Advertisement
E-Paper

'জীবন আমাকে নীরব করেছে, নম্রতা শিখিয়েছে'

কান চলচ্চিত্র উৎসবে লিখে পাঠিয়েছিলেন ইঙ্গমার বার্গম্যান। জীবনের ‘বুনো স্ট্রবেরি’ তুলতে তুলতে তত দিনে তিনি হেমন্তের বিষণ্ণ ‘অটাম সোনাটা’ পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব-সিনেমার দরবারে। গত কাল একশো বছর পেরিয়ে গেলেন সিনেমার জাদুকর।কান চলচ্চিত্র উৎসবে লিখে পাঠিয়েছিলেন ইঙ্গমার বার্গম্যান। জীবনের ‘বুনো স্ট্রবেরি’ তুলতে তুলতে তত দিনে তিনি হেমন্তের বিষণ্ণ ‘অটাম সোনাটা’ পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব-সিনেমার দরবারে। গত কাল একশো বছর পেরিয়ে গেলেন সিনেমার জাদুকর।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৮ ০৮:২০
শিল্পী: ইঙ্গমার বার্গম্যান। ছবি: গেটি ইমেজেস।

শিল্পী: ইঙ্গমার বার্গম্যান। ছবি: গেটি ইমেজেস।

ঠাকুমা জানেন, সকালের এই সময়ে নরম রোদ এসে-পড়া ঘরে তাঁর বছর পাঁচেকের নাতি এখন সূর্যালোকের শব্দ শুনতে ব্যস্ত। ও এখন বসে আছে ডাইনিং টেবিলের নীচে। বিশাল জানালা দিয়ে এসে পড়েছে ঝকঝকে রোদ, তার কিছুটা আবার ঢুকে এসেছে টেবিলের নীচের মেঝেতেও। দু’চোখ মেলে কল্পনাকে ছোঁয় সে। সুইডেনের উপসালা শহরের উপকণ্ঠে এই অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই ক্যাথিড্রাল। কে যেন রোজ ঘণ্টা বাজায় ক্যাথিড্রালে। শিশুটি জানে, এ বার মেঝে থেকে রোদের আলো সরে যাবে। চুমু খাবে দেওয়ালে ঝোলানো ভেনিস শহরের ছবির উপর। কোথা থেকে এ সময়েই ভেসে আসে ওয়াল্টজ়-এর ছন্দে তিন তালের সুর। শিশুটি তারই মাঝে খুঁজে পায় অন্য এক শিল্প। ছবিটিতে জল নড়ে, মানুষের কোলাহল আর তার সঙ্গে আবহে মিশে যায় ওয়াল্টজ়-এর সুর, ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাধ্বনি। ছবি হয়ে ওঠে রুপোলি পর্দা।

শিশু ইঙ্গমার বার্গম্যান জানত, এই এটুকুই তার সুখের সময়। বাবা এল বলে! কাপড়ের গুদামঘরে বন্দি থাকতে হবে এখন বেশ কিছু ক্ষণ। তার শৃঙ্খলার শিক্ষা। বাবার ছিল খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রেম— মননে-কর্মে-চিত্তলোকে। পাদ্রিসুলভ রীতিনীতির শাসন বরাদ্দ ছিল ছেলের জন্য। তারই মাঝে আলো খোঁজা বার্গম্যানের। ধর্মীয় অনুশাসনের চৌকাঠ পেরোতে চেয়েছেন বারবার। শয়তান বা ঈশ্বর, ভাল বা মন্দ, ধ্বংস বা সৃষ্টি, আলো বা ছায়া.. সব কিছুকেই তিনি নিজস্ব চেতনায় ধরতে চেয়েছেন। বাল্টিক সাগরের নীল নির্জন তীরে কাটানো শেষ বয়সের বার্গম্যান তাই শৈশবের মুহূর্তগুলো ভুলতে পারেননি। দেওয়ালে বিচ্ছুরিত রঙিন আলোর বিভাজন, ম্যাজিক লণ্ঠনে প্রতিফলিত শুধুই রঙের মেলা। নাকে আসত গরমে পোড়া ধাতব পাতের গন্ধ! শুটিংয়ের সময়েও তিনি যেন একটা শিশু, যেন ঠাকুমার বাড়ির দোতলার ঘরে খেলনা থিয়েটার নিয়ে ‘স্ট্রিন্ডবার্গ’ নাটকের মহড়ায় মগ্ন। ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেকজ়ান্ডার’ ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে তাঁর ফেলে আসা ছোটবেলার নানান বাঁক, বৈপরীত্য।

১৯৬০। তিনি তখন ৪২ বছরের যুবক। সুইডিশ চলচ্চিত্রের বিশ্ববরেণ্য পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যান! ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’-এর শুটিং চলছে সুইডেনের উত্তর প্রান্তে ডালারমা অঞ্চলে। মে মাস। তবু মাইনাস ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা আর সঙ্গে হিমেল হাওয়া। অভিনেতারা নানা রঙের পোশাক পরে শট নেওয়ার প্রস্তুতিতে। হঠাৎ কেউ এক জন আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে চিৎকার করে উঠল। সবার চোখ এক দিকে। দিগন্তে ফার গাছের মাথার উপরে আকাশ জুড়ে সাদা বকের মেলা! শুটিং গেল ভেস্তে। সবাই চলল ছোট্ট সেই টিলাটার উপর, মুক্ত বিহঙ্গের দু’ডানার কাছাকাছি। এই মুক্তিই তো খুঁজে এসেছেন বার্গম্যান। কাজের ফাঁকে অন্য কিছু ভাল লাগার প্রতি আসক্তি, আর তার তৃপ্তির সুধা পান করার বিলাসিতা যে একমাত্র শিল্পীদেরই অধিকার।

‘দ্য সেভেন্‌থ সিল’ ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য

ইঙ্গমার বার্গম্যান এমনই এক ব্যক্তিত্ব, স্টকহল্‌মে জীবনে প্রথম বার পা রেখেই সত্যজিৎ রায় ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। ‘‘যখন ছবি কোনও দলিল নয়, তখন সেটা হয় স্বপ্ন। সে জন্যই তারকোভস্কি সবার মাঝে শ্রেষ্ঠ।’’ আন্দ্রেই তারকোভস্কি সম্পর্কে বার্গম্যান এমনই মত দিয়েছিলেন। আর তারকোভস্কিও বলেছেন দু’জন মানুষের কথা, যাঁদের দর্শন তাঁকে ভাবিত করে— ব্রেসোঁ এবং বার্গম্যান।

যদিও তারকোভস্কির সঙ্গে বার্গম্যানের দেখা হয়নি। স্টকহল্‌মে যেখানে বার্গম্যানের পুরনো অফিস ছিল, অনেক পরে, সেখানে তারকোভস্কিরও একটি অফিস হয়। আসলে বার্গম্যান নির্জনতাপ্রিয় পরিচালক। প্রতি বছর, ফারো দ্বীপে তাঁর জন্মদিনে যদিও পুরো পরিবারের উপস্থিত থাকার রেওয়াজ ছিল। বহু দূরের পথ এই ফারো। বার্গম্যানের সিনেমা, নাটক, গল্প, চিত্রনাট্য, দর্শন, জীবনবোধ— সব কিছু নিয়ে আদ্যোপান্ত চর্চা করার পরেও ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক মিচিকো কাকুতানি এই দুরূহ কাজটি করে ফেলেছিলেন— বার্গম্যানকে সশরীরে সাক্ষাৎ। ১৯৮৩। বার্গম্যানের তখন খুব সুনাম, সম্মান। চট করে কাউকে অন্দরমহলে আপ্যায়িত করার লোক তিনি নন। কিন্তু মিচিকোকে তাঁর এতটাই পছন্দ হয়েছিল, হাসতে হাসতে তাঁর কলেজ জীবনের অদ্ভুত এক প্রেমের কথাও বলে ফেললেন। কলেজ জীবনের এক সুইডিশ তরুণীকে বন্ধুমহলের সবার পছন্দ। সবাই তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। বার্গম্যানও। কিন্তু সবার মতো তিনিও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। তরুণী জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্নের পুরুষ ছিল কোনও এক মিশরীয় রাজপুত্র। বার্গম্যানের সত্যিই জানা নেই সেই তরুণীর হালফিল হদিস। কিন্তু মিশরীয় রাজপুত্র সত্যিই একটা অলীক প্রতীক মাত্র— বার্গম্যানের বুঝতে দেরি হয়নি। এই ধরনের প্রতীকের ব্যবহার তিনি ছবিগুলোতে বারবার এনেছেন। সেখানে বাদ যায়নি প্রেমের বিভিন্নতা, ধর্মীয় সংশয় ও সঙ্কট, জীবন, মৃত্যুও। ‘দ্য সেভেন্‌থ সিল’ ছবিতে প্লেগ আক্রান্ত শহরের পটভূমিতে তিনিই পেরেছিলেন জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর দাবা খেলার দৃশ্য তৈরি করতে। এই ধরনের দৃশ্য মহাকাব্যিক—সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে অপু-দুর্গার কাশফুলের সারি ডিঙিয়ে রেলগাড়ি দেখার দৃশ্যের মতো।

আর একটি ঘটনাও বার্গম্যানকে বড় বিব্রত করেছে। ১৯৩৪-এর নাৎসি জার্মানিতে তিনি বেশ কিছু দিন এক পাদ্রির সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। তিনি তখন ষোলো বছরের কিশোর। পাদ্রির সঙ্গে নাৎসি সভাতেও গিয়েছেন। কিন্তু বহু পরে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ছবি দেখার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজনৈতিক নরক কতটা ভয়ঙ্কর। দীর্ঘ দিন রাজনীতি সংক্রান্ত বইপত্র থেকে দূরে কাটিয়েছেন। এই ধরনের টুকরো বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে ছিল যেন ম্যাজিক লণ্ঠনের মতোই— অন্ধকার ঘরে দেওয়ালে বিচ্ছুরিত সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ, দেখা না-দেখা কল্পলোকের কোলাজ, অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিসত্তার সিনেম্যাটিক বহিঃপ্রকাশ। বার্গম্যানরা এমনই হন। পৃথিবীকে সুন্দর কিছু উপহার দিতে আসেন। তাই যা কিছু সুন্দর—তা বার্গম্যান। ‘দ্য সাইলেন্স’, ‘অটাম সোনাটা’, ‘দ্য সেভেন্‌থ সিল’, ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’, ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেকজ়ান্ডার’, ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ়’— তাঁর মহামূল্যবান ছবিগুলি সুন্দরেরই উদ্‌যাপন।

গতকাল ১৪ জুলাই সারা পৃথিবী জুড়ে হয়েছে বার্গম্যান শতবর্ষ উদ্‌যাপন উৎসব। ‘বার্গম্যান ফাউন্ডেশন’ এক অভিনব ব্যাপার চালু করেছে। বার্গম্যানের হাতের লেখার ফন্ট তৈরি হয়েছে। সেই ফন্টে যে কেউ লিখতে পারে গান-গল্প-কবিতা। এরিক জ্যাগবার্গ-এর এ এক অভিনব উদ্যোগ।

বার্গম্যান বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যদি অন্ধত্ব আর বধিরতার মধ্যে কোনও একটিকে পছন্দ করতে হয়, আমি শ্রবণ মাধ্যমটাই পছন্দ করব। সঙ্গীত ছাড়া আমি কিছু ভাবব— এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যেন আমার জীবনে না আসে!’’ তাই বার্গম্যান শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হচ্ছে বেশ কিছু জায়গায়— সুরে, ছন্দে। যেখানে বাখ, মোৎজ়ার্ট বা শপ্যাঁর সিম্ফনি মনে করিয়ে দেবে শতবর্ষের বার্গম্যানকে। ছবি তো আছেই। বছরভর উৎসব। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছবি-উৎসব, অসলো থেকে বার্লিন, প্যারিস থেকে আমস্টারডাম— বার্গম্যান রেট্রোস্পেকটিভ, সেমিনার, চলচ্চিত্র-চর্চা।

নামী সুইডিশ কোরিয়োগ্রাফার আলেকজ়ান্ডার একম্যান এবং রয়্যাল সুইডিশ ব্যালে-র আরও কয়েক জন নৃত্যশিল্পী বার্গম্যানের কোরিয়োগ্রাফির উপরে তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে তা দেখানোও হয়ে গিয়েছে। বার্গম্যানের ছবির প্রতিটি ফ্রেমেই সযত্ন ফুটে উঠত কোরিয়োগ্রাফিক্যাল ইমেজ। চরিত্রগুলোর মাথা নাড়া, চলাচল, হাতের মুদ্রা— সব কিছুর মধ্যেই অন্তর্নিহিত ছিল এই ইমেজ। আর সেগুলো দিয়েই রচিত হয়েছে এই তথ্যচিত্রপট।

১৯৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সম্মান-প্রদান মঞ্চে বার্গম্যান উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাঁর মেয়ে লিন উলম্যান বার্গম্যানের বার্তা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন—‘‘বছরের পর বছর ধরে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে ইমেজ নিয়ে খেলা করার পর জীবন আমার কাছে ধরা দিয়েছে—আমাকে সঙ্কুচিত করেছে, নীরব করেছে। সম্মান দিয়েছে। নম্রতা শিখিয়েছে। আপনাদের ধন্যবাদ।’’

Ingmar Bergman The Seventh Seal Filmmaker Autumn Sonata ইঙ্গমার বার্গম্যান Cannes Film Festival
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy