত একটু অন্য রকম ঠেকল।

যেন বলতে চাইলেন, যত বড় স্টার হও, তোমাকেও বলতে হবে অভিনেতা সবার ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকেন। অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন।

লক্ষ করলাম, প্লেনে চড়ার আগে পর্যন্ত, একই জগতের মানুষ হয়েও দুজনে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই পরস্পরের উপস্থিতি সম্বন্ধে উদাসীন রইলেন।

পরে যখনই ঘটনাটাকে মনের চোখ দিয়ে আবার দেখেছি, বার বার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দুজনের সেই ব্যঞ্জনাময় হাসির ছবি। মনে হয়েছে, তবে কি দুজনেরই পেশাদারি জীবনের চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে কোথাও অপূর্ণতা ছিল? বা, শিল্পীদের মধ্যে প্রায়ই কি পারস্পরিক সম্ভ্রমের সঙ্গে সঙ্গেই একটু রেষারেষিও থেকে যায়?

রাজ কপূরকে লোকে এখনও স্টার এবং শোম্যান হিসেবেই মনে রেখেছে। আর উৎপল দত্ত? সাধারণ দর্শক তো বটেই, বিদগ্ধ মানুষের কাছেও তিনি শুধু শক্তিশালী অভিনেতাই নন, এক জন চিন্তাবিদ এবং নাট্যকার হিসেবেও সমাদৃত। তবে এ কি সেই ‘নদীর এপার কহে...’?

ঠিক জানি না। তবে সেই অটোগ্রাফগুলোর সঙ্গে সেই হাসিগুলোও আমার কাছে থেকে গেছে, একই রকম মূল্যবান হয়ে।

soumyajit48@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy