বিন্দুতে সিন্ধু, এ কথা সাহিত্য এবং বিজ্ঞান, দু’টির ক্ষেত্রেই সমান ভাবে খাটে। বিজ্ঞান বলে, এ রকম প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী একটি বিন্দু থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। রাতের আকাশের দিকে তাকালে যে অসংখ্য আলোকবিন্দু দেখা যায়, তা নিয়ে কবি-সাহিত্যিক থেকে বিজ্ঞানী, কারও কৌতূহলের শেষ নেই। রাতের আকাশে এ আলোর জগৎ যেন অলৌকিক মায়ার জগৎ। এখন যে প্রশ্নটা আমাদের মনকে সবচেয়ে নাড়া দেয়, তা হল, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা কি একা? না কি আমাদের মতোই সমান্তরাল কোনও মহাবিশ্ব আছে, যেখানে অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের পৃথিবীর মতো প্রাণের! আমরা যেমন তাদের সন্ধান করে চলেছি প্রতিনিয়ত, কে জানে, তারাও হয়তো প্রতিনিয়ত খুঁজে চলেছে আমাদের! এই সন্ধানপ্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল ‘ইউএফও’।
এই ‘ইউএফও’-র অনুসন্ধান যেমন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমাঞ্চকর, তেমনই আকাশপথে নিয়ত যাতায়াতকারী বিমানের নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রায় ১৪৪টি দেশের বিভিন্ন মানুষদের বয়ানে বার বার উঠে এসেছে ‘ইউএফও’ দেখতে পাওয়ার ঘটনা, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্য দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিমানচালকরা। প্রতি বছর ২ জুলাই বিশ্ব জুড়ে ‘ওয়ার্ল্ড ইউএফও ডে’ দিনটির গুরুত্ব শুধু বিজ্ঞান-গবেষক ও বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্যই নয়, লেখক ও পাঠকদের জন্যও উল্লেখযোগ্য। এই ‘ইউএফও’ শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক রহস্য অনুসন্ধান বা গবেষণা নয়, মানুষের নিজেকে জানার, নিজের সীমাকে অতিক্রম করার এক রূপক। অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা, মানবসভ্যতার সীমা এবং আধুনিক জীবনের প্রযুক্তিনির্ভরতা— এই সব কিছু মিলিয়ে একটি বৃহত্তর সাহিত্যিক ও দার্শনিক আলোচনার পরিসর তৈরি করে ইউএফও নিয়ে অনুসন্ধান।
বাংলা সাহিত্যে ইউএফও-র ভাবনা আমাদের কল্পনা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং আত্মিক বোধের পরিচয়। বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁদের রচনায় আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদান, যেমন রোবট, টাইম মেশিন, অদৃশ্যতা ইত্যাদি এসেছে, তেমনই এসেছে ভিনগ্রহ, মহাকাশযান ও ইউএফও-র রোমাঞ্চকর ইঙ্গিত। সত্যজিৎ রায়ের প্রোফেসর শঙ্কু-সিরিজ় কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, গোটা ভারতীয় সাহিত্যে অন্যতম জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান রচনা। এই সিরিজ়ে তিনি বহু বার ইউএফও ও ভিনগ্রহী জীবনের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর লেখায় ইউএফও শুধু এক অজানা মহাজাগতিক রহস্য নয়, বরং এটি মানুষের ভয়, কৌতূহল, আত্ম-অন্বেষণ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন হয়ে উঠেছে। ‘ইউএফও’কে তিনি ব্যবহার করেছেন এক ধরনের অপরিচিত গতিশীল আকাশযান রূপে, যার মাধ্যমে মানুষ বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে সেতুবন্ধন করেছে। তাঁর প্রোফেসর শঙ্কু সিরিজ়ে ‘অজ্ঞাত বস্তু’, ‘মহাজাগতিক প্রাণী’ ও ‘ভিনগ্রহী সভ্যতা’র উপাদান বার বার এসেছে। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ (১৯৬১), ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউএফও’ (১৯৮২) গল্পে তিনি সরাসরি ইউএফও-র ধারণাকে ব্যবহার করেছেন। ‘স্বর্ণপর্ণী’ (১৯৯০) গল্পেও মহাজাগতিক রহস্য ও ভিনগ্রহী চিন্তা উঠে এসেছে। তাঁর ‘অন্য পৃথিবী’তে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে গ্রহান্তরের সভ্যতার ছবি।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর ঘনাদা সিরিজ়েও নানা সময়ে ইউএফও কিংবা মহাকাশ-ভিত্তিক রহস্য এসেছে, যেখানে গল্পকার বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও রোমাঞ্চের সমন্বয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। পদার্থবিদ ঘনাদা এমন একটি অদ্ভুত বস্তুর সন্ধান আমাদের দেন, যা আকাশে হঠাৎ করে ভেসে ওঠে এবং রহস্যজনক ভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। পাঠকের মনে এটাই এক রকম ইউএফও-র চিত্র হয়ে ফুটে ওঠে। তাঁর ‘ঘনাদা ও লালগ্রহের অভিযান’ গল্পে মঙ্গলগ্রহ নিয়ে এক বৈজ্ঞানিক অভিযানের কথা রয়েছে, যেখানে ভিনগ্রহের অস্তিত্ব ও সেই সন্ধানযাত্রার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। ‘ঘুংরু’, ‘ম্যাজিক’, ‘পিঁপড়ে’ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে তিনি পরোক্ষ ভাবে গ্রহান্তরের সভ্যতা ও অজানা গ্রহের কথা বলেছেন।
শুধু বাংলা গদ্যসাহিত্য নয়, মেহেরুন্নিসা পারভীন, নির্মলেন্দু গুণের আধুনিক কবিতাতেও মহাজাগতিক অনুভূতি, অজানা বাস্তবতা ও বিস্ময়ের প্রতিচ্ছবি অনেক সময় ইউএফও-র রূপকে প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরনের সাহিত্যিক প্রয়াস কেবল বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধই করেনি, বরং বাঙালির কল্পনাশক্তিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে প্রসারিত করেছে।
ইউএফও নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বব্যাপী কৌতূহল। আধুনিক প্রযুক্তি ও মহাকাশ-গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যেও এর প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। বাংলা সাহিত্যে ইউএফও নিয়ে ভাবনার সূচনা মূলত বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মিলনে, যা পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায়। তাঁরা বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কল্পনাকে অন্য গ্রহের দিকে নিয়ে গেছেন। লেখকদের কলমে ইউএফও নিছক বৈজ্ঞানিক বিষয় নয়, বরং কল্পনার বিস্তার, প্রযুক্তি বা আশার প্রতীক। তাঁরা পাঠকদের শুধু বিনোদন দেননি, বরং কল্পনা ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে গড়ে তুলেছেন নতুন এক সাহিত্যধারা। বাংলা সাহিত্য শুধু সমাজভাবনামূলক আবেগ বা প্রেম দিয়েই গঠিত হয়নি; কল্পবিজ্ঞানের মতো সাহিত্যে বিজ্ঞানচেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে বিজ্ঞান কেবল যন্ত্র বা গবেষণার নয়; তা মানুষ ও সমাজের জন্য কী ফল বয়ে আনে, তারও আলোচনা রয়েছে। যেমন ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হতে পারে, প্রযুক্তির অপব্যবহার সমাজে কী বিপর্যয় আনতে পারে, তা বার বার এই সাহিত্যে উঠে এসেছে। লেখকরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশ অভিযানের মতো আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণাকে বাংলার পাঠকের কাছে তুলে ধরছেন। বাংলা কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্য শুধু কল্পনা নয়, বরং বিজ্ঞানচেতনার এক শক্তিশালী মাধ্যম। নিখাদ ফ্যান্টাসি, ফিকশন বা গল্প হলেও সত্যজিৎ বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায় অসাধারণ মুনশিয়ানা আছে, আছে হিউমার-থ্রিল-অ্যাডভেঞ্চারের সংমিশ্রিত রেসিপি।
বিশ্বসাহিত্যে দেখা যায়, প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫৫ বছর ধরে বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত কল্পবিজ্ঞান কাহিনির লেখক ফ্র্যাঙ্ক হার্বার্টের লেখা উপন্যাস ‘ডিউন’ আসলে এক জলহীন এক মরুগ্রহের কথা বলে। জুল ভের্নের ‘টোয়েন্টি থাউজ়্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ লেখার প্রায় আঠারো বছর পর সত্যিকারের ইলেকট্রিক সাবমেরিন তৈরি হয় এবং এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য ওয়র্ল্ড সেট ফ্রি’ লেখার প্রায় তিরিশ বছর পর তৈরি হয়েছিল পারমাণবিক বোমা। বর্তমান সময়ের চিনের কল্পবিজ্ঞানী লেখক সিশিন লিউ তাঁর ‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’ গল্পে মাল্টিভার্সের কথা বলেছেন। গল্পের নায়কের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভিনগ্রহী প্রাণীর, যারা পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে চায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবমনের নতুন ভাবনাকে রূপ দেয় বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার, যা প্রতিষ্ঠিত করে লেখকের কাল্পনিক বক্তব্যকে। বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে এখানেই কল্পবিজ্ঞান প্রাসঙ্গিক। কল্পবিজ্ঞান থেকেই মানুষের ভাবনাচিন্তা পেয়েছে ভবিষ্যতের দিশা। কল্পবিজ্ঞান হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতের বিস্ময়-বাস্তব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)